অক্টোবর মাসের শেষের দিকে। সবাই জানতো ১৭ নভেম্বরের মধ্যে অযোধ্যা মামলার রায় ঘোষিত হবে। বাতিল করা হয়। সঙ্ঘের যাবতীয় বৈঠক। অধিকারী ও প্রচারকদের বলা হয় নিজ নিজ স্থানে থাকতে। এর উদ্দেশ্য ছিল একটাই, জনগণকে শান্ত রাখা। সে রায় যেমনই আসুক না কেন। অযোধ্যা মামলা ঘিরে হিন্দু সমাজের ধৈর্যের বাঁধ ক্রমশ ভাঙছিল, তাদের সংযত রাখা; মামলার রায় বিপক্ষে পেলেও পরবর্তী আইনি পদক্ষেপের প্রস্তুতি, মানুষকে বোঝানো, আবার রায় পক্ষে গেলে শান্তি বজায় রাখা, উচ্ছ্বাসে সংযম রাখা আর এস এস এবং তাদের শাখা সংগঠনগুলি সম্প্রীতি রক্ষায় অবিস্মরণীয় ভূমিকা নিয়েছে। রামজন্মভূমি মামলার এই রায়ই প্রত্যাশা করেছে গোটা দেশ। মানুষের আকাঙ্ক্ষা বাস্তবে পরিণত হওয়ার পরও সংযমী প্রতিক্রিয়া, উচ্ছ্বাসের বাঁধ ভাঙলেও প্রকাশ্যে, বাহ্যিকভাবে তার প্রকাশ ছিল না। বিজেপি-আরএসএসের কেন্দ্রীয় নেতৃত্ব দেশভক্তির কথা বলেছেন, দেশবাসী অকুণ্ঠ সাধুবাদ দিয়েছেন তাদের। কংগ্রেস সহ প্রায় সব বিরোধী দল মহামান্য সর্বোচ্চ আদালতের রায়ের প্রতি সম্মান জানিয়েছে, সে যার যেমনই রাজনীতিবোধ থাকুক না কেন। এমনকী জামা মসজিদের ইমাম-সহ মুসলমান সম্প্রদায়ের সিংহভাগও রায়কে মেনে চলার প্রতিশ্রুতি দিয়েছেন।
এই ঐক্যবদ্ধ ভারতের ছবির পাশাপাশি সেদিন পশ্চিমবঙ্গবাসী প্রত্যক্ষ করল দেশের আরেক চিত্র। হাতে গোনা মৌলবাদী মুসলমানদের সঙ্গে গলা মিলিয়ে যারা শুধু রামমন্দির নির্মাণের বিরোধিতাই করল না, চিরাচরিত স্বভাব অনুযায়ী ভারতীয় বিচারব্যবস্থার ওপর নগ্ন আক্রমণ চালালো, পাকিস্তানকে যারপরনাই খুশি করে। ভারতীয় রাজনীতির এই একমাত্র ব্যতিক্রমী। দলটা সবার পরিচিত, চৌত্রিশ বছরের দুঃশাসনে পশ্চিমবঙ্গের স্রেফ সর্বনাশই করেনি, উর্বর এক ভূমিকে শ্মশানে পরিণত করেছিল আর মুসলমান মৌলবাদকে প্রশ্রয় দিয়ে পশ্চিমবঙ্গকে মিনি পাকিস্তানে রূপান্তরিত করেছিল, যার খেসারত আজও দিতে হচ্ছে।
ভারতবর্ষের গণতন্ত্র-সংবিধানকে পদদলিত করে ১৯৬৪ সালে ভারত আক্রমণকারী চীনের দালালি করবার কারণে যে দলের জন্ম, যাদের পূর্বপুরুষ জেহাদি সংসর্গে জন্ম নিয়েছিল তারা উগ্র ভারত-বিরোধী হবেই। তার প্রদর্শন দেখা গেল সোশ্যাল মিডিয়া থেকে পলিটব্যুরোর বিবৃতিতে। এদের একাংশ রায় ঘোষণার আগে শান্তির বাণীর মুখোশ পরলেও, নকশাল পরিচালিত জঈশ-ই-মহম্মদে প্রতি আস্থাশীল বাঙ্গলার সবচেয়ে ‘বিকৃত দৈনিকপত্র-এর পক্ষ থেকে লাগাতার উস্কানি দেওয়া হচ্ছিল। কল্পিত মুসলমানদের নাম দিয়ে তারা রায়ের আগে কতটা বিপন্ন তার প্রচার হচ্ছিল। রায় বেরোতে এদের সম্পাদকীয় সদস্য ও তাদের তাঁবেদারদের আর পায় কে। এমনিতেই সুযোগ পেলে দেশের সংবিধানকে পদদলিত করার অভ্যাস এদের মজ্জাগত। এবং বাবরি ধাঁচার শোকে এদের বুক ধড়পড়ানি গত সাতাশ বছরের অভ্যাস। তার পরিসমাপ্তিতে এদের ব্যথায় এমনই চাগাড় দিয়েছিল যে নির্বিচারে গত ৯ নভেম্বর রায় ঘোষণার পর সোশ্যাল মিডিয়া জুড়ে চলল উস্কানি আর দেশের বিচার ব্যবস্থার ওপর অনাস্থা।
সাধারণ বামেরা অবশ্য আরেক কাঠি ওপরে। কারুর মন্তব্য এবার তাজমহল ভেঙে দেওয়া হবে, কেউ বলছে। মুসলমানদের দেশছাড়া করা হবে, আবার প্রধান বিচারপতিকে কটাক্ষ করে বলা হচ্ছে ভারত-রত্ন পাওয়ার লোভে তিনি এমন করেছেন, অনেকে ভারতবর্ষ হিন্দু রাষ্ট্রে পরিণত হলো–জওহরলাল নেহরু-জ্যোতি বসুর ভারত কোথায় গেল তা ভেবে সারা হচেছ। ৯ নভেম্বর, ২০১৯ সোশ্যাল মিডিয়ায় নানা কিসিমের বামপন্থীরা সদা সচেষ্ট এমন গুজব মাঝেমধ্যে আকাশে ওড়ে বটে, তবে সেদিন মুসলমানদের ক্ষেপিয়ে তুলে দাঙ্গা বাঁধানোর এমন পরিকল্পিত প্রয়াস বামপন্থীরা আর অতিবাম পরিচালিত যে দৈনিকটি নিয়েছিল তা এর আগে আর কখনও দেখা গিয়েছে বলে মনে পড়ে না।
দাঙ্গার সঙ্গে হিন্দুত্ববাদীদের জুড়ে দেওয়ার যে প্রবণতা এরা সৃষ্টি করেছে, তার কারণটাও বোধহয় এদিন বোঝা গেল। কারণ নিজেদের আড়াল করার এমন প্রকৃষ্ট উপায় সত্যিই বিরল। হিন্দু সমাজ সেদিন শান্ত, সংযত থেকে ভারতবর্ষের শাশ্বত ভাবধারার জয় উপলব্ধি করেছে। আর দেশের শান্তিভঙ্গকারী, দাঙ্গাবাজ পাকপক্ষ তাদের পিতৃভূমি পাকিস্তানকে খুশি করার লক্ষ্যে ১৯৯২-এর ডেমো প্রদর্শনের যাবতীয় চেষ্টা করেছিল। প্রশাসন সতর্ক না হলে এদের বিরদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়া যাবে না। আগামীদিনেও এরা দেশের শান্তি বিঘ্নের চেষ্টা করবে বাকস্বাধীনতা আর গণতন্ত্রের চতুর্থ স্তম্ভের আড়ালে তাই প্রশাসনের সঙ্গে জনগণকেও সতর্ক থাকতে হবে। শুধু নির্বাচনে কুলোর হাওয়া দিয়ে এদের বিদায়ই যথেষ্ট নয়, সামাজিক প্রতিরোধেরও প্রয়োজন।
বিশ্বামিত্র-র কলম
2019-11-15