১৯১৪ থেকে ১৮ সাল পর্যন্ত চলা প্রথম বিশ্বযুদ্ধে ২ কোটি মানুষের জীবনহানি হয়েছে। সে সময়ের নিরিখে এই মৃত্যু সংখ্যার অভিঘাতে গোটা আন্তর্জাতিক রাজনীতির অভিমুখটিই সম্পূর্ণ ভিন্নরূপে উঠে আসতে থাকে। এই দিশা বদলের ভয়ংকর পরিণতি দেখা যায় ২১ বছর পর দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের রক্তক্ষয়ী সূচনায়। তখন হঠাৎ তৎকালীন বিশ্ব ক্ষমতার ভরকেন্দ্রগুলিতে আমূল পরিবর্তন নজরে পড়ে। তবুও ১৯১৪ সালের আগস্ট মাসে শুরু হওয়ার সময় ইউরোপ জুড়ে অভূতপূর্ব উন্মাদনা শুরু হলেও খুব কম লোকই আন্দাজ করতে পেরেছিল কতটা ধ্বংসাত্মক হতে চলেছে এর পরিণতি। হায়! এখনকার চিরাচরিত ধারার পণ্ডিতরা বিশ্বাস করে তৃপ্তি পেয়েছিলেন যে, ছেলেরা ক্রিসমাস পড়লেই সব ঘরে ফিরে আসবে।
ইতিহাস হয়তো এই চলতি বছরে নিজের পুনরাবৃত্তি করতেও পারে, নাও পারে। ব্রিটেনের প্রধানমন্ত্রী বরিস জনসন যাকে এক ‘শয়তানসম অসুস্থতা বলে আখ্যা দিয়েছেন তার প্রভাবে বিশ্বের অর্থনীতি ও সমাজনীতিতে হয়তো আবার এক পরিবর্তনের সন্ধিক্ষণ এসে উপস্থিত হয়েছে। কিংরা আর এক ইতিহাসবিদ টেলরের কথায় আবার এসেছে ইতিহাসের বাঁকের ঘুম, যখন ইতিহাস কিন্তু মোড় ঘোরাতে মোটেই রাজি নয়। কিন্তু লক্ষণগুলি নিঃসন্দেহে বিপদসংকেত। গত সপ্তাহে বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা (WHO) জানিয়েছে, পৃথিবী হয়তো ২৫ মার্চের আগের জায়গায় আর ফিরে যাবে না। সেই স্বাভাবিক জীবনযাত্রার রূপ হয়তো বদলে যাবে। একথা ব্যাখ্যা করতে গিয়ে WHO জানায়, এই কোভিড ভাইরাস-১৯’ হয়তো আমাদের জীবনের সঙ্গী হয়েই আর ৫টা ভাইরাসের মতোই থেকে যাবে। কখনই নিশ্চিহ্ন হবে না। তাই এক অজানা আতঙ্ক আজ ঘিরে ধরছে যে, যদি-না বিজ্ঞানী ও গবেষকরা এক আশ্চর্য প্রতিষেধকের এর সন্ধান না পান তাহলে বিশ্বকে এক চিরস্থায়ী সংক্রমণের আশঙ্কা নিয়েই চলার নিয়তিকেই মেনে নিতে হবে। যার সর্বোচ্চ পরিণতি অকালমৃত্যু। ঠিক যখন মনে হচ্ছিল মানুষের অদম্য প্রাণশক্তি ও কৌতুহল জ্ঞানের ভাণ্ডার আয়ত্তাধীন করে ফেলেছে, ঠিক সে সময়েই চীনের উহান শহর থেকে আসা এই মারণ ভাইরাস মানুষের মধ্যে সেই অপরিচিত, অজানা সম্পর্কে মানুষের প্রাগতৈহাসিক আতঙ্ককেই জাগিয়ে তুলল।
গত ১২ মে প্রধামন্ত্রীর ভাষণের আগেই WHO কর্তৃপক্ষ তাদের উল্লেখিত হতাশ পর্যবেক্ষণের কথা তাকে অবহিত করেছিলেন কিনা নিশ্চিত করে বলা যায় না। কিন্তু তার বক্তব্যের ফাকে প্রধামন্ত্রীর এই ভাইরাসের সঙ্গে বাঁচার কৌশল আমাদের রপ্ত করতে হবে’ কথাটি বিশ্লেষণ করলে বোঝা যায় যে, হয়তো তিনি অবগত ছিলেন।
তবে একটা বিষয় পরিষ্কার, WHO এই করোনাজনিত বিশ্বব্যাপী সর্বাত্মক হতাশা ও গোটা সমাজের মানসিক স্বাস্থ্যের যে। অবনতির ইঙ্গিত দিয়েছে এবং তজ্জনিত যে নেতিবাচক পরিস্থিতি উদ্ভূত হতে চলেছে তাতে গা ভাসিয়ে না দিয়ে তিনি এই করোনা আক্রান্ত বিশ্বে ভারতের কর্তব্য ও ভবিষ্যৎ কী হবে তা নিয়ে যথাযথ পরিকল্পনার রপরেখা তৈরি করছেন। হ্যা, তার নিদানগুলি যে নিতান্তই অলখ বা ভগবান নির্ধারিত বাণী এমনটা ভাববার কোনো কারণ নেই। প্রতিদিনের পরিস্থিতি নির্ভর অনেক কিছু অদলবদল সেখানে হতেই পারে। তার কারণ তো একটাই যাতে সরকার মানুষের সর্বাঙ্গীণ কল্যাণে আসতে পারে। আজকের এই সময়ে মানুষ দিশেহারা, তারা একটি নির্দিষ্ট গতিমুখের সন্ধানে অধীর। তারা হাতড়ে বেড়াচ্ছে আশা-আশ্বাসের পথ যদি কোনো আংশিক নিশ্চয়তার হদিস পাওয়া যায়। এমন একটি চূড়ান্ত অস্থির সময়ে প্রধানমন্ত্রী অন্তত সামনের পথে হাঁটার কিছু দিক নির্দেশ এবং নির্দিষ্ট পরিকল্পনা জাতির সামনে রেখেছেন। যে কোনো যুদ্ধকালীন পরিস্থিতিতে মানুষ নির্ণায়ক, দৃঢ় নেতৃত্ব প্রত্যাশা করে। মোদী সেই উচ্চতায় উঠতে পেরেছেন।
তার পরিকল্পনা তৈরির মূলে রয়েছে। দেশবাসীর প্রতিজ্ঞা ও ধৈর্যশীলতার প্রতি অগাধ আস্থা। যার প্রতিফলন দেখা গিয়েছিল এই মহামারী জনিত যে টালমাটাল পরিস্থিতি তৈরি হয় তার সঙ্গে লড়াইয়ের ক্ষেত্রে। দীর্ঘ পর্যায় ধরে লকডাউনের আবহে মানুষের দুর্দশা ও কষ্টবহুক্ষেত্রে অন্তিম পর্যায়ে পৌঁছে যায়। বহুক্ষেত্রে সৃষ্টি হয় আতঙ্ক ও ভয়। বিশেষ করে যে লক্ষ লক্ষ মানুষ কাজ হারিয়েছে ও একই সঙ্গে সেখানেই আটকে পড়েছে, তারাই অবর্ণনীয় কষ্টের শিকার হয়েছে। তবুও আমাদের মতো দেশের বিশাল আয়তন সাপেক্ষে যে বিপুল কর্মকাণ্ড চূড়ান্ত দ্রুততার সঙ্গে সফল করার দরকার ছিল সেই পরিপ্রেক্ষিতে বিচার করলে সামগ্রিক প্রচেষ্টা ছিল সর্বার্থে অভিনন্দনযোগ্য। একথা সত্যি বহু ক্ষেত্রে বদমেজাজি আচরণ লক্ষ্য করা গেছে বিশেষ করে পশ্চিমবঙ্গের ক্ষেত্রে। এটি দুঃখজনক নিঃসন্দেহে। তবুও গত ১৬ মে-র পরিসংখ্যান অনুযায়ী ৮৬৬৭৮ জন সংক্রামিত ও ২৭৬০ জনের মধ্যে মৃতের সংখ্যাকে আটকে রাখার নজির কৃতিত্বের পরিচয়ই বহন করে। ভারত সম্পর্কে পাশ্চাত্যের কিছু সদা-সন্দেহপ্রবণ তথাকথিত পণ্ডিত ধরে নিয়েছিলেন যে, অতীতের নানা দুর্ভিক্ষ ও মন্বন্তরগুলির মতো এবারের গণ-মৃত্যুর মাত্রা ছাড়িয়ে যাবে। তাঁরা এখনও পর্যন্ত যোগ্য জবাব পেয়েছেন। হা, তাদের অনুমান সত্য হতে পারে যদি মানুষ ১৮ মে’র পর উপযুক্ত বিধিবিধান না মেনে চলে।
দ্বিতীয়ত, ভারত অত্যন্ত বিপজ্জনক পরিস্থিতির মোকাবিলায় যে খাড়া হয়ে যোগ্য জবাব দিতে পারে বিশ্বের অন্য দেশগুলির কাছে এই উপলব্ধি তাদের আগামীদিনে ক্রমাগত স্বার্থপর করে তুলবে। আমেরিকা তার আন্তর্জাতিক নেতৃত্বের ভূমিকা থেকে কিছুটা সরে দাঁড়িয়েছে। ইউরোপের দেশগুলি ভিন্ন ভিন্ন সুর-বিরোধী দিশায়। চলছে। অন্যদিকে চীনের ক্ষমতা একটা ভীতিপ্রদ তাৎপর্য নিয়ে এগোচ্ছে। সামগ্রিক বিশ্বায়নের রূপ কল্পনা বা ধারণা ধূলিসাৎ হয়ে গেছে। এমনকী পশ্চিম এশিয়ার দেশগুলিতেও ভারতীয় কর্মীদের যে সুযোগ এতদিন ছিল তাও সঙ্কুচিত হয়ে এসেছে। এর ফলে এই সমস্ত দেশ থেকে ভারতে যে টাকার আগমন হতো তার স্রোত বন্ধ হতে চলেছে। এই বিশ্ব পরিস্থিতির পটভূমিতে ভারতের কাছে নিজের সামর্থ্য বাড়ানো ও। পক্ষান্তরে দেশের অভ্যন্তরেই ব্যাপক উৎপাদন বৃদ্ধির মাধ্যমে আত্মনির্ভরতা বাড়ানোই একমাত্র পথ। এটা মনে করার কোনো কারণ নেই যে,এটি দেশকে বহির্বিশ্ব থেকে গুটিয়ে নেওয়ার নিদান। পক্ষান্তরে, এই নীতির অভ্যন্তরেই রয়েছে বাস্তব পরিস্থিতি অনুযায়ী বিচক্ষণতার সঙ্গে নিজেকে তৈরি করা যাতে কারুর অপার করুণার ওপর নির্ভরশীল হয়ে বা নিতান্ত অধস্তন সুলভ তাঁবেদারি করে দেশকে টিকে থাকতে না হয়। অবশ্যই মোদীর বিধানগুলি খোলাখুলিভাবেই জাতীয়তাবাদ-নির্ভর ও একই সঙ্গে প্রযুক্তিনির্ভর। এ প্রসঙ্গে অবশ্যই জাপানের সঙ্গে তুলনা উঠবে। কিন্তু দ্বিতীয় মহাযুদ্ধপূর্ব জাপানে যে অর্থনৈতিক পুনর্গঠন হয়েছিল তাতে যে সামরিক প্রয়োগ কুশলতা ছিল, ভারতে কখনই তা থাকবে না। ভারতের সমস্ত প্রায়োগিক দিকগুলিই নিয়ন্ত্রিত হবে গণতান্ত্রিক পরিকাঠামোয় ও ন্যূনতম শক্তি প্রয়োগে।
এই অনিশ্চিত বিশ্বের পৃষ্টভূমিতে ভারতের সামনে কঠিন চ্যালেঞ্জ। সেই কারণে তাকে সামলানো ও সঠিক পথে নিয়ে যাওয়ার চেষ্টাও হবে সাবধানী ও সূক্ষ্ম। কিন্তু এর সঙ্গে ভারতের অভ্যন্তরীণ চ্যালেঞ্জও উড়িয়ে দেওয়ার নয়। প্রধানমন্ত্রীকে তাঁর লক্ষ্য সফল করতে গেলে বা নিদেনপক্ষে। তার কাছাকাছি আসতে গেলেও দেশের মানুষকে সেইভাবে অনুপ্রাণিত করতে হবে। যাতে তারা পূর্ণ মাত্রায় আত্মবিশ্বাসী হয়ে উঠতে পারে। একাজটা করতে গেলে। প্রথমেই চিন্তাধারার শ্লথতা ও গোঁড়ামি ঝেড়ে ফেলতে হবে। লাল সুতোর আমলাতান্ত্রিক ফাস ও একইসঙ্গে নেতিবাচকতার কোনো স্থান থাকবে না। আর এই বস্তুগুলির প্রাধান্যের ফলেই ভারত তার সম্ভবনার পূর্ণ বিকাশ কোনো দিনই করতে পারেনি। তাই বলছি, এই চ্যালেঞ্জ একাধারে অর্থনৈতিক, মানবিক ও বৌদ্ধিক স্তরে মোকাবিলা দাবি করে। বিশ্বের উদ্যোগপতিদের কেবল ‘ভারতে উৎপাদন করো’বলে আবাহন করে আনলেই হবে না, তাৎপর্যপূর্ণভাবে আমাদের ভারতে তৈরি। জিনিসের উৎকর্ষের জন্য যেন গর্বও জন্মায়।
স্বপন দাশগুপ্ত
(লেখক বিশিষ্ট নিবন্ধকার ও রাজ্যসভার সদস্য)