বর্তমান সময়ের অন্যতম উত্তপ্ত সংবাদ ন্যাশানাল ট্রেনিং এজেন্সি পরিচালিত ‘নিট-জেইই এন্ট্রান্স টেস্ট ২০২০’। এই নিয়ে সােশ্যাল মিডিয়া ও মেনস্ট্রিম মিডিয়ায় নানা বিতর্ক হয়ে চলেছে। নিট’ হলাে ন্যাশানাল এসিজিবিলিটি এন্ট্রান্স টেস্ট (আন্ডার গ্রাজুয়েট) এমবিবিএস ও বিডিএসে সরকারি ও প্রাইভেট মেডিক্যাল কলেজে ভর্তির সর্বভারতীয় স্তরের একমাত্র পরীক্ষা। আগে এর নাম ছিল এআই পিএমটি (অল ইন্ডিয়া প্রি মেডিক্যাল টেস্ট)। অন্যটি হলাে জেইই (জয়েন্ট এন্ট্রান্স এক্সজামিন) টেস্ট , সর্বভারতীয় স্তরের বিটেকে ভর্তি হওয়ার জন্য অর্থাৎ আইআইটি, এনআইটি, বিভিন্ন রাজ্যের সরকারি ও বেসরকারি ইঞ্জিনিয়ারিং কলেজে পড়ার প্রবেশিকা পরীক্ষা। জেইই পরীক্ষাটি দুটি স্তরে হয়ে থাকে, জেইই মেন এবং জেইই অ্যাডভান্স। শেষেরটি আইআইটি-তে প্রবেশের চূড়ান্ত প্রবেশিকা পরীক্ষা। ২০১৯ সাল থেকে এআইপিএমটি ও জেইই-কে অধিকতর সুষ্ঠভাবে পরিচালনা করার জন্য কেন্দ্রীয় সরকার দুটিকে এক ছাতার তলায় নিয়ে আসে ন্যাশনাল টেস্টিং এজেন্সির অধীনে। বর্তমানে দেশে ইঞ্জিনিয়ারিং ও ডাক্তারিতে ভর্তি হওয়ার জন্য একমাত্র সংস্থা এবং সংবিধানগত ভাবে সর্বোপরি। এবছর এনটিএ পরিচালিত এই পরীক্ষা প্রতি বছরের জন্য এপ্রিল মাসে হওয়ার ঠিক ছিল কিন্তু কোভিড-১৯ পরিস্থিতিতে পরিবর্তন করে প্রথমে জুলাই মাসে নির্ধারিত হয়, আবার একই কারণে বাতিলও হয়ে যায়। শেষপর্বে সরকার ইউজিসি এবং সংশ্লিষ্ট ইঞ্জিনিয়ারিং ও মেডিক্যাল সংস্থাগুলি অনেক ভেবেচিন্তে আলােচনার পর চূড়ান্ত তারিখ ঘােষণা করা করে এবছর ১ সেপ্টেম্বর থেকে ৬ সেপ্টেম্বরের তারিখে জেইই মেন, ২৭ সেপ্টেম্বর জেইই অ্যাডভান্স। এই পরীক্ষাগুলি সবই নির্দিষ্ট পরীক্ষা কেন্দ্রগুলিতে অনলাইনে নেওয়া হবে।
অন্যদিকে ১৩ সেপ্টেম্বর এমবিবিএস ও বিডিএস প্রবেশিকা নিট নেওয়া হবে। এই পরীক্ষাটি কাগজে-কলমে হয়ে থাকে। টেস্ট গ্রহণ পরীক্ষা থেকে পঠনপাঠন শুরু আগামী ডিসেম্বরের মধ্যে না হতে পারলে এক পূর্ণ শিক্ষাবর্ষ নষ্ট হয়ে যাবে অর্থাৎ জিরাে শিক্ষাবর্ষ হয়ে উঠবে যার খেসারত ছাত্র-ছাত্রীদের শিক্ষাগ্রহণকালে ও পরবর্তী কর্মপ্রার্থীরূপেও অত্যন্ত একবছর পিছিয়ে থেকে শুরু করার মধ্য দিয়ে।
কোভিড-১৯ উদ্ভূত পরিস্থিতির কথা বিবেচনা করে এই পরীক্ষার জন্য ব্যবস্থাপনায় এনটিএ এবং সরকারের পরিকল্পনায় কোনাে খামতি নেই। পাবলিক ডােমেনে দেওয়া পরিসংখ্যান থেকে জানা যাচ্ছে বর্তমানে সারা দেশে এমবিবিএস পড়ার জন্য ৫৩৯টি কলেজ রয়েছে যার মধ্যে ২৭৯টি সরকারি এবং ২৬০টি বেসরকারি, মােট আসন সংখ্যা ৭৬৯২৮টি। আরও বেশি সংখ্যক প্রার্থীকে সুযােগ করে দেওয়ার জন্য সরকার এই সংখ্যা বর্তমান বছরে ১৫০০০-এর মতাে বাড়িয়ে প্রায় ৯০০০০
করার পদক্ষেপ গ্রহণ করেছে । ডাক্তারির পােস্টগ্রাজুয়েট এবং ডিএম ডিগ্রির জন্য ২০৪টি মেডিক্যাল কলেজ রয়েছে। এই ক্ষেত্রেও ছাত্র-ছাত্রী ধারণ ক্ষমতা যথাক্রমে পিজিতে ১৭০০টি আসন বাড়িয়ে ৩২১৫৮টি এবং ডিএমে ৪০৭টি আসন বাড়িয়ে ৩২০৪টি আসন করা হয়েছে। সুতরাং তুলনামূলক বেশি সংখ্যক ছাত্র-ছাত্রীকে সুযােগ করে দেওয়ার সরকারের সদিচ্ছা প্রশ্নাতীত।
এনটিএ-র প্রকাশিত নােটিফিকেশন থেকে জানা যাচ্ছে ২০২০ সালের মােট জেইই প্রার্থী ৮.৫৮ লক্ষ এবং নিট পরীক্ষার্থী মােট ১৫.৯৭ লক্ষ। এরজন্য পরীক্ষা কেন্দ্র। বাড়িয়ে জেইই-তে ৫৭০ থেকে ৬৬০ এবং নিটে ২৫৪৬ বাড়িয়ে (৫০ শতাংশে) ৩৮৪৩ করা হয়েছে যাতে কোভিড পরিস্থিতিতে বেশিসংখ্যক পরীক্ষার্থী নিজ নিজ বাসস্থানের কাছাকাছি কেন্দ্র পেতে পারে। এই মুহূর্তের পরিসংখ্যান থেকে জানা যাচ্ছে উভয় পরীক্ষায় এ পর্যন্ত ১৭ লক্ষের মতাে প্রার্থী অ্যাডমিট কার্ড ডাউনলােড করে ফেলেছে। এবং ৯৯ শতাংশ প্রার্থী নিজ পছন্দমতাে পরীক্ষাকেন্দ্র পেতে সক্ষম হয়েছে। কেন্দ্রীয় শিক্ষামন্ত্রী রমেশ পােখরিওয়াল জানাচ্ছেন, জেইই-তে ৯৯.০৭ শতাংশ পরীক্ষার্থী প্রথম পছন্দের পরীক্ষা কেন্দ্র পেয়েছে। মাত্র ১২০ জন পরীক্ষা কেন্দ্র বদলের অনুরােধ করেছে। এদিকেনিট-এর ক্ষেত্রে ৫ বার পরীক্ষা কেন্দ্র বদলের সুযােগ দেওয়া হয়েছে এবং পরিসংখ্যান জানাচ্ছে যে এই মুহূর্ত পর্যন্ত ৯৫০০০ জন প্রার্থী করেছে, এখন আরও ৯৮.৮৭ শতাংশ তাদের প্রথম পছন্দের পরীক্ষা কেন্দ্র পেয়ে গেছে। সুতরাং এই তথ্য থেকে প্রতীয়মান যে সেপ্টেম্বরে পরীক্ষা দেওয়ার ক্ষেত্রে ছাত্র-ছাত্রীরা মন স্থির করে ফেলেছে।।
এনটি এ জানাচেছ পরীক্ষাগ্রহণ কেন্দ্রগুলিতে কী ব্যবস্থা নেওয়া হয়েছে— ১০ লক্ষ মাস্ক, ১০ লক্ষ গ্লাভস, ১৩০০ ইনফ্রারেড থার্মোমিটার গান, ৬৬০০ মিটার হ্যান্ড সানিটাইজার এবং সমসংখ্যক ডিসইনফ্যানট্যান্ট, ৬৬০০ স্পঞ্জ, ৩৩০০ স্প্রে বােতল এবং ৩৩০০ জন সাফাই কর্মী।
ফলে বাড়লাে অতিরিক্ত খরচ ১৩ কোটি টাকা। এর জন্য প্রার্থীদের কাছ থেকে ১৫০ টাকার পরিবর্তে ৪০০ টাকার করে নেওয়া হবে। ৮.৫৮ লক্ষ জেইই পরীক্ষার্থীর জন্য ১.১৫ লক্ষ ইনভিজিলেটর নিয়ােগ করা হয়েছে। পরীক্ষার শিফট সংখ্যা বাড়িয়ে ১২টি করা হয়েছে। শুরু হবে সকাল ৯-৩০ থেকে ১২.৩০ পর্যন্ত, মাঝে স্যানিটাইজ করার জন্য যথেষ্ট সময় রেখে পরবর্তী ক্ষেত্রে বিকেল ৩টে থেকে করা হয়েছে। আসন বিন্যাস সােশ্যাল দূরত্ব রাখতে অলটারনেট আসনের পরিকল্পনা করা হয়েছে, হল প্রতি ১২ জন করে পরীক্ষার্থী। প্রার্থীদের আরােগ্য সেতু অ্যাপ সচল ও সক্রিয় রাখতে বলা হয়েছে। প্রবেশের সময়, দস্তাবেজ চেক ও সিকিউরিটি চেক সবই স্পর্শবিহীন ভাবে সম্পন্ন হবে এবং প্রবেশ ও প্রস্থানের চূড়ান্ত সতর্কতা রাখা হবে। এনটিএ এবং ইউনিয়ন এডুকেশন মন্ত্রী সমস্ত রাজা সরকারের সঙ্গে পরিবহণ ব্যবস্থা সুষ্ঠ ও যথাযথ করেছে। অতএব ব্যবস্থাপনা সন্তোষজনক। পরীক্ষার্থী ও পরীক্ষক উভয় পক্ষই অনুকূ ল মানসিকতায় থাকবে সেক্ষেত্রে সমস্যা কোথায় ?
সমস্যাটা দেশের রাজনীতির ধারক বাহকদের। কেন্দ্রীয় শিক্ষামন্ত্রক চাইছেনা এই পরীক্ষা গ্রহণ সেপ্টেম্বর ২০২০-তে বাতিল ঘােষণা করা হােক। বাতিলের এই দাবি উঠেছিল বিরােধী দলের রাজনীতিকদের তরফ থেকে। বিরােধীদল পরিচালিত ৬টি রাজ্যের মুখ্যমন্ত্রীরাও একই দাবি করছিলেন। এর একটা সম্ভাবনা মনে করা হচ্ছে যে, প্রায় ১ কোটির মতাে এই পরীক্ষার্থী আগামী নির্বাচনে ভােটার হয়ে উঠবে তাদের তুষ্ট করার এটা একপ্রকার প্রচেষ্টা হতে পারে। আর একটি কারণ অর্থ ও ব্যবসা। এক্ষেত্রে এক বিশাল ‘নেক্সাস’ কাজ করছে। ১৯৯৬-১৯৯৮ সালের মধ্যে সারাদেশে বহু বেসরকারি ইঞ্জিনিয়ারিং কলেজ খুলেছে, যেগুলি নির্মাণে প্রচুর অর্থ দরকার হয়েছিল এবং সেক্ষেত্রে কংগ্রেস ও বাম নেতাদের অথবা তাদের পৃষ্ঠপােষকতায় অর্থ ব্যয় করে এগুলি গড়ে উঠেছে। পরীক্ষা গ্রহণ বাতিল করাতে পারলে লােকসানের জিগির তুলে শূন্য আসন ভরাটের দাবি করে ছাত্রদের থেকে মােটারকম অর্থের বিনিময়ে আসন বেচতে আরম্ভ করবে, এক প্রকার পূর্ণ মাফিয়াগিরি। নিরাপত্তার জন্য কোভিড-১৯-এর কারণে বহু স্কুল বাের্ড ১২ ক্লাসের পরীক্ষা নিতে সক্ষম হয়নি, সেক্ষেত্রে তাদের ইন্টারন্যাল অ্যাসেসমেন্ট থেকে ফলাফল নির্ণয় করা হয়েছে কিন্তু ইঞ্জিনিয়ারিং ও মেডিক্যালের জন্য এই ফলাফল ভর্তির মানদণ্ড হতে পারে না। কারণ, দেখা গেছে গত বছরগুলির পরীক্ষার সমীক্ষা থেকে দেখা গেছে যে, ১২ ক্লাসে ভালাে ফলাফল না করেও পরীক্ষার্থী জেইই ও নিটে সফল হয়েছে। সুতরাং এই কারণেও এইসব যােগ্য প্রার্থী বঞ্চিত হােক এনটিএ এবং সরকার হতে দিতে চায় না।
অন্যদিকে মিডিয়ার এক বড়াে অংশ এবং সােশ্যাল মিডিয়ার দ্বারা ক্রমাগত প্রচার, বিভিন্ন প্রতিক্রিয়া, পরীক্ষা বাতিলের আবদার ও সিদ্ধান্ত স্বপক্ষে না গেলে আত্মাহুতি দেওয়ার হুমকি পর্যন্ত দেওয়া হয়েছে। কিন্তু এখানে ছাত্রদের ভূমিকা কতটা রয়েছে? প্রকৃত পরীক্ষার্থীদের ফেসবুক ও টুইটার দেখা দরকার, তাদের মিছিল মিটিং অবস্থান ইত্যাদি করার সময় কোথায়? তারা তাে পড়াশুনায় ব্যস্ত রয়েছে। তবে ছাত্র নামধারী এরা কারা? একটু তলিয়ে দেখলেই পাওয়া যাচ্ছে এরা আদৌও ছাত্র নয়। ফেসবুক পােস্ট, টুইট সব নকল, টুইটগুলি ও টুইট করনেওয়ালারাও। অনুসন্ধান থেকে জানা যাচ্ছে এগুলি অধিকাংশ কংগ্রেস, তৃণমূলের আইটি সেল দ্বারা করা হচ্ছে। সােশ্যাল মিডিয়ার পােস্টগুলির ছবি দেওয়া হচ্ছে না, পরিচয় গােপন রাখলেও প্রকাশ হয়ে পড়েছে। অনেক সাংবাদিকও এতে জড়িত। সমস্ত অ্যাকাউন্টগুলি রাজনৈতিক দলের আইটি সেলের দ্বারা বলে ধরা পড়ছে। রিটুইটগুলিও কংগ্রেসের আইটি সেলের অথবা ভাড়াটে কেউ, টুইট প্রতি ২ টাকা করে পাওয়া যায় নাকি। প্রচারগুলি অধিকাংশ ক্ষেত্রেই বহু পুরানাে, যেমন—হাতের শিরা কেটে আত্মহননের প্রচারটি ২০১৬ সালের, বন্যার ছবি ২০১৭ সালের এবং ধরনা প্রদর্শন ২০১৮ সালের মার্চ মাসের। নকল পােস্ট করতে গিয়ে দিশেহারা ও দেউলে অবস্থা দেখা গেছে, যেমন একটি ছাত্রীর ফেসবুক পােস্টে পরীক্ষা বাতিলের আবদার তার বাবার করােনায় আক্রান্ত নিয়ে, কিন্তু প্রমাণ হিসেবে দাখিল করা মেডিক্যাল প্রমাণ। পত্রটি পাকিস্তানের লাহােরের হাসপাতালের।
বিরােধী রাজনৈতিক দলগুলি, প্রধানত পশ্চিমবঙ্গ-সহ ৬টি রাজ্যের মুখ্যমন্ত্রীরা সুপ্রিমকোর্টে পরীক্ষা বাতিলের রিভিউ পিটিশন দাখিল করেছিলেন। যদি ইতিমধ্যে সুপ্রিমকোর্ট আগেই ১১ জন ছাত্রের (?) এই ধরনের আবেদন খারিজ করে দিয়েছে। পশ্চিমবঙ্গ-সহ বিরােধী রাজনীতিকরা প্রায়ই অভিযােগ করে থাকে যে এইসব ক্ষেত্রে ফেডারেল নীতি এড়িয়ে যাওয়া হচ্ছে। এক্ষেত্রে সুপ্রিমকোর্টের মতামত জানা যাক— ‘সংবিধানের আর্টিকেল ১(১)-এ বলা হচ্ছে ‘India, that is Bharat, shall so a Union of States। ব্যাখ্যা প্রসঙ্গে লােকসভায় বিআর আম্বেদকর জানিয়েছেন, এই ইউনিয়ন কোনাে চুক্তি থেকে হয়নি, রাজ্যের কোনাে স্বাধীনতা নেই পৃথক সত্তা দাবি করার, রাজ্যের ভুমিকা বাস্তবে নগণ্য। পশ্চিমবঙ্গের সঙ্গে মামলায় সুপ্রিমকোর্ট। জানিয়েছিল রাজ্য মােটেই ‘Union of soveriegn’ নয়। অর্থাৎ ‘more unitary than federal’।
ভারতীয় শিক্ষা ব্যবস্থার প্রশাসনিক পরিকাঠামাে কেমন সংক্ষেপে দেখা যাক। ভারতভিন্নতাবিশিষ্ট দেশ হলেও এর শিক্ষা ব্যবস্থা কিন্তু জটিল নয়। ন্যাশনাল পলিশি অন এডুকেশন’ শিক্ষা বিষয়টিকে যুগ্ম তালিকায় স্থান দিয়েছে। এক্ষেত্রে কেন্দ্র ও রাজ্যের যৌথ উদ্যোগে নীতি নির্ধারণ হয় এবং পারস্পরিক দায়িত্বে আবদ্ধ রয়েছে। কিন্তু বাস্তবে শিক্ষা ব্যবস্থার রাজনীতিকরণ ঘটেছে এবং কেন্দ্র ও রাজ্যস্তরে বিভিন্ন উদ্দেশ্য নিয়ে বিভিন্ন এজেন্সি ও আমলাদের মধ্যে লড়াই ঘটে চলেছে।
চূড়ান্ত ভণ্ডামি দেখা যাচ্ছে বিরােধীদল পরিচালিত রাজ্যগুলির ক্ষেত্রে। রাজস্থানে। আগস্ট-সেপ্টেম্বরে একাধিক পরীক্ষা নেওয়া হয়েছে ও হবে। পিটিআই জানাচ্ছে, এখন থেকেই ওই রাজ্যে সমস্ত ধর্মীয় স্থান উন্মুক্ত করা হলাে (কোনাে সংক্রমণের ভয় নেই এখানে), শুধুমাত্র নিট-জেইই পরীক্ষার ক্ষেত্রেই সংক্রমণের আশঙ্কা কেন? অর্থাৎ লক্ষ্য রাজনীতি, ঘেঁটে দেওয়ার চেষ্টা, বিশৃঙ্খলা সৃষ্টির পরিকল্পনা। ঝাড়খণ্ড ও ওড়িশা সরকার পরীক্ষা গ্রহণের সময় পুনর্বিবেচনা করার অনুরােধ করেও পরীক্ষা চলাকালীন সুষ্ঠ পরিবহণের ব্যবস্থার নিশ্চয়তা ঘােষণা করেছে এবং হােটেল ইত্যাদিও খােলা রাখার আবেদন করা হয়েছে। সুতরাং পরীক্ষা নির্দিষ্ট সময়েই হবে।
দেশের বিভিন্ন স্বনামধন্য শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের অধিকর্তারা, যেমন আইআইটি দিল্লির ডিরেক্টর ডি. রামগােপাল রাও ছাত্রদের উদ্দেশ্যে ফেসবুক পােস্টে অনুরােধে জানাচ্ছেন, পরীক্ষা বাতিল করে পরে নেওয়া হলে মেধাবী ছাত্রদের উজ্জ্বল ভবিষ্যতে বড়াে ধাক্কা লাগবে, জিরাে শিক্ষাবর্ষ হয়ে যাবে। লক্ষ লক্ষ ছাত্র-ছাত্রীর কোভিড থাকবে, কিন্তু ক্যারিয়ার বসে থাকবে না, লকডাউনের চিরস্থায়ী অবস্থায় অপেক্ষা করা অনুচিত সিদ্ধান্ত হয়ে যাবে। তিনি আরও জানাচ্ছেন, পরীক্ষা গ্রহণের পর ফলাফল, ভর্তি ও অনলাইনে পড়াশুনা শুরুর সমস্ত ব্যবস্থাই করা হয়ে আছে এই ডিসেম্বরের মধ্যে শিক্ষাবর্ষ টিকিয়ে রাখার উদ্দেশ্যে। পরীক্ষা পিছিয়ে দিলে আইআইটি দিল্লিতে একসঙ্গে দুটি ব্যাচের স্থান সংকুলান অসম্ভব, চূড়ান্ত চাপ হয়ে যাবে, পরিচালনা করা কষ্টকর হয়ে যাবে। ফলস্বরদপ পঠনপাঠনের গুণমান অধােগামী হয়ে উঠবে। পরীক্ষা নিয়ে টিভি বিতর্কগুলির সমালােচনায় তাঁর মন্তব্য এগুলির ‘উত্তাপ বেশি কিন্তু আলাে কম এবং রাজনৈতিক উদ্দেশ্য দ্বারা মেরুকৃত, এর থেকে তফাতে থাকাই শ্রেয়’- নিষ্ঠাবান ছাত্র-ছাত্রীদের প্রতি তাঁর এই নির্দেশ। একই মতামত দিয়েছেন গুয়াহাটি ও রােপারের আইআইটি-র অধিকর্তারা।
স্বল্পবুদ্ধির রাজনৈতিক নেতারা অসম ও বিহারের বন্যার অজুহাতে পরীক্ষা বাতিলের দাবি এনেছেন, কিন্তু বন্যার ঘটনা এই দুই রাজ্যে ফি বছরের খবর। তামিলনাড়ু ও দিল্লির শাসকরা বাতিলের পক্ষে যদিও অন্যসব ক্ষেত্রে তারা ইতিমধ্যে উন্মুক্ত করার নির্দেশ জারি করে চলেছেন। অন্যদিকে, দেশের ও বিদেশের বিভিন্ন ইউনিভার্সিটির ১৫০ জন শিক্ষাবিদ প্রধানমন্ত্রীকে পত্র দিয়ে সময়ে পরীক্ষা নেওয়ার পক্ষে তাঁদের সমর্থন জানিয়েছেন।
এই প্রসঙ্গে নিজের ছাত্রজীবনের অভিজ্ঞতা উল্লেখ করতে হচ্ছে, ১৯৭৫-১৯৭৬ সালের জরুরি অবস্থা কালের প্রথম দিককার ঘটনা। কিছু করে দেখানাের তাড়নায় প্রশাসন মন্দের ভালাে সত্তরের দশকের ব্যাপক গণটোকাটুকি পশ্চিমবঙ্গ থেকে খেদাতে সক্ষম হয়েছিল। ‘যুগ যুগ জিও’, চীনের চেয়ারম্যান আমাদের চেয়ারম্যান ও শিক্ষাঙ্গনে ‘দুনিয়ার মজদুর এক হও’ স্লোগানের কিছুদিনের জন্য হলেও পিণ্ডি চটকে দিয়ে শিক্ষাক্ষেত্রে সুস্থতা ফিরে এনেছিল। যারা গণটোকাটুকি পন্থী ছিল, পরীক্ষা বাতিলের দাবি ও হুমকি দিয়েছিল, সংখ্যাগরিষ্ঠ ছাত্র-ছাত্রীরা পরীক্ষামুখী হওয়ায় তারা গুটিয়ে যায়। অধিকাংশ ছাত্র-ছাত্রীরা চিরকালই অন্তত ভবিষ্যৎ গড়ার স্বার্থে পড়াশােনা ও পরীক্ষাকে গুরুত্ব দিয়ে থাকে এবং এখনও তাই করবে। একটা ঘটনা আমাদের ছাত্র থাকাকালীন যা হয়ে রয়েছে, ক্রমাগত রাজনৈতিক আন্দোলনের ফলে শিক্ষাবর্ষ পিছিয়ে পড়া, আমাদের ফেল না করেও প্রায় ২ বছরের মতাে সমস্ত ছাত্রজীবন। দুঃখের বিষয়, আজ পর্যন্ত রাজনৈতিক দলগুলি এরজন্য ভুল স্বীকার করেনি, ক্ষমা প্রার্থনাতে দূরের কথা। সেই অভিজ্ঞতা থেকে বর্তমানের ছাত্রদের সতর্ক করে দিতে চাই কখনও শিক্ষাবর্ষ নষ্ট অথবা পিছিয়ে দেওয়ার ফাঁদে পড়বে না।
পরীক্ষার্থীরা পরীক্ষায় বসার সিদ্ধান্তে অবিচল। অভিভাবকদের এক্ষেত্রে সতর্ক করা হচ্ছে সন্তানের ভবিষ্যৎ নিয়ে প্রচারের প্রতারণার শিকার হবেন না এবং রাজনৈতিক নেতাদের হাতের পুতুল হওয়া থেকে বিরত থাকুন।
ছাত্র-ছাত্রীদের জন্য অনেক অনেক শুভেচ্ছা।
ড. প্রদোষ রঞ্জন ঘােষ
2020-09-08