মাস্টারদা সূর্য সেন ও চট্টগ্রামের অস্ত্রাগার লুণ্ঠন

ভারতের স্বাধীনতা সংগ্রামের ইতিহাসে বিপ্লবীদের আত্মবলিদানের কথা নতমস্তকে স্মরণ করা উচিত। বঙ্গপ্রদেশের বিপ্লবী সংগঠনগুলির মধ্যে অনুশীলন সমিতি, যুগান্তর, মাস্টারদা সূর্য সেনের ইন্ডিয়ান রিপাব্লিকান আর্মি ইত্যাদি বিপ্লবী সংগঠনের কর্মকাণ্ড ইংরেজের বুকে কাঁপন ধরিয়ে দিয়েছিল।
তখনকার অবিভক্ত বাঙ্গলার চট্টগ্রাম জেলার অন্তর্গত রাউজান থানার নোয়াপাড়া গ্রামে ১৮৯৪ সালের ২২ মার্চ এক নিম্নমধ্যবিত্ত পরিবারে সূর্য সেনের জন্ম হয়। তার বাবার নাম রাজমণি সেন এবং মায়ের নাম শশীবালা দেবী। ছয় ভাই-বোনের মধ্যে সূর্য সেন চতুর্থ।
ছোটো বয়সেই সূর্য সেন বাবাকে হারিয়েছেন। কাকা গৌরমণি সেনের তত্ত্বাবধানে মানুষ হন তিনি। ছোটোবেলা থেকেই খুব দামাল ছিলেন তিনি; পড়াশুনাতেও ছিলেন খুব ভালো। ১৯১২ সালে চট্টগ্রাম ন্যাশনাল ইনস্টিটিউট থেকে প্রথম বিভাগ পেয়ে ম্যাট্রিকুলেশন পাশ করেন। ১৯১৪ সালে চট্টগ্রাম কলেজ থেকে কৃতিত্বের সঙ্গে আই এ পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হন। বহরমপুর কৃষ্ণনাথ কলেজ থেকে ১৯১৮ সালে সসম্মানে বিএ পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হন। তিনি। কৃষ্ণনাথ কলেজে পড়ার সময়েই তিনি যুগান্তর দলের নেতা বিপ্লবী সতীশ চন্দ্র চক্রবর্তীর সংস্পর্শে আসেন এবং গভীরভাবে অনুপ্রাণিত হন।
বিএ পাশ করার পর চট্টগ্রামের উমাতারা উচ্চ বিদ্যালয়ে শিক্ষকতা আরম্ভ করেন তিনি এবং অচিরেই ছাত্রদের প্রিয় পাত্র হয়ে ওঠেন। স্কুলে শিক্ষকতার সময় তিনি তাঁর প্রিয় ছাত্রদের নিয়ে সেবাসমিতি গঠন করে সমাজের দীন দুঃখী অসহায় মানুষের জন্য সেবার কাজ করতে থাকেন। সবাই তাকে ভালোবেসে মাস্টারদা বলে সম্বোধন করতেন।
১৯১৯ সালের ১৩ এপ্রিল জালিয়ানওয়ালাবাগের হত্যাকাণ্ডকে কেন্দ্র করে সারা দেশে প্রতিবাদের ঢেউ উঠে। মাস্টারদা সূর্য সেন তার ছাত্রদের নিয়ে এই জঘন্য হত্যাকাণ্ডের বিরুদ্ধে প্রতিবাদ সভা সংগঠিত করেছিলেন। বিপ্লবী চেতনা তার মধ্যে গভীর থেকে গভীরতর হতে শুরু করে; তিনি ইংরেজের বিরুদ্ধে লড়াই করার জন্য চট্টগ্রামে একটি সংগঠিত বিপ্লবী দল গড়ে তোলার তাগিদ অনুভব করেন। ১৯২০ সালে তার অনুগামীদের নিয়ে সাম্যাশ্রম নামে একটি গুপ্ত সমিতি গঠন করেন। ক্রমে ক্রমে চট্টগ্রামের বিভিন্ন জেলায় এই সমিতির শাখা গড়ে ওঠে। ১৯২১ সালে গান্ধীজীর নেতৃত্বে। সারা দেশ জুড়ে অহিংস অসহযোগ আন্দোলন শুরু হয়। দেশবন্ধু চিত্তরঞ্জন দাশ চট্টগ্রামের বিপ্লবী দলকে এই আন্দোলনে শামিল হতে আহ্বান জানান। মাস্টারদা সূর্য সেন যদিও গান্ধীজীর অহিংস নীতিতে বিশ্বাসী ছিলেন না, তবুও দেশবন্ধুর ডাকে সাড়া দিয়ে এই আন্দোলনে অংশগ্রহণ করেছিলেন। ১৯২২ সালে ৪ ফেব্রুয়ারি উত্তর প্রদেশের চৌরিচৌরায় সত্যাগ্রহীদের সামান্য হিংসাত্বক ঘটনাকে কেন্দ্র করে গান্ধীজী আন্দোলন। প্রত্যাহার করে নেন। প্রচণ্ড হতাশ হয়েছিলেন মাস্টারদা। তিনি উপলব্ধি করেছিলেন গান্ধীজীর অহিংসার পথে ইংরেজের কাছ থেকে স্বাধীনতা পাওয়া যাবে না।
প্রথম প্রথম সুভাষচন্দ্রের অনুপ্রেরণায় কংগ্রেসের বিভিন্ন কার্যক্রমে অংশগ্রহণ করলেও ক্রমে ক্রমে তিনি উপলব্ধি করেন। সশস্ত্র সংগ্রাম ছাড়া ইংরেজদের তাড়ানো সম্ভব নয়। তিনি তাঁর অনুগামী বিপ্লবীদের নিয়ে তৈরি করেন ইন্ডিয়ান রিপাব্লিকান আর্মি এবং চট্টগ্রাম জেলাতে সশস্ত্র অভ্যুথ্যানের সিদ্ধান্ত গ্রহণ করেন। আইরিশ বিপ্লবীদের ধাঁচে চট্টগ্রামের ইংরেজ শাসকের সংস্থাগুলোর উপর ব্যাপক আঘাত হানার পরিকল্পনা করলেন মাস্টারদা এবং তার রিপাব্লিকান আর্মিকে সেইভাবে তৈরি করতে থাকেন।
তার অনুগামী বিপ্লবীদের কাছে তিনি যে কর্মসূচি তুলে ধরলেন তা হলো—চট্টগ্রামের পুলিশ-অস্ত্রাগার ও অক্সিলিয়ারি ফোর্সের অস্ত্রাগার লুঠ করতে হবে। টেলিফোন টেলিগ্রাম এক্সচেঞ্জ ধ্বংস করে ইংরেজ প্রশাসকের যোগাযোগ ব্যবস্থা বানচাল করে দিতে হবে, সরকারি ট্রেজারি লুঠ করে বিপ্লবের জন্য প্রয়োজনীয় অর্থের সংস্থান করতে হবে, চট্টগ্রামের রেল যোগাযোগ বিচ্ছিন্ন করে দিতে হবে, জেলখানা আক্রমণ করে রাজনৈতিক বন্দিদের মুক্ত করতে হবে, ইউরোপিয়ান ক্লাব আক্রমণ করে উচ্চপদস্থ ইংরেজদের মনে আতঙ্কের সঞ্চার করতে হবে ইত্যাদি। এইসব কর্মসূচি বাস্তবায়িত করার জন্য গোপন পরিকল্পনা আরম্ভ করলেন। বিপ্লবী নির্মল সেন, লোকনাথ বল, অনন্ত সিংহ, গণেশ ঘোষ, অম্বিকা চক্রবর্তী, উপেন বিশ্বাস প্রমুখের উপর এক একটি কাজের দায়িত্ব অর্পণ করলেন সর্বাধিনায়ক মাস্টারদা সূর্য সেন। মাস্টারদার নেতৃত্বে তারা পরিকল্পনা মাফিক প্রস্তুতি নিতে থাকলেন।
অবশেষে ঠিক হলো ১৮ এপ্রিল (১৯৩০) রাত পৌনে দশটায় অ্যাকশন শুরু হবে৷ লোকনাথ বল ও নির্মল সেনের নেতৃত্বে বিপ্লবীরা চট্টগ্রামের পাহাড়তলীর অক্সিলিয়ারি ফোর্সের অস্ত্রাগার আক্রমণ করে অস্ত্রশস্ত্র গোলাবারুদ লুঠ করবে তারপর অস্ত্রাগারে আগুন লাগিয়ে দেবে। একই সময়ে অনন্ত সিংহ ও গণেশ ঘোষের নেতৃত্বে বিপ্লবীরা পুলিশের অস্ত্রাগার আক্রমণ করে দখল করে নেবে। অম্বিকা চক্রবর্তী ও আনন্দ গুপ্তের নেতৃত্বে বিপ্লবীরা টেলিগ্রাম ও টেলিফোন এক্সচেঞ্জ ধ্বংস করে দেবে।ঠিক হলো সবকটি দল একই সময়ে অ্যাকশন আরম্ভ করবে, কাজ শেষ করে বিপ্লবীরা পুলিশ আর্মিতে ফিরে আসবে। সেখানে মাস্টারদা যথাসময়ে আর একটি বাহিনী নিয়ে উপস্থিত থাকবেন এবং সেখানে দলের হেড কোয়ার্টার বসবে।
নিখুঁত পরিকল্পনায়, অমিতবিক্ৰমে এবং অসম্ভব বুদ্ধিমত্তার সঙ্গে বিপ্লবীরা তাঁদের কাজ সারলেন। টেলিগ্রাম ও টেলিফোন এক্সচেঞ্জ ধ্বংস করে দেওয়া হয়েছে। অক্সিলিয়ারি ফোর্সের অস্ত্রাগারের একজন সার্জেন্ট গুলিতে মারা পড়লেন বাকিরক্ষীরা প্রাণ ভয়ে পালিয়ে গেল। অস্ত্রাগারের তালা ভেঙ্গে প্রচুর পরিমাণে বন্দুক গুলিগোলা লুঠ করে অস্ত্রাগারে আগুন লাগিয়ে দিয়ে লোকনাথ বল ও নির্মল সেনের সহযোগী বিপ্লবীরা ফিরে এলেন পুলিশ আর্মারিতে। পুলিশ আর্মারি ইতিমধ্যে দখল হয়ে গেছে। মাস্টারদা যথাসময়ে সেখানে উপস্থিত হয়ে হেড কোয়ার্টার বসালেন। সেখানকার ব্রিটিশের পতাকা, ইউনিয়ন জ্যাক নামিয়ে ভারতের জাতীয় পতাকা তুলে দেওয়া হয় পুলিশ আর্মারির (অস্ত্রাগারের) মাথায়। তারপর পুলিশ অস্ত্রাগারের অস্ত্রশস্ত্র লুঠ করে অস্ত্রাগারে আগুন ধরিয়ে দেওয়া হলো। সবাই মিলে বন্দে মাতরম্ ধ্বনিতে আকাশবাতাস কাপিয়ে দিলেন। সবই নিখুঁতভাবে হচ্ছিল। কিন্তু অস্ত্রাগারে আগুন লাগাতে গিয়ে বিপ্লবী হিমাংশু সেনের গায়ে আগুন লেগে যায়। গুরুতর ভাবে আহত হিমাংশু সেনকে গাড়িতে তুলে অন্যত্র সরিয়ে নিয়ে যান অনন্ত সিংহ, গণেশ ঘোষ। সাহায্য করার জন্য সঙ্গে যান বিপ্লবী জীবন ঘোষাল ও আনন্দ গুপ্ত। ইতিমধ্যে ইংরেজের পুলিশ খবর পেয়ে গেছে। দূরে একটি ওয়াটার ওয়ার্কস আছে; সেদিক থেকে লুইসগানের গুলির আওয়াজ আসছে। মাস্টারদা উপলব্ধি করলেন গণেশ ঘোষ, অনন্ত সিংহ, জীবন ঘোষাল, আনন্দ গুপ্তের জন্য আর বেশি অপেক্ষা করলে বিপদ বেড়ে যাবে; তাই তিনি বিপ্লবীদের নিয়ে সুলুকবহর পাহাড়ের দিকে পালালেন। সেখানে তিন দিন অতিবাহিত করেন তারা। কিন্তু সেখানে খাদ্য নেই, পানীয় জল নেই, সংবাদ আদান-প্রদানের কোনো উপায় নেই। তাই ক্ষুধার্ত অবসন্ন বিপ্লবীরা ২২ এপ্রিল জালালাবাদ পাহাড়ে গিয়ে আশ্রয় নিলেন।
বনে কাঠ কাটতে আসা কাঠুরিয়াদের কাছ থেকে ইংরেজের পুলিশ বিপ্লবীদের খবর পেয়ে যায়। জেলা ম্যাজিস্ট্রেট মিঃ উইলকিন্স, পুলিশ সুপার মেজর বেকার, অক্সিলিয়ারি ফোর্সের কর্তা ক্যাপ্টেন টেইট, সুরমাভ্যালি বাহিনীর ক্যাপ্টেন রবিন্সসন বিশাল বাহিনী নিয়ে জালালাবাদ পাহাড় ঘিরে ফেলেন। সারাদিন ধরে তীব্র গুলির লড়াই চলে বিপ্লবীদের সঙ্গে। অবশেষে সন্ধ্যা ঘনিয়ে আসে। যুদ্ধ সেদিনকার মতো বন্ধ। ৮০ জন ব্রিটিশ সৈনিক মারা যায় সেই যুদ্ধে। ১২ জন বিপ্লবী শহিদ হলেন। তারা হলেন—বিপ্লবী নরেশ রায়, ত্রিপুরা সেন, বিধু ভট্টাচার্য, হরিগোপাল বল, মতি কানুনগো, প্রভাস বল, শশাঙ্ক দত্ত, নির্মল লালা, জিতেন দাশগুপ্ত, মধুসূদন দত্ত, পুলিন ঘোষ ও অর্ধেন্দু দস্তিদার। তাদের প্রতি শেষ শ্রদ্ধা জানিয়ে ভারাক্রান্ত মন নিয়ে ব্যথিত চিত্তে অবশিষ্ট বিপ্লবীদের নিয়ে রাতের অন্ধকারে পাহাড় ত্যাগ করার সিদ্ধান্ত নিলেন মাস্টারদা। তারা কয়েকটি দলে বিভক্ত হয়ে পাহাড়ের যেদিকে পুলিশ নেই অনুমান করে সেইদিক দিয়ে পাহাড় ছেড়ে বিভিন্ন দিকে পালালেন।
রিপাব্লিকান আর্মির বিপ্লবীরা চট্টগ্রাম জুড়ে নানারকম দুঃসাহসিক কর্মকাণ্ড আরম্ভ করে দিল। মাস্টারদা তাঁর অনুগামীদের নিয়ে পলাতক জীবনযাপন করছেন। গোপন আস্তানা থেকে নির্দেশ দিচ্ছেন। নির্ভরযোগ্য সূত্রে মাস্টারদা খবর পেলেন বাংলার ইনস্পেক্টর জেনারেল মি. ক্রেক চট্টগ্রাম কুমিল্লা হয়ে চাঁদপুর স্টেশন থেকে কলকাতা যাবেন। রামকৃষ্ণ বিশ্বাস ও কালীপদ চক্রবর্তীর উপর দায়িত্ব দিলেন মি ক্রেককে হত্যা করার। ১৯৩০-এর ১ ডিসেম্বর শেষ রাতে যখন মেল ট্রেন চঁাদপুর স্টেশনে ঢোকে তখন খবর অনুযায়ী প্রথম শ্রেণীর কামরায় মি কেকে গুলি করে ওরা। কিন্তু অস্পষ্ট আলোয় ভুল করেছিলেন বিপ্লবীরা। মারা যান তারিণী মুখার্জি নামে একজন রেলের উচ্চপদস্থ অফিসার। ধরা পরে যান তারা। বিচারে রামকৃষ্ণ বিশ্বাসের ফাসি হয় আর কালিপদ চক্রবর্তীর দ্বীপান্তর হয়। মাস্টারদার নির্দেশে হরিপদ ভট্টাচার্য নামক একজন চোদ্দ পনেরো বছরের বালক নিজাম পল্টনের মাঠে বার্ষিক ফুটবল প্রতিযোগিতার পুরস্কার বিতরণের সময় অত্যাচারী ডি এস পি আসানুল্লা খাঁকে গুলি করে মারে। মাস্টারদার বাহিনীর বিপ্লবীদের গুলিতে মারা যান কুমিল্লার সহকারী পুলিশ সুপার অত্যাচারী শাসক মিঃ এলিসন, ঢাকার জেলা ম্যাজিস্ট্রেট মিঃ ডুরনে। চট্টগ্রামের অবস্থা তখন হয়ে উঠেছিল ভয়াবহ। ব্রিটিশ প্রশাসক সান্ধ্য আইন জারি করেছে। ব্রিটিশ পুলিশ বাড়ি বাড়ি ঘুরে সন্দেহমূলক ছাত্র-যুবকদের তল্লাশির নামে অত্যাচার করছে। বিপ্লবীদের বাড়ি ভাঙচুর করে আত্মীয়স্বজনদের গ্রেপ্তার করছে। যে সকল বিপ্লবী গ্রেপ্তার হয়েছিল তাদের অভিযুক্ত করে ব্রিটিশ সরকার শুরু করে ‘চট্টগ্রাম অস্ত্রাগার লুণ্ঠন মামলা। ডিনামাইট ও ল্যান্ডমাইনের সাহায্যে জেলের প্রাচীর উড়িয়ে দিয়ে বন্দি বিপ্লবীদের মুক্তি করার একটি পরিকল্পনা করা হয়েছিল কিন্তু পরিকল্পনাটি প্রকাশ হয়ে পরায় তা ভেস্তে যায়। এককথায় চট্টগ্রামের ব্রিটিশ প্রশাসকের বুকে কাঁপন ধরিয়ে দিয়েছিলেন মাস্টারদা সূর্য। সেন। পুলিশ ও গয়েন্দারা অবিরাম তল্লাশি চালিয়েও কিছুতেই ধরতে পারছিল না তাঁকে। ব্রিটিশ পুলিশের দৃষ্টি এড়িয়ে তিনি তাঁর অনুগামীদের নিয়ে ব্রিটিশের বিরুদ্ধে সংগ্রাম চালিয়ে যেতে লাগলেন। ব্রিটিশ পুলিশ তার মাথার দাম ঘোষণা করলো দশ হাজার টাকা। এটা তখনকার দিনে প্রচুর টাকা।
মাস্টারদা তখন চট্টগ্রামের দেশপ্রেমিক যুবক-যুবতীদের প্রেরণা। প্রীতিলতা ওয়াদ্দেদার, কল্পনা দত্ত, বীণা দাস প্রমুখ বীরাঙ্গনা যুবতীরা দলে নাম লিখিয়েছেন। দিনটা ছিল ১৯৩২ সালের ১৩ জুন। মাস্টারদা চট্টগ্রামের ধলঘাটের সাবিত্রী দেবীর আশ্রমে আত্মগোপন করে আছেন। সঙ্গে আছেন একান্ত বিশ্বস্ত নির্মল সেন, অপূর্ব সেন প্রমুখ। গোপনে দেখা করতে এসেছেন চট্টগ্রামের অগ্নিকন্যা প্রীতিলতা ওয়াদ্দেদার, সঙ্গে কল্পনা দত্ত। প্রয়োজনীয় কথাবার্তা সেরে রাতের অন্ধকারেই ফিরে যাবেন তারা। পুলিশ টের পেয়ে গেছিল এই গোপন আস্তানার কথা। ক্যাপ্টেন ক্যামেরনের নেতৃত্বে ব্রিটিশের পুলিশ ঘিরে ফেলে ওই আস্তানা। প্রচণ্ড গুলির লড়াই চলে।শহিদ হলেন অপূর্ব সেন। প্রচণ্ড আহত হন নির্মল সেন। আহত অবস্থায় তীব্র গুলির লড়াই করে মাস্টারদা, প্রীতিলতা ও কল্পনাকে পালাতে সাহায্য করেন। অবশেষে তিনি প্রাণ ত্যাগ করেন।
এই ঘটনার প্রতিশোধ নেওয়ার জন্য আরও কঠোর হয়ে ওঠেন প্রীতিলতা। ইংরেজের বিরুদ্ধে কোন একটা অ্যাকশন করার জন্য অস্থির হয়ে উঠলেন। মাস্টারদা দৃঢ় প্রতিজ্ঞ প্রীতিলতাকে পাহাড়তলির ইউরোপিয়ান ক্লাব আক্রমণের দায়িত্ব দিলেন। দিনটা ছিল ১৯৩২ সালের ২৪ সেপ্টেম্বর। রাত ১০টা। অগ্নিকন্যা প্রীতিলতা মিলিটারি পোশাকে সজ্জিত হলেন। সঙ্গে গেলেন মহেন্দ্র চৌধুরী ও সুশীল দে ঘোড়ার গাড়ির কোচম্যানের বেশে। সবারই পোশাকের অন্তরালে রয়েছে আগ্নেয়াস্ত্র। পানে-নাচে-গানে মত্ত সাহেব মেমরা। প্রীতিলতা ক্লাবের পিছন দিয়ে সবার নজর এড়িয়ে ঢুকে পরলেন। প্রহরীরা ভাবল ক্লাবের সদস্য কোনো সাহেব অফিসার। মহেন্দ্র চৌধুরী ও সুশীল দে অন্য কোচম্যানদের সঙ্গে মিশে গেল এবং সকলের নজর এড়িয়ে যথাস্থানে টাইম বোমা সেট করে দিল। প্রীতিলতার ইশারায় তারা বোমা ছুড়ল ক্লাবের মধ্যে। প্রীতিলতা গুলি চালাতে আরম্ভ করলেন। প্রীতির সঙ্গে আসা অন্য বিপ্লবীরা ক্লাবের দুদিক ঘিরে গুলি চালাতে আরম্ভ করল। চারিদিকে হুড়োহুড়ি দৌড়োদৌড়ি আরম্ভ হয়ে গেল। প্রচুর সাহেব মেম হতাহত হলো।
ইতিমধ্যে খবর পেয়ে ইংরেজের পুলিশ বাহিনী ছুটে এল। প্রীতিলতা তার সহযোগী বিপ্লবীদের পালাবার নির্দেশ দিলেন। কিন্তু নিজে পটাশিয়াম সায়ানাইড খেয়ে আত্মহত্যা করলেন। তখনকার দিনে একজন শিক্ষিতা তরুণীর এইরকম দুঃসাহসিক বিপ্লবী কর্মকাণ্ড সারা দেশের মানুষকে স্তম্ভিত করে গিয়েছিল। যুবক-যুবতীদের মধ্যে আত্মবলিদানের স্পৃহা বেড়ে গেছিলো। তাকে দেখে এগিয়ে এসেছিলেন আরও অনেক দুঃসাহসিক বাঙ্গালি তরুণী যেমন—কুন্দপ্রভা, নির্মলা। চক্রবর্তী, সুহাসিনী রক্ষিত, নিরুপমা বড়ুয়া, বকুল দত্ত প্রমুখ। ইংরেজ শাসকের কপালে চিন্তার ভাজ পড়তে লাগল।
মাস্টারদার দলের বিপ্লবীদের দ্বারা ক্ষত বিক্ষত চট্টগ্রামের ইংরেজ প্রশাসক মাস্টারদাকে ধরার জন্য পাগলের মতো। খুঁজতে লাগলো। ইউরোপিয়ান ক্লাব আক্রমণ করার পর তিনি গৈরালা গ্রামে আত্মগোপন করেছিলেন। তাঁকে ধরিয়ে দেওয়ার জন্য ১০ হাজার টাকা পুরস্কার ঘোষণা করা হয়েছিল। তখনকার দিনে ১০ হাজার টাকার মূল্য প্রচুর। নেত্র সেন নামক এক ব্যক্তি পুরস্কারের লোভে তার বাড়িতে আশ্রয় দেবার ছল করে ইংরেজ পুলিশকে গোপনে খবর দিয়ে দেয়। এবার আর পালাতে পারলেন না মাস্টারদা। ধরা পড়ে গেলেন তিনি। দিনটা ছিল ১৯৩৩ সালের ১৬ ফেব্রুয়ারি। ইংরেজ প্রশাসক তাকে কনডেন্ড সেলের নির্জন প্রকোষ্ঠে। রেখে নির্মম ভাবে অত্যাচার করে। তার হাত পা ভেঙে দেওয়া হয়েছিল, নখ উপড়ে ফেলা হয়েছিল। হাতুড়ি দিয়ে মেরে তার দাঁত ভেঙে ফেলা হয়েছিল। তারপর মৃতপ্রায় শরীরটাকে ফাসিতে লটকে দেওয়া হয়েছিল ১৯৩৪ সালের ১২ জানুয়ারি মধ্যরাতে। একই সময়ে মাস্টারদার বিশ্বস্ত আর একজন সহকর্মী তারকেশ্বর দস্তিদারকেও ফাঁসি দেয় ইংরেজরা। মাস্টারদাকে ইংরেজরা এতটাই ভয় পেত যে তার মৃতদেহটিকেও ভয় পেয়েছিল তারা। চট্টগ্রামের মাটিতে শেষকৃত্য করতে দেওয়া হয়নি। ইংরেজ শাসক বঙ্গোপসাগরে ভাসিয়ে দিয়েছিল তার মৃতদেহটিকে।
ইংরেজের বিরুদ্ধে সশস্ত্র বিপ্লবের ইতিহাসে মাস্টারদা সূর্য সেনের নাম সোনার অক্ষরে লেখা থাকবে। তিনি বলেছিলেন—“বন্ধুগণ, এগিয়ে চল। কখনো। পিছিয়ে যেও না। …ওঠো, জাগো। জয় আমাদের সুনিশ্চিত।
প্রণব দত্ত মজুমদার

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

This site uses Akismet to reduce spam. Learn how your comment data is processed.