মোদী সরকারের আমলে স্বাস্থ্যকর্মীদের সুরক্ষায় নতুন সংশোধিত এপিডেমিক আইন

১৮৯৭ সালের শতাব্দী প্রাচীন মহামারী আইন সংশোধনীর জন্য কেন্দ্রের বর্তমান মোদী সরকার এক অর্ডিন্যান্স জারি করে গত ২২ এপ্রিল। কারণ মারণ ভাইরাস করোনা আক্রান্তদের বাঁচানোর কোনো যাঁরা নিরন্তর চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছেন চিকিৎসক, নার্স ও স্বাস্থ্যকর্মীরা বিভিন্নভাবে হামলার শিকার হচ্ছেন। করোনা আবহে চিকিৎসক সহ সমস্ত স্বাস্থ্যকর্মীর সুরক্ষা দেওয়া সরকারের কর্তব্যের মধ্যেই পড়ে। আর তাদের সুরক্ষার জন্যই সরকারের এই অর্ডিন্যান্স। তাই সংকটকালে সরকারের এই অর্ডিন্যান্স শুধু সমর্থনযোগ্যই নয়, প্রসংশার দাবি রাখে। কেননা আমাদের দেশে এমনিতে চিকিৎসক সংখ্যায় কম। শুধু তাই নয়, আমাদের দেশে চিকিৎসক তৈরির ভালো পরিকাঠামোও তেমন নেই। ভারতে প্রতি ১,০০০ জন পিছু নেই একজন ডাক্তারও। মেডিক্যাল কাউন্সিল অব ইন্ডিয়ার রিপোর্ট অনুসারে এই মুহূর্তে ১০,২২,৮৫৯ জন চিকিৎসক রয়েছেন। তারা যদি রোজ ৮০ শতাংশ পরিষেবাও দেন, তাহলে প্রতি ১,০০০ জন পিছু ০.৬২ জন চিকিৎসক পাওয়া যায়। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার ওয়েবসাইট থেকে পাওয়া তথ্য অনুসারে অস্ট্রেলিয়ার এই হার প্রতি হাজারে ৩.৩৭৪ জন, ব্রাজিলে ১.৮৫২ জন, চীনে ১.৪৯ জন, ফ্রান্সে ৩.২২৭ জন, জার্মানিতে ৪.১২৫ জন, রাশিয়াতে ৩.৩০৬ জন, মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে ২,২৫৫৪ জন। এমনকী পাকিস্তানও এক্ষেত্রে আমাদের চেয়ে এগিয়ে। প্রতি হাজার জনে ০.৮০৬ জন। একদিকে আমাদের দেশে ডাক্তারের সংখ্যা কম, তার উপর করোনা সংক্রমণের পরীক্ষা করতে গিয়ে সেইসব যোদ্ধা, যাঁরা মৃত্যুকে উপেক্ষা করে চিকিৎসা করে যাচ্ছেন, সেই চিকিৎসক, নার্স, স্বাস্থ্যকর্মীদের প্রতি অমানবিক আচরণও লজ্জায় মাথা হেট করে দিচ্ছে। হাসপাতাল থেকে ফিরে শারীরিকভাবে ক্লান্ত, মানসিকভাবে বিধ্বস্ত চিকিৎসক, নার্স তার একমাত্র আশ্রয় ও বিশ্রামস্থল, তার গৃহে ফেরার পর কী দেখছেন? দেখছেন তাঁর এতদিনকার পরিচিত প্রতিবেশী হুমকি দিচ্ছেন। ঘর ছেড়ে বেরিয়ে যেতে। ফতোয়া জারি। করছেন লিফট, কমন প্লেসগুলি ব্যবহার করা যাবে না! দরজা বন্ধ করে দিচ্ছেন মুখের ওপর। শুধুমাত্র করোনার রোগীর চিকিৎসা করেছেন বলে মার খেতে হচ্ছে চিকিৎসক ও নার্সসহ স্বাস্থ্যকর্মীদের! হ্যা, চেন্নাইয়ের মতো শহরে পাথর ছুড়ে মারা হয়েছে এক চিকিৎসককে। ওই চিকিৎসককে কবর দেওয়ার সময় স্থানীয় মানুষ বাধাও দেন। প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদী জনগণের কাছে আর্জি জানিয়েছিলেন স্বাস্থ্যকর্মীদের কৃতজ্ঞতা, শ্রদ্ধা জানাতে। তার আর্জিতে সাড়া দিয়ে দেশবাসী কাঁসর, ঘণ্টা, থালা, বাটি, শঙ্খ বাজিয়ে এবং হাততালি দিয়ে অক্ষরে অক্ষরে সেটা পালন করেছেন। কিন্তু এই দেশেরই একাংশ এখন চিকিৎসক ও স্বাস্থ্যকর্মীদের সঙ্গে অমানবিক ব্যবহার করছেন। একাধিক রাজ্যের রাজ্য সরকার, বিশিষ্ট ব্যক্তিত্ব, সেলবদের। সচেতনতা বার্তা, অনুরোধেও করোনা মোকাবিলায় ফ্রন্টলাইনে থাকা চিকিৎসক, স্বাস্থ্যকর্মীদের উপর হামলা বন্ধ হয়নি। আর এইসব বিভিন্ন ঘটনার প্রতিবাদ হিসাবে চিকিৎসকদের সংগঠন কর্মবিরতির মতো আন্দোলনের সিদ্ধান্ত নিয়েছিল এবং এই বার্তা কেন্দ্রীয় সরকারের গোচরেও আসে। তাই কেন্দ্রীয় সরকার অতি সম্প্রতি চিকিৎসক, স্বাস্থ্যকর্মী ও আশাকর্মীদের উপর হামলা হলে দোষীদের কঠোর শাস্তি প্রদানের জন্য এই অর্ডিন্যান্স জারি করে ১৮৯৭ সালের এপিডেমিক ডিজিজ অ্যাক্ট বা মহামারী আইনের সংশোধন করে।

১৮৯৬ সালে বোম্বে প্রেসিডেন্সি অধুনা মুম্বাইয়ে প্লেগের পরিপ্রেক্ষিতে ব্রিটিশ ভারতে ১৯৮৭ সালের ৪ ফেব্রুয়ারি তৈরি করা হয়েছিল ‘দ্য এপিডেমিক ডিজিজ অ্যাক্ট বা মহামারী প্রতিরোধ আইন। এই আইনে মোট চারটি ধারা ছিল। আইনের প্রথমেই স্পষ্টবলা হয়েছে— “An Act to provide for the better prevention of the spread of Dangerous Epidemic Diseases” কেন্দ্র ও রাজ্য উভয়েরই এই আইন প্রয়োগের অধিকার রয়েছে। আইনের দ্বিতীয় ধারায় রাজ্য সরকার ও কেন্দ্রশাসিত অঞ্চলগুলিকে রোগ ছড়িয়ে পড়া আটকাতে বিশেষ ব্যবস্থা গ্রহণ ও বিধি তৈরির অধিকার দেওয়া হয়েছে। নতুন অর্ডিন্যান্স জারি করে যে সংশোধন ওই আইনে আনা হয়েছে তারমধ্যে গুরত্বপূর্ণ সংশোধনগুলি নিয়ে নিম্নে কিছুটা আলোচনা করে নিই। দ্য এপিডেমিক ডিজিজ অ্যাক্ট’ বা মহামারী প্রতিরোধ আইনের ১ নম্বর ধারার সঙ্গে ১(ক) একটি নতুন ধারা সংযোজন করা হয়েছে। এই ধারায় তিনটি ‘সংজ্ঞা দেওয়া হয়েছে। সংজ্ঞাগুলি জানা আমাদের একান্ত প্রয়োজন। প্রথম ‘সংজ্ঞাটি হচ্ছে আক্রমণের (act of violence)। মহামারী চলাকালীন সেবা প্রদানকারী স্বাস্থ্য সেবাকর্মীদের বিরুদ্ধে যে কোনও ব্যক্তির দ্বারা সংঘটিত যে। ক্রিয়াকলাপ অন্তর্ভুক্ত থাকবে সেগুলি হচ্ছে—অপমানের ফলে স্বাস্থ্য সেবাকর্মীদের জীবনযাত্রার বা কাজের পরিবেশ নষ্ট করা এবং তার দায়িত্ব পালনে বাধা দেওয়া। ক্লিনিক প্রাঙ্গণে, ক্লিনিকের অভ্যন্তরে বা অন্য কোথাও স্বাস্থ্য সেবাকর্মীদের জীবনহানি, আহত, আঘাত, ভয় দেখানো বা বিপদ সৃষ্টি করা বা তাদের কাজকর্মে বাধা প্রদান করা। স্বাস্থ্য সেবাকর্মীদের হেফাজত থেকে কোনো সম্পত্তি বা কোনো নথি ক্ষতি বা ধ্বংস করা হলে। এইসব ক্ষেত্রে ধরে নেওয়া হবে এইগুলো act of violence হিসাবে। দ্বিতীয় ‘সংজ্ঞা-টি হচ্ছে স্বাস্থ্য সেবাকর্মী (healthcare service personnel)। এর অর্থ হচ্ছে তিনি এমন একজন ব্যক্তি যিনি মহামারী সম্পর্কিত দায়িত্বশীলতার ক্ষেত্রে তার দায়িত্ব পালন করার সময় আক্রান্ত রোগীদের সঙ্গে সরাসরি যোগাযোগ করতে পারেন এবং তারজন্য সংক্রমণের ঝুঁকি থাকে। এগুলির অন্তর্ভুক্ত সরকারি ও ক্লিনিক্যাল স্বাস্থ্য সেবাকর্মী যেমন ডাক্তার, নার্স, প্যারামেডিক্যাল কর্মী ও কমিউনিটি হেলথ ওয়ার্কার। এছাড়াও মহামারী আইনের অধীনে মহামারীর প্রাদুর্ভাব রোধে ব্যবস্থা গ্রহণের জন্য ক্ষমতাপ্রাপ্ত অন্য যে কোনও ব্যক্তি ও রাজ্য সরকার নোটিফিকেশনের মাধ্যমে ঘোষিত কোনো ব্যক্তি। তৃতীয় ‘সংজ্ঞা’-টি হচ্ছে সম্পত্তির (Property)। ওই সংশোধিত আইনে সম্পত্তি বলতে বুঝানো হয়েছে ২০১০ সালের Clinical Establishments (Registration and Regulation) Act Galatics স্থাপিত ক্লিনিক। মহামারী চলাকালীন রোগীদের জন্য চিহ্নিত কোয়ারেন্টাইন বা আইসোলেশনের সুবিধা এবং মোবাইল মেডিক্যাল ইউনিট। এছাড়াও অন্য যে কোনো ‘সম্পত্তি’ মহামারীর সঙ্গে সরাসরি সম্বন্ধ রয়েছে স্বাস্থ্য সেবাকর্মীদের।

নতুন অধ্যাদেশ কর্তৃক সংশোধিত আইন অনুযায়ী কোনোও ডাক্তার বা স্বাস্থ্যকর্মীর ওপর কেউ হামলা করলে তাকে জামিন অযোগ্য ধারায় গ্রেপ্তার করা হবে (cognizable and non-bailable)। এফ.আই.আর নথিভুক্ত হওয়ার এক মাসের মধ্যে ওই হামলার ঘটনা নিয়ে তদন্ত শেষ করতে হবে পুলিশকে। একজন ইন্সপেক্টর পদমর্যাদার পুলিশ অফিসারকেই তদন্ত করতে হবে এইসব মামলার। তার পর এক বছরের মধ্যে আদালতকে সাজা ঘোষণা করতে হবে। যদি ওই সময়ের মধ্যে আদালত সাজা ঘোষণা করতে না পারে তবে তার কারণ লিপিবদ্ধ করে রাখতে হবে। অবশ্য সেই বর্ধিত মেয়াদ ঘোষণা করতেই হবে। অভিযোগ প্রমাণিত হলে অপরাধের গুরুত্ব অনুযায়ী অর্থাৎ whoever-(i) commits or abets the commission of an act of violence against a healthcare service personnel; or (ii) abets or causes damage or loss to any property আইন অনুসারে তখন ৩ মাস থেকে ৫ বছরের জেল হবে। একইসঙ্গে ৫০ হাজার টাকা থেকে ২ লক্ষ টাকা পর্যন্ত জরিমানাও দিতে হবে। ডাক্তার ও স্বাস্থ্যকর্মীদের গাড়ি ভাঙচুর, ক্লিনিক কিংবা চিকিৎসা কেন্দ্রের ক্ষতিসাধন করা হলে দ্বিগুণ। ক্ষতিপূরণ আদায় করা হবে হামলাকারীদের কাছ থেকে। এছাড়াও ছয় পৃষ্ঠার নতুন। অধ্যাদেশের শেষ পৃষ্ঠায় বলা হয়েছে। সম্পত্তি’-র ক্ষয়ক্ষতি হলে সেক্ষেত্রে সংশ্লিষ্ট সম্পত্তির বাজারমূল্যের দ্বিগুণ বা ক্ষতির পরিমাণ আদালত যেটা নির্ধারণ করবে সেটাও ক্ষতিপূরণ হিসাবে হামলাকারীকে দিতে হবে। আর যদি আদালত নির্ধারিত মূল্য অভিযুক্ত ব্যক্তি দিতে না পারে তখন এই নতুন অধ্যাদেশে বলা হয়েছে এইরূপ “Upon failure to pay the compensation awarded, such amount shall be recovered as an arrear of land revenue under the Revenue Recovery Act, 1980”.

শেষে বলা যায়, ১৮৯৭ সালের মহামারী প্রতিরোধ আইনটি ব্রিটিশ জমানায় হয়েছিল। সেই আইনকে বর্তমান সময়ের উপযুক্ত করে গড়ার জন্যই কেন্দ্রের মোদী সরকার অর্ডিন্যান্সের মাধ্যমে ১৯৮৭ সালের মহামারী প্রতিরোধ আইনে সংশোধন করে। এককথায় কেন্দ্রীয় সরকার করোনা মোকাবিলায় ফাক রাখতে চাইছে না। আর এই যুদ্ধে স্বাস্থ্যকর্মীরাই প্রকৃত সৈনিক। তাই সৈনিকদের মনোবল ও নিরাপত্তার দিকটাও গুরুত্ব দিয়ে দেখা দরকার। সম্ভবত সেই উদ্দেশ্যেই কেন্দ্রীয় সরকার বর্তমান পরিস্থিতির কথা বিবেচনা করে তড়িঘড়ি করে এই অর্ডিন্যান্স জারি করে। এই অর্ডিন্যান্স আনার আগেও কেন্দ্রের মোদী সরকার ডাক্তার ও স্বাস্থ্যকর্মীদের নিরাপত্তার কথা চিন্তা করে ৫০ লক্ষ টাকা বিমার ঘোষণা করেছে। কেন্দ্রীয় গৃহসচিব অজয় ভাল্লা এই অর্ডিন্যান্স রাষ্ট্রপতির সম্মতি পাওয়ার আগে এক পত্র লিখে দেশের সবকটি রাজ্যের মুখ্যসচিবদের জানিয়েছেন চিকিৎসক, নার্স ও স্বাস্থ্যকর্মীদের পর্যাপ্ত সুরক্ষা নিশ্চিত করার জন্য। মনে রাখতে হবে, চিকিৎসক ও নার্স নিজের এবং তার পরিবারের সদস্যদের সংক্রামিত হওয়ার আশঙ্কা নিয়েই কোভিড় ১৯-এর বিরুদ্ধে লড়ছেন। নোভেল করোনার বিরুদ্ধে প্রথম সারিতে থেকে লড়াই জারি রাখা এই চিকিৎসকরা আর রোগী দেখতে না চাইলে তখন কী হবে অনুমান করতেও ভয়ে শিউড়ে উঠতে হয়। তাই এখনই সময় নিজেকে সচেতন করার। না হলে অচিরেই একটি সংক্রমণ যা সচেতন হয়েই আটকানো সম্ভব ছিল, তা দেশের প্রতিটি বাড়ির প্রতিটি মানুষকে সংক্রামিত করবে এমন ভাবে, যা আমরা দুঃস্বপ্নেও ভাবিনি, ভাবতেও চাই না।

ধৰ্মানন্দ দেব

(লেখক বিশিষ্ট আইনজীবী)

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

This site uses Akismet to reduce spam. Learn how your comment data is processed.