কেন্দ্রীয় সরকার নতুন শিক্ষানীতি ঘােষণা করেছে। সত্যি কথা বলতে কী, জাতীয় শিক্ষানীতি বলতে যা বােঝায় তা আমাদের কোনােকালেই ছিল না। যা ছিল তা হলাে ১৯৮৪ সালে রাজীব গান্ধী সরকারের আমলে পাশ হওয়া কেন্দ্রীয় শিক্ষানীতি, যা ১৯৯২ সালে সামান্য কিছু সংশােধন হয়। একেই এতদিন জাতীয় শিক্ষানীতির তকমা দিয়ে চালানাে হচ্ছিল, কিন্তু রাজ্যে রাজ্যে তার যে বৈষম্য তাও প্রকটিত হয়েছিল। বিশেষ করে প্রাথমিক শিক্ষায় যে অসাম্য, যাও-বা চেপে রাখা সম্ভব হচ্ছিল, কিন্তু স্কুল শিক্ষা ও তার হাত ধরে উচ্চশিক্ষায় এই বৈষম্য বেআব্র হয়ে পড়েছিল। যাদের অভিভাবককের কর্মসূত্রে বদলির কারণে স্কুলজীবন একাধিক রাজ্যে অতিবাহিত হয়েছে বা যারা উচ্চশিক্ষার কারণে ভিন রাজ্যের কলেজ-বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়তে গিয়েছেন, তারা খুব ভালােভাবেই জানেন অপরিচিত শিক্ষা-ব্যবস্থা পদ্ধতির সঙ্গে মানিয়ে নিতে তাদের কতটা নাজেহাল হতে হয়েছিল। বহু ছাত্রের উচ্চশিক্ষা সম্পূর্ণ হয়নি শুধুমাত্র রাজ্যে রাজ্যে শিক্ষানীতির এই বৈষম্যের কারণে। অথচ রাজীব গান্ধী সরকারের শিক্ষাক্ষেত্রে নয়া জাতীয় নীতি প্রণয়নের প্রাথমিক লক্ষ্যই ছিল রাজ্যে রাজ্যে শিক্ষাব্যবস্থার অসাম্য দূর করা ও সব রাজ্যে শিক্ষার সমঅধিকার প্রতিষ্ঠিত করা।
কিন্তু কার্যক্ষেত্রে তা কার্যকর করা অসম্ভব হয়েছিল। কারণ সরকারের সার্বিক নীতিতেই অসাম্য হয়ে গিয়েছিল। এক দেশ দো বিধান দো নিশান’-এর যে প্রথা স্বাধীনতা-পরবর্তী সময়ে কার্যকর হয়েছিল, দেশের শিক্ষানীতিও তার ব্যতিক্রম হতে যাবে কোন। দুঃখে! সুতরাং গলদটা ছিল দেশের সরকারকে স্বাধীনতা-পরবর্তী সময় সুদীর্ঘকাল যারা পরিচালনা করেছিলেন তাদের নীতির মধ্যেই। স্বাধীনতার পর দেশের প্রথম শিক্ষামন্ত্রী মৌলনা আবুল কালাম আজাদ দেশে অভিন্ন শিক্ষা-ব্যবস্থা প্রণয়নের লক্ষ্যে ১৯৪৮-৪৯ সালে বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষা কমিশন, ১৯৫২-৫৩ সালে মাধ্যমিক শিক্ষা কমিশন চালু করেছিলেন। কিন্তু এই কমিশনগুলােকে। কখনই কাজের পূর্ণ স্বাধীনতা দেওয়া হয়নি। কমিশন তার মতাে করে নামমাত্র কখনও। কোনাে নীতি (পসিসি) নিলেও তার প্রণয়নের দায়িত্ব মূলত বর্তাতাে সংশ্লিষ্টরাজ্য। সরকারের ওপর। ফলে অভিন্ন শিক্ষাব্যবস্থা শব্দটা শুনতে গালভরা হলেও তা কার্যকর। করা বাস্তবে কোনােদিনই সম্ভবপর হয়নি। এছাড়া অন্যান্য অন্তরায়ও ছিল।
আবুল কালামের গলদটা আর একটা জায়গায় ছিল। তাঁর শিক্ষানীতিতে প্রাথমিক শিক্ষা আদপেই গুরুত্ব পায়নি। তা মিলিয়ে। দেওয়া হয়েছিল স্কুলশিক্ষার সঙ্গে। আলাদা করে কোনও গুরুত্ব আরােপ করা হয়নি। তার ফল কী হয়েছে স্বাধীনতার এত বছর পরে ভারতবাসী হাড়ে হাড়ে টের পাচ্ছে। ভারতের মতাে দারিদ্র-কবলিত দেশে। প্রাথমিক শিক্ষাটুকুও বহু মানুষের নেই। এই অশিক্ষার হাত ধরেই কর্মসংস্থানে তাদের প্রতি বঞ্চনা, বৈষম্য প্রকট হয়েছে, একটা শ্রেণী তার সুযােগ সম্পূর্ণরূপে নিয়েছে। এখন কথায় কথায় আম্বানি- আদানিদের জুজু দেখানাে হয়, আর এটা যারা দেখান। তাদের রাজনৈতিক পূর্বসূরিরা ভারতবর্ষের মানুষকে প্রজন্মের পর প্রজন্ম ধরে প্রাথমিক শিক্ষার অধিকার থেকে বঞ্চিত করে, তাদের ভাষাতেই বলি মানুষকে পুঁজির দাস’ কেন। বানানাে হলাে, কাদের স্বার্থে? সেটা জানার অধিকার কি দেশবাসীর নেই? তাদের ‘দাস। ক্যাপিটাল’-এর কোন অনুচ্ছেদে ক্রীতদাস তৈরির এই মহার্ঘ উপায় বর্ণিত আছে সেটা জানতে চাইলে তারা রীতিমতাে তেড়ে আসবেন জানি, কিন্তু ইতিহাস প্রমাণ দেবে মানুষের অসহায়তা, দরিদ্রতা এবং অশিক্ষার সুযােগ নিয়ে দেশে দেশে ক্ষমতা কায়েমের রহস্যটা এখন ওপেন সিক্রেট। স্বাধীনতার পর নেহর সরকার যতই কমিউনিস্ট বিরােধিতার নাটক করুক এবং এটাও এখন সবাই জানেন নেহরু ভারতের কমিউনিস্ট পার্টির সাংগঠনিক বিরােধী হতে পারেন। কারণ ‘শুয়ােরের খোঁয়াড়ে’ তাে আর যাই করুক গণতান্ত্রিক সহাবস্থান হয় না। কিন্তু মতাদর্শগতভাবে নেহর একজন সাচ্চা কমিউনিস্টই ছিলেন এবং সরকারি শিক্ষানীতি তার সরকার সেই ভাবেই প্রণয়ন করেছিল, শিক্ষামন্ত্রীর ভূমিকাটা এখানে নগণ্য।
নেহর গত যাবার পর তৎকালীন কেন্দ্রীয় সরকারের এই উচ্চশিক্ষায় জোর আরও বাড়ে। কোনাে সন্দেহ নেই দেশের শ্রীবৃদ্ধি নিঃসন্দেহে উচ্চশিক্ষার ওপর নির্ভর করে। তবে এর মধ্যে সরকারের দেশের শ্রীবৃদ্ধির আকাঙ্ক্ষা যত না ছিল, তার থেকেও বেশি ছিল নিজের নাম কেনার আকাঙ্ক্ষা যে, দেখ তৃতীয় বিশ্বের সদ্য স্বাধীনতা পাওয়া একটা দেশ, তার সরকারের সুযােগ্য পরিচালনায় শিক্ষাব্যবস্থা কেমন উন্নতি লাভ করেছে! এতে ঘটেছে আরও বিপত্তি। দেহের সব রক্ত যেমন মুখে জমা হলে তাকে সুস্বাস্থ্যের লক্ষণ বলা যায় না, তেমনি ১৯৬৪-৬৬ সালে বিশ্ববিদ্যালয় মঞ্জুরি কমিশন (ইউজিসি), কোঠারি কমিশন তৈরি হলেও প্রাথমিক শিক্ষার হাল অতি শােচনীয় থেকে বিন্দুমাত্র পরিবর্তন হয়নি। সরকার মুখে প্রাথমিক শিক্ষাব্যবস্থাকে গুরুত্ব দেবার কথা বললেও তা যে নেহাত ছিল কথার কথা তা সবাই বুঝতে পেরেছিল। শিক্ষা-কমিশননের সুপারিশে শুধুমাত্র স্কুল শিক্ষা, যার মধ্যে প্রাথমিক শিক্ষাও ছিল তা ১০+২ মাপকাঠিতে মান্যতা পেয়েছিল সর্বত্র। আবার ১০ বছরের মধ্যে চার বছর প্রাথমিক শিক্ষার জন্য বরাদ্দ ছিল। এতেও রয়ে গেছিল বহু গলদ, যেমন মাধ্যমিকের পর এখানে উচ্চমাধ্যমিকের স্তরকে এখন। হাইস্কুল বলা হয়। আবার মহারাষ্ট্র সমেত কিছু রাজ্যে সেটাই ‘জুনিয়ার কলেজ। অবশ্য আগে পশ্চিমবঙ্গ উচ্চমাধ্যমিক স্তরকে প্রি-ইউনিভার্সিটি নামে অভিহিত করার চল ছিল। এগুলাের স্বাধীনতা পরবর্তী সময়ে। সময়ে বহু পরিবর্তন হয়েছে। তার ইতিহাস স্বল্প পরিসরে দেওয়া সম্ভব নয়। কিন্তু একথা ঠিক প্রাথমিক শিক্ষা ও স্কুলশিক্ষায় পদ্ধতিগত কিছু সাম্য পরবর্তীকালে সাধিত হলেও নামের ফেরে ভিন রাজ্যে ছাত্র-ছাত্রীরা গেলে তা জীবন অতিষ্ঠ করে তুলেছিল। প্রত্যেক রাজ্যের ছাত্র-ছাত্রীদের ক্ষেত্রেই এটা প্রযােজ্য। যাই হােক, উ চচ্চশিক্ষায়, বিশেষ করে কারিগরি শিক্ষাক্ষেত্রে বিগত শতাব্দীর ষাটের দশকে আইআইটির মতাে বিজ্ঞানশিক্ষার প্রথম সারির আন্তর্জাতিক খ্যাতিসম্পন্ন প্রতিষ্ঠানের যেমন জন্ম হয়েছে বা ন্যাশনাল কাউন্সিল অব এডুকেশনাল রিসার্চ অ্যান্ড ট্রেনিং (এনসিইআরটি) মাধ্যমে যেমন স্কুলশিক্ষায় কিছু সংস্কার করার চেষ্টা হয়েছিল। আবার একই সঙ্গে জওহরলাল নেহরু বিশ্ববিদ্যালয় নামক সার্থকনামা প্রতিষ্ঠান স্থাপনের মধ্যে দিয়ে দেশদ্রোহী উৎপাদনের কারখানাও নির্মাণ করার চেষ্টা হয়েছিল, যে বিষবৃক্ষের ফল আজও ভারতের অভ্যন্তরীণ সুখ-শান্তি ও নিরাপত্তা বিঘ্নিত করে তুলেছে। জেএনইউ প্রতিষ্ঠার মূল উদ্দেশ্যই ছিল রাষ্ট্রের বিরােধিতা, সঠিকভাবে বললে নেহর পরিবারের ও নেহরুর মতাদর্শ (অর্থাৎ কমিউনিজম) কায়েম করা। যে কারণে বিরােধী মতাদর্শের পড়ুয়া জেএনইউতে বিশেষ করে আর্টস ফ্যাকাল্টিতে পড়লেও তার মতাে কোনােদিনই গুরুত্ব পায়নি। বরং হাবেভাবে এটাই দেখানাে হয়েছে, জেএনইউ ভারতবর্ষের তথাকথিত উচ্চশিক্ষার নিয়ন্ত্রক এবং যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয়, হায়দরাবাদ বিশ্ববিদ্যালয় ইত্যাদির মতাে এককালের দেশপ্রেমী পড়ুয়া উৎপাদনের কেন্দ্রকেও সেই ছাঁচেই ঢালাই করা হয়েছে। এতে করে নেহরু পরিবার ও তার লেজুর কমিউনিস্ট সঙ্গীদের আরও একটা লাভ হয়েছে। ভারতের প্রকৃত ইতিহাস ভুলিয়ে দিতে, দেশের স্বাধীনতা সংগ্রামে জওহরলাল নেহর অপকীর্তি ও কমিউনিস্টদের নজিরবিহীন বিশ্বাসঘাতকতা থেকে দৃষ্টি ফেরাতে কমিউনিস্ট -সৃষ্ট মনগড়া দেশদ্রোহিতা-সূচক কাহিনিকে এবং দেশের স্বাধীনতা-সংগ্রামীদের অপমানকারী, দেশের নবজাগরণের মনীষীদের প্রতি ঘৃণা সৃষ্টিকারী ‘কৃত্রিম ইতিহাস আবিষ্কার’কেই মূলধারার ইতিহাস বলে এতকাল স্বীকৃতি দেওয়ার চেষ্টা হয়েছে। কংগ্রেস-সৃষ্ট তথাকথিত ‘জাতীয় শিক্ষানীতি’র এটাই সবচেয়ে বড়াে বিপর্যয়।
যাইহােক, ১৯৬৮ সালে কোঠারি কমিশনের রিপাের্ট ও পরামর্শের ওপর ভিত্তি করে ইন্দিরা গান্ধীর সরকার শিক্ষাব্যবস্থায় কিছু পরিবর্তন সাধন করে ও সেইসঙ্গে সংস্কারও করে। জাতীয় শিক্ষানীতি’বলতে যা বােঝায় তা না হলেও অন্তত সুনির্দিষ্ট নীতির ভিত্তিতে শিক্ষাক্ষেত্র এর ফলে পরবর্তী কিছু দিন পরিচালিত হতে পেরেছিল। কারণ এর কিছু সদর্থক দিক ছিল। ১৪ বছর পর্যন্ত শিক্ষা মৌলিক অধিকার, শিক্ষকদের শিক্ষাদানের প্রশিক্ষণ, শিক্ষাদানের মাধ্যম হিসেবে ‘তিন ভাষা’ ইংরেজি, হিন্দি ও আঞ্চলিক ভাষাসূত্র ব্যবহার করা— এই গুরুত্বপূর্ণ সিদ্ধান্তগুলি কার্যকর করেছিল ইন্দিরা গান্ধীর সরকার। তবে এই সরকারের দৃঢ়তার অভাবে শেষােক্ত সিদ্ধান্ত নিয়ে পরবর্তীকালে অনভিপ্রেত বিতর্কের জন্ম হয়েছে এবং আজ যাকে ব্যবহার করে মানুষের সেন্টিমেন্টকে কাজে লাগিয়ে জাতিদাঙ্গা তৈরির চেষ্টা হচ্ছে, দেশদ্রোহিতার নতুন আঙ্গিকও বােধহয় সৃষ্টি হচ্ছে। ভারতীয় ভাষাগুলির মধ্যে সর্বাধিক প্রচারিত ভাষা হিসেবে ঠিক হয়েছিল। ইংরেজির পর হিন্দিকেই শিক্ষার মাধ্যমের মাপকাঠি করা হবে সরকারি ভাষা হিসেবে ঘােষণা করে, কিন্তু গুরুত্ব পাবে আঞ্চলিক ভাষাও। কিন্তু তৎকালীন সরকারের প্রচার-ব্যবস্থার গলদে প্রথমে দক্ষিণ ভারতে, আজ পশ্চিমবঙ্গে হিন্দিকে রাষ্ট্রভাষা হিসেবে দেখিয়ে হিন্দি-বিদ্বেষ ছড়ানাে হচ্ছে। সুপরিকল্পিতভাবে। এছাড়াও কোঠারি কমিশনের সুপারিশ ও তার সরকারের কার্যকরী করার সদিচ্ছার মধ্যেও তফাত ছিল। কমিশন সংস্কৃতের হৃতগৌরব পুনরুদ্ধার করতে সুপারিশ করেছিল। কিন্তু কংগ্রেস সরকারের ঔদাসীন্যে পরবর্তীকালে তা মৃতভাষায় পর্যবসিত। কমিশনের ক্ষমতা সুপারিশ করা পর্যন্ত, কিন্তু তা কার্যকর করার দায়িত্ব সরকারের ঘাড়েই বর্তায়। ইন্দিরা গান্ধীর সরকার কমিশনের সুপারিশ কার্যকরী করার চেয়ে গতানুগতিতেই বেশি নজর দিয়েছিল। তাই ১০+২+৩ পদ্ধতি ব্যতীত কোঠারি কমিশনের গুরত্ব এদেশীয় শিক্ষাব্যবস্থায় আর সেভাবে বােঝা যায়নি।
মূলত কোঠারি কমিশনের সুপারিশ ব্যর্থ হওয়ার জন্যই রাজীব গান্ধীর আমলে শিক্ষাক্ষেত্রে জাতীয় নীতি গ্রহণের পরিকল্পনা করা হয়। সেই মােতাবেক ১৯৮৬ সালে তথাকথিত জাতীয় শিক্ষানীতি ঘােষিত হয়। প্রধানত শিক্ষায় সমানাধিকার অর্থাৎ নারী শিক্ষা, তপশিলি জাতি-উপজাতিদের শিক্ষার বিষয় সুনিশ্চিত করাই ছিল এর প্রাথমিক লক্ষ্য। এবং দূরশিক্ষা-ব্যবস্থা লাগু করে শিক্ষার সুযােগ সম্প্রসারিত (যার ফলে দূরশিক্ষায় দেশের সর্ববৃহৎ প্রতিষ্ঠান ইগনু মানে ইন্দিরা গান্ধী ন্যাশনাল ওপেন ইউনিভার্সিটির জন্ম) করা ছাড়া কেন্দ্রীয় সরকারের ‘৮৬ সালে গৃহীত জাতীয় শিক্ষানীতির আর সেরকম কোনাে সার্থকতা নেই। পরে নরসীমা রাওয়ের প্রধানমন্ত্রিত্বের আমলে এর কিছু পরিবর্তন হয়।
এই মােটামুটি আমাদের জাতীয় শিক্ষার চালচিত্র। মােদী সরকার ক্ষমতায় আসার পর থেকেই সচেষ্ট ছিল শিক্ষাক্ষেত্রে জাতীয় নীতি’ তৈরি করে তা অনুসরণ করার। গত ছ’বছরে এই নিয়ে কম আলাপ-আলােচনা হয়নি। তার মধ্যে বিশেষ উল্লেখযােগ্য ২০১৫ সালে ৭-৮ নভেম্বরে রামকৃষ্ণ মিশন ইনস্টিটিউট অব কালচারে জাতীয়তাবাদী ও পৃথিবীর মধ্যে সর্ববৃহৎ ছাত্র-সংগঠন অখিল ভারতীয় বিদ্যার্থী পরিষদের উদ্যোগে আয়ােজিত জাতীয় শিক্ষানীতি বিষয়ে দুদিনের একটি জাতীয় আলােচনাচক্র। এছাড়াও আরও অনেক আলাপআলােচনার পরই কেন্দ্র সরকার এনিয়ে সুচিন্তিত পদক্ষেপ করেছে।
এতে যথারীতি কমিউনিস্টরা শিক্ষাক্ষেত্রে গৈরিকীকরণের জুজু দেখছেন। তা দেখুন, তাতে আপত্তি নেই। কারণ এতদিনের সযত্নে লালিত ভারত ইতিহাসের মিথ্যার ওপর নির্মিত সৌধ ভেঙে পড়লে, তাদের এই হাঁসফঁস অবস্থায় আশ্চর্যের কিছু নেই। বিশেষজ্ঞরা খুঁটিনাটি বিচার বিশ্লেষণ করে দেখবেন, কোনােটা খুব ভালাে হলাে, কোনােটা ততটা নয়। আইন পাশ হতে দিতে হবে দীর্ঘ সংসদীয় পথ পাড়ি। তবে এখনই হলফ করে বলা যায় কেন্দ্রীয় সরকার ২০২৫ সালের মধ্যে যেভাবে ভারতবর্ষের সব শিশুদের কাছে প্রাথমিক শিক্ষার সুযােগ পৌঁছে দিতে বদ্ধপরিকর, তা বাস্তবায়িত করা গেলে জগৎসভায় শ্রেষ্ঠ আসন ভারত অবিলম্বে নেবে। ভারতের বারাে বছরের বিদ্যালয় শিক্ষা আগে যেখানে মােটামুটি তিনটি ভাবে বিভক্ত ছিল, সেখানে নতুন শিক্ষানীতিতে একে পাঁচটি ভাগে বিভক্ত করে ছাত্র-ছাত্রীদের ভিতটা পাকাপােক্ত করার দিকে নজর দেওয়া হয়েছে। পাশাপাশি প্রভূত সংস্কার করা হয়েছে উচ্চশিক্ষায়, দৈনিক সংবাদপত্রের মাধ্যমে যা আপনারা ইতিমধ্যেই অবগত হয়েছেন।
সরকার কতটা সফল হবে, তা হয়তাে আগামীদিনই বলবে। এই ‘ভারতের জগৎসভায় শ্রেষ্ঠ আসন’ কথাটা শুনলে কমিউনিস্টরা কেমন যেন অসহিষ্ণু হয়ে পড়েন। সারা ভারতে ১.৫ শতাংশও ভােট নেই, মােদী সরকার যা শুরু করেছে, তাতে জেএনইউয়ের মৌরসিপাট্টাও গেল বলে! তাই অক্ষমের আর্তনাদের মতাে জগৎসভায় শ্রেষ্ঠ আসন’কথাটার প্রতি কটাক্ষের, ব্যঙ্গের আবরণে বিষ উগরে দেওয়াই তাদের কাজ এবং সােশ্যাল মিডিয়ায় তারা তা করছেনও। কিন্তু এটা অনস্বীকার্য যে, এক দেশ-এক শাসনব্যবস্থায় একটি জাতীয় শিক্ষানীতির বিশেষ তাৎপর্য আছে। এক দেশ, এক নীতি ইতিপূর্বে কোনাে কেন্দ্রীয় সরকার চালু করতে পারেনি বলেই জাতীয় শিক্ষানীতি কথার কথা হয়েই থেকে গেছে। তাই মােদী সরকারের জাতীয় শিক্ষানীতিকে সরকারের সামগ্রিক নীতির সঙ্গে আলাদা করে দেখা যাবে না। ভারতকে জগৎশ্রেষ্ঠ করার যে সামগ্রিক প্রক্রিয়া শুরু হয়েছে, জাতীয় শিক্ষানীতি তার একটি পদক্ষেপ মাত্র। এতে করে সবচেয়ে অসুবিধেয় পড়েছে ভারতকে যারা এক দেখতে চায় না, তারা ‘টুকরে টুকরে’ গােষ্ঠী হিসেবেই তাদের সবাই চেনেন। তাদের শয়তানি, দেশবিরােধী বুদ্ধি প্রথম ধাপেই বুঝে ফেলেছে এক দেশ এক নীতির লক্ষ্যেই কেন্দ্র সরকারের এই জাতীয় শিক্ষানীতি, আর তাতেই তারা প্রমাদ গুণেছে। দেশকে টুকরাে করার কাজে না লাগলে, দেশকে অস্থির করার কাজে না লাগলে ‘টুকরে’ গােষ্ঠীটাই তাে তুলে দিতে হয়। তাই অস্তিত্ব বিলােপের এই আশঙ্কা গৈরিকীকরণের ধুয়াে তুলতে বাধ্য করেছে তাদের।
অভিমন্যু গুহ