ছোটোবেলার কিছু বই এবং বন্ধুদের কাছ থেকে কিছু জোগাড় কয়েক বছর আগে একটি লাইব্রেরি গড়ে তুলেছিলাম। লক্ষ্য ছিল পাঠক্রমে যুক্ত থাকা বিষয়গুলি, যা সমাজ ও রাষ্ট্রকে জানার জন্য অত্যন্ত প্রয়ােজনীয়, তাতে ছােটোদের আগ্রহী করে তােলা এবং মানসিক বিকাশের জন্য সাংস্কৃতিক রুচির পরিবর্তন করা। এজন্য নাচ, গান, কবিতা বলা, ঘুরতে নিয়ে যাওয়া আরও অনেক কিছুর ব্যবস্থা হলাে। জোর দেওয়া হলাে ধ্রুপদী শিক্ষা ব্যবস্থায়। কারণ নিজের শিকড়কে না জানলে কোনাে শিক্ষাই সম্পূর্ণ হতে পারে না।
দরিদ্র পরিবারের শিশুদের জন্য সম্পূর্ণ নিঃশুল্ক এই ব্যবস্থা গড়ে তুলতে গিয়ে মূল প্রতিবন্ধক হয়ে দাঁড়ালাে অভিভাবকরা। শিশুর কাছে অভিভাবকের চাহিদা হলাে প্রাপ্ত নম্বর।নাচ, গান নাটক, ছবি আঁকা, খেলাধুলা বা দেশ-বিদেশের নানান ধরনের গল্পের বই পড়া আজকের দিনের অভিভাবক ও শিক্ষকদেরও একাংশ মনে করেন এতে সময় শুধু নষ্ট। আবার সংগীত ও নৃত্যের অনুশীলনে চটকদারি মাচার নৃত্য ধ্রুপদী তালিমে বাধা হয়ে দাঁড়ালাে। কবিতার চর্চায় প্রবল প্রতিবন্ধক আশির দশক থেকে আধুনিক কবিতার নামে ভারত ও ভারতীয় সংস্কৃতি-বিরােধী অসংখ্য রচনা। রবীন্দ্রনাথ ও সমতুল সাহিত্যকে সম্বল করে এই চর্চা চালাতে কালঘাম ছুটে গিয়েছে। প্রাচীন ভারতের ঐতিহ্য, বঙ্গ ও বাঙ্গালির গৌরব, স্বাধীনতা আন্দোলনের সঠিক ইতিহাস নিয়ে। চর্চা করতেও কম বিড়ম্বনার মধ্যে পড়তে হয়নি। তবে, ছােটোরা কিন্তু এই ব্যবস্থায় এতটাই আনন্দ পেয়েছে যে, বাড়ির সঙ্গে রীতিমতাে যুদ্ধ করে এই আয়ােজন তারা টিকিয়ে রেখেছে। পড়ার বইয়ের মধ্যে গল্পের বই রেখে গােগ্রাসে গিলেছে দেশ-বিদেশের নানা অজানা ঘটনা আর রহস্য। মায়ের রক্তচক্ষুকে উপেক্ষা করেই জেনে ফেলেছে। মহারাজা শশাঙ্ক থেকে প্রতাপাদিত্য, ফেলুদা থেকে বঙ্কিমে অবাধ বিচরণ করেছে। হইহই করে নিজের এলাকা থেকে পাশের এলাকা চেনার আনন্দ উপভােগ করেছে। শিশুর দৈহিক ও মানসিক বিকাশে অতীব সহায়ক ও অত্যন্ত স্বাভাবিক এই আনন্দগুলাে পেতে এত লুকোছাপার কারণ একটাই—এগুলাে সিলেবাস নেই।
সিলেবাসে না থাকা ও আরও নম্বরের প্রতিযােগিতায় বিকেলের খেলা ফেলে পিঠে ভারী বইয়ের বােঝা নিয়ে, এ মাস্টার থেকে। সে মাস্টারের বাড়ি ঘুরে বেড়াতে বেড়াতেই আগামী প্রজন্মের সময় চলে যায়। ডাক্তার, ইঞ্জিনিয়ার হওয়ার দৌড়ে ব্যর্থ ছেলে-মেয়েরা অন্ধকারে ভবিষ্যৎ হাতড়ে বেড়ায়। উচ্চশিক্ষায় বিষয় নির্বাচনে পছন্দের চেয়েও বেশি মূল্যবান হয়ে দাঁড়ায় প্রয়ােজন। আনন্দহীন বিষাদ নিয়ে বেড়ে ওঠা এই প্রজন্মই তাে কথায় কথায় অবাধ্য হয়ে ওঠে, ন্যায়নীতিবােধ না শেখায় অন্যায়ের সঙ্গে জড়িয়ে পড়ে অবলীলায়।
সত্তর বছর ধরে চলা ভ্রান্ত শিক্ষা ব্যবস্থার কলুষময় পরিবেশকে হেমন্তের হাওয়ায় শুদ্ধ করে দিল নতুন জাতীয় শিক্ষানীতি। মাতৃভাষা, সাহিত্য, সংগীত, দর্শন, শিল্প, নৃত্য, থিয়েটার, গণিত, পরিসংখ্যান, সমাজবিজ্ঞান , অর্থনীতি, ক্রীড়া ইত্যাদি বিষয়কে উচ্চশিক্ষার পাটক্রমে যুক্ত করা ভারতীয় সমাজ ব্যবস্থায় এক অভূতপূর্ব ঘটনা। এখন থেকে গুরুত্ব পাবে ভারতীয় কৃষ্টি, সংস্কৃতি, ইতিহাস ভাষা ইত্যাদি। সমাজ সেবা, পরিবেশ বিদ্যা, নীতিশিক্ষা ইত্যাদি প্রজেক্টের মাধ্যমে বিদ্যালয় স্তর থেকেই শিক্ষার্থীদের চেতনার উন্মেষ ঘটাতে সাহায্য করবে। এতে নম্বরও যােগ হবে। ফলে মধ্য চিন্তার অভিভাবকদের শ্যেনদৃষ্টির হাত থেকে রেহাই পাওয়া যাবে। আরও একটি বিষয় উল্লেখযােগ্য তা হলাে বিষয় নির্বাচন। এতদিন বিজ্ঞানের মেধাবী ছাত্র-ছাত্রী ইতিহাসের প্রতি ভালােবাসা থাকলেও নিয়মের বেড়াজালে পাঠে বঞ্চিত হয়েছে। এবার সেই অসাম্য ঘুচে গেল।
নতুন এই শিক্ষানীতিতে দেশর ধ্রুপদী বা ক্লাসিকাল ভাষা সংক্রান্ত কয়েকটি সুপারিশ করা হয়েছে। এবং এর মাধ্যমে সংস্কৃত, প্রাকৃত, পালির মতাে সুপ্রাচীন ধ্রুপদী ভাষা ছাড়াও বেশ কয়েকটি আধুনিক ভাষাকে পঠনপাঠনের আওতায় আনার কথা বলা হয়েছে। এই তালিকায় তামিল, তেলুগু, কন্নড়, মালায়ালাম ও ওড়িয়া ভাষার ক্লাসিকাল রূপ ও ক্লাসিক সাহিত্যকে বিদ্যালয় স্তরের পাঠক্রমে ঐচ্ছিক বিষয় হিসেবে রাখার কথা বলা হয়েছে। পাঁচ-পাঁচটি ভারতীয় ভাষা ছাড়াও একটি বিদেশি ভাষা ফারসিকেও এখানে অন্তর্ভুক্ত করা হয়েছে। অথচ এই তালিকায় বাংলাভাষার নাম নেই। বিভিন্ন মহলে এনিয়ে বিক্ষিপ্ত সমালােচনাও হচ্ছে। কংগ্রেস সাংসদ অধীর চৌধুরী থেকে বাম, অতিবাম অনেকেই এ নিয়ে সরব।
এখানে জেনে রাখা ভালাে যে, ক্লাসিকাল বা ধ্রুপদী তালিকায় বাংলাভাষা না থাকার বিষয়ে এই নীতির প্রস্তাবক কস্তুরীরঙ্গন কমিশনের কিছুই করার ছিল না। আধুনিক যে ভাষাগুলির ধ্রুপদী মর্যাদা লাভ হয়েছে তার মধ্যে তামিল সর্বপ্রথম ২০০৪ সালে এই স্বীকৃতি লাভ করে। এর পর ক্রমান্বয়ে সংস্কৃত(২০০৫), কন্নড়, তেলুগু (২০০৮), মালায়ালাম (২০১৩) এবং ওড়িয়া (২০১৫) এই স্বীকৃতি লাভ করে।
এখন প্রশ্ন, মনমােহন সিংহ সরকারের সংসদে যখন ভাষার ধ্রুপদীকরণে দক্ষিণের সাংসদরা সােচ্চার, তখন বাম শাসিত পশ্চিমবঙ্গের সাংসদ ও বুদ্ধিজীবীদের ভূমিকা কী ছিল? ২০০৪ সালে প্রথম ইউপিএ সরকারে মমতা ব্যানার্জি তখন মন্ত্রী, সংখ্যার বিচারে বামেরাও মন্দ ছিল না। লােকসভায় দুটি বামদলের মিলিত সদস্য ২৯। দ্বিতীয় ইউপিএ সরকারে লােকসভায় তৃণমূল ১৯ জন সদস্য নিয়ে যথেষ্টশক্তিশালী। বামেদের সদস্য সংখ্যা ১৬। অথচ এই আলােচনাচক্রে বাম বা তৃণমূল সাংসদের কোনাে ভূমিকা লিপিবদ্ধ নেই। সুনীল গাঙ্গুলির নেতৃত্বে স্বঘােষিত বুদ্ধিজীবীদের গুন্ডাবাহিনী তখন কলকাতার রাস্তায়, দোকানে দোকানে হিন্দি সাইনবাের্ড খুলতে ব্যস্ত। আরব সাম্রাজ্যবাদীদের অঙ্গুলিহেলনে দুই বঙ্গের সংযুক্তি ঘটিয়ে কী করে ‘বৃহৎ বাঙ্গলা’ গড়া যায়, সেই ষড়যন্ত্রে ধর্মতলায় তখন গড়ে উঠেছে ভাষাশহিদ স্মারক সমিতি।
অতএব, ভারতবর্ষে ধ্রুপদী ভাষা সংস্কৃতি চর্চায় সময় নষ্ট বলেই মনে করেছে পশ্চিমবঙ্গের এই দুর্বুদ্ধিজীবীর দল। কারণ, এই ধ্রুপদী ভাষার দাবি মানেই তাে প্রাচীন বঙ্গ সংস্কৃতিকে স্বীকার করা, যা আদপে সনাতন ভারতবর্ষ বা হিন্দু সংস্কৃতি। আরব সাম্রাজ্যবাদীদের পক্ষে তা মেনে নেওয়া অসম্ভব। এই কারণে চরম নিরুৎসাহ ও ঔদাসীন্য দেখিয়েছে বামপন্থী সরকার ও তাদের লালিত বুদ্ধিজীবীর দল।
শুধু ভাষা নয়, সুপ্রাচীন বঙ্গ সংস্কৃতি যা ভারতীয় নাট্যশাস্ত্রে উল্লিখিত আছে, সেই গৌড় বঙ্গের সংস্কৃতি ‘গৌড়ীয় নৃত্য সর্বজনমান্য নৃত্যগুরু ও গুণীজনের বিশেষ প্রশংসা লাভ করলেও রাজ্য সরকারের তরফে তাকে মেনে নিতে প্রবল অনাগ্রহ আমরা লক্ষ্য করেছি। কারণ একই হিন্দু সংস্কৃতির প্রচার চলবে না।
বঙ্গপ্রদেশ শুধুমাত্র ভাষার কারণের নয়, বরং দক্ষিণ ভারতের মতাে এই ভৌগােলিক অঞ্চলও সুপ্রাচীন সাংস্কৃতিক ঐতিহ্যের উত্তরাধিকারী। কমপক্ষ আড়াইহাজার বছরের ধারাবাহিক নিদর্শন রয়েছে তার। মহামুনি ভরতারনাট্যশাস্ত্রে উল্লেখ করেছেন, “অঙ্গা বঙ্গা উকলিঙ্গা বৎসাশ্চৈবৌড্রমাগধা।” নাট্যশাস্ত্রে নৃত্য সংস্কৃতির চারটি প্রকারের উল্লেখ আছে—আবন্তী, দাক্ষিণাত্য, পাঞ্চালী ও ঔড্রমাগধী। এই ঔড্রমাগধী নৃত্যধারাই গৌড়বঙ্গে প্রচলিত ছিল। শ্রীচৈতন্যদেবের সময়েও বঙ্গদেশে এর প্রভাব ছিল অপরিসীম। গৌরাঙ্গ মহাপ্রভু স্বয়ং এর প্রচারক ছিলেন। তিনি নিজেও ছিলেন একজন নৃত্যশিল্পী।‘রুক্সিণীহরণ’পালায় তিনি রুক্মিণীর ভূমিকায় নৃত্যাভিনয় করেছেন। হরিচরণ দাসের ‘অদ্বৈতমঙ্গল’-এ চৈতন্যদেবের নৃত্যের কথা পাওয়া যায়। দ্বাদশ শতাব্দীর কবি জয়দেবের গীতগােবিন্দ কাব্যগ্রন্থে এই নৃত্যধারার বহু বর্ণনা পাওয়া যায়। প্রাচীন বঙ্গের এই শাস্ত্রীয় বা ধ্রুপদী নৃত্যধারা বয়ে চলেছে সাহিত্যে, ভাস্কর্যে, চিত্রকলায়, শাস্ত্রে। আশির দশকে অধ্যাপিকা মহুয়া মুখােপাধ্যায়ের সুবৃহৎ গবেষণার মধ্য দিয়ে এই ধারাকে পুনর্জাগরিত করা হয়। ভরতমুনির নাট্যশাস্ত্র, মতঙ্গমুনির বৃহদ্দেশী, শারঙ্গদেবের সংগীত রত্নাকর, মহেশ্বর মহাপাত্রের অভিনয় চন্দ্রিকা, পণ্ডিত শুভঙ্করের সংগীত দামােদর, শ্রীহস্তমুক্তাবলী, কবি জয়দেবের গীতগােবিন্দম্, রূপ গােস্বামীর উজ্জ্বল নীলমণি, ভক্তিরসামৃতসিন্ধু ইত্যাদি বহু শাস্ত্রগ্রন্থে অসামান্য নৃত্যধারার উল্লেখ রয়েছে। মনসামঙ্গল, চণ্ডীমঙ্গল, অন্নদামঙ্গল বা রাধা-কৃষ্ণের প্রেমলীলা আশ্রিত গৌড়ীয় বৈষ্ণবদের কীর্তনাঙ্গে সমৃদ্ধ গৌড়বঙ্গের এই ধ্রুপদী নৃত্য।
হাজার হাজার নৃত্যশিল্পী এই নৃত্যধারার চর্চা করে চলেছেন, রচনা হয়েছে অসংখ্য প্রবন্ধ, একাধিক গবেষণা, মৌলিক গ্রন্থ, তথ্যচিত্র। দেশে বিদেশে প্রভূত প্রশংসা কুড়ােলেও আজও মেলেনি ধ্রুপদী হিসেবে। রাষ্ট্রীয় স্বীকৃতি। ১৯৫৩ সালে সংগীত অ্যাকাডমি গড়ে ওঠে। একে একে স্বীকৃতি পায় দক্ষিণের ভরতনাট্যম, কথাকলি, কুচিপুরি, মােহিনীআট্যম্। ভরতমুনির নাত্যশাস্ত্ৰনুযায়ী পাঞ্চালী ও আবন্তীর পুনর্জাগরণ না ঘটলেও ঔড্রমাগধীরূপে। মণিপুরি, ওড়িশি, সত্রীয় স্বীয় স্বীয় প্রদেশের মানুষের উৎসাহ ও দরবারে স্বীকৃতি পেয়েছে। গৌড়ীয়নৃত্যের স্বীকৃতির দাবি শুধুমাত্র ধ্রুপদী ধারার অনুশীলনের জন্য নয়, বরং বামৈস্লামিক শক্তির মিলিত প্রয়াসে রুদ্ধ হয়ে যাওয়া বঙ্গ সংস্কৃতিকে পুনর্জাগরিত করতে পারে এই ধ্রুপদী ধারা। বৃহবঙ্গের ষড়যন্ত্রে কুঠারাঘাত করবে বঙ্গ সংস্কৃতির পুনর্জাগরণের এই মহামন্ত্র। জাতীয় শিক্ষানীতি প্রস্তাবকরা দেশের সনাতনী মাঙ্গলিক ধ্রুপদী এই শিক্ষা ব্যবস্থাই তাে শিশুদের কাছে পৌছে দিতে চেয়েছেন।
ভাষার অধিকারের দাবিতে যে বাঙ্গালির আন্দোলন মানভূম থেকে দাড়িভিট পর্যন্ত আজও উজ্জ্বল; সেই বাঙ্গালির পরিচয় চিহ্নিত করেই ভাষা সংস্কৃতির এই দাবির পক্ষে জোরদার আওয়াজ তুতে হবে। মেধা ও প্রযুক্তির মেলবন্ধন ঘটিয়ে এই নয়া শিক্ষানীতি শিশুদের এইহঁদুর দৌড়ের ঘৃণ্য প্রতিযােগিতা থেকে মুক্তি দেবে। পাশাপাশি ধ্রুপদী সাহিত্য সংস্কৃতি চর্চার মধ্য দিয়ে মানসিক বিকাশ ঘটিয়ে দেশ ও সমাজের কাছে উপযুক্ত উন্নত নাগরিক করে গড়ে তুলবে এই স্বপ্নই তাে দেখিয়েছেন স্বামী বিবেকানন্দ, শ্রীঅরবিন্দ।
প্রবীর ভট্টাচার্য্য