গত ৭ মে ইংল্যান্ডের সর্বোচ্চ আদালতের কাছে ভারতের পলাতক অর্থনৈতিক জালিয়াত বিজয় মাল্যের আবেদন করার আপিল মামলা খারিজ করেছিল সে দেশের উচ্চ আদালত।ইংল্যান্ড থেকে ভারত যাতে তাকে ফেরত না নিয়ে আসতে পারে অর্থাৎ প্রত্যার্পণের এই মামলা কয়েক বছর ধরেই চলছে। গত এপ্রিল মাসের ২০ তারিখেই লন্ডন উচ্চ আদালত তার প্রত্যর্পণ নাকচ করার আবেদন খারিজ করে দেয়। তখনই মাল্যের ভাগ্য প্রায় নির্ধারিত হয়ে যায়। ভারত থেকে ১৩টি রাষ্ট্রায়ত্ত ব্যাঙ্কের ৯ হাজার কোটি টাকার ওপর ঋণ খেলাপী এই স্বভাবতস্কর ২০১৬ সালের ১ মার্চ সন্তর্পণে ভারত থেকে পালিয় যান। স্মরণে থাকবে, কংগ্রেসের তৎকালীন সভাপতি রাহুল গান্ধী এই পলায়নকে বিজেপি’র যোগসাজস বলে চালাতে কোনো ত্রুটি রাখেননি। তিনি সাংবাদিক সম্মেলন ডেকে সংসদ চত্বরে তদানীন্তন অর্থমন্ত্রী অরুণ জেটলি ও মাল্যের ১/৩/১৬ তারিখে বাজেটের পরের দিনের আলাপচারিয়তার উল্লেখ করেন। তাঁর সহযোগী পি এন পুনিয়া নির্দ্বিধায় জানান, মাল্য ও জেটলির মধ্যে ৭/৮ মিনিট একান্ত কথোপকথন হয়েছে যা তাদের মতে মাল্যর ভারত ছাড়ার কৌশল সংক্রান্ত বলেই তার অনুমান। জেটলি এই অভিযোগ পত্রপাঠ অস্বীকার করেন। সেই সময়কার টিভি ক্লিপিংস দেখলে বোঝা যায়। জেটলিজী কী তৎপরতায় মাল্য প্রসঙ্গ অস্বীকার যাচ্ছেন।
এপ্রিল মাসে হাই কোর্টে জয়ের পর উচ্ছ্বসিত ভারতের সিবিআই আধিকারিক আরকে গৌর জানান, ‘লুটেরা ও পলাতক অর্থনৈতিক অপরাধীর বিরুদ্ধে এই রায় তাদের তদন্তকে অন্তিম রূপ দিতে বাড়তি শক্তি যোগাবে।
রাহুল গান্ধী পুনিয়ার অনুমান নির্ভর বক্তব্যকে ধ্রুবসত্য ধরে নিয়ে অর্থমন্ত্রী জেটলিকে মিথ্যেবাদী বলতে দ্বিধা করেননি। লন্ডন হাইকোর্টের বিচারক লর্ড আরাউন কিন্তু বলেছেন মাল্যর কিংফিসারের উড়ান সংস্থা একটি অর্থনৈতিকভাবে দুর্বল, নেগেটিভ সম্পদ মূল্য ও মূল্যায়ন সংস্থাগুলির নেতিবাচক মূল্যায়নকে অগ্রাহ্য করে ভারতের IDBI ব্যাঙ্ক নিজেদের ঋণদান নীতি অনুসরণ না করে মাল্যের ডোবা কোম্পানিকে ঋণ দিতে বাধ্য হয়। জেটলি রাজ্যসভায় দাঁড়িয়ে বিরোধী নেতা গোলাম নবি আজাদের প্রত্যুত্তরে পর পর তথ্য সাজিয়ে বলেন, মাল্যকে প্রথম ২০০৪-এর সেপ্টেম্বরে ঋণ দেওয়া হয়। ২০০৮ সালেই এই ঋণ রুগ্ন হয়ে পড়তে থাকে। ব্যাঙ্কগুলির খাতায় ৩০/৪/২০০৯ অর্থবর্ষে পরিভাষায় NPA বা অনুৎপাদক সম্পদ হয়ে পড়ে। তবুও ২১/২/২০১০ সালে অদৃশ্য চাপে এই ডুবে যাওয়া ঋণকে Restrust wing বা শোধ করার শর্ত লঘু করা হয়। বলা দরকার, এই সমস্ত ঋণই কিন্তু UPA II -এর আমলে সরকারি ব্যাঙ্কগুলি থেকে নেওয়া হয়। জেটলির ২০১৭ সালের তথ্যের সময় ২০১৫ অবধি বকেয়ার পরিমাণ ছিল ৯০৯১ কোটি টাকা। লক্ষণীয়, ভারতের দুটি অগ্রণী বেসরকারি প্রথম শ্রেণীর ব্যাঙ্ক HDFC ও ICICI ব্যাঙ্কও মাল্যকে লোন দিয়েছিল। কিন্তু বেসরকারি হওয়ায় তাদের মাথার ওপর বেআইনি ও অসাধু নির্দেশ নেওয়ার বা তা মান্য করার কোনো বাধ্য বাধকতা ছিল না। তারা ঋণের নিরাপত্তা হিসেবে মাল্যের লাভে চলা মদ কোম্পানি United Breswiries-এর শেয়ার বন্ধক রেখে টাকা দেয়। সেই বিপদসঙ্কেত টের পেয়ে গচ্ছিত শেয়ার বাজারে বেচে নিজেদের দেনা মিটিয়ে নেয়। এর ফলে পরিষ্কার হয়ে যায় মাল্যের ঋণের সঙ্গে UPA কর্তৃপক্ষ কীভাবে জড়িয়ে গিয়েছিল। শুধু ভারতের আদালত নয়, বিলেতের উচ্চ আদালতেও মাল্যর পরাজয় CBI ও ED-র মধ্যে যে আশা জাগায় সেটাই আরও পরিণতি পেয়েছে গত ১৪ই মে হাইকোর্টের রায়ের বিরুদ্ধে সুপ্রিম কোর্টে যাওয়ার আপিল মামলা লন্ডন হাইকোর্টে খারিজ হওয়াতে। বিশেষ করে ন্যায়াধীশ আরউইন ও এলিজাবেথ লেং যাঁরা এপ্রিলে মাল্যর মামলা খারিজ করেছিলেন তাঁরা এদিন বলেন, এক্ষেত্রে বৃহত্তর জনগুরুত্বের (Public Importance) IGOT GOICH 197213 নেই, সেকারণে ইংল্যান্ডের সর্বোচ্চ আদালতে যাওয়ার মতো কোনো যোগ্যতাও এই মামলার নেই।
এখন লন্ডনের বিলাসবহুল বেকার স্ট্রিট ও Hertford_hire-এর ৩০ একর জুড়ে থাকা প্রায় ৮০ কোটি টাকার খামারবাড়িতে। মাত্র খান পঞ্চাশেক বহুমূল্য গাড়ি ও অন্যান্য বিলাস ব্যসন নিয়ে বসবাস করার (কেননা ইনি ঠগ ছাড়াও অত্যন্ত বিকৃতমনস্ক নারীলোলুপ একজন মানুষ) দিন হয়তো হাতে গোনা হয়ে আসছে। কেননা সংশ্লিষ্ট সূত্রের মতে তার option গুলি সীমিত হয়ে। আসছে। প্রত্যর্পণ আইনজ্ঞ বেগ কিথ বলেছেন, এই রায়ের ওপর নিষেধাজ্ঞা পাওয়ার ক্ষেত্রে মাল্যকে প্রত্যক্ষ প্রমাণ দিতে হবে যে ভারতের জেলগুলি বসবাসের পক্ষে নিরাপদ নয়। কিংবা তিনি বর্তমানে চলা ‘ফোরোনা সরঞসনের প্রসঙ্গও তুলতে পারেন। এগুলি সবই তার অপরাধের পরিধির বাইরে। পড়ে রয়েছে ইউরোপিয়ান কোর্ট অব হিউম্যান রাইটস (ECHR)। এঁরাও কিন্তু দেখবে তার অপরাধ স্থলের দেশে ফিরে গেলে কাদের মানবাধিকার ক্ষুন্ন হবে। কেননা এগুলি সাধারণত রাজনৈতিক আশ্রয় প্রার্থীদের ক্ষেত্রে প্রযোজ্য হয়। ভারতীয় জেলের বিষয়ে তো প্রধানমন্ত্রী ইতিপূর্বেই কমনওয়েলথ সম্মেলনের অবকাশে ব্রিটেনকে বার্তা দিয়ে রেখেছেন যে Arthar Road জেলে তারা মহাত্মা গান্ধীকে রেখেছিলেন, এই ব্যক্তি তার থেকেও উচ্চমার্গের? বিষয়টা তাদের ভাবাবে।
দেশের এনফোর্সমেন্ট ডাইরেক্টটরেট তাই চরম আশাবাদী। আগামী ২৮ দিনের মধ্যেই হয়তো তারা লন্ডন উড়ে যাবেন। ইনজাংসন প্রার্থনা নামঞ্জুর হলে (সে সম্ভবনা প্রবল) লন্ডনের হেথরো বিমানবন্দরেই তারা এই ভয়ংকর অর্থনৈতিক সন্ত্রাসীকে হেফাজতে নেবেন। পুলিশবাহিনী পরিবেষ্টিত হয়ে বর্তমানে সাড়ে ছ’কোটি টাকার ব্যক্তিগত জামিনে থাকা পলাতক আসামি আর্থার রোড জেলের নির্ধারিত ১২ নং ব্যারাকে ঢুকবেন যার ছবি আগেই স্কটল্যান্ড ইয়ার্ডের লোকেরা নিয়ে গেছে।
২০১৯-এর নির্বাচনের প্রাক্কালে নরেন্দ্র মোদী প্রতিশ্রুতি দিয়েছিলেন, “ আপনারা ২০১৪ থেকে ৫ বছর দিয়েছিলেন, আমি ঠিক ঠিক লোককে জেলকুঠুরির সামনে এনেছি আর ৫ বছর দিন, তাদের অন্দর করে দেবো।” ৫ বছর তো পেয়েছেনই, হয়তো সেই উদ্বোধন মুহূর্ত সমাগত!
সুব্রত বন্দ্যোপাধ্যায়