মুখ্যমন্ত্রীর কল্যাণে লাটে উঠেছে রাজ্যে সরকারি চিকিৎসা ব্যবস্থা

একটি প্রশ্ন দিয়ে আজকের লেখাটা শুরু করতেই হচ্ছে। কী সেই প্রশ্ন? প্রশ্নটা হচ্ছে, আমাদের জনসাধারণের জীবন নিয়ে ছিনিমিনি খেলার অধিকার কি কারাের আছে? বিশেষ করে রাজ্যের অভিভাবকের ? এখানে অভিভাবক শব্দটা ব্যবহার করা হচ্ছে একটিই কারণে, সাধারণ মানুষ সর্বোচ্চ গণতান্ত্রিক অধিকার দিয়ে তাঁকে নির্বাচিত করেছেন রাজ্যের মুখ্যমন্ত্রী হিসেবে রাজ্যের সাধারণ মানুষের হিতার্থে কাজ করবেন বলে। ৩৪ বছরের একটি জগদ্দল পাথরকে সরিয়ে সেই ক্ষমতা তাঁকে অর্পণ করেছিলেন সাধারণ মানুষ। এই অধিকার পাবার আগে যে বঞ্চনা, অবহেলা তাঁরা পাচ্ছিলেন, তাঁর অবসান তাঁরা চেয়েছিলেন বলেই পরিবর্তন এনেছিলেন। কিন্তু সেই আশা কতটা যে নিরাশায় পরিণত হতে পারে অদূর ভবিষ্যতে সেটা তাঁরা কল্পনাতেও আনতে পারেননি। এমন একজনকে অভিভাবক হিসেবে তারা আনলেন, যিনি মিথ্যাটাকেই বাস্তবের মােড়কে সাধারণ মানুষকে ধোঁকা দেন। সেটা বুঝতে একটু বেশি সময়ই লাগলাে রাজ্যবাসীর। রাজ্যের প্রধান, মুখ্যমন্ত্রী আজ যে ক্ষেত্রেই লক্ষ্য দিয়েছেন, সেটারই ভবিষ্যৎ একেবারেই অন্ধকার । এমনটাই বলছেন জনসাধারণ। এর পিছনে কারণ হিসেবে তারা বলছেন, তিনি পরিকল্পনা শব্দটার মানে বােঝেন বা বােঝার চেষ্টাও করেন না। না হলে তার কথার সঙ্গে প্রতি পদক্ষেপে বাস্তবের উলটো ছবিটা প্রকাশ্যে চলে আসে কেন?সব ক্ষেত্রেই তা দেখা গেছে। তাহলে কি তার পার্ষদকুল এক কথায় পরিকল্পনা বিষয়টা জানেন না বা পরিকল্পনা মেনে তার বাস্তব রূপ দিতে জানেন না? একথা বললে হয়তাে পার্ষদকুলের আঁতে ঘা লাগতেই পারে। সে লাগুক, একজন সাধারণ মানুষ হিসেবে এ কথা বলার অধিকার বা সমালােচনা করার অধিকার সংবিধান দিয়েছে সবাইকে। তবে আমাদের রাজ্যে এই সত্যটা মানতে পারেন না শাসককুল।

আমাদের রাজ্য এখন করােনার মহামারীর এক জ্বলন্ত দৃষ্টান্ত হতে চলেছে। তবুও আমাদের আশার বাণী এই যে সীমিত সংখ্যক করােনা যােদ্ধা, রাজ্যের স্বাস্থ্য ব্যবস্থার নকল। বুদির গড়কে বাঁচিয়ে রাখার চেষ্টা করে চলেছেন। তাদের কুর্নিশ জানাতে দ্বিধা নেই। মনে চাপা অসন্তোষ পুষে তারা পরিবার-পরিজন ছেড়ে অক্লান্ত ভাবে নিজেদের নিয়েজিত রেখেছেন এই যুদ্ধে। কিন্তু তাদের এই যুদ্ধের যিনি সেনাপতি, যার দায়িত্বে রয়েছে। সবকিছু, যিনি দামামা বাজিয়ে বলে বেড়ান যে তার রাজ্যের স্বাস্থ্য ব্যবস্থা সারা দেশের মধ্যে অন্যতম,তার ভূমিকাটা কী? সেই প্রশ্ন কি কেউ তুলছেন? তােলার ক্ষমতা নেই।বা তুললেই কোতল মানে তিনি হয়তাে একঘরে, অস্তিত্বহীন হয়ে পড়বেন।

কথা হচ্ছিল বিভিন্ন সরকারি হাসপাতালের চিকিৎসকদের সঙ্গে। তাঁরা নাম প্রকাশ করতে চান না। তাঁরা সবাই প্রথিতযশা চিকিৎসক। কেউই চান না আজকের শাসকদলের নােংরা রাজনীতির বলি হতে। তাদের বক্তব্য বা মনােভাব একটু বলার দরকার আছে। তাদের পরিকাঠামাে আছে, সেটা নিশ্চয় জানা আছে মুখ্যমন্ত্রীর বা তার এই স্বাস্থ্য দপ্তরের প্রতিমন্ত্রীদের। যখন করােনাকে নিয়ে একটা ঘােষণা হলাে, তখন সেই তথ্যকে ভিত্তি করে একটা নির্দিষ্ট পরিকল্পনা করে কী এগােনা যেত না? প্রথম দিকে এই পরিস্থিতিকে সামলাবার মতাে সময় হাতে ছিল। কিন্তু সেই সময়ে কী পরিস্থিতির মােকাবিলার খুঁটি সাজানাে যেত না? অনেক চিকিৎসক আবার বলছেন, “যখন আমরা সামান্য হলেও ঢাল তলােয়ার পেলাম, তখন অনেকটাই দেরি হয়ে গেছে। আমরা সবাই ক্ষতবিক্ষত। লড়তে লড়তে হাঁপিয়ে উঠেছি। ওই প্রথমের সামান্য ভুলে এখন যখন বিষয়টার চেহারা সুনামির, তখন আর তাকে সামলাবার ক্ষমতা আমাদের নেই।

এতাে গেল করােনার কথা। কিন্তু সাধারণ চিকিৎসা ! সেটার কী হচ্ছে? সে খবর কি করােনা হাসপাতাল করে দিচ্ছেন মুখ্যমন্ত্রী তথা স্বাস্থ্যমন্ত্রী। সেখানে সাধারণ চিকিৎসা করাতে আসা সাধারণ রােগীদের চিকিৎসা লাটে উঠেছে। সেই বিষয়টার দিকে কি কেউ নজর দিয়েছেন কেউ? সম্প্রতি জোকা ইএসআই মেডিক্যাল কলেজ ও হাসপাতালকে কোভিড হাসপাতাল হিসেবে রাজ্য সরকার ঘােষণা করেছে। সেখানের ৫০০ শয্যার পুরােটাই করােনা চিকিৎসায় ব্যবহার করা হবে। এই হাসপাতালে সাধারণ শিল্প-কলকারখানার শ্রমিক-কর্মচারীরা চিকিৎসার সুযােগ পেতেন। কয়েকমাস আগে থেকেই বন্ধ সাধারণ পরিষেবা। বহির্বিভাগ ও অন্তর্বিভাগ কোনােটাতেই সাধারণ রােগের চিকিৎসা হচ্ছে না। এই হাসপাতালের এক বিভাগীয় প্রধান জানিয়েছেন, সেইসব রােগী, যারা ক্যান্সারে আক্রান্ত, ডায়ালিসিস নিচ্ছেন বা কোনাে কঠিন রােগের নিয়মিত চিকিৎসার সুযােগ পেতেন, তাঁরা প্রায় বিনা চিকিৎসায় রয়েছেন। এদের সেই সামর্থ্য নেই যে পয়সা দিয়ে অন্য হাসপাতালে যাবেন। তাদের বাড়িতে বিনা চিকিৎসায় বেঁচে থাকার অধিকারটাকে ঈশ্বরের হাতে ছেড়ে দেওয়া ছাড়া উপায় নেই।

গত কয়েকদিন আগের একটা ঘটনার কথা বলতে হচ্ছে একটি কারণে, ঠাকুরপুকুরের সত্যনারায়ণ পল্লীতে এক পরিবারের তিনজন আত্মহননের পথ বেছে নিলেন। অপরাধ তারা অর্থহীন, অসুস্থ অবস্থায় বেসরকারি কোনাে জায়গায় চিকিৎসা করাবার ক্ষমতার্তদের নেই। স্থানীয় পুলিশের সাহায্যে যদিও একটি গাড়িতে করে বেশ কিছু হাসপাতালে যাবার সুযােগ এসেছিল গুরুতর অসুস্থ অশীতিপর বৃদ্ধের। ওই। সফরে সঙ্গী তার সত্তরাের্ধ্ব স্ত্রী এবং তার চলৎশক্তিহীন পুত্রের। এ হাসপাতাল ও-হাসপাতাল ঘুরে বাড়ির সামনে ছুঁড়ে ফেলে দিয়ে গিয়েছিল অ্যাম্বুলেন্স। কেননা সবাই ফিরিয়ে দিয়েছিল।বাড়িতে ফিরে গােটা পরিবার আর বাঁচতে চায়নি এই সমাজে।করােনার জেরে এখন কোনাে হাসপাতালেই আর সাধারণ রােগের চিকিৎসা প্রায় হচ্ছে না বললেই চলে। এর পিছনে কারণ দুটো। এক চিকিৎসকরা সংক্রমণের ভয়ে চিকিৎসা করতে চাইছেন না। আর অন্য দিকে সংক্রমিত হবার ভয়ে সাধারণ রােগী চিকিৎসা করাতে যেতে ভয় পাচ্ছেন। দ্বিতীয় কারণটা একেবারেই গৌণ। চিকিৎসকরা অধিকাংশ ভয়ে তাদের প্র্যাক্টিস বন্ধ রেখেছেন। নয়তাে-বা যাঁরা হাসপাতালে রয়েছেন তাঁরা যতটুকু না হলে নয়, ততটুকু করেই চলে আসছেন। বিশেষ করে করােনা চিকিৎসা করার ক্ষেত্রের বাইরের চিকিৎসকরা। আমাদের রাজ্যে স্বাস্থ্য পরিসেবার ক্ষেত্রে একটি ভয়ংকর চিত্র ফুটে উঠেছিল একটি সমীক্ষায়। সেই সমীক্ষায় দেখা যাচ্ছে যে স্বাস্থ্য পরিসেবার ক্ষেত্রে যে দুটি হাতিয়ারকে অবলম্বন করে এগােতে হয়, সেই চিকিৎসক ও প্যারা-মেডিক্যাল স্টাফ। সেই দুটি ক্ষেত্রেই সাধারণ যে অনুপাত থাকার দরকার সেটা নেই। প্রতি ১০০০ জনে এই অনুপাত ১.৮৩। যেটা একেবারে না হলে নয়, সেই অনুপাত হচ্ছে ২.২৫। ফলে বােঝাই যাচ্ছে স্বাস্থ্য পরিষেবা দেবার ক্ষেত্রে ন্যূনতম সেই হাতিয়ারটুকুই আমাদের রাজ্যে নেই। অথচ ২০১৭ সালের একটি বেসরকারি স্বেচ্ছাসেবী সংস্থার করা সমীক্ষা অনুযায়ী সারা রাজ্যের বিভিন্ন সরকারি হাসপাতালে প্রায় বছরে ১২ কোটি মানুষ বহির্বিভাগে চিকিৎসা করাবার জন্য নাম নথিভুক্ত করেন। তাহলে একটি প্রশ্ন এসেই যায়, এই সব মানুষদের সিংহভাগ এখন চিকিৎসা করাচ্ছেন কোথায় ? চিকিৎসকদের মতে, এদের অধিকাংশই চিকিৎসা ক্ষেত্রের বাইরে রয়েছেন। এর একমাত্র কারণ, সরকারি হাসপাতালগুলােতে করােনা ছাড়া এই মুহূর্তে অন্য কোনাে দিকে সেই অর্থে লক্ষ্য দেওয়া হচ্ছে না। একটি সামান্য উদাহরণ তারা দেন। বলেন, কলকাতা মেডিক্যাল কলেজে কত মানুষ চিকিৎসার সুযােগ গ্রহণ করতেন। ওই হাসপাতালকে নিয়ে নেওয়ার ফলে বঞ্চিত হলেন তাঁরা। এটা কি সরকারি স্তরে পরিকল্পনার অভাব নয়? হঠাৎ করে নিয়ে নেওয়ায়, এই হাসপাতালে ভর্তি থাকা বহু রােগীর কথা চিন্তাভাবনায় আনা হলাে না কেন?

কয়েকদিন আগের একটি ঘটনার উল্লেখ করতেই হচ্ছে। ঠাকুরপুকুরে একজন মহিলা গুরুতর অসুস্থ হয়ে পড়লেন।তাকে সেই মুহূর্তে কোনাে সরকারি হাসপতাল বানার্সিং হোেম ভর্তি নিতে অস্বীকার করে। পেসমেকার বসানাে মহিলা একেবারে বিনা চিকিৎসায়, রাস্তাতেই প্রাণ হারান। এই অব্যবস্থা সৃষ্টির জন্য দায়ী কে? এই প্রশ্ন তােলার অধিকার কারাের নেই। আসলে স্বাস্থ্য ক্ষেত্র নিয়ে মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের ফাঁকা বুলি আজ মানুষ বুঝে ফেলেছে। আমাদের রাজ্যে সরকারি ক্ষেত্রে যােগ্য চিকিৎসক আছেন। তারা সরকারি স্তরে তাদের সেবা দেবার চেষ্টাও করেন। তা সত্ত্বেও পরিকল্পনার অভাবে সেই সেবা থেকে বঞ্চিত হন সাধারণ মানুষ, যারা একেবারেই চিকিৎসা করাবার জন্য নির্ভর করে থাকেন সরকারি চিকিৎসা ব্যবস্থার ওপর। আচ্ছা, সরকারি আমলা, মন্ত্রী ,ভাইপাে বা মুখ্যমন্ত্রী স্বয়ং কি একেবারে শুরুতেই, তাঁর নিজের চিকিৎসার জন্য কোনাে সরকারি চিকিৎসা ব্যবস্থার ওপর বিশ্বাস করেন? নইলে ভাইপাে-ভাইঝির চিকিৎসার জন্য মিন্টো পার্কের কাছের নামি হাসপাতালে চিকিৎসার সুযােগ নিতে হয় কেন? তাহলে কি সরকারি হাসপাতালে চিকিৎসার সেই পরিকাঠামাে নেই? আবার যখন তিনি চিকিৎসা ক্ষেত্রের জন্য কোনাে আন্তর্জাতিক কমিটি তৈরি করেন, সেখানেও সরকারি হাসপাতালের যােগ্য চিকিৎসকদের ঠাই দেন না কেন ? তাহলে কি তিনি সরকারি চিকিৎসকদের যােগ্যতর মনে করেন না? এ প্রশ্নও তুলছেন অনেকেই। ফলে আজকের স্বাস্থ্য ব্যবস্থা লাটে তােলার মূল যে রাজ্যের অভিভাবক তা এক কথায় মেনে নেওয়া ছাড়া উপায় কী? আজকের স্বাস্থ্য পরিসেবার ক্ষেত্র বেসরকারি ক্ষেত্রের কাছে ক্রমেই বিকিয়ে যাওয়ার জন্য দায়ী কে? সেই অভিভাবক। একথাও বলা যেতেই পারে।

বিশ্বপ্রিয় দাস

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

This site uses Akismet to reduce spam. Learn how your comment data is processed.