আমাদের শারদীয়া দুর্গাপূজায় কুমারী পূজা হলো এক অপরিহার্য অঙ্গ। আর এই পূজার মূলে রয়েছে মহাশক্তিরই সাত্ত্বিক ভাবের আরাধনা। তন্ত্রশাস্ত্রে আছে যে, মহামায়া বিশ্বব্যাপিনী মহাশক্তিরূপে থাকলেও নারীমূর্তির মধ্যেই তার সমধিক প্রকাশ দেখা যায়। নারী মাত্রই দেবীর অংশে জন্ম। তবে অবিবাহিতা শুদ্ধ নারীর মধ্যেই মাতৃত্বের শুদ্ধচেতনা ও অনন্ত প্রেম বেশি লক্ষ্য করা যায়। এ কারণে কুমারী পূজা করা হয়। কুমারীমাতার শুদ্ধ অন্তঃকরণে অনন্ত প্রেম, পবিত্রতা ও করুণাশক্তি বিরাজ করে। তবে সব কুমারীতে নয়। যেসব কুমারীরা শুদ্ধ, অপাপবিদ্ধা এবং উচ্চসংস্কার সম্পন্ন তাদের অন্তরেই মাতৃচেতনার প্রকাশ বেশি। মনে রাখতে হবে যে, প্রত্যেক কুমারীর অন্তরে (সংস্কার অংশে) বিদ্যা সংস্কার ও অবিদ্যা সংস্কার বিরাজ করছে। বিদ্যা সংস্কার বেশি হলে সেই কুমারীকে দেখতে হয় দেবীর মতো অত্যন্ত পবিত্রতায় ভরা মুখমণ্ডল, প্রেম ও করুণাশক্তিসম্পন্ন চক্ষুদ্বয়, দেহের গঠন অত্যন্ত সুলক্ষণা, গৌরবর্ণা, অতুল কেশরাশি—ঠিক যেন মা লক্ষ্মী। আবার অবিদ্যা অংশ বেশি থাকলে কুমারীর চোখ-মুখ হবে সংকীর্ণ, চোখের মধ্যে ভালোবাসার দীপ্ত ভাব ফুটে উঠবে না। স্বভাবে হবে একগুঁয়ে, রাগী এবং শৃঙ্খলাবিহীন। কথাবার্তা ও আচরণ তার লক্ষ্মীর মতো শ্রী ও সুন্দর হবে না। প্রকৃতিতে এই বিদ্যাশক্তি ও অবিদ্যাশক্তিসম্পন্ন কুমারী সর্বত্র বিরাজ করছে। কাজেই অবিদ্যাসম্পন্না কন্যা যেমন সহজেই দেখা যায় তেমনই দেবীভাবের কন্যাও প্রচুর দেখা যায়। এইসব শুভ লক্ষণযুক্ত দেবীভাবের কন্যাদের শাস্ত্রবিধি সম্পন্ন পূজা। করলে, তাদের সম্মুখে আরতি করলে, মন্ত্র উচ্চারণ করলে, ধূপ-ধুনা দিলে তাদের অন্তঃকরণের শুভসংস্কারটা প্রসারিত হয়ে উদ্বেলিত হয়ে ওঠে এবং সেই কুমারী তখন শুদ্ধ মাতৃস্বরূপিনী হয়ে মায়ের সঙ্গে একাত্মা লাভ করে থাকে। বলতে কী এমন উচ্চ সংস্কারসম্পন্ন শুদ্ধ কুমারীকেই পূজা করা হয়ে থাকে।
এই কুমারী কন্যা হবে প্রকৃত অর্থে সুন্দরী এবং দেহের ‘ঋতু ভাব বর্জিত। নারীধর্ম শুরু হওয়ার পূর্বেই তাকে আরাধনা করা উচিত। মাতৃসাধক শ্রীরামকৃষ্ণ বলেছেন, ‘সব স্ত্রীলোক ভগবতীর এক-একটি রূপ। তবে শুদ্ধাত্মা কুমারীতে ভগবতীর বেশি প্রকাশ। শুদ্ধাত্মা ভাবটা মেয়েদের ক্ষেত্রে দুই থেকে দশ বছরের মধ্যে প্রকটভাবে থাকে। তাই এমন বয়সের মধ্যেই কুমারীদের পূজা করতে হয়। তবে কি যৌবন শুরু হওয়ার পর থেকে বয়স্কা মেয়েরা শুদ্ধাত্মা আর থাকে না? থাকে সর্বদাই। কিন্তু চিন্তা করতে হবে যে, শুদ্ধজ্ঞান ঢাকা থাকে মনের কলুষতার আবরণে।
এ কারণেই তন্ত্রশাস্ত্রে বলে, ঋতুবতী হওয়ার পূর্বে শুদ্ধ স্বভাবের কন্যাদের মধ্যে প্রবল দৈবীশক্তি জাগ্রত থাকে। কুমারী পূজার মাধ্যমে কন্যাহৃদয়ের এই সুপ্ত দৈবীশক্তিকে জাগিয়ে মানুষের। কল্যাণে নিয়োগ করার ভাবনা থেকেই কুমারী পূজার উৎপত্তি হয়েছে। সে কারণে কুমারী নির্ধারণের সময়ে সযত্নে যার পূজা হবে সেই কন্যার লক্ষণসমূহ ভালো করে দেখতে হয়। তার যেন কুরূপ না হয় কিংবা সে যেন জন্মান্ধ, খুব রোগা, চক্ষু কোটরাগত, দেহে লোম পরিপূর্ণ, অঙ্গে ব্রণ ভর্তি, দেহে দুর্গন্ধ, ঋতুমতী কিংবা হাতে বা পায়ে এক আঙুল কম সম্পন্না এবং চোখের দৃষ্টি অপরাধপ্রবণ না হয়—এসব লক্ষণ ভালো করে দেখে নিতে হয়। কারণ কুমারী পূজার উদ্দেশ্য হলো নারীদেহে দৈবীশক্তির সাক্ষাৎ জাগরণ এবং তার আরাধিতা পাদপদ্মের মধ্য দিয়ে দুঃখী-তাপিত-সহ সকল মানুষের কল্যাণ চিন্তা।
প্রশ্ন হতে পারে, তবে কি কেবল ব্রাহ্মণ বংশের কন্যাই পূজার জন্য কাম্য হতে পারে? তা নয়। ব্রাহ্মণ কন্যা, ক্ষত্রিয় কন্যা, বৈশ্য কন্যা এবং শূদ্র কন্যাও সুলক্ষণাযুক্ত হলে অবশ্যই পূজা করা যায়। দেবী পুরাণকার মতে, ব্রাহ্মণ কন্যা মঙ্গল কর্মে, ক্ষত্রিয় কন্যা সর্ব বিষয়ে জয়লাভ করতে, বৈশ্য কন্যা বিষয় লাভ করতে এবং শূদ্রা কন্যা সর্ব কর্মে শুভবোধ জাগাতে পূজিতা হতে পারে। ব্রাহ্মণ কন্যা উচ্চ বংশজাত ও শুভ সংস্কারসম্পন্ন হলে স্বভাবতই অনেকে কুমারী হিসাবে নিয়োগ করেন সত্য, তবে অন্যান্য জাতির শুভ লক্ষণযুক্ত কন্যার মধ্যেও যে অত্যন্ত দেবীশক্তি বর্তমান তা যেন কোনওভাবেই সন্দেহ প্রকাশ করা না হয়। এক্ষেত্রে আমরা বেলুড় মধ্যে কুমারী পূজার প্রবর্তক স্বামী বিবেকানন্দের কথা ভাবতে পারি। তিনি বোধহয় জীবনে যে কন্যাটিকে কুমারী রূপে প্রথম পূজা করেছিলেন সে ছিল একজন মুসলমান। তখন ১৮৯৮ সাল। স্বামীজী কাশ্মীরে ভ্রমণ করছেন। সঙ্গে নিবেদিতা, ওলি বুল প্রমুখ। হঠাৎ তিনি একমুসলমান মাঝির চার বছরের কন্যার মধ্যে প্রবল দৈবীভাব উপলব্ধি করলেন এবং তারপর সেখানেই তাকে কুমারী রূপে পূজা করলেন। অতঃপর ১৮৯৯ সালে তিনি কন্যাকুমারী ভ্রমণকালের শহরের উচ্চপদস্থ সরকারি কর্মী মন্মথ ভট্টাচার্যের কন্যাকে কুমারী রূপে পূজা করেছিলেন। সর্বোপরি ১৯০১ খ্রিস্টাব্দে বেলুড় মঠে দুর্গাপূজার সূচনা করে অষ্টমীর দিন জ্বর গায়েও তিনি নয় জন কুমারীকে অত্যন্ত ভক্তিভরে পূজা করেছিলেন। সে সময় সাক্ষাৎ জগন্মাতা সারদাদেবী স্বয়ং মন্দিরে উপস্থিত ছিলেন। প্রশ্ন হলো, স্বামীজী কি স্বয়ং গুরুদেবের অনুপ্রেরণাতেই কুমারী পূজা করতে আগ্রহান্বিত হয়েছিলেন? আমাদের মনে হয়, স্বামীজী স্বয়ং তন্ত্রশাস্ত্রে বিশ্বাসী ছিলেন। এই শাস্ত্রে কুমারী পূজা করার কথা মহিমাব্যঞ্জক ভাবের সঙ্গে প্রকাশ করা হয়েছে। তাছাড়া ঠাকুরের আদর্শ তো আছেই। স্বামীজীর নিজস্ব উপলব্ধিও সহায়ক হয়েছিল।
এখন যেসব প্রশ্ন কুমারী পূজা করতে গেলে সকলের মনে ওঠে তাহলো— কুমারী পূজা কেন করা হয়। কুমারী পূজা কেমন ভাবে করতে হয়? এই পূজা করলে কী কী ফল লাভ হয়? সারা বছরই কি কুমারী পূজা করা যায় ? কত জন কুমারীকে একসঙ্গে পূজা করা যায়? ভারতীয় ধর্ম ও সংস্কৃতিতে কুমারী পূজা কতদিন ধরে চলে আসছে? আমাদের কুমারী পূজার সময় কী করা উচিত? এইসব প্রশ্নগুলি নিয়ে আলোচনা করার প্রাক্কালে যেটা বলা দরকার তাহলো যে, ভারতে কুমারী পূজার ইতিহাসটা খুবই প্রাচীন। প্রায় পৌরাণিক যুগ থেকে দেবীপূজার সঙ্গে সাক্ষাৎ নারায়ণী রূপে কুমারী পূজার প্রচলন হয়ে আসছে। তবে যেহেতু পূজা হলো তন্ত্রের দান তাই তন্ত্রশাস্ত্রে কুমারী পূজার মাহাত্ম সবিস্তারে বর্ণনা করা হয়েছে। এক্ষেত্রে অবশ্য দেবীভাগবত, যামল তন্ত্র, দেবী পুরাণ, যোগিনী তন্ত্র প্রভৃতি শাস্ত্রের নাম উল্লেখ করা যায়। দেবী ভাগবতে আশ্বিনের শুক্লা প্রতিপদ থেকে মহানবমী পর্যন্ত নয় দিন ধরে প্রত্যহ যথাবিধি অনুসারে কুমারী পূজার কথা উল্লেখ করা হয়েছে। তা হলো কুমারীকে নিত্য সুন্দর বসন ও ভূষণে সাজাতে হবে। তার আগে অবশ্য কুমারীকে ভালো করে স্নান। করাতে হবে। তারপর সুন্দর পরিচ্ছন্ন বা বেনারসি পরিয়ে তার কপালে সুন্দর চন্দনের ফোটা লাগাতে হবে, বস্ত্রে সুগন্ধি ও অগুরু দিতে হবে, গলায় থাকবে ফুলের মালা, আর থাকবে নানা ফুলের গহনা কিংবা অন্য অলংকার। এইসব বস্ত্র-ভূষণে সজ্জিত করে কুমারীকে বাদ্য, শঙ্খ, কাসা, উলুধ্বনি সহযোগে পূজামণ্ডপে তার জন্য নির্দিষ্ট রাখা আসনে এনে বসাতে হবে। অতঃপর তাকে সাক্ষাৎ মায়ের রূপ ভেবে পাদ্য, অর্ঘ্য, ধূপ, কুমকুম, চন্দন ও অন্যান্য মাঙ্গলিক দ্রব্য দিয়ে অত্যন্ত ভক্তি ও শ্রদ্ধা সহকারে পূজা করতে হবে। তবে কুমারীকে এনে আসনে বসিয়েই পূজারি তার পা দুটি ধুইয়ে আলতা পরিয়ে দেবেন, গলায় পুষ্পের মালা পরাবেন এবং কপালে তিলক দেবেন। এছাড়া কুমারীর। সম্মুখে নৈবেদ্য প্রভৃতি ভোগদ্রব্যাদি স্থাপন করবেন এবং তাঁকে যথাসময়ে পূজা করে মুখে নৈবেদ্য প্রসাদ ও পানীয় জল গ্রহণ করাবেন। এভাবে সাক্ষাৎ দেবীজ্ঞানে কুমারীকে অর্চনা করতে করতে পুরোহিত গদগদ কণ্ঠে ধ্যানমন্ত্র উচ্চারণ করে বলবেন—
ওঁ কুমারীং কমলারূঢ়া ত্রিনেত্রাং চন্দ্রশেখরাম্।
তপ্ত কাঞ্চন বর্ণাভাং নানালঙ্কার ভূষিতাম্।
রক্তাম্বর পরিধানাং রক্তমাল্য অনুলেপনা।বামেন অভয়দাং ধ্যায়ে দক্ষিণেন বরপ্রদাম্।
—অর্থাৎ যিনি পদ্মাসীনা লক্ষ্মীস্বরূপা, ত্রিনেত্রা, যাঁরা মাথায় চন্দ্রকলা শোভা পাচ্ছে, যার বর্ণতপ্তকাঞ্চনতুল্য, যিনি নানা অলংকারে ভূষিতা, যিনি রক্তবস্ত্র ও রক্তমাল্য পরিহিতা, যাঁর দেহরক্ত ও চন্দনাদির দ্বারা অনুলিপ্ত, যাঁর বাম হাত অভয় মুদ্রা ও ডান হাত বর প্রদানে প্রসারিত সেই কুমারীকে আমরা ধ্যান করি।
আবার অন্য একটি ‘তন্ত্রের ধ্যানমন্ত্রে আছে—
বালরূপাঞ্চ ত্রৈলোক্যসুন্দরীং বরবৰ্ণিনীম্।
নানালঙ্কার নাঙ্গীং ভদ্রবিদ্যা প্রকাশিনীম্।
চারুহাস্যাং মহানন্দ হৃদয়ং শুভদাং শুভাম্।
ধ্যায়েৎ কুমারীং জননীং পরমানন্দরূপিণীম্।
—অর্থাৎ যিনি তিন ভুবনের মধ্যে শ্রেষ্ঠা এবং শোভন বর্ণধারিণী— সামনে উপস্থিত এই বালিকা মূর্তি, এঁর নানা অঙ্গে বিভিন্ন রকমের অলংকার থাকায় এঁর দেহটি ঈষৎ অবনত অবস্থায় আছে; ইনি অধিকারী বলে বিবেচিত হন। অতঃপর কুমারীকে ভক্তি ভরে প্রদক্ষিণ ও দক্ষিণা প্রদান করে প্রণাম মন্ত্র উচ্চারণ করে বলতে হয়—
নমামি কুলকামিনীং পরমভাগ্য সন্দায়িনীং।
কুমার-রতি-চাতুরীং সকলসিদ্ধি-মানন্দিনীম্।
প্রবাল-গুটি-কাস্রজং রজতরাগ বস্ত্রান্বিতাং।
হিরণ্যতুলা-ভূষণাং ভুবনবাক্ কুমারীং ভজে।
—অর্থাৎ হে কুলকামিনী, অতুল সৌভাগ্যদাত্রী, কুমার কার্তিকের মনে আনন্দ সঞ্চারিণী, সকল সিদ্ধিদাত্রী ও আনন্দবিধায়িনী দেবী কুমারী তোমায় প্রণাম জানাই। তুমি প্রবালখণ্ডের মালা, রুপো ও রঞ্জিত বস্ত্র এবং স্বর্ণতুল্য ভূষণে অলংকিতা আছো, হে দেবী— তোমাকে ভজনা করি। তাছাড়া দেবীর একটি অন্য স্তব ও প্রণাম মন্ত্র আছে—
ওঁ আয়ুর্বলং যশো দেহি, ধনং দেহি কুমারীকে।
সর্বং সুখং চ মে দেহি, প্রসীদ পরমেশ্বরী।
ব্রাহ্মী মাহেশ্বরী রৌদ্রী রূপত্ৰিতয়ধারিণী।
অভয়ঞ্চ বরং দেহি, নারায়ণি নমোহস্তুতে।
—হে দেবী কুমারী, তুমি আমাদের আয়ু, বল, যশ, ধন ও সকলপ্রকার সুখ প্রদান করো। তুমি আমাদের সকলের প্রতি প্রসন্না হও। হে দেবী— তুমি ব্রাহ্মী, মাহেশ্বরী ও রৌদ্রারূপী ধারণ করে। আমাদের অভয় ও বরদান করো। হে নারায়ণী, তোমাকে নমস্কার করি।
এই কুমারী পূজা হলো জীবন্ত শক্তির উপাসনা। প্রত্যেক নারীই জগন্মাতার সাক্ষাৎ মূর্তি। শ্রীশ্রী চণ্ডীতে আছে, ‘স্ত্রিয়ঃ সমস্তাঃ সকলা জগৎসু। এই জগতে সমস্ত স্ত্রীমূর্তিই দেবীর স্বরূপ। তবে শুদ্ধ কুমারীতেই এই মহাশক্তি দেবীর বেশি প্রকাশ। এ কারণে মহাতীর্থ কামাক্ষ্যা ও কন্যাকুমারীতে এবং ভারতের প্রধান প্রধান শাক্ত পীঠগুলিতে নিত্য কুমারী পূজার প্রচলন হয়ে রয়েছে। শ্রীরামকৃষ্ণদেব এবং স্বামী বিবেকানন্দ উভয়েই স্ত্রী-শরীরকে সাক্ষাৎ শক্তি বিগ্রহ বলে ভাবতেন। ঠাকুর শ্রীরামকৃষ্ণের কথায়, ‘মাটির প্রতিমায় দেবতার পূজা হয়, আর মানুষের হয় না। এটা সত্য যে, মানুষের মধ্যেই ঈশ্বরের সবচেয়ে বেশি প্রকাশ। আবার মানুষের মধ্যে যাঁরা সৎ ও পবিত্র তাদের মধ্যে ভগবৎশক্তি অপেক্ষাকৃত বেশি। অপরদিকে ছোটো শিশুদের নির্মল আধার হওয়ার ফলে তাদের মধ্যে দৈবী প্রকৃতির প্রভাব বেশি থাকে। এ কারণেই পবিত্র কুমারীর পূজা করা হয়ে থাকে। আমাদের তন্ত্রশাস্ত্রে এক থেকে ষোলো বছর পর্যন্ত কুমারীকে পূজা করার কথা বলা হয়েছে। তবে ‘বিশ্বসার’ তন্ত্রে পরিষ্কারভাবে বলা হয়েছে—দশ বছরের বেশি কুমারীদের পূজা করা মোটেই বিধিসম্মত নয়। এটাই অধিক যুক্তিযুক্ত বলে মনে হয়।
যামলতন্ত্রে বলা হয়েছে যে, কুমারী পূজার জন্য নির্বাচিত কন্যার বয়স এক বছর হলে তার নাম হয় সন্ধ্যা। দুই বছর হলে ‘সরস্বতী’, তিন বছর হলে ‘ত্রিধামূর্তি’, চার বছরের হলে ‘কালিকা’, পাঁচ বছরের হলে সুভগা,ছয় বছরের হলে ‘উমা’, সাত বছর বয়স হলে কুজিকা, নয় বছরের কন্যা হলে নাম হয় ‘কালসঙ্কটা’, দশ বছর হলে ‘অপরাজিতা’, এগারো বছর হলে ‘রুদ্রাণী’, বারো বছরে ‘ভৈরবী, তেরো বছরে ‘মহালক্ষ্মী’, চৌদ্দ বছরে ‘পীঠনায়িকা’, পনেরো বছরের ‘ক্ষেত্রজ্ঞা’ এবং ষোলো বছর হলে কন্যার নাম ‘অম্বিকা’। এক থেকে ষোলো বছর পর্যন্ত কন্যার পূজা করার কথা বলা হলেও মূলত ছয়, সাত ও আট বছরের কন্যারই পূজা করা বিধেয়। অর্থাৎ‘উমা’, ‘মালিনী’ ও ‘কুজিকা’ নামধারী কন্যাদের পূজা করলে উত্তম ফল লাভ হয়। পূজার সময় এইসব বয়সের কন্যাদের প্রচলিত নামেনা ডেকে তাদের ‘উমা’, ‘মালিনী’ নামে ডেকে ও ভাবনার মধ্য দিয়ে কুমারী পূজা করা বিধেয়।
তবে ‘দেবী ভাগবত’-এ পরিষ্কার বলা হয়েছে যে, দুই থেকে দশ বছরের কুমারীকে পূজা করা উচিত এবং এইসব কুমারীর পূজার সময় কী কী নামপ্রদান করা হয় ও সেই অনুসারে পূজা করলে কী কী ফল লাভ হয় তাও পরিষ্কারভাবে বলা হয়েছে। যেমন—
কুমারিকা— দুই বছর বয়সের কন্যা। পূজা করলে মানুষের দুঃখ ও দারিদ্রনাশ ঘটে এবং ধন, আয়ু ও বল বৃদ্ধি পায়।
ত্রিমূর্তি—তিন বছরের কন্যা। পূজা করলে ধন-সম্পদ প্রাপ্তি ঘটে এবং পুত্র-পৌত্রাদির গৌরব বৃদ্ধি পায়।
কল্যাণী—চার বছরের কন্যা। পূজা করলে বিদ্যা ও সুখলাভ হয়।
রোহিণী— পাঁচ বছরের কন্যা। পূজা করলে মানুষের রোগ নাশ হয়।
কালিকা—ছয় বছরের কন্যা। পূজা করলে শত্রু বিনাশ হয়।
চণ্ডিকা–সাত বছরের কন্যা। পূজা করলে ধন ঐশ্বর্য প্রাপ্তি ঘটে।
শাকম্ভরী—আট বছরের কন্যা। পূজা করলে মোহগ্রস্ত করে শত্রুর বিরুদ্ধে জয়লাভ করা যায়।
দুর্গা-নয় বছরের কন্যা। পূজা করলেদুঃখদারিদ্র নাশও কঠিনতম শুভ কাজে সাফল্যলাভ হয়। সুভদ্রা—দশ বছরের কন্যার নাম। পূজা করলে বাঞ্ছিত দ্রব্য লাভ হয়।
মোট কথা, যে কোনও বয়সের কুমারী পূজা করা হোক না কেন তার ফল পাওয়া নিশ্চিত। সে কারণে যোগিনী তন্ত্রে বলা হয়েছে যে, কুমারী পূজা না করলে কেবলমাত্র পূজা-হোম দ্বারা দেবীর পূজা সম্পন্ন হয় না। অপরদিকে কুমারী পূজা করলে পূজা-হোম সহ সমস্ত কিছুই পূর্ণতা লাভ করে। বলা হয়েছে যে, কুমারীকে একটি মাত্র ফুলও যদি দান করা যায় তাহলে সুমেরু পর্বতের মতো বিশাল ফুল দানের ফল পাওয়া যায়। আর কুমারীকে ভোজন করালে ত্রিভুবনের সকলকেই ভোজন করানো হয়। এ কারণেই তন্ত্রসার’ গ্রন্থে দৃঢ়ভাবে বলা হয়েছে যে, ‘কুমারী পূজা’র ফল শত কোটি মুখে বলেও শেষ করা যাবে না। তবে কুমারী পূজা করলে যে মেয়েদের প্রতি অন্তরে শ্রদ্ধা ও ভক্তিভাব জাগ্রত হয় এতে কোনও সন্দেহ নেই। তাছাড়া দুর্গা পুজা করলে যে সমস্ত ফল পাওয়া যায় তা কুমারী পূজার মাধ্যমেও লাভ করা যায়। এখন প্রশ্ন হলো—একসঙ্গে কত জন কুমারীকে পূজা করা যেতে পারে?
‘দেবীভাগবত’মতে, দেবীপূজার প্রথম দিনে একজন, দ্বিতীয় দিনে দু’জন এবং তৃতীয় দিনে তিন জন কুমারীর পূজা করা যেতে পারে। আবার প্রত্যেকদিন নয় জন করে কুমারীকেও পূজা করা যায়।
সাধারণত দুর্গাপূজার মহাষ্টমীর দিনই কুমারী পূজা করা হয়ে থাকে। এ ব্যাপারে বেলুড় মঠ ও অন্যান্য স্থানের কথা উল্লেখ করা যেতে পারে। তবে নবমীতেও কুমারী পূজা’ বিধেয় বলে মনে করা হয়। তাছাড়া বছরের যে কোনও সময়ে, পবিত্র কোনও দিনে, জগদ্ধাত্রী পূজায়, অন্নপূর্ণা পূজায়, এমনকী জগন্মাতা কালিকা পূজাতেও মহাসমারোহে কুমারী পূজা করা যেতে পারে।
এই কুমারী পূজার মাধ্যমে নারীর অন্তর্নিহিত শুভ দেবীশক্তিটাই জাগ্রত করা হয়। এই অন্তর্নিহিত দৈবীশক্তি জাগালেই দেবীপূজা সার্থকতা লাভ করে। ব্যাপক অর্থে কুমারী পূজার মধ্য দিয়ে আমাদের ঘরের মা, ভগিনী, পত্নী, কন্যা প্রভৃতি নারীরূপিণীদের শ্রদ্ধা ও সম্মান জানানো হয়। এই পূজা নারীর পবিত্র জীবন চেতনার পূজা, নারীর নারীত্বের পূজা, নারীর প্রতি তীব্র প্রেমভাবের পূজা। আমাদের শাস্ত্রে বলা হয়েছে যে, নারী শক্তিরূপা। সংসারের লক্ষ্মীস্বরূপা। তাদের শ্রদ্ধা ও সম্মান করলেই সংসার সুন্দর হয় এবং জীবনের সমস্ত দিক মঙ্গলময় হয়ে ওঠে। আর নারীকেও তাদের এই দৈবী প্রকৃতির কথা সর্বদা মনে রাখতে হবে। সেজন্য নারীকে সর্বপ্রথম নিজেদের ভেতরে অপরিসীম শ্রদ্ধাবোধকে জাগাতে হবে এবং তাঁদের অন্তরে যে মহাশক্তি বিরাজ করছে সে সম্বন্ধেও সচেতন হয়ে উঠতে হবে। তাদের আপনার অন্তরটি শুধু নারীচেতনার মধ্যেই সীমাবদ্ধ রাখলে চলবে না, অনন্ত শক্তিচেতনার সঙ্গে একাত্মা স্থাপন করতে হবে। এভাবে তারা অনন্ত শক্তিময়ী হলেই সমাজের, দেশের ও দশের যথেষ্ট কল্যাণে সাধিত হবে। আর এ কারণেই কুমারী পূজার প্রচলন করা হয়েছে। পরিশেষে, নারী তাদের আপনার দিব্য স্বরূপের প্রতি আরও সচেতন হয়ে শ্রদ্ধা, প্রেম, সহযোগিতা ও সহমর্মিতাবোধে আপ্লুত সুস্থ-স্বাভাবিক এবং মঙ্গলময় করে গড়ে তুলতে ব্রতী হয়ে উঠুন—এই প্রার্থনা করি।
স্বামী বেদানন্দ
2019-12-05