কাশ্মীরের ভবিষ্যৎ ভারতের সঙ্গে একসূত্রে বাঁধা তার রূপ নির্ধারণের ভার আমাদের হাতে

২০১৯ সালের ৫ আগস্টের আগে পর্যন্ত সকলেই জানত কাশ্মীর সমস্যার সমাধানে যা-ই পন্থা নেওয়া হােক না কেন ৩৭০ ধারাকে ছোঁয়া যাবে না। সেই মিথটি চিরকালের জন্য বিলুপ্ত হয়ে গেছে ঠিক এক বছর আগে। ৬৯ বছরের আয়ুষ্কালাবধি এই মিথটি (যা এক ধরনের অলঙ্নীয়) কাশ্মীর উপত্যকায় এক বিপজ্জনক স্বপ্ন-কল্পনাকে প্রশ্রয় দিয়ে এসেছে।

ইতিহাসবিদদের কাছে ২০১৯-এর ৫ আগস্ট একটি অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ দিন হিসেবে চিহ্নিত হয়ে থাকবে। সংসদে গৃহমন্ত্রী অমিত শাহতার ঐতিহাসিক ভাষণে জম্মু-কাশ্মীর নিয়ে অনেকগুলি সুদূরপ্রসারী পরিবর্তন আনার কথা বলেন। একটি জোরালাে সংবিধান অনুমােদিত ধাক্কায় স্বাধীনতার সময় থেকে চলে আসা কাশ্মীরের পূর্বর্তন রাজতন্ত্রের অবস্থানের নিরিখে ভারতীয় সংবিধানের সঙ্গে যে পরম্পরা বিরােধী সম্পর্ক একরকম অলিখিত আইনে পর্যবসিত হয়েছিল তা অপসারিত হয়। একই সঙ্গে রাজনৈতিক, সাংবিধানিক, প্রশাসননিক সমস্ত চালু ব্যবস্থাগুলিও তামাদি হয়ে যায়। এমন ৭ দশক ধরে গেড়ে বসে থাকা একটা ব্যবস্থা রাতারাতি বাতিল হয়ে গেলে সুবিধাভােগীরা কী ধরনের প্রত্যাঘাত করতে পারে, জনগণের মধ্যে কী প্রতিক্রিয়া দেখা যেতে পারে এ নিয়ে আশঙ্কা ছিল অগাধ। ২০১৬ সালে শ্রীনগর ও পার্শ্ববর্তী অঞ্চলে কী ধরনের হিংসাত্মক বিক্ষোভ হয়েছিল (বুরহান ওয়ানি) সেই আতঙ্ক সকলের মনেই উঁকি দিচ্ছিল। জম্মু-কাশ্মীরের নব গঠিত প্রশাসনিক কাঠামাের প্রশংসা এসূত্রে করা আবশ্যক। বিশেষ করে সব রকমের নিরাপত্তা রক্ষা বাহিনীর সুনিপুণ নেতৃত্বের কারণে একটি বছর পার হয়ে গেলেও শ্রীনগরের রাজপথে বা অন্যত্র একজন। সাধারণ নাগরিকেরও মৃত্যু হয়নি। নিখুঁত পরিকল্পনা ও তার সার্থক রূপায়ণের এটি একটি শ্রেষ্ঠ উদাহরণ হয়ে থাকবে। কোনাে বড়াে ধরনের মুখােমুখি সংঘর্ষের খবর পর্যন্ত। পাওয়া যায়নি। এধার-ওধার দু একটি ঘটনায় নাগরিকদের মৃত্যু ধর্তব্যের মধ্যে নয়। অন্তত এ কারণে বিক্ষোভ সম্পর্কিত নয়। শ্রীনগরের রাস্তাঘাটগুলি বহুকাল পরে নিষ্ঠুর পাথররাজদের দাপটে মুক্ত অবস্থান দেখছে। সব চেয়ে বড়াে কথা হলাে, সেখানকার হাসপাতালগুলি কাতারে কাতারে। নিরাপত্তারক্ষা বাহিনীর ‘পেলেট গুলিতে আহত মানুষের ভিড়ে উপচে পড়েনি।

এবার আসা যেতে পারে ঝড়ের পরে নতুন করে গড়ে তােলার বিষয়ে। এই সূত্রে জম্মু-কাশ্মীর পুলিশবাহিনীর আত্মনিয়ন্ত্রণের প্রশংসা জরুরি। অনেকেরই এ বিষয়ে চিন্তা ছিল যে উদ্ভূত নতুন পরিস্থিতির সঙ্গে পুলিশবাহিনী নিজেদের খাপ খাইয়ে নিতে পারবে তাে? তারা এই ধরনের আশঙ্কাকে অমূলক প্রতিপন্ন করে উপত্যকায় নিরবচ্ছিন্ন শান্তি-শৃঙ্খলা বজায় রাখতে অসাধারণ দায়বদ্ধতা ও নিষ্ঠার নিদর্শন রেখেছেন। একটি এমন সপ্তাহও পার হয়নি যখন এই নিবেদিত প্রাণ পুলিশবাহিনী জাতির প্রতি দায়বদ্ধতা দেখাতে ব্যর্থ হয়েছে। উপযুপরি সন্ত্রাসবাদীদের আক্রমণ সফলভাবে প্রতিহত করতে তারা অকাতরে প্রাণ বিসর্জন দিয়েছেন। এই গৌরবময় জাতীয় কর্তব্যে সেনাবাহিনীর জওয়ান থেকে অনেক কর্তব্যরত উচ্চপদাধিকারীরাও দেশ সুরক্ষিত রাখতে সন্ত্রাসীদের শিকার হয়েছেন। তাই ভারতীয় সেনাবাহিনী ও অন্য কেন্দ্রীয় নিরাপত্তারক্ষী বাহিনীর সঙ্গে কাঁধে কাঁধ মিলিয়ে লড়ার ক্ষেত্রে জম্মু-কাশ্মীর পুলিশ অতুলনীয় ভূমিকা পালন করেছে। ২০১৯-এর ৫ আগস্টের পর কাশ্মীরবাসীকে শান্তির স্বাদ পৌঁছে দিতে তাদের ভূমিকা কাশ্মীরিরা মনে রাখবেন।

এই সূত্রে সীমান্ত পেরিয়ে অনুপ্রবেশ ও বড়াে আকারের সন্ত্রাসবাদী হামলা না ঘটতে দেওয়ার ঘটনাও অন্যতম সাফল্যের তালিকায় থাকবে। ৫ আগস্টের পর সন্ত্রাসবাদীদের ওপর পাকিস্তানের আইএসআই-এর লাগাতার চাপ ছিল বড়ােসড়াে সংঘর্ষ, বিক্ষোভ সংঘটিত করার। এমন কিছু করার যাতে ভারত ব্যতিব্যস্ত হয়ে পড়ে। কিন্তু সন্ত্রাসবাদীদের মােকাবিলার উপযুক্ত প্রশিক্ষণপ্রাপ্ত বাহিনী সর্বদা মজুত থাকায় বিগত কয়েকমাসে কট্টর সন্ত্রাসবাদীদের বিরুদ্ধে তারা উল্লেখযােগ্য সাফল্য পেয়েছে। এর ফলে প্রতিটি দিনই সন্ত্রাসবাদী ও তাদের পাকিস্তানি প্রভুরা চূড়ান্ত হতাশায় ভুগছে। তার সঙ্গে ৩৭০ ধারা বিলােপের প্রতিশােধ নিতে কিছু না কিছু করে দেখাবার চিন্তায় উন্মাদ হয়ে উঠছে।

এক্ষেত্রে মূল ভারতের সঙ্গে কাশ্মীরকে ভাগীদার করতে ধারা ৩৭০ তুলে দেওয়া যেমন নিতান্তই জরুরি ছিল তেমনি এর সঙ্গে জড়িত ধামাধরা যে সিস্টেম বলবৎ ছিল তাকে হঠানােও ছিল সমান জরুরি। এরাই তিন দশক ধরে সন্ত্রাসবাদীদের পুষেছে। এর মধ্যে মসজিদ-মাদ্রাসার যুগলবন্দি আবার সর্বাপেক্ষা গুরুত্বপূর্ণ। এরাই নবীন প্রজন্মকে কট্টর পন্থায় দীক্ষিত করে বিচ্ছিন্নতাবাদী আন্দোলনকে একটা হিংস্র জিহাদি চেহারা দেওয়ার বিশেষ প্রশিক্ষণ দিত। এই মসজিদে উত্তরপ্রদেশ, বিহার থেকে আমদানি করা বিশেষ ধরনের উগ্র মােল্লা আনা হতাে যারা কেবলমাত্র ইসলামি জিহাদি প্রচার করে তরুণদের মন বিষিয়ে তুলে ভারত বিরােধী করে তুলত যা কখনই কাশ্মীর উপত্যকার সংস্কৃতির সঙ্গে মেলে না। আমার মনে হয়, এবার সরকার এই মাদ্রাসাগুলিকে অধিগ্রহণ করে সেগুলিকে কেন্দ্রীয় বিদ্যালয়ে রূপান্তরের কথা বিবেচনা করতে পারে। এর ফলে জিহাদি ভাইরাসের মূলে আঘাত করা হবে। উপত্যকার ছেলে-মেয়েরা আধুনিক শিক্ষা নিয়ে চাকরির উপযুক্ত হয়ে উঠতে পারবে।

বিচ্ছিন্নতাবাদীদের মধ্যে আর একটা অহেতুক আশঙ্কা সর্বদা লালিত হতাে তা হলাে বাইরে থেকে (ভারতের অন্য অংশ) লােক এসে তাদের ওপর আধিপত্য করবে। বসবাসকারী আইনের সাম্প্রতিক পরিবর্তন তীব্র আশঙ্কার জন্ম দেয়। কিন্তু ভারতের অন্যান্য প্রদেশের পরিস্থিতির পরিপ্রেক্ষিতে বিচার করলে বােঝা যায় তাদের এ ধারণা ভিত্তিহীন। ভারতবর্ষের কোনাে রাজ্যই কখনও এমন কথা বলেনি যে তাদের। জনসংখ্যার ভারসাম্য নষ্ট হয়ে গেল বা নিজস্ব সংস্কৃতি বিপদাপন্ন হয়ে পড়েছে। উলটে এই উপত্যকাই ধর্মীয় বিতাড়নকে প্রথম প্রশ্রয় দেয়। বিপুল হিংস্র উন্মাদনায় হিন্দু কাশ্মীরি পণ্ডিতদের ঘরবাড়ি কেড়ে নিয়ে তাদের উদ্বাস্তু বানিয়ে দেয়। এই উ পত্যাকার কায়েমি স্বার্থান্বেষী রাজনীতিবিদরাই বরাবর জম্মু ও লাদাখের জনসংখ্যায় উপত্যকার লােক ঢুকিয়ে সেখানকার জনভারসাম্য নষ্ট করার চেষ্টা করেছে, যাতে উপত্যকার প্রাধান্য চিরস্থায়ী হিসেবে গােটা জম্মু-কাশ্মীরে অন্যায়ভাবে। বলবৎ থাকে। এখন অন্য লােক উপত্যকায় আসার সম্ভাবনায় তাদের বুক ফেটে যাচ্ছে।

এই প্রসঙ্গে পরিবর্তিত পরিস্থিতিতে কাশ্মীরের বিদ্বজ্জন সমাজ (সিভিল সােসাইটি)কেও মানসিকতায় প্রয়ােজনীয় পরিবর্তন আনতে হবে। দীর্ঘকাল ধরে তারা এক ধরনের কল্পিত অবহেলার শিকার বলে চালিয়ে এসেছেন। এর উলটো পিঠে প্রতিশােধ ফর্মুলা হিসেবে সারা ভারতের লােকেদের মুসলমান বিদ্বেষী বলে চালানাের তত্ত্বে মদত দিয়েছেন। এখন কিন্তু সময় ও সুযােগ দুই এসেছে বিশেষভাবে কট্টরবাদী, ভারত-বিদ্বেষীদের চিহ্নিত করণের। তাদের মূলধারা থেকে বিচ্ছিন্ন করে এতদিন ধরে সংঘটিত অপরাধের জন্য আইনানুগ কঠিনতম সাজা দেওয়া প্রয়ােজন। শিক্ষক, ডাক্তার, উকিল বা সরকারি আধিকারিক বা কর্মী যারা সরকারের ঘর থেকে মাইনে নিয়ে ভারত থেকে বিচ্ছিন্ন হওয়ার ভাবনা পােষণ করেন ও মানুষের মধ্যে প্রচার করেন তাদের এই দ্বৈত ঘৃণ্য ভূমিকা বন্ধ হওয়া দরকার। যারা এই ধরনের ভারত-বিরােধী কাজ সবচেয়ে বেশি করেছে তাদের মধ্যে নিদেনপক্ষে কিছুকে বেছে নিয়ে চাকরি থেকে এখুনি বরখাস্ত করা উচিত। এটা করতে পারলে তবেই উপত্যকায় ভারতের পক্ষে মতবাদ ও সংবেদনশীলতা তৈরি হবে। শ্রীনগরে প্রচারমাধ্যমের কার্যকলাপকায়েমি স্বার্থান্বেষীদের ও সন্ত্রাসবাদীদের সঙ্গে এমনই একসূত্রে বাঁধা যা ভারতবর্ষের কোথাও দেখা যায় না। এর ফলে বাস্তব পরিস্থিতির কোনাে সত্য সংবাদই প্রকাশ্যে আসে না।

এবিষয়ে জাতীয় প্রচারমাধ্যমের তরফে কিছু সংশােধনী ব্যবস্থা নেওয়া আশু প্রয়ােজন। প্রশাসনিক ক্ষেত্রে ২০১৮ সালে। যে পঞ্চায়েতি প্রক্রিয়া চালু হয়েছিল তাকে আরও শক্তিশালী করা দরকার। আমাদের যদি ভারতের সপক্ষে দীর্ঘমেয়াদে পাকাপাকিভাবে কাশ্মীরবাসীর মানসিকতার পরিবর্তন আনতে হয় তাহলে পঞ্চায়েতের মতাে তৃণমূল স্তরে কাজের বিকল্প নেই। মােবাইল যােগাযােগ ব্যবস্থাও উপযুক্তভাবে ফিরিয়ে আনা দরকার। কোনাে অঞ্চলে অস্থিরতা, বিক্ষোভ দেখা দিলে সেখানে আবার পরিষেবা প্রত্যাহার করে নেওয়া যেতেই পারে। পরিবর্তনের গতি তাে স্তব্ধতায় নয়, তার সাফল্য সচলতায়। সে পথেই চলেছে কাশ্মীর উপত্যকা।

অভিনব কুমার

(লেখক আইপিএস অফিসার)

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

This site uses Akismet to reduce spam. Learn how your comment data is processed.