গত ১৫ ডিসেম্বর সিপিএম নেতা ও প্রাক্তন মন্ত্রী ডা: সূর্যকান্ত মিশ্র এক সাংবাদিকের প্রশ্নের উত্তরে বলেছেন, এনপিআর, যেটা এনআরসি-র আগে করতে হয় সেটা নাকি মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় এই রাজ্যে শুরু করার জন্য নির্দেশিকা জারি করেছেন এবং বিজেপির সঙ্গে তাল মিলিয়ে করছেন। ঠিক তার একদিন পরেই সেই নির্দেশিকা হঠাৎ করেই ১৬ তারিখ তুলে নেওয়া হয়। এটা ভেবে অবাক হইনি যে পশ্চিমবঙ্গ সরকার এটা তুলে নিয়েছে, অবাক হলাম। এটা ভেবে যে মুখ্যমন্ত্রী এখন ওই ডাক্তারবাবুর কথা মতাে কাজ করছেন…!
২০১১ সালে জানুয়ারিতে ভারতের সর্বশেষ জনগণনার রিপাের্ট প্রকাশিত হয়। জনগণনার রিপাের্ট বলেছি কিন্তু রিপাের্ট তৈরি বলিনি। কারণ দুটো আলাদা আলাদা পর্যায়ের রিপাের্ট তৈরি করতে প্রায় এক বছর সময় লাগে। তালিকায় নাম তুলতে হয়তাে ১৫/২০ দিন লাগে কিন্তু তার বিভিন্ন স্তরের প্রস্তুতি করতে লাগে প্রায় পাঁচ থেকে ছয় মাস আর নাম সংগ্রহের পরে সেটা মিলিয়ে পাঠাতে লাগে আরও প্রায় তিন চার মাস। আর এতে খরচ হয় কয়েক হাজার কোটি টাকা। আর সেই টাকা দেয় অর্থ মন্ত্রক। তাই রেজিস্ট্রার জেনারেল অব সেন্সাসকে বার্ষিক বাজেট পেশের আগেই আনুমানিক খরচের হিসেব জমা দিতে হয়, আর জাতীয় বাজেট ফেব্রুয়ারি মাসের মধ্যেই শেষ করতে হয়।
২০১১ সালের জনগণনার একটা ঘটনা বলছি। ২০১০ সালের শুরুর দিকে, আমি তখন। ছিটমহল বিনিময় আন্দোলনের সর্বক্ষণের কার্যকর্তা। কোচবিহারের জেলাশাসক তখন স্মারকী মহাপাত্র। ফেব্রুয়ারি মাসে একটা ডেপুটেশনের দিতে জেলা শাসকের দপ্তরে কয়েক হাজার ছিটমহলের বাসিন্দার সঙ্গে গেছি। ডেপুটেশনের পরে ভীষণ অপ্রাসঙ্গিক ভাবে জেলা শাসক জিজ্ঞেস করলেন দু’পাশের (ভারত ও বাংলাদেশ) সব ছিটমহল মিলে মােট লােকসংখ্যা কত হতে পারে? আমি বললাম আমার কাছে সঠিক হিসেব নেই তবে পঞ্চাশ হাজারের কম হবে না। তিনি বললেন আমাকে এর একটা সঠিক হিসেব দিতে পারবেন? আমি কিছু না বুঝেই বললাম। হ্যা পারবাে।
ফিরে এসে ভাবছিলাম যে কার কাছে সাহায্য নেবাে, ঠিক তখনই ইংল্যান্ডের ডারহাম বিশ্ববিদ্যালয়ের একজন গবেষক ছিটমহলের বিষয়ে গবেষণা করার জন্যে একজন সাংবাদিকের মাধ্যমে আমার সঙ্গে যােগাযােগ করেন। ঈশ্বর যেন নিজেই নিয়ে এসেছেন। তার সঙ্গে আমার প্রায় চার পাঁচ ঘণ্টার আলােচনা শেষে আমরা একটা প্রােফর্মা তৈরি করে সেই মতােই পরদিন থেকে কাজ শুরু করি। নিজের শখের একটা মহেন্দ্র পিজোট জিপ আর আমার স্ত্রীর প্রভিডেন্ট ফান্ড থেকে তিন লক্ষ টাকা ধার নিয়ে চার মাসের কঠিন পরিশ্রমের পরে একটা হিসেব আসে ৪৯৫৪৮ জন মানুষের। ২০১০ সালের ২৭ জুন প্রবল বৃষ্টিতে ভিজে আবার কয়েক হাজার মানুষকে সঙ্গে নিয়ে সেই হিসেব জেলা শাসকের হাতে তুলে দিয়ে আসি। যা পরবর্তীতে ২০১১ সালে ১৪ থেকে ১৭ জুলাই সরকারি জনগণনাতে গিয়ে দাঁড়ায় ৪৯৫৮৩ জন। এর কিছুদিন পরেই একটা ছােট্ট খবর পাই যে পশ্চিমবঙ্গের কয়েকজন জেলা শাসককে সেন্সাস জেনারেল দিল্লিতে ডেকেছেন তার মধ্যে কোচবিহারের জেলাশাসকও আছেন। পরে অসমর্থিত সূত্রে জানতে পারি ওই হিসেবটা উপরে পাঠানাের ফলেই তাকে ডাকা হয়েছিল, কারণ এটাও একটা সাংবিধানিক সংকট ছিল।
এবার প্রসঙ্গে ফিরে আসি, ভারতের এই জনগণনার রিপাের্ট কখনােই কোনাে অঙ্গ রাজ্য বাদ দিয়ে হতে পারে না। তাই পশ্চিবঙ্গ সরকার যদি এই প্রক্রিয়া অবিলম্বে শুরু না করে তবে সাংবিধানিক সংকট নিরসনের জন্যই রাষ্ট্রপতিকে সরাসরি হস্তক্ষেপ করতে হবে, আর ঠিক তখনই ডাক্তারবাবুর দল, মাননীয়ার দল-সহ সব শেয়াল এক সঙ্গে চিৎকার করে বলবে “ওই দেখুন বিজেপি তার ফ্যাসিস্ট রূপ নিয়েছে” আর ডাক্তারবাবুরা বলবেন, “এই কারণেই আমরা তৃণমূলের বিরদ্ধে হলেও বিজেপিকে আটকাতেই সমস্ত ধর্মনিরপেক্ষ শক্তি একসঙ্গে লড়াই করবাে।” এটা একটা অনেক বড়াে ষড়যন্ত্রের সবে শুরু করলেন ডাক্তারবাবু ও মাননীয়া। আসলে আগামী নির্বাচনে কংগ্রেস ও কমিউনিস্টরা একসঙ্গে হয়েও কিছুই করতে পারবে না, বরং অবৈধ অনুপ্রবেশকারী ভােটাদের যেন ভাগ না হয় তার প্রক্রিয়া শুরু করলেন আর তাদের (কংগ্রেস ও বামপন্থী) সম্মিলিত যে ৮/১০ শতাংশ ভােট আছে তা যদি তৃণমূলকে দিয়ে কোনাে মতে কয়েকটি পৌরসভা আর বিধানসভার আসন পাওয়া যায়। তবে অস্তিত্ব টিকে যাবে। নীতি, আদর্শ কিংবা পশ্চিমবঙ্গের কথা ভাবার তাদের দরকার নেই। এই জনগণনার কাজটা আটকে দিয়ে সাংবিধানিক সংকট সৃষ্টি করতে পারলেই তারা প্রচার শুরু করবে, যেভাবে জোর করে নাগরিকত্ব আইন সংশােধন করেছে ঠিক সেভাবেই পশ্চিমবঙ্গের বিভিন্ন জনজাতির সংরক্ষণ তুলে দিয়ে ব্রাহ্মণ্যবাদ চালু করছে। বিজেপি। এসব মিথ্যে প্রচার করতে তারা যথেষ্ট পটু এবং এভাবেই হিন্দু বাঙ্গালিকে আবার তাৎক্ষণিক ভাবে দেশভাগের ইতিহাস। ভুলিয়ে দিয়ে পশ্চিমবঙ্গকে পশ্চিম বাংলাদেশ বানানাের প্রক্রিয়াকে সম্পন্ন করতে চাইছে। আর আমরা হিন্দু বাঙ্গালিরা মহম্মদ সেলিমের ধুতি আর মাননীয়ার শাড়ি দেখে এই আনন্দেই আত্মহারা থাকবাে যে এই বেশ ভালাে আছি। আমরা একবারের জন্যেও ভাববাে না যে শ্যামাপ্রসাদের জন্যই আজকেও আমরা বেঁচে আছি বা জেহাদি হইনি। এটাই আমাদের ইতিহাস। তাই এখন হিন্দু বাঙ্গালিকে শুধুমাত্র বিজেপির ভােট চাওয়ার জন্য পথে নামলে। হবে না, ভারতের সংবিধান ও সাংবিধানিক সংস্থার অধিকার রক্ষার জন্যেও পথে নামতে হবে। সনাতন ভারতে কেউ উচ্ছিষ্ট ছিল না, সর্বধর্ম সমন্বয় কিংবা অতিথি সেবা আমাদের কাছে ঈশ্বরের তপস্যাকিন্তু অস্মিতা রক্ষা করার খাদের কিনারায় দাঁড়িয়ে থাকা বুদ্ধিমান হিন্দু বাঙ্গালি যদি এই মুহূর্ত থেকে নিজের জ্ঞান, বিচার বুদ্ধি ও অধিকার প্রয়ােগ না করে তবে টোটোপাড়ার বিলুপ্তপ্রায় টোটো জনজাতির মতাে সংরক্ষিত জীবনযাপন করতে হবে অথবা বিলুপ্ত হয়ে যেতে হবে।
দীপ্তিমান সেনগুপ্ত
(লেখক ছিটমহল বিনিময় সমন্বয় কমিটির আহ্বায়ক)
2019-12-27