এই সময়ে যাঁরা আমার মতাে সঙ্ঘকাজের সঙ্গে যুক্ত, তাদের প্রত্যেকের জীবনেই মােতলগজীর কিছু না কিছু প্রভাব আছে। প্রত্যেকেই অনুভব করছেন তাঁর জীবনীশক্তিকে। তিনি কেমন মানুষ ছিলেন, একটা কথা মনে পড়ছে ‘বৃত্তপত্ৰমে নাম ছপেগা প্যাহেনুঙ্গা সাগর সম হার /ছােড় চলে য়হ ক্ষুদ্র ভাবনা হিন্দুরাষ্ট্রকে তারণ হার। আর একটি মর্মকথা আছে— ‘তেরা বৈভব অমর রহেম হম দিনচার রহেঁ না রহেঁ”। একথা স্বয়ংসেবক, কার্যকর্তা, প্রচারক প্রত্যেকের কর্মপথের পাথেয়। মােতলগজী ঠিক এটাই ছিলেন— যাকে বলে প্রসিদ্ধিপরাঙ্মুখ। বহু বছর তিনি পশ্চিমবঙ্গ, অসমে অর্থাৎ সঙ্ঘের দৃষ্টিতে যাকে আমরা পূর্বক্ষেত্র বলি, সেই ক্ষেত্রে কাজ করেছেন, তেমনই সঙ্কাজের তীর্থভূমি নাগপুরে অনেক বছর কাটিয়েছেন। তাসত্ত্বেও আমরা কোনােদিন তাকে দেখিনি নিজেকে অতিরিক্ত উচ্চতায় স্থাপন করতে।, বরং নিজেকে অতি সাধারণ, অতি সামান্য করে রেখেছেন। কারণ তিনি প্রসিদ্ধি পরায়ূখ। সঙ্ঘকাজ করা ও কার্যকর্তা তৈরি করাই ছিল তার জীবনের সর্বশ্রেষ্ঠ অবদান। আমাদের প্রত্যেক কার্যকর্তার তার থেকে এই কর্মপ্রেরণা গ্রহণ করা উচিত।
মােতলগজীর জীবন গীতােক্ত সেই উচ্চ আদর্শের ওপর অধিষ্ঠিত। সুখ-দুঃখ, জয়-পরাজয় ও লাভালাভে তিনি কোনােদিন বিচলিত হতেন না। তিনি অখিল ভারতীয় স্তরে প্রচারকদের জন্য ভ্রমণ করতেন। আজকের নবীন প্রচারকরা আমাদের মতাে প্রবীণ প্রচারকদের দৃষ্টিকোণ থেকেই তাকে দেখেছে। নিছক কালের গণ্ডিতে তাকে বাঁধা যাবে না। তিনি কালােত্তীর্ণ। সন্তরা বলেন, গীতার কথাগুলাে হলাে তত্ত্বমূলক,
কিন্তু মােতলগজী সেই তত্ত্বকথা আমাদের জীবনে ব্যবহারিক ভাবে কার্যকরী করেছেন। এরকম এক মহান প্রচারককে আমরা হারালাম যাঁর জীবনের লক্ষ্য ছিল একটাই – সঙ্ঘকাজ।
তিনি যে পরিবারে বড়াে হয়েছেন সেই পরিবার থেকে প্রচারক বের হওয়া নির্ধারিতই ছিল, কিন্তু কে বের হবেন—তাঁর দাদা না তিনি, সেই নিয়ে দ্বন্দ্ব ছিল। শেষ পর্যন্ত তারই জয় হয়েছিল। তাঁর দাদা চেন্নাইয়ে বহু বছর কাটিয়েছেন, সেখানে অধ্যাপনা করতেন। তাঁর ভাইঝি একজন প্রখ্যাত চিকিৎসক। যেদিন মােতলগজী পরলােকে পাড়ি দিলেন, সেদিন পরম পূজনীয় সরসঙ্ঘচালক মােহনজীর ফোন পেলাম। তিনি আমাকে বাংলাতেই বললেন, ‘অদ্বৈতদা, মােতলগজী চলে গেলেন। অকস্মাৎ এই সংবাদে আমি বাকরুদ্ধ হয়ে গেলাম। একটু সামলে নিলে নিয়ে একটা কথাই মােহনজীকে জিজ্ঞেস করলাম, ‘তার ডাক্তার ভাইঝি শেষ সময়ে কাছে ছিলেন কি না। মােহনজী বললেন, হ্যা, ছিলেন। আমি আশ্বস্ত হলাম, কারণ শেষ সময়ে সেই ডাক্তার ভাইঝি তার সেবা করেছেন। পরম শান্তিতে তিনি পরম ধামে গমন করতে পেরেছেন।
জীবনের অন্তিম মুহূর্তেও তিনি সচল ছিলেন। প্রয়াত হবার একদিন আগ্যে তিনি কার্যালয় থেকে ডাক্তারের চেম্বারে গিয়েছিলেন। তাই আমরা বলতে পারি, তিনি সজ্ঞানেই অমৃতলােকে যাত্রা করেছেন। আমরা করােনা আবহে ভার্চুয়াল শ্রদ্ধাঞ্জলি সভা করছি। ঈশ্বরের ইচ্ছাও বােধহয় তাই—তিনি যে প্রসিদ্ধিপরাঙ্মুখ। লােকচক্ষুর অন্তরালে থেকে তার কাজ করার বহু নমুনা আছে। অসমের দুর্গম এলাকায় কঠিন। পরিস্থিতিতে তার অমানুষিক পরিশ্রমের কথা কোনােদিন কাউকে বলেননি।
আমার তাকে প্রথম দেখার দিনটির কথা মনে আছে। ১৯৮১ সালে তিনি কলকাতায় এসেছিলেন। সঙ্ঘ শিক্ষা বর্গ থেকে তিনি প্রচারক বেরিয়ে নাগপুরে ছিলেন। নাগপুর থেকে তাকে অসমে পাঠানাে হয়েছিল। ডিব্ৰুগড় বিভাগ প্রচারক, গৌহাটি মহানগর প্রচারক হিসেবে বেশ কয়েক বছর কাজ করার পর শ্রীগুরুজী তাকে মায়ের অসুস্থতার কারণে নাগপুরে থেকে সঙ্ঘের কাজ করতে বলেন। তিনি । নাগপুরে ফিরে যান। তখন নাগপুর আলাদা প্রান্ত হিসেবে ঘােষিত ছিল। তাকে নাগপুর প্রান্ত প্রচারক ঘােষণা করা হলাে। কলকাতায় যখন এলেন, দেখলাম কত বিশাল তার কর্মক্ষেত্র। আমি বিদর্ভ প্রান্তে প্রচারক বৈঠকে গিয়েছিলাম। মােতলগজীর সঙ্গে আমি শ্রীরাম যােশীর বাড়িতে গিয়েছি। দেখলাম, শ্রীরাম যােশীর সঙ্গে তার ঘনিষ্ঠ বন্ধুত্ব।
নাগপুরে তিনি বালুজী নামে পরিচিত। আমরা তাকে কেউ শ্রীকৃষ্ণজী, কেউ মােতলগজী বলি। বেশিরভাগ স্বয়ংসেবক শ্রীকৃষ্ণদা বলেন। নাগপুরে তার সম্পর্ক প্রতিটি স্বয়ংসেবক, প্রতিটি কার্যকর্তার ঘরে ঘরে। নাগপুরে তিনি বহু কার্যকর্তা নির্মাণ করেছেন। একদিন কার্যালয়ে আমরা আলােচনা করছিলাম যে, কার্যালয়ে থেকে পড়াশােনা করা বিদ্যার্থীদের কার্যকর্তা রূপে তৈরি করা যায় কি না। অনেকে বলেছিলেন কার্যালয়ে যে বিদ্যার্থীরা থাকেন তাদের সেভাবে দেখাশােনা করা হয় না, ফলে তাদের মধ্যে সংস্কারও কিছু জন্মায় না। আমি উৎসাহ প্রকাশ করেছিলাম, কার্যালয়ে যদিদু’তিন জন বিদ্যার্থী থাকেন তাদের উন্নতি অবশম্ভাবী। যদি আমাদের অধিকারীরা তাদের ভােেলাভাবে গড়ে নিতে পারেন, তবে আমরা আগামীদিনে অনেক ভালাে কার্যকর্তা পেতে পারি। তখন আমি আমার জীবনের প্রসঙ্গে বললাম আমিও কার্যালয়ে থেকে পড়াশােনা করেছি। তখন মােহনজী বললেন, “ঠিক কথা, মােতলগজী আমাকেও কার্যালয়ে ডেকে নিয়ে এসেছিলেন। আজ তিনি সরসচ্ছাচালক। মােতলগজীর হাতের স্পর্শ পেয়েছিলেন সেকথা স্মরণ করে তিনি গর্ব অনুভব করেন। মােতলগজীর হাতের ছোঁয়া যারা পেয়েছেন তারা অনেক দূর এগিয়ে যেতে পেরেছেন। মােহনজী তার প্রকৃষ্ট উদাহরণ।।
তিনি এরকমই ছিলেন একটি শক্তিকেন্দ্র। ৬ আগস্ট দিনটা আমাদের কাছে বড়ােই বেদনার। আজকের দিনে খ্রিস্টান প্রভাবিত জঙ্গি সংগঠন এনএলএফটি সঙ্ঘের চার কার্যকর্তাকে অপহরণ করে। মােতলগজী তখন ক্ষেত্র প্রচারক, আমি সহ প্রান্ত প্রচারক। আমি প্রত্যক্ষদর্শী—তিনি যন্ত্রণায় কতটা কাতর হয়েছিলেন। কিন্তু ধীরে ধীরে শান্ত সমাহিত চিত্তে তাদের মুক্তির জন্য চেষ্টা করে যাচ্ছেন। যত রকম প্রয়াস নেওয়া সম্ভব তিনি নিয়েছিলেন। তাদের মুক্তির জন্য যতটা অর্থ সংগ্রহ করা সম্ভব তা তিনি করেছিলেন। আশ্চর্য হতে হয়, কী অসীম ধৈর্যশক্তির সঙ্গে তিনি সেই দিনগুলিতে কাজ করেছিলেন। সমস্ত রকম চেষ্টা সত্ত্বেও শেষ রক্ষা হয়নি। সেই চারজন কার্যকর্তার আত্মা নিশ্চয় শান্তি পাবে সবাই সেই প্রার্থনা করি। সেসময় সেই চার কার্যকর্তার পরিবারের ধৈর্যচ্যুতি ঘটা স্বাভাবিক ছিল। কিন্তু মােতলগজী শান্তচিত্তে তাঁদের কথা শুনতেন। কোনােদিন তাকে উত্তেজিত হতে দেখিনি। তিনি তাঁদের পরিবারের বেদনা ভাগ করে নিতেন।
তার সঙ্গে কাজ করার সুবাদে আমি কত কিছু শিখেছি। আমি তখন কোচবিহার জেলা প্রচারক। তিনি প্রবাসে এসেছেন। একজন। কার্যকর্তা স্কুটার কিনেছেন, যেটা আমি চালাবার চেষ্টা করছি। আমরা সবাই জানি, মােতলগজী স্কুটার চালাতে পারেন। তাঁর পাকা হাত। আমি একেবারে নতুন। তিনি ক্রমাগত আমাকে উৎসাহ দিয়ে চলেছেন। আমি চালাচ্ছি, তিনি পেছনে বসে। মাঝে মাঝে ব্রেক কষতে হচ্ছে, স্টার্ট বন্ধ হয়ে যাচ্ছে, কিন্তু তিনি আমাকে হতােদ্যম না করে উৎসাহ দিয়েছেন। আমার জেলা প্রচারক থেকে অখিল ভারতীয় দায়িত্ব, আমার স্বীকার করতে কুণ্ঠা নেই, এই যাত্রাপথ তিনি মসৃণ করে দিয়েছেন।
২০০৩ সালে যখন উত্তরবঙ্গ প্রান্ত ঘােষণা হলাে, আমাকে তখন প্রান্ত প্রচারকের দায়িত্ব নিতে বলা হয়। এর পিছনে যে মানুষটির প্রেরণা ছিল তিনি মােতলগজী। তিনি যখন পশ্চিমবঙ্গে এলেন, তখন মূলত কলকাতা ও হাওড়া মহানগরের কাজ দেখতেন। ধীরে ধীরে সহ প্রান্ত প্রচারক, প্রান্ত প্রচারক, ক্ষেত্র প্রচারক হলেন। তার কাছে শুনেছি, যখন তিনি এখানে এসেছিলেন তখন খাদ্যাভ্যাসের ব্যাপারে তাকে অবর্ণনীয় কষ্ট সহ্য করতে হয়েছিল। বাঙ্গালি বাড়িতে তাঁকে মাছ খেতে দিত, আজীবন নিরামিষাশী মানুষটি মাছ খেতেন, তবে কাটা বাছতেন দুই হাত দিয়ে। বলতেন—দেখাে, অভ্যাসে মানুষ সবই পারে, আমি মাছ না খেলে ওরা দুঃখ পাবেন। তিনি বললেন, আমি জানতাম অসমে গিয়ে আমার খাদ্যাভ্যাসের পরিবর্তন করতে হবে। তাই ট্রেনে নাগপুর থেকে গৌহাটি যাওয়ার সময় ডিম খাওয়ার অভ্যাস করেছিলাম। তার এই সমর্পিত জীবনের থেকে আমরা শিক্ষা পাই যে, আমাদের যে ক্ষেত্রে যেতে হবে সেখানকার উপযােগী হতে হবে। এই শিক্ষাটা আমাদের প্রচারকদের মস্ত পাওনা তাঁর কাছ থেকে। তার মৃত্যুর পর অসম থেকে যে অসংখ্য ফোন আসছিল তাতে বুঝতে পারি যে অসমবাসীরা স্বজন হারানাে বেদনা অনুভব করছেন। কোনাে কার্যকর্তা বলতে পারবেন না যে তার সঙ্গে মােতলগজীর কথা কাটাকাটি হয়েছে। বিভিন্ন কার্যালয় প্রমুখের কাছে শুনেছি মােতলগজী সামান্য কাজে বাইরে গেলেও বলে যেতেন।
মােতলগজী তার উচ্চ দায়িত্বের জন্য আলাদা কোনাে সুযােগ গ্রহণ করেননি। প্রত্যেকটি অনুশাসন তিনি পালন করতেন। ২০০৩ থেকে ২০১০ পর্যন্ত তিনি ক্ষেত্র প্রচারক ছিলেন। তারপর অখিল ভারতীয় সহ প্রচারক প্রমুখ ছিলেন, তারপরে দু’বছর কার্যকারিণীর সদস্য ছিলেন। তা সত্ত্বেও তিনি শান্ত সমাহিত চিত্তের মানুষ। কেশব ভবনে তিনি মাঝে মাঝে আমার ঘরে আসতেন, জিজ্ঞেস করতেন, প্রচারক বৈঠক কবে। আমি তাঁকে ডায়েরি খুলে বলে দিতাম। মাঝে মাঝে তার ঘরেও আমাকে ডেকে পাঠাতেন —ইন্টারকমে অত্যন্ত কুণ্ঠা সহকারে বলতেন, “পাঁচ মিনিটের জন্য আমার ঘরে একটু আসবে?’আমি ঠিক সময়ে তার ঘরে পৌঁছে যেতাম।
তাঁর সমস্ত কাজ থেকে প্রেরণা নিয়ে তার অসমাপ্ত কাজ যদি আমরা করতে পারি তবে সেটাই হবেতার প্রতি আমাদের শ্রেষ্ঠ শ্রদ্ধার্ঘ্য। অসমে যখন তিনি ছিলেন তাঁন তার কাছে শুনেছি রাস্তাঘাটের কী শােচনীয় অবস্থা ছিল, যােগাযােগ ব্যবস্থা ছিল না, বাস নেই, ট্রেন নেই, তার মধ্যেও তিনি সেখানে সঙ্ঘকাজের বিস্তার করতে পেরেছিলেন, জেলায় জেলায় স্থানীয় ভাবে কার্যকর্তা তেরি করেছিলেন। ঈশ্বরের কাছে প্রার্থনা—তার আত্মা সাধনােচিত ধামে গমন করুক।
অদ্বৈতচরণ দত্ত
(লেখক অখিল ভারতীয় সহ প্রচারক প্রমুখ)
2020-08-31