লকডাউনে ঘরবন্দি জেনারেশন জেডের নতুন আবিষ্কার

টিভিতে রামায়ণ প্রথম সম্প্রচারিত হয়েছিল ১৯৮৭ সালে। দিল্লিবাসী আস্থা ঢলের তখন জন্ম হয়নি। এখন তার ষোলো বছর বয়েস। সারা দেশে লকডাউন ঘোষিত হবার দিন অর্থাৎ ২৩ মার্চ, আস্থা বেশ মুশকিলেই পড়ে গিয়েছিল। কিছুদিন আগেই শেষ হয়েছে সিবিএস ই-র টেন্থ স্ট্যান্ডার্ডের পরীক্ষা। হাতে তখন অফুরন্ত অবসর। আস্থা আগে থাকতেই ছুটির প্ল্যানিং করে রেখেছিল। কিন্তু সব শেষ করে দিল লকডাউনের ঘোষণা। বাইরে বেরোনোর উপায় নেই। বন্ধুদের সঙ্গে আড্ডা দেওয়া বন্ধ। এইরকম একটা বিচ্ছিরি পরিস্থিতিতে আরেকটি ঘোষণা করা হলো কেন্দ্রীয় সরকারের তরফ থেকে। লকডাউনে ঘরবন্দি মানুষের মনোরঞ্জনের জন্য রামায়ণ ও মহাভারত আবার টিভিতে সম্প্রচার করা হবে। প্রথম দিন বাবা-মা’র সাধাসাধিতেই টিভির সামনে বসেছিল আস্থা। পরের দিন থেকে আর ওকে সাধতে হয়নি। ইদানীং ও সারা সপ্তাহ অপেক্ষা করে রামায়ণ। দেখবে বলে। ওর নিজের কথায়, “সিরিয়াল দুটো খুব ন্যাচারাল। অযথা নাটক তৈরি করার চেষ্টা নেই। বেশি বিজ্ঞাপন নেই। সব থেকে বড়ো কথা, গল্পটা খুব ভালো। একটা এপিসোড দেখলে মনে হয় পরেরটাও দেখি।” তিন দশক বেশ লম্বা সময়। এতদিন পর পুরনো কোনও জনপ্রিয় সিরিয়াল নতুন করে দেখানো হলে সাধারণত বিশেষ কল্কে পায় না। প্রজন্মভেদে মানুষের রচি ও পছন্দ-অপছন্দ বদলে যায়। কিন্তু রামায়ণ ও মহাভারত সাধারণের পর্যায়ভুক্ত নয়। এই দুটি কাহিনির আবেদন যে চিরকালীন তার প্রমাণ আরও একবার পাওয়া গেল আস্থার স্বীকারোক্তিতে। এখানে অবশ্যই আরও একজনের কথা বলতে হবে। তিনি দীপিকা। সিংহ। পাটনার একটি কলেজে পড়ান। বয়েস সাতাশ বছর। দীপিকাও আস্থার মতো নিয়মিত রামায়ণ মহাভারত দেখেন। হ্যা তিনি তার বয়স, সময় এবং প্রজন্মের দৃষ্টিভঙ্গি অনুসরণ করে প্রশ্ন তুলেছেন। নির্বিবাদে রামায়ণের সব ঘটনা মেনে নিতে পারেননি। তার প্রশ্ন, সীতাকে কেন অগ্নিপরীক্ষা দিতে হলো? কেনই বা তিনি নির্বাসিত হলেন? প্রশ্ন তিনি করতেই পারেন। ধরে নেওয়া যেতে পারে, সীতার সঙ্গে কোথাও না কোথাও একাত্মতা অনুভব করছেন বলেই রামায়ণ তথা ভারতবর্ষের মহানায়িকার দুঃখ তাকে পীড়া দিচ্ছে। এবং তিনি প্রশ্ন তুলছেন।

রামায়ণ মহাভারতের ঘটনা এবং চরিত্রগুলির সঙ্গে সাধারণ মানুষের এই একাত্মতাবোধ কোনও নতুন কথা নয়। হাজার হাজার বছর ধরে ভারতবর্ষের মানুষ রাম-সীতা-লক্ষ্মণ, কৃষ্ণ-অর্জুন-দ্রৌপদীকে তাদের আপনজন হিসেবে গ্রহণ করেছে। রামায়ণ মহাভারত তাদের কাছে নিছক মহাকাব্য নয়, ইতিহাস। ভারতবর্ষের ইতিহাস। এই দেশ যতই ‘ডিজিটাল ইন্ডিয়া’ নামের প্রসাধনে ঢাকা পড়ুক, এখানকার কোটি কোটি মানুষ আজও বিশ্বাস করে তাদের একজন। মর্যাদাপুরুষোত্তম সম্রাট ছিলেন, যাঁর নাম শ্রীরাম। যিনি সারা ভারতবর্ষকে প্রথম এক এবং অভিন্ন জাতীয়তাবোধে দীক্ষিত করেছিলেন। যিনি মেলাতে পেরেছিলেন এ দেশের ভিন্ন ভিন্ন জনগোষ্ঠীর মানুষকে। এবং সারা ভারতবর্ষ ‘শ্রীরাম’ নামক ছাতার নীচে দাঁড়িয়ে রাবণের সঙ্গে যুদ্ধ করেছিল। এখানকার মানুষ বিশ্বাস করে তাদের একজন মা ছিলেন, যাঁর নাম সীতা। যিনি সারা জীবন অশেষ দুঃখ-যন্ত্রণা সহ্য করেও মুহূর্তের জন্য মাতৃধর্ম, নারীধর্ম এবং স্ত্রীধর্ম থেকে বিচ্যুত হননি। দীপিকা রামের সমালোচনা করেছেন কিন্তু যার কথা মাথায় রেখে করেছেন, সেই সীতা কোনওদিন রামের সমালোচনা করেননি। কারণ তিনি জানতেন রামে রাজধর্ম পালন করেছেন। একজন সম্রাটের কাছে তার ব্যক্তিধর্মের চেয়ে রাজধর্ম সর্বাংশে শ্রেষ্ঠ। অন্তত তাই হওয়া উচিত। সীতা এটাও জানতেন যে, রাজধর্ম পালনার্থে রাম তাকে নির্বাসিত করেছেন ঠিকই কিন্তু তার জন্য নিজেও দিবারাত্রি মনোকষ্টে ভুগেছেন। পতিব্রতা স্ত্রীকে পরিত্যাগ করে শান্তি পাননি মুহূর্তের জন্য। রাজচক্রবর্তী সম্রাট হিসেবে রাম চাইলে দ্বিতীয় পত্নী গ্রহণ করতে পারতেন, করেননি। সারা জীবন একনিষ্ঠ থেকেছেন সীতার প্রতি। সীতাও রাম ব্যতীত অন্য কোনও পুরুষের কথা ভাবেননি। ভারতবর্ষে স্বামী-স্ত্রীর সম্পর্ক কেমন হয় বা কেমন হওয়া উচিত তার পূর্ণাঙ্গ প্রমাণ মেলে রামায়ণে।

ফেমিনিজমের আতসকাচের নীচে সীতা-দ্রৌপদীদের খাটো মনে হতে পারে কিন্তু মানবিক এবং পারিবারিক দৃষ্টিকোণ থেকে বিচার করলে দেখা যাবে তাঁরা তা নন। নর-নারীর সম্পর্ক তখনই পূর্ণতায় পৌছয় যখন অধিকার এবং কর্তব্যের মধ্যে সামঞ্জস্য থাকে। ওটি না থাকলে সম্পর্ক টেকে না। আজকের ইউরোপ-আমেরিকায় বিবাহবিচ্ছেদের পরিসংখ্যানের দিকে নজর দিলে তার যথেষ্ট প্রমাণ পাওয়া যাবে।

তবুও আস্থা ঢল এবং দীপিকা সিংহ ধন্যবাদাহ। ওরা এবং ওদের মতো অসংখ্য ছেলে-মেয়ে রামায়ণ-মহাভারত দেখছেন এবং দেখে চরিত্রগুলির সঙ্গে একাত্মতা অনুভব করছেন—এটা করোনা মহামারীর আবহে মস্ত বড়ো খবর। এর থেকে একটা জিনিস স্পষ্ট, ভারতের জেনারেশন জেড তাদের শেকড় হারায়নি। বস্তুত, সম্প্রচার শুরু হওয়ার পর প্রথম সপ্তাহেই রামায়ণের দর্শকসংখ্যা যে ১৭ কোটিতে পৌছতে পেরেছে এবং চতুর্থ সপ্তাহের শেষে সংখ্যাটি দাড়িয়েছে ৫১ কোটিতে তার একটি প্রধান কারণ জেনারেশন জোডের টিভির সামনে বসে পড়া। মনে রাখতে হবে, এই সময় বিভিন্ন বেসরকারি চ্যানেলেও তাদের পুরনো জনপ্রিয় সিরিয়ালগুলি সম্প্রচার করছে। এইসব সিরিয়ালের মধ্যে সিআইডি এবং বিগ বসের মতো সিরিয়ালও রয়েছে। কিন্তু সবাইকে ছাপিয়ে গেছে রামায়ণ ও মহাভারত। Ramanand Sagar Productions এখনও পর্যন্ত সারা পৃথিবীতে সর্বাধিক টিআরপির সিরিয়াল বলে স্বীকৃত গেম অব । থ্রোনসের রেকর্ড ভেঙে দিয়েছে রামায়ণ। এমনকী, ভেঙে গেছে আইপিএল ফাইনালের রেকর্ডও। তিন দশক পর টিভির পর্দায় ফিরে এসে রামায়ণ-মহাভারতের এই চমকপ্রদ সাফল্য সব দিক থেকে আশাব্যঞ্জক। বিশেষ করে মেট্রো কালচারে অভ্যস্ত দিল্লি -মুম্মাই কলকাতার অল্পবয়সি ছেলে-মেয়েরা যেভাবে তাদের বাবা-মা’র সঙ্গে বসে বসে টিভিতে রামায়ণ ও মহাভারত দেখছে, তা অন্যরকম ভবিষ্যতের ইঙ্গিত দেয়। এই প্রসঙ্গে ভারতের রাজনৈতিক মহলের কথা না বললে চলে না। এ দেশে রামকে নিয়ে, রামায়ণ-মহাভারত নিয়ে রাজনীতি সেই ব্রিটিশ আমল থেকেই হয়ে আসছে। ব্রিটিশরা বরাবর রাম এবং কৃষ্ণকে মহাকাব্যের ‘হিরো’ হিসেবে প্রতিপন্ন করেছে। তাদের কাছে রাম এবং কৃষ্ণ কাল্পনিক চরিত্র। এদের কোনও ঐতিহাসিক ভিত্তি নেই। স্বাধীনতা প্রাপ্তির পর তথাকথিত ভারতীয় ঐতিহাসিকরাও এই মত বজায় রেখেছেন। কেউ কেউ আরও এককাঠি এগিয়ে রাম এবং কৃষ্ণকে ‘হিন্দুদের দেবতা বানিয়ে ভারতের ইতিহাসকে ঘুলিয়ে দেবার চেষ্টা করেছেন। স্বয়ং রবীন্দ্রনাথ রামায়ণ ও মহাভারতকে ‘ভারতবর্ষের ইতিহাস’ হিসেবে উল্লেখ করলেও এরা সে কথায় কর্ণপাত করেননি। ভারতের ইতিহাস বিকৃত করার এই ষড়যন্ত্রের পিছনে ছিল কমিউনিস্টরা। তাদের মদত জুগিয়েছিল কংগ্রেস। উদ্দেশ্য ভারতের সুপ্রাচীন ঐতিহ্য ধ্বংস করে এ দেশের সাংস্কৃতিক ভিতটি দুর্বল করা। দুর্ভাগ্যজনক হলেও এটা সত্যি, কংগ্রেস এবং এ দেশের কমিউনিস্ট দলগুলি এখনও এই নেতিবাচক প্রবণতা থেকে মুক্ত হতে পারেনি। তার প্রমাণ রামায়ণ ও মহাভারতের পুনঃসম্প্রচারের সিদ্ধান্তের বিরুদ্ধে কংগ্রেস নেতা রাহুল গান্ধীর প্রতিবাদ। তার মতে রাজনৈতিক ফয়দা লোটার জন্য মোদী সরকার এই সিদ্ধান্ত নিয়েছে। না, রাহুল গান্ধীর এহেন আচরণে বিস্ময়ের বিন্দুমাত্র অবকাশ নেই। রামায়ণ এবং রামের কথায় রাহুল গান্ধীরা আতঙ্কিত হয়ে পড়েন। ভাবতে থাকেন রাম নামক সোনার কাঠির ছোয়ায় এই বুঝি ‘ধর্মনিরপেক্ষ ভারতবর্ষের ঘুম ভেঙে গেল ! ঘুম একবার ভাঙলে জাতপাত আর ভেদাভেদের রাজনীতি চলবে না। বাঙ্গালিরা। শিখ পাঞ্জাবিদের দেখে ‘বাধাকপি’ বলে উপহাস করবে না। দক্ষিণ ভারতীয়রা উত্তর ভারতীয়দের বিষনজরে দেখবে না। সুস্থ রাজনৈতিক আবহাওয়ায় স্বাস্থ্য ফিরবে দেশের। এমন একটি ইতিবাচক ভাবনা রাহুল গান্ধীরা কীভাবে ভাবতে পারেন। তাই তার প্রতিবাদ।

তবে আমাদের ভাগ্য ভালো এ দেশের মানুষ রাহুল গান্ধীর কথা তত সিরিয়াসলি ধরেন না। তাই বোধহয় রামায়ণ ও মহাভারত সব রেকর্ড ভেঙে এগিয়ে চলেছে। সব থেকে। বড়ো কথা দেশের অগণিত অল্পবয়সি ছেলে-মেয়ে রামায়ণ দেখছে। রিঅ্যাক্ট করছে। ঘুম ভাঙছে দেশের। অহর্নিশ মৃত্যুভয়ে। শিহরিত এই সময়ে এর থেকে বড়ো পাওয়া আর কী হতে পারে।

সন্দীপ চক্রবর্তী

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

This site uses Akismet to reduce spam. Learn how your comment data is processed.