নিজামুদ্দিনের তবলিগিদের কাজকর্ম জেহাদেরই নামান্তর

হাসিনা সরকার যা করে দেখাতে পেরেছে, মমতা সরকার তা পারেনি। কারণ ভোটব্যাঙ্ক মুসলমান তুষ্টিকরণ। একদিন এ তুষ্টিরই কুফল ভোগ করতে হবে মমতার দলকে।… নিজামুদ্দিনের তবলিগিরা যখন তুলেছে জেহাদের জিগির, তখন তথাকথিত বুদ্ধিজীবী ও স্বার্থান্বেষী রাজনীতির কারবারিরা একেবারে নিশ্চপ। ৭০ বছরের সেকুলারবাদের এটাই নির্মম পরিহাস

ভারতে করোনা সংক্রমণের আবহে একটি ধর্মীয় জমায়েত যে কত বড়ো সর্বনাশ ঘটাতে পারে তার জ্বলন্ত উদাহরণ সম্প্রতি দিল্লির নিজামুদ্দিন এলাকায় অনুষ্ঠিত বিশ্ব তবলিগিইসালামিক জলসা। ওই জলসা বা জমায়েতে উপস্থিত ছিলেন দেশ-বিদেশের অন্তত হাজার চারেক মোল্লা-মৌলবি, ইমাম-মৌলানা, হাজি-কাজি-গাজি-সহ অসংখ্য মানুষ। এছাড়াও ওই জলসায় উপস্থিত ছিলেন শ্রোতা হিসেবে দিল্লির বিভিন্ন মহল্লা ও পার্শ্ববর্তী রাজ্য থেকে আসা কয়েক হাজার মুসলমান। তবে যখন নিজামুদ্দিনে জমায়েতটি হয়েছে তখন বিশ্বজুড়ে করোনা বসিয়েছে মারণ থাবা। ভারতের বিভিন্ন রাজ্যের মতো রাজধানী দিল্লিতেও ছড়িয়ে পড়েছে করোনার বিষ। যেহেতু দিল্লির পুলিশ-প্রশাসন কেন্দ্রের হাতে, সেহেতু ওই জমায়েতের অনুমতি দিল্লি পুলিশই দিয়েছে। কিন্তু তখন। এদেশে বিশেষত দিল্লিতে করোনা সংক্রমণ তেমন ঘটেনি।তাই জলসা চলাকালীন দিল্লিতে সংক্রমণ বৃদ্ধি পাওয়ায় প্রশাসন অনুমতি বাতিলের নির্দেশিকা জারির কথা বললেও তাদের কথায় উদ্যোক্তারা নির্দেশ অমান্য করে ধর্মসভা চালিয়ে গেছেন। পক্ষান্তরে উদ্যোক্তাদের বক্তব্য, তাঁরা সভা বন্ধের কোনো নির্দেশিকা পাননি। আর দু’পক্ষের এই চাপান। উতরের খবর সংবাদমাধ্যমে প্রকাশ পেতেই। সরকার ও বিরোধীপক্ষের মধ্যে ওঠে তর্কবিতর্কের ঝড়। বিরোধীদের প্রশ্ন, দিল্লির পুলিশ প্রশাসন সর্বনাশা করোনার সংক্রমণের কথা জেনেশুনেও কেন জলসা হতে দিল?তাঁরা এ নিয়ে সরকার পক্ষকে মূলত ‘বলির পাঁঠা’ বানিয়েছে। পুলিশ প্রশাসনের কথাকে তারা পাত্তাই দেয়নি। এ যেন ‘যত দোষ নন্দ ঘোষ’!

সত্যি বলতে কী, গণতান্ত্রিক দেশে এটাই দস্তুর। সরকারের ভুল ত্রুটি ধরে দেওয়া বিরোধীদের কর্তব্য এবং সাংবিধানিক অধিকার। কিন্তু সরকারের জনস্বার্থে নেওয়া সঠিক সিদ্ধান্তের সমালোচনা বা ভুল ব্যাখ্যা করাও। গণতন্ত্রের পক্ষে ক্ষতিকর। তাই কে দোষী বা কে নির্দোষ, সেই বিতর্কে না গিয়ে বিরোধীদের কাছে কয়েকটা প্রশ্ন, জনস্বার্থের কথা ভেবেদিল্লি পুলিশ যদি দমন পীড়নের আশ্রয় নিয়ে নিজামুদ্দিনের জমায়েত বন্ধ করে দিত তাহলে কি আপনারাই মোদী সরকারকে ‘সাম্প্রদায়িক বলে গালাগাল দিতেন না? মোদী সরকার ‘মুসলমান বিরোধী’বলে চিলচিৎকার করতেন ? আর এসব করে বিশ্বদরবারে ভারতের ‘পরমতসহিষ্ণুতা’ভাবমূর্তিকে কালিমালিপ্ত করার অস্ত্র চিরশত্রু পাকিস্তান-সহ ভারত বিরোধীদের হাতে তুলে। দিতেন না?নাকি উদ্বাহু হয়ে মোদী সরকারের গুণকীর্তন করতেন? দিল্লির পুলিশ প্রশাসন সভা বন্ধ করতে শক্তি প্রয়োগ না করে যে পরিণত বুদ্ধির পরিচয় দিয়েছে তাকে তো আপনাদের প্রশংসা করা উচিত। কিন্তু তা না করে উলটে আপনারা পুলিশ প্রশাসন ও সরকারের নিন্দে-মন্দ ও সমালোচনা করছেন করোনার ধুয়ো তুলে। এই তো আপনাদের রাজনৈতিক চরিত্র ! কিন্তু মানুষি আপনাদের ধাপ্পাবাজি, রাজনৈতিক দেউলিয়াপনা ধরে ফেলেছে। আগামী নির্বাচনে এর যোগ্য জবাব আপনারা হাতে-নাতে পেয়ে যাবেন। সেটা কিন্তু সুখকর হবে না।

সর্বোপরি নিজামুদ্দিন জমায়েতের আয়োজক বা উদ্যোক্তারা সারা বিশ্বে এমনকী, ভারতেও করোনা সংক্রমণের ভয়াবহতার কথা জেনেশুনে আইন ও প্রশাসনিক নিষেধাজ্ঞাকে বুড়ো আঙুল দেখিয়ে গাজোয়ারি সভা চালিয়ে গিয়ে শুধু কাণ্ডজ্ঞানহীনতারই নয়, দেশদ্রোহিতারও পরিচয় দিয়েছে। যেখানে নবি মহম্মদের দেশ সৌদি আরব করোনা সংক্রমণ ঠেকাতে সেদেশের প্রতিটি মসজিদে তালা ঝুলিয়ে দিয়েছে, সেখানে নিজামুদ্দিনের তবলিগি বন্ধ হলো না কেন? কোন অদৃশ্যশক্তি রয়েছে এদের পিছনে? খবরে প্রকাশ, ভারতে করোনা আক্রান্তদের ৩০ শতাংশ আক্রান্ত। হয়েছে নিজামুদ্দিন ফেরত তবলিগিদের দ্বারা। তবলিগিরা সব পালিয়েছে। তবে মূল পাণ্ডা মৌলানা সাদ পুলিশের জালে ধরা পড়েছে। তার বিরুদ্ধে পুলিশ অনিচ্ছাকৃত খুনের মামলা রুজু করেছে। কিন্তু মানুষের দাবি, ওই একই মামলা রুজু করা হোক তবলিগির সঙ্গে যুক্ত সবার বিরুদ্ধে। জানা গিয়েছে, অন্তত এক ডজন দেশ থেকে তবলিগিরা দিল্লিতে এসেছে। চীন থেকেও এসেছে ৯ জন। কিন্তু প্রশ্ন, করোনার আঁতুড়ঘর চীনের তবলিগিরা ‘ভিসা পেলেন কী করে? তবে কী সর্ষের মধ্যেই ভূত? উপরন্তু ‘গোদের উপর বিষ ফোড়ারমতো অনুপ্রবেশকারী রোহিঙ্গারাও নাকি ছিল ওই তবলিগে। তারা এখন নিখোঁজ। আসলে ‘ভারত আপদ’ অবৈধ রোহিঙ্গারা দ্বিতীয় কাশ্মীর’ পশ্চিমবঙ্গে রয়েছে মমতা সরকারের আশ্রয় ও প্রশ্রয়ে জামাই আদরে। ওই অবৈধ অনুপ্রবেশকারীরা নানা সমাজ বিরোধী ও দেশবিরোধী কাজের সঙ্গে যুক্ত। অথচ রাজ্যের মুসলমান তোষণকারী সরকার নির্বিকার। তাছাড়া অরাজকতার ‘মক্কা’ এ রাজ্যের অধিকাংশ মুসলমান করোনাকে পাত্তাই দিচ্ছে না। তারা মানছে না সরকারের কোনো আইন ও বিধিনিষেধ। তারা যেন অন্য গ্রহের বাসিন্দা। এর অবশ্য কারণও আছে। কিছুদিন যাবত সোশ্যাল মিডিয়ায় ভাইরাল’হয়েছে একটি খবর। আর সেটি হচ্ছে, এক শ্রেণীর মৌলানা-মৌলবি প্রচার করছেন, যেসব । মুসলমান পাঁচবার নামাজ পড়বে ও কোরান পাঠ করবে, করোনা তাদের স্পর্শ করবে না। আর এই খবর প্রচার হতেই সরকারি আইন না মানার প্রবণতা বেড়েছে মুসলমানদের মধ্যে। তারা লকডাউন অমান্য করে দলবদ্ধ হয়ে মসজিদে নামাজ পড়ছে। পুলিশ অসহায়। জোড়হাতে একসঙ্গে মসজিদে নামাজ না পড়ার অনুরোধ জানালেও অধিকাংশ তাতে কর্ণপাত করছে না। আবার পুলিশ মসজিদে তালা ঝোলাতেও পারছে না। তাই বহু মসজিদে এখনও চুপিসারে দলবদ্ধ নামাজ চলছে। ফলে সংক্রমণও বাড়ছে। তাছাড়া অনেক মুসলমান করোনা আক্রমণ ঠেকাতে মুসলমান কোরানের একটি আয়াত দিনরাত পাঠ করছে যে আয়াতটি নাকি করোনা ধ্বংসে সক্ষম। একথা যদি সত্যি হয়, তাহলে বলতেই হবে, কোরানে করোনার কথা আছে। তাই প্রশ্ন, কোরানে যদি করোনা ধ্বংস বা জব্দ করার কোনো আয়াত থেকেই থাকে তাহলে তা মুসলমান বিশ্বের মুসলমানদের মনে পড়ল নাই-বা কেন? পড়লে তো বিশ্বের বিশেষত আরবের হাজার হাজার মুসলমানকে করোনার শিকার হতে হতো না। বেঘোরে মরতে হতো না ভারত-বাংলাদেশের শত শত হতভাগ্য মুসলমানকেও। কাজেই রটনাটি যে সত্য নয়— ভুয়ো, মিথ্যে ও অপপ্রচার তাতে কোনো সন্দেহ নেই। তাই পুলিশের উচিত অপপ্রচারকারীদের গ্রেপ্তার করে তাদের বিরুদ্ধে আইনি ব্যবস্থা নেওয়া। কিন্তু পুলিশের সেই ক্ষমতা আছে কি এ রাজ্যে ? যে রাজ্যের মুসলমানরা শাসকদলের দুধেলগাই, ভোটব্যাঙ্ক, তাদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেবে কোন পুলিশ? তারা যে শাসকদলের দলদাস। তাই মুসলমানরা যতই আইন ও নিষেধাজ্ঞাকে অমান্য করুক, লকডাউনকে বুড়ো আঙুল দেখাক, এ রাজ্যে তাদের সাত খুন মাপ। তা না হলে লকডাউনের মধ্যেও এ রাজ্যের মুর্শিদাবাদের একটি মসজিদে দলবদ্ধ ভাবে নামাজ পড়তে পারে তারা? এতবড়ো দুঃসাহস? তাদের বিরুদ্ধে আইনি ব্যবস্থা নেওয়া তো দূরের কথা, উলটে পুলিশকে দেখা গেছে হাতজোড় করে মসজিদে নামাজ না পড়ার অনুরোধ জানাতে। এ রাজ্য থেকেও প্রায় শ’খানেক তবলিগি গিয়েছিল নিজামুদ্দিনে। তারা ফিরেও এসেছে এ রাজ্যে। কিন্তু তাদের কোয়ারেন্টাইনে পাঠাবার আগে পরিবারের সঙ্গে থাকার কারণে বহু পরিবার হয়েছে করোনা সংক্রমিত। রাজ্য সরকার অবশ্য সে সব খবর চেপে দিয়েছে। চেপে দিয়েছে আক্রান্ত ও মৃতের খবর।

পার্শ্ববর্তী বাংলাদেশে করোনার মারণ ব্যাধি মহামারীর আকার ধারণ করেছে। সেদেশে মৃত্যুমিছিল অব্যাহত। প্রতিদিনই বাড়ছে মৃত ও আক্রান্তের সংখ্যা। এর প্রধান কারণ সত্যি বলতে, হাজার হাজার বাংলাদেশি সাধারণ মানুষ বহু দেশে শ্রমিকের কাজ করে। বিশ্বব্যাপী করোনার প্রাদুর্ভাব দেখা দেওয়ায় সেই পরিযায়ী শ্রমিকরা দলে দলে ফিরতে থাকে বাংলাদেশে। ওই শ্রমিকদের অনেকেই শরীরে বয়ে নিয়ে আসে করোনার বিষ। সেই বিষ ছড়িয়ে পড়ে নিজনিজ পরিবার-সহ সারা দেশে। বাংলাদেশ সরকার দেশবাসীকে করোনার ভয়াবহতা সম্পর্কে সতর্ক করে। নাগাড়ে চলে প্রচারও। কিন্তু সেই সতর্কতা ও প্রচারকে উপেক্ষা করে হাট বাজারে, মসজিদ-মহফিল বা জলসায় যাতায়াত অব্যাহত রাখে। তাই অবাধ মেলামেশার ফলে করোনা সংক্রমণ বাড়তে থাকে হু হু করে।

ওদিকে আবার একদল স্বঘোষিত মোল্লা-মৌলবি করোনাকে তুচ্ছ তাচ্ছিল্য করে প্রচার করতে থাকে করোনাকে মুসলমানদের। ভয় পাওয়ার কিছু নেই, করোনা কাফেরদের। বিনাশ করবে। এমনকী পাঁচবার নামাজ পড়া ও কোরান পাঠেরও ফতোয়া দে, আরও কত কী! আবার ‘পানিপড়া’ পানের নির্দেশ দিলে তাদের বাড়িতে টাকা দিয়ে পানিপড়া নেওয়ার লাইন পড়ে যায়। কিন্তু কোনো ফতোয়া, দাওয়াইতেই ফল না মেলায় জনতা বিক্ষুব্ধ হয়ে ওঠে এবং মোল্ল-মৌলবিদের মুণ্ডপাত করতে থাকে। এমতাবস্থায়, করোনা সংক্রমণ নিয়ন্ত্রণের বাইরে চলে গেলে এবং মৃত্যু মিছিল দীর্ঘতর হলে হাসিনা সরকারের টনক নড়ে। অগত্যা সরকার দেশ জুড়ে লকডাউন জারি করে। নিষিদ্ধ হয় যে কোনো জমায়েত, সমাবেশ, মাহফিল, ধর্মীয় জলসা, উৎসব, মসজিদে নামাজ পাঠ, সমবেত ভাবে অন্যান্য ধর্মীয় ও সামাজিক অনুষ্ঠান, উপাসনা, পুজোপাঠ ও হাটবাজার, দোকান, রেস্তোঁরা, শপিংমল, সিনেমা হল প্রভৃতি। চালু হয় নির্দিষ্ট দূরত্ব রেখে দাঁড়ানো, হাঁটাচলা। বাংলাদেশিরা অবশ্য নিষেধাজ্ঞা, আইন, লকডাউন মেনে চলায় তাদের সংক্রমণ ও মৃত্যুর সংখ্যা নগণ্য। তবে বাংলাদেশে করোনা নিরাময়ের উপযুক্ত ওষুধ বা প্রতিষেধক না থাকায় এবং বিশেষজ্ঞ চিকিৎসকের অপ্রতুলতার কারণে সংক্রমণ ও মৃত্যুকে বাগে আনা সম্ভব হচ্ছে না। শেষ পর্যন্ত সরকার সংক্রমণ ও মৃত্যু মিছিল আটকাতে বাধ্য হয়েছে লকডাউনকেই বাঁচার হাতিয়ার করছে। তাই সারা দেশে জারি করা হয়েছে রেড অ্যালার্ট। নামানো হয়েছে সামরিক বাহিনী। লকডাউন ভঙ্গকারী ও করোনা নিয়ে বিভ্রান্তি ছড়ানোর বিরুদ্ধে কড়া শাস্তির হুশিয়ারি দিয়েছে সরকার। ব্যাস, এতেই কাজ। অপপ্রচারকারীরা সব বেপাত্তা। কোরান থেকে করোনা গেছে পালিয়ে। মানুষ ঢুকে পড়েছে ঘরে। তাই একথা বলতে বাধা নেই, হাসিনা সরকার যা করে দেখাতে পেরেছে, মমতা সরকার তা পারেনি। কারণ ভোটব্যাঙ্ক মুসলমান তুষ্টিকরণ। অবশ্য একদিন এ তুষ্টিরই কুফল ভোগ করতে হবে মমতার দলকে। তবে ভারত একদিন করোনামুক্ত হবে। দেশবাসী আবার হাসবে। বিশ্ব আজ ভারতকে অনুসরণ করছে। করছে প্রশংসাও। কিন্তু নিজামুদ্দিনের তবলিগিরা যখন তুলেছে জেহাদের জিগির, তখন তথাকথিত বুদ্ধিজীবী ও স্বার্থান্বেষী রাজনীতির কারবারিরা একেবারে নিশ্চুপ। ৭০ বছরের সেকুরলারবাদের এটাই নির্মম পরিহাস।

ধীরেন দেবনাথ

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

This site uses Akismet to reduce spam. Learn how your comment data is processed.