১৮৪২ সালের চিং রাজবংশ পর্যন্ত হংকং মূল চীন দ্বারা শাসিত ছিল। তার পর নানকিংয়ের চুক্তিবলে দ্বীপটিকে ব্রিটিশ সাম্রাজ্যের হাতে তুলে দেওয়া হয় এবং এরপর দ্বিতীয় আফিম যুদ্ধের পরে ১৮৯৮ সালে কোওলুন উপদ্বীপকে অন্তর্ভুক্ত করা হয়। ১৯৪১ থেকে ১৯৪৫ সাল পর্যন্ত এটি জাপানি সাম্রাজ্যের দখলে ছিল।
দীর্ঘ গৃহযুদ্ধের পরে ১৯৪৯ সালে প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল গণপ্রজাতন্ত্রী চীন। কিন্তু জাতিসঙ্ ১৯৭২ সাল পর্যন্ত তাইওয়ানকে আসল চীন বলে মানত। ওই বছর জাতিসঙ্ তাইওয়ানের পরিবর্তে মূল চীনকে স্বীকৃতি দেয়। চীন অনুরোধ করেছিল যে হংকংকে জাতিসঙ্ঘের অ-স্বশাসিত অঞ্চলগুলির তালিকা থেকে অপসারণ করা হোক। এই ভাবে হংকংকে তার স্বাধীনতার অধিকার থেকে বঞ্চিত করা হলো। ১৯৮৪ সালের ডিসেম্বরের চীন-ব্রিটিশ যৌথ ঘোষণাপত্রে হংকঙের সার্বভৌমত্ব ব্রিটিশ যুক্তরাজ্য থেকে গণপ্রজাতন্ত্রী চীনে স্থানান্তর করার শর্ত দেওয়া হয় এবং তা ১৯৯৭ সালে ১ জুলাই একটি বিশেষ ‘হস্তান্তর অনুষ্ঠানের মাধ্যমে সমাপ্ত হয়।
দুই সরকারের মধ্যে শর্ত হয়েছিল যে হস্তান্তরের পরে হংকঙের ভিন্ন অর্থনৈতিক, রাজনৈতিক ও আইনি ব্যবস্থাপনা বজায় রাখা হবে এবং পরবর্তীকালে গণতান্ত্রিক সরকার গড়ার লক্ষ্য নিয়ে হংকঙের রাজনৈতিক ব্যবস্থার বিকাশ ঘটানো হবে। এই গ্যারান্টি চীন-ব্রিটিশ যৌথ ঘোষণাপত্রে প্রকাশিত হয়েছিল এবং হংকঙের আধা-সাংবিধানিক মূল আইনে অন্তর্ভুক্ত ছিল। শুরুতে অনেক হংকংবাসী হংকঙের চীনে মিশে আসার বিষেয়ে উৎসাহী ছিল।
তবে, হংকঙের বাসিন্দা এবং মূল ভূখণ্ড, বিশেষত কেন্দ্রীয় সরকারেরমধ্যে ১৯৯৭ সাল। থেকে, বিশেষ করে ২০০০-এর প্রথম দশকের শেষের দিকে এবং ২০১০-এর দশকের শুরুতে উত্তেজনা দেখা দিয়েছে। বিবাদ বেঁধেছিল যে কারণে তার মধ্যে আছে— ব্যক্তিগত ভ্রমণ পরিকল্পনা এবং গুয়াংঝোউ-শেনজেন-হংকং এক্সপ্রেস রেল লিঙ্ক। কিছু লোক ২০১১ সালে যুক্তি দেখায় যেহেতু হংকং সরকার বেসিক আইনের ২৩ নম্বর অনুচ্ছেদ কার্যকর করার জন্য প্রয়োজনীয় আইন প্রণয়ন করতে ব্যর্থ হয়েছিল, তাই হংকঙের প্রতি বেজিংয়ের অপেক্ষাকৃত ‘দূরে থাকো’ পদ্ধতির নাটকীয় পরিবর্তন হয়েছে। তাদের মত এই চীনের কৌশল হলো হংকং ও চীনের বাকি অংশগুলির মধ্যে সীমানা মুছে ফেলা; মূল ভূখণ্ডের চীন সরকারের কিছু প্রতিনিধি হংকঙের রাজনৈতিক এবং আইনি ব্যবস্থার উপর আক্রমণ চালাচ্ছে। আরও আনুষ্ঠানিকভাবে, কেন্দ্রীয় সরকার ২০১৪ সালে একটি প্রতিবেদন প্রকাশ করেছিল যাতে দাবি করা হয় যে হংকঙের বিচার বিভাগকে সরকারের অধীনস্থ হতে হবে, স্বতন্ত্র নয়। বেসিক আইন এবং চীন-ব্রিটিশ যৌথ ঘোষণাপত্র হংকঙের সার্বজনীন ভোটাধিকারের লক্ষ্যে নির্বাচনী ব্যবস্থা বিকাশ করার চুড়ান্ত আশ্বাস দেয় তবে আইন পরিষদের অধিকতর গণতন্ত্রপন্থীরা একটু একটু করে সংস্কারের পদ্ধতি মানেনি। কেন্দ্রীয় সরকার যখন এগিয়ে এল তখন প্যান-ডেমোক্র্যাটরা ‘সব-চাই-বা-কিছুচাই-না’ কৌশল অবলম্বন করেছিল যার ফলে ২০০৮-২০১৮ সালের মধ্যে নির্বাচনের আশা শেষ হয়ে যায়।
হংকঙের বিক্ষোভকারীরা ২০১২ জাতীয় দিবসে কমিউনিস্ট পার্টির সাধারণ সম্পাদক শি জিনপিংয়ের প্রতিকৃতিতে ডিম ছেড়ে। ব্রিটিশ উপনিবেশ এবং আন্তর্জাতিক শহর হিসাবে হংকঙে অতীতকাল থেকে আন্তর্জাতিক সাংস্কৃতিক মূল্যবোধ রয়েছে, একই সঙ্গে অনেকগুলি ঐতিহ্যবাহী চীনা সাংস্কৃতিক মূলবোধ ধরে রেখেছে, তারা মূল ভূখণ্ডের চীনের বহু অংশের সংস্কৃতির থেকে একেবারে বিপরীতে রয়েছে; মূলচীনে বহু আন্তর্জাতিক সাংস্কৃতিক মান কখনই শেকড় গাড়তে পারেনি, বরং মূল চীনা ধারার সাংস্কৃতিক মূল্যবোধ আরও বেড়েছে। হংকং একটি বহুজাতিক সমাজ, মূল ভূখণ্ডের থেকে। তার জাতি-ভাষা-সংস্কৃতি ভিন্ন। হংকঙের আছে খুব উন্নত অর্থনীতির সঙ্গে খুব উচ্চমানের জীবনযাত্রা, মূল ভূখণ্ডের চীনের তুলনায় স্বাস্থ্যবিধি এবং সামাজিক ন্যায়-অন্যায় সম্পর্কিত ভিন্ন মূল্যবোধ। সাংস্কৃতিক ও অর্থনৈতিক পার্থক্য হংকং এবং মূল ভূখণ্ডের চীনের মধ্যে দ্বন্দ্বের প্রাথমিক কারণ, তাছাড়া মূল ভূখণ্ড থেকে আগন্তুকের সংখ্যা বৃদ্ধি উত্তেজনা সৃষ্টি করেছে। হংকং ট্যুরিজম বোর্ডের দেওয়া পরিসংখ্যান অনুসারে ২৮ জুলাই ২০০৩-এ ‘ব্যক্তিগত পর্যটন পরিদর্শন’ প্রকল্প কার্যকর হওয়ায় মূল ভূখণ্ডের দর্শনার্থীর সংখ্যা ২০০২ সালে ৬৮.৩ লক্ষ থেকে বেড়ে ২০১৩ সালে ৪ কোটি ৭০ লক্ষ হয়েছে। মূল ভূখণ্ড এবং হংকঙের বিভিন্ন খাতে যেমন স্বাস্থ্য এবং শিক্ষা খাতে ব্যয় যথাক্রমে দুই অংশের সম্পদ বণ্টনের সঙ্গে জড়িত।
২০১১-র ৫ ফেব্রুয়ারি হংকঙের টুর গাইডলি কিয়াঝেনের সঙ্গে মূল ভূখণ্ডের তিন পর্যটকদের ঝগড়া হয়েছিল। লি পর্যটকদের অপমান করে তাদের ‘কুকুর’ বলেছিলেন। পর্যটকরা ক্ষেপে গেলে তা শেষ পর্যন্ত। লড়াইয়ে পরিণত হয়। লি এবং তিনজন পর্যটককে শারীরিক নির্যাতনের জন্য পুলিশ গ্রেপ্তার করেছিল।
২০১৯ সালে এপ্রিল মাসে প্রত্যর্পণ বিল প্রবর্তিত হয়েছিল। এর ফলে বিক্ষোভের সূচনা হয়। এই বিলের বলে নির্দিষ্ট পরিস্থিতিতে অপরাধমূলক সন্দেহভাজনদের মূল ভূখণ্ড চীনে প্রত্যর্পণ করার অনুমতি দেওয়া হয়। বিরোধীরা বলেছে যে এর দরুণ হংকংবাসীরা অবিচার ও হিংস্র আচরণের মুখে পড়বে। এই বিলের কারণে হংকঙের উপর চীনের প্রভাব বাড়বে, তারা হংকঙের নেতা, কর্মী ও সাংবাদিকদের নিশানা করতে এর অপব্যবহার করবে। কয়েক হাজার মানুষ রাস্তায় নেমেছিল। কয়েক সপ্তাহ বিক্ষোভের পরে, নেতা ক্যারি ল্যাম শেষ পর্যন্ত বলেছিলেন যে এই বিলটি অনির্দিষ্টকালের জন্য স্থগিত করা হবে।
কীভাবে বিক্ষোভ বাড়ল?
বিক্ষোভকারীরা বিলটি পুনরুদ্ধার করতে পারে বলে আশঙ্কা করেছিল, তাই বিক্ষোভ অব্যাহত রেখে, এটা পুরোপুরি প্রত্যাহারের আহ্বান জানিয়েছিল। ততক্ষণে পুলিশ এবং বিক্ষোভকারীদের মধ্যে সংঘর্ষ আরও ঘন ঘন এবং হিংস্র হয়ে উঠেছিল। জুলাইয়ের বিক্ষোভকারীরা সংসদে হামলা চালিয়ে এর কিছু অংশকে বিদ্রুপ করে। আগস্টে এক প্রতিবাদকারীর চোখে আঘাত লাগে, সংহতি দেখানোর জন্য লাল বর্ণের চোখের পাচ পরে প্রতিবাদীরা বিক্ষোভ দেখায়। আগস্টে হংকং আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরে বিক্ষোভ কর্মসূচিতেও নতুন করে সংঘর্ষ বেঁধেছিল এবং কয়েকশো উড়ান বাতিল করা হয়েছিল। বিলটি শেষ পর্যন্ত সেপ্টেম্বরে প্রত্যাহার করা হয়েছিল, তবে বিক্ষোভকারীরা বলেছিলেন। এটি খুব অল্প, খুব দেরিতে।
বিক্ষোভ অব্যাহত রয়েছে, হিংসা। ক্রমবর্ধমান। ১ অক্টোবর, যখন চীন। কমিউনিস্ট পার্টিরশাসনের ৭০ বছর উদ্যাপন করছিল, তখন হংকংয়ে সবচেয়ে হিংসাত্মক এবং বিশৃঙ্খলাপূর্ণ ঘটনা ঘটেছিল। বিক্ষোভকারীরা লাঠি, পেট্রোল বোমা এবং অন্যান্য জিনিস ছুঁড়ে পুলিশের সঙ্গে সংঘর্ষে জড়ায়। ১৮ বছর বয়সী একজনের বুকে গুলি লেগেছিল। এর প্রতিক্রিয়ায় সরকার প্রতিবাদকারীদের মুখোশ পরা নিষিদ্ধ করেছিল। এই নিষেধাজ্ঞা অনেক প্রতিবাদী কর্মী অস্বীকার করে চলেছে।
নভেম্বরের প্রথম দিকে, বেজিংপন্থী একজন আইনজীবীকে এক ব্যক্তি সমর্থক হওয়ার ভান করে রাস্তায় ছুরিকাঘাত করেছিল। এক সপ্তাহ পরে, যখন কর্মীরা একটি সড়ক অবরোধ করার চেষ্টা করছিল তখন এক পুলিশ এক প্রতিবাদকারীকে কাছ থেকে গুলি করে এবং পরে সেদিন আরেকজনকে সরকারবিরোধী বিক্ষোভকারীরা আগুন ধরিয়ে দেয়। দুজনকেই হাসপাতলে চিকিৎসা করতে হয়েছিল। আন্দোলনকারীরা কী চায়?
কিছু প্রতিবাদকারী এই নীতি গ্রহণ। করেছেন : ‘পাঁচটি দাবি, একটিও কম নয়!’ দাবিগুলো হলো—
বিক্ষোভগুলিকে ‘দাঙ্গা’ হিসেবে চিহ্নিত করা যাবে না।
গ্রেপ্তারকৃত বিক্ষোভকারীদের জন্য ক্ষমা।
পুলিশের বর্বরতার অভিযোগে একটি স্বাধীন তদন্ত।
সম্পূর্ণ সর্বজনীন ভোটাধিকার প্রয়োগ।
পঞ্চম দাবি, বিল প্রত্যাহার, ইতিমধ্যে পূরণ করা হয়েছে।
কেউ কেউ ক্যারি লামের পদত্যাগও চান, তাকে তারা বেজিংয়ের পুতুল হিসেবে দেখেন। হংকং আন্দোলনকে সমর্থন করে বিশ্ব জুড়ে প্রতিবাদ ছড়িয়ে পড়েছে। যুক্তরাজ্য, ফ্রান্স, মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র, কানাডা এবং অস্ট্রেলিয়ায় বিক্ষোভ সমাবেশ অনুষ্ঠিত হয়েছে। অনেক ক্ষেত্রেই আবার বিক্ষোভকারীদের সমর্থনকারী লোকজন ও বেজিংপন্থী সমাবেশগুলির মুখোমুখি সংঘর্ষ হয়েছে।
চীনের রাষ্ট্রপতি শি জিনপিং বিচ্ছিন্নতাবাদীদের সতর্ক করেছেন, চীনকে বিভক্ত করার যে কোনও চেষ্টা করলে ‘মেরে হাড় গুঁড়ো করে দেব।
হংকঙের নিজস্ব বিচার বিভাগ এবং মূল ভূখণ্ড চীন থেকে পৃথক আইনি ব্যবস্থা রয়েছে। এই অধিকারগুলির মধ্যে রয়েছে সমাবেশের স্বাধীনতা এবং বাকস্বাধীনতা। তবে এই স্বাধীনতাগুলি বেসিক আইনের মেয়াদ ২০৪৭ সালে শেষ হয়ে যাবে, তখন হংকঙের অবস্থা কী হবে তা পরিষ্কার নয়।
সুদীপনারায়ণ ঘোষ