ইজরায়েল ১৯৬৭ সালে ওয়েস্ট ব্যাঙ্ক এবং পূর্ব জেরুজালেম দখলের পর থেকে প্রায় ১৪০টি বসতি গড়ে তুলেছে। আন্তর্জাতিক আইন অনুযায়ী জনবসতিগুলি ব্যাপকভাবে অবৈধ বলে বিবেচিত। হয়। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র সম্প্রতি বলেছে যে ইজরায়েলের বসতিগুলি অবৈধ বলে বিশ্বাস করে না তারা। ২০১৯-এর ২৯ নভেম্বর আমেরিকা যুক্তরাষ্ট্রের সচিব বলেছেন যে গাজা বা ওয়েস্ট ব্যাঙ্ক ভূখণ্ডে ইজরায়েলিদের বসতি স্থাপন আর অবৈধ নয়। এই সিদ্ধান্তের কারণ ব্যাখ্যা করতে গিয়ে সচিব মাইক পম্পেইও বলেছেন যে অসামরিক বসতিস্থাপন সম্পর্কিত ইজরায়েলি আদালতের রায় সেখানকার মাটির সঙ্গে জড়িত সুনির্দিষ্টঘটনা ও পরিস্থিতির মূল্যায়ন করে দেওয়া হয়েছে—আমেরিকা যুক্তরাষ্ট্র তাই তাকে স্বীকৃতি দেয়। পিটিআই ওয়াশিংটন এখবর জানাচ্ছে।
বড়োসড়ো নীতিগত পরিবর্তন করে ট্রাম্প প্রশাসন ঘোষণা করেছে যে প্যালেস্টাইন এলাকায় ইজারায়েলি বসতিস্থাপন অবৈধ বলে তারা আর মনে করে না। তারা জোর দিয়ে বলেছে যে, এইরূপ বসতিস্থাপন আন্তর্জাতিক আইনের সঙ্গে অসঙ্গতিপূর্ণ’ আগেকার এই যুক্তি শান্তি প্রক্রিয়াকে এগিয়ে নিয়ে যেতে আদৌ সাহায্য করেনি।
সুতরাং আমেরিকা সরকার অসামরিক বসতিস্থাপনের আইনগত অবস্থানের উপর কোনো মতামত দিচ্ছেনা। সোমবার পররাষ্ট্রদপ্তরের ‘ফোগি বটম’ সদর দপ্তরে পম্পেইও সাংবাদিকদের বলেন, “ট্রাম্প প্রশাসন ইজরায়েলি জনবসতিগুলির বিষয়ে ওবামা প্রশাসনের দৃষ্টিভঙ্গিকে পাল্টাতে চায়।” ইজরায়েলি আদালত বসতিস্থাপনের ক্রিয়াকলাপকে চ্যালেঞ্জ করার এবং এর সঙ্গে যুক্ত মানবিক দিকগুলি মূল্যায়ন করার সুযোগ দিয়েছে। ইজরায়েলি আদালত নির্দিষ্ট কিছু বসতিস্থাপন কার্যক্রমের বৈধতাকে মেনে নিয়েছে এবং সিদ্ধান্ত নিয়েছে যে বাকিগুলো আইনগতভাবে মেনে নেওয়া যায় না। পম্পেইও বলেছেন, “আইনি বিতর্কে সমস্ত পক্ষের মতামত বিচার করে আমেরিকা যুক্তরাষ্ট্র এই বিশ্বাসে উপনীত হয়েছে। যে ওয়েস্ট ব্যাঙ্কে ইজরায়েলি অসামরিক বসতিস্থাপন করা আন্তর্জাতিক আইনের সঙ্গে অসামঞ্জস্যপূর্ণ নয়।”
“দ্বিতীয়ত, আমরা ওয়েস্ট ব্যাঙ্কের স্থিতির চূড়ান্ত সমাধান বা পক্ষপাতপূর্ণ বিচার করছি না। এটা ইজরায়েলি ও ফিলিস্তিনিদের মধ্যে আলোচনার বিষয়। আন্তর্জাতিক আইন কোনও বিশেষ সিদ্ধান্ত চাপিয়ে দিতে পারে না বা আলোচনায় কোনও আইনগত বাধা সৃষ্টি করে না”।
“তৃতীয়ত, যে ইজায়েলি জনবসতিগুলি আন্তর্জাতিক আইনের সঙ্গে সামঞ্জস্যপূর্ণ নয় সেগুলো আমরা কখনো স্বীকার করব না, ওয়েস্ট ব্যাঙ্কে অসামরিক বসতিস্থাপনের মতো যেগুলো সম্পর্কে ইতিহাস ও পরিস্থিতি বিবেচনা করে সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়েছে সেগুলোই স্বীকার করব। আমাদের আজকের সিদ্ধান্ত আগ বাড়িয়ে নেওয়া নয় বা বিশ্বের অন্য কোনও অঞ্চলের পরিস্থিতি সম্পর্কিত আইনি সিদ্ধান্ত নয়’ বলেছেন শীর্ষ আমেরিকান কূটনীতিক।
পম্পেইও বলেছেন, “এবং অবশেষে ‘অসামরিক বসতি স্থাপনের কথা আন্তর্জাতিক আইনের সঙ্গে সামঞ্জস্যপূর্ণ নয়’ একথা কোনো কাজে দেয়নি, কারণ তাতে শান্তিপ্রক্রিয়া এগোয়নি”।
তিনি বলেছেন যে কঠিন সত্যিটা এই যে আদালতে এই দ্বন্দ্বের সমাধান কখনই হবে না এবং আন্তর্জাতিক আইনের দিক থেকে কে ঠিক ও কে ভুল তাই নিয়ে তর্ক করলে শান্তি আসবে না। এটি একটি জটিল রাজনৈতিক সমস্যা যা কেবল ইজরায়েলি ও ফিলিস্তিনিদের মধ্যে আলোচনার মাধ্যমে সমাধান করা সম্ভব বলে তিনি মন্তব্য করেন। পম্পেইও আরো বলেছেন যে তার দেশ, ওয়েস্ট ব্যাঙ্কে এই ইজরায়েলিয় বসতিগুলির অবস্থানের বিষয়টি আলোচনা দ্বারা চূড়ান্ত সমাধান করার জন্য সংশ্লিষ্ট দুই দেশকে উৎসাহিত করে। আমেরিকা শান্তির খাতিরে সহায়তা দেওয়ার জন্য গভীরভাবে প্রতিশ্রুতিবদ্ধ এবং এই লক্ষ্যে সহায়তা করার জন্য সব কিছু করবে।
প্রাক-ট্রাম্প প্রশাসনের মত :
পম্পেইওর মতে, ওয়েস্ট ব্যাঙ্কে বসতিস্থাপন কার্যকলাপ সম্পর্কে কয়েক দশক ধরে জারি করা প্রকাশ্য মার্কিন বিবৃতি বড়োই বেখাপ্পা। যেমন ১৯৭৮ সালে, জিমি কার্টার প্রশাসন স্পষ্টভাবে সিদ্ধান্ত নিয়েছিল যে ইজারায়েলের অসামরিক বসতি স্থাপনের বিষয়টি আন্তর্জাতিক আইনের সঙ্গে সঙ্গতিপূর্ণ নয়। তবে মাঝখানে ১৯৮১ সালে রাষ্ট্রপতি রোনাল্ড রেগান এই সিদ্ধান্তের সঙ্গে একমত হননি এবং বলেছিলেন যে তিনি বিশ্বাস করেন না যে জনবসতিগুলি মূলত অবৈধ ছিল। কিন্তু রেগান-পরবর্তী প্রশাসনগুলি আবার স্বীকার করেছে যে এই অবাধে বসতিস্থাপন কার্যক্রম। শান্তির পথে বাধা হতে পারে, কিন্তু তারা বিচক্ষণ দূরদর্শিতার সঙ্গে স্বীকার করেছেন। যে আইনি লড়াইতে শান্তিস্থাপন এগোয়নি।
ওবামার পূর্বের কয়েক দশক ধরে তার আগেকার আমেরিকান সরকারগুলো গা বাঁচিয়ে চলা দুমুখো নীতি নিয়েছিল; ইজরায়েলি জনবসতিগুলি অবৈধ, তারা জোর দিয়ে প্রকাশ্যে এই বিবৃতি দিয়েছিল। ২০১৬ সালের ডিসেম্বরে, পূর্ববর্তী প্রশাসনের একেবারে শেষে, তৎকালীন ওবামা প্রশাসন সেই নীতির পরিবর্তন করেছিল।
পম্পেইও জানিয়েছেন “আইনানুগ বিতর্কের সবদিক সাবধানতার সঙ্গে অধ্যয়ন করার পরে, ট্রাম্প প্রশাসন রাষ্ট্রপতি রেগানের পূর্বোক্ত মতের সঙ্গে একমত হয়”। “আজকের এই সিদ্ধান্ত ওবামা প্রশাসন ও রাষ্ট্রসঙ্ঘের নিরাপত্তা পরিষদের ২৩৩৪ প্রস্তাবের অপমানজনক উত্তরাধিকারকে ফিরিয়ে দেওয়ার ক্ষেত্রে আরও একটি পদক্ষেপ নিয়েছে” বলে সিনেটর টেড ক্রুজ বলেছেন।
ডেমোক্র্যাটদের প্রতিক্রিয়া : আধ ডজনেরও বেশি ডেমোক্র্যাটিক কংগ্রেসপন্থী একটি যৌথ বিবৃতিতে বলেছে যে বিতর্কিত অঞ্চলে নির্মিত ইজরায়েলি জনবসতিগুলিকে আর আন্তর্জাতিক আইনের পরিপন্থী বলে বিবেচনা করবে না বলে ঘোষণা করে ট্রাম্প প্রশাসন একাই কয়েক দশকব্যাপী চলা মার্কিন নীতি উল্লঙ্ঘন করেছেন এবং আন্তর্জাতিক আইন উপেক্ষা করেছেন, এতে অধিকৃত অঞ্চলগুলিতে ইজরায়েলি বসতিকে কার্যত বৈধ করেছে।
মার্কিন দূতাবাসকে জেরুজালেমে সরিয়ে নেওয়ার, সাম্প্রতিক সিদ্ধান্তের পাশাপাশি ওয়াশিংটন ডিসিতে ফিলিস্তিনের অফিস ও জেরুজালেমে মার্কিন কনস্যুলেট বন্ধ করে দেওয়া এবং ওয়েস্ট ব্যাঙ্ক ও গাজায় সহায়তা কমানোর ব্যবস্থা করা—এসব এই ছবি তুলে ধরে যে ট্রাম্প প্রশাসন মধ্য প্রাচ্যের শান্তি ও সুরক্ষার লেশ মাত্র আশা শেষ করে দিয়েছে।
“এটা পরিষ্কার যে প্রশাসনের ইজরায়েলি ও ফিলিস্তিনিদেরকে সরল বিশ্বাসে একত্রিত করার কোনও পরিকল্পনা নেই, ডেমোক্র্যাটিক কংগ্রেস সদস্যরা হলেন ডেভিড প্রাইস, জান স্কাওকস্কি, জন ইয়ারমুথ, জেরি কনলি, বারবারা লি, পিটার ওয়েলস, অ্যালান লোয়েনথাল, লয়েড ডগেট এবং আল ব্লমেনার।
কাশ্মীরি পণ্ডিত : নিউইয়র্কের ভারতের কনসাল জেনারেল সন্দীপ চক্রবর্তী বলেছেন যে, ১৯৭০-এর দশকে হিংসার কারণে উপত্যকা ছেড়ে আসা কাশ্মীরি পণ্ডিতদের পুনর্বাসনে ইজরায়েলি মডেল অনুসরণ করতে পারে ভারত। একটি বেসরকারি অনুষ্ঠানে বক্তব্য রাখতে গিয়ে যুক্তরাষ্ট্রের শীর্ষ ভারতীয় কূটনীতিক বলেছেন যে কাশ্মীরি পণ্ডিতরা শীঘ্রই উপত্যকায় ফিরে যেতে পারেন কারণ“ইজরায়েলি জনগণ যদি তা করতে পারে তবে আমরাও এটা করতে পারি।”
“আমি বিশ্বাস করি…আপনার জীবদ্দশায়। আপনি ফিরে যেতে পারবেন…এবং আপনি সুরক্ষা পাবেন…কারণ ইতিমধ্যে বিশ্বে আমাদের একটি মডেল রয়েছে।”
“.মধ্যপ্রাচ্যে এটা হয়েছে, ইজরায়েলি জনগণ যদি এটি করতে পারে তবে…আমরাও করতে পারি…তারা তাদের সংস্কৃতিকে দেশের বাইরে ২০০০ বছর ধরে বাঁচিয়ে রেখেছিল এবং তারা ফিরে গেছে। আমি মনে করি আমাদের সকলকে কাশ্মীরি সংস্কৃতি বাঁচিয়ে। রাখতে হবে। কাশ্মীরি সংস্কৃতি ভারতীয় সংস্কৃতি, হিন্দু সংস্কৃতি। কাশ্মীর ছাড়া আমরা কেউই ভারতবর্ষের কথা ভাবতে পারি না। আমার জীবদ্দশায় আমরা আমাদের জমি ফিরে পাব, আমাদের জনগণকে কিছুটা সময় পিছনে যেতে হবে, সরকার যা করেছে তা করেছে।”
পাকিস্তানের প্রধানমন্ত্রী ইমরান খান বলেছেন — “এটা ভারত সরকারের আরএসএসের মতাদর্শের ফ্যাসিবাদী মানসিকতা দেখায়। তারা ১০০ দিনেরও বেশি সময় ধরে জম্মু ও কাশ্মীরের অবরোধ অব্যাহত রেখেছে, কাশ্মীরিদের মানবাধিকারের চরম লঙ্ঘন করেছে এবং শক্তিধর দেশগুলি তাদের ব্যবসায়ের স্বার্থের জন্য নীরব রয়েছে, এই বিতর্কের প্রতিক্রিয়া জানিয়ে সন্দীপ চক্রবর্তী বলেছেন যে জম্মু ও কাশ্মীর সম্পর্কে তার মন্তব্য এবং ইজরায়েলি ইস্যুতে অপ্রাসঙ্গিকভাবে তার বক্তব্য প্রচার করা হয়েছে। শ্রী চক্রবর্তী শুধু বোঝাতে চেয়েছিলেন যে ইহুদিদের তাদের আদি বাসস্থান গাজা ও পূর্ব জেরুজালেম থেকে বহিষ্কার করা হয়েছিল কিন্তু তারা বাইরে থেকে সঙ্ঘবদ্ধ হয়ে নিজেদের জমি পুনরুদ্ধার করেছে, কাশ্মীরি হিন্দুরাও যেন তাই করে।
সুদীপনারায়ণ ঘোষ
2019-12-13