সম্প্রতি আমাদের সংবিধান থেকে ৩৭০ ও ৩৫-এ অনুচ্ছেদকে বাদ দেওয়ার ফলে পাকিস্তান ও তার দোসর চীন ভীষণ ক্রুদ্ধ হয়েছে। তাদের মতে, এতে গণতন্ত্রকে হত্যা করা হয়েছে। কাশ্মীরিদের প্রতিভীষণ অন্যায় করা হয়েছে এবং লঙ্ঘন করা হয়েছে। আন্তর্জাতিক রীতিনীতি। ব্যাপারটাকে তারা টেনে নিয়ে গেছে রাষ্ট্রসঙ্রে (ইউ.এন.ও.) দরবারেও।
কিন্তু এক্ষেত্রে দুটো প্রশ্ন ওঠে। প্রথমত, ব্যাপারটা আমাদের সংবিধান সংক্রান্ত। সংবিধানের ৩৬৮ নং অনুচ্ছেদ অনুসারে সংবিধান সংশোধনের ব্যাপারটা রয়েছে সংসদ ও রাষ্ট্রপতির হাতে। কিছু নির্দিষ্ট বিষয়কে সংশোধন করতে হলে অবশ্য সংসদের দুই তৃতীয়াংশের সমর্থনের দরকার হয় এবং কতকগুলোর জন্য রাজ্যগুলোর অন্তত অর্ধেকের সমর্থন লাগে। আর লাগে রাষ্ট্রপতির স্বাক্ষর। এক্ষেত্রে বিলটা রাজ্যসভায় ১৩৫/৬১ ও লোকসভায় ৩৫০/৭২ ভোটে গৃহীত হয়েছে। ব্যবধানটা অবশ্যই সুবিশাল। তার পর পেয়েছে। রাষ্ট্রপতির সমর্থন।
তাহলে এক্ষেত্রে আপত্তি উঠছে কেন? চীন ও পাকিস্তানের সম্মতি নেওয়া হয়নি বলে? তাহলে কী আমাদের এই দুই দেশের অনুমতি নিতে হবে এই ব্যাপারে ?
দ্বিতীয়ত, ৩৭০নং অনুচ্ছেদটা আছে— আমাদের সংবিধানের একবিংশ অধ্যায়ে যার শিরোনাম ‘Temporary, Transitional and special Provisins। সুতরাং এটা একটা সাময়িক ও অস্থায়ী বিষয়ের প্রতীক। আর তার ৩নং উপধারায় আছে—রাষ্ট্রপতি তার যে কোনো সংশোধন বা বিলুপ্তি ঘটাতে পারেন। এই কারণে ড. জি. এস. পাণ্ডে মন্তব্য করেছেন,- Art. 370 is a temporary provision. It is not intended to be permanent.’—(কনস্টিটিউশানাল ল অব ইন্ডিয়া, পৃ. ৪৩৯)।
কিন্তু পূর্বতন বিভিন্ন কেন্দ্রীয় সরকারের সংকীর্ণ স্বার্থের কারণে এটা স্থায়ী হয়ে উঠেছিল— গত সত্তর বছর ধরে এটা থেকে গিয়েছিল ভোটব্যাঙ্কের সঙ্গে জড়িয়ে পড়ার ফলে। বর্তমানের মোদী সরকার এবার তাই এক সাহসী পদক্ষেপ গ্রহণ করেছে।
পাকিস্তান অবশ্য চীনের সঙ্গে জোট বেঁধে জলঘোলা করার জন্য রাষ্ট্রসঙ্ঘের নিরাপত্তা পরিষদের দ্বারস্থ হয়েছিল কয়েকদিনের মধ্যেই। কিন্তু সেখানেও তাদের মুখ পুড়েছে। চীন ছাড়া অন্য চোদ্দোটা সদস্য দেশ এই ব্যাপারে হস্তক্ষেপ করতে চায়নি, তারা কোনও প্রস্তাবও গ্রহণ করেনি।
এর আগেও পাকিস্তান কাশ্মীর প্রসঙ্গ নিয়ে বহুবার রাষ্ট্রসঙ্ঘে গেছে। তখন এই দেশ ছিল আমেরিকার তাবেদার। তাই আমেরিকা ও তার সঙ্গীরা বারবার ব্যাপারটা নিয়ে ভারতকে বিব্রত করতে চেয়েছে, আর রাশিয়া তাতে বাধা দিয়েছে। বর্তমানে আমেরিকা সরে গেছে পাকিস্তানের থেকে বেশ দুরে। তার ফলে চীন ছাড়া তার আর। কোনও সঙ্গী জোটেনি।
এইসব দেশের মতে, কাশ্মীর ভারত ও পাকিস্তানের দ্বিপাক্ষিক বিষয়, এই কারণেই এটা আন্তর্জাতিক প্রতিষ্ঠানের আলোচ্য বিষয় হতে পারে না। তাদের এই নির্লিপ্ততা অবশ্যই অভিনন্দনযোগ্য। কিন্তু যুক্তিটার মধ্যে একটু ফাক আছে।
এটা অবশ্যই দ্বিপাক্ষিক বিষয় নয়, এটা ভারতের একান্ত নিজস্ব ও অভ্যন্তরীণ বিষয়। কাশ্মীর নিয়ে সিদ্ধান্ত নিতে পারে একমাত্র ভারতই। এক্ষেত্রে পাকিস্তানের কোনও ভূমিকাই থাকতে পারে না। এই প্রসঙ্গে। ইতিহাসের পৃষ্ঠা একটু উলটানো যাক।
ভারতবর্ষ থেকে ব্রিটিশ শাসন শেষ হওয়ার সময় এই দেশে ছোটো-বড়ো দেশীয় রাজ্য ছিল ৫৬২ টা। তারা ছিল প্রায় স্বাধীন। বাকি দেশটা ছিল ব্রিটিশদের প্রত্যক্ষ শাসনাধীন। তাই দেশের স্বাধীনতার পর দেশীয় রাজ্যগুলোর অবস্থান কী হবে— এই প্রশ্ন উঠলে ইন্ডিয়ান ইন্ডিপেন্ডেস্ অ্যাক্ট এর সমাধান করেছে। ভারতে বা পাকিস্তানের পক্ষে সেই সব দেশীয় রাজ্যের নবাব বারাজা ‘ইন্সট্রুমেন্ট অব অ্যাকসেশন-এ স্বাক্ষর দিয়ে যোগ দিতে পারবেন, আগের মতো স্বাধীনও থাকতে পারবে। তার ফলে বিভিন্ন দেশীয় রাজ্যের রাজা বা নবাব ইচ্ছেমতো ভারত বা পাকিস্তানে যোগ দিয়েছেন।
কিন্তু কাশ্মীরের রাজা হরি সিংহ স্বাধীন থাকতে চেয়েছিলেন প্রথম থেকেই। তাঁকে ভারতের দিকে আনার জন্য ভারতের বড়লাট কাশ্মীর গেলে তিনি জ্বরের অজুহাতে নির্ধারিত বৈঠকও বাতিল করে দিয়েছেন— সেটা ছিলusual illness’, প্রয়োজনে তিনি এটাই করতেন- (লিওনার্ড মলে—- দ্য লাস্ট ডেজ অব দ্য ব্রিটিশ রাজ, পৃ. ২১৩)।
কিন্তু ইতিহাস চলেছে তার নিজের নিয়মে। ১৯৪৭-এর ২২ অক্টোবর প্রায় ২০০০ সৈন্য নিয়ে পাকিস্তান হানা দেয় কাশ্মীরে। তারা দ্রুত গতিতে চলেছিল রাজধানী শ্রীনগরের দিকে। বাধ্য হয়ে রাজা হরি সিংহ তখন ভারতের সাহায্যলাভের আশায় মরিয়া হয়ে প্রধানমন্ত্রী মেহেরচঁাদ মহাজনকে দিল্লি পাঠিয়েছিলেন। কিন্তু তিনি বুঝেছেন যে, রাজা ইন্সটুমেন্টে অব অ্যাকসেশনে স্বাক্ষর না দিলে ভারতের পক্ষে হস্তক্ষেপ করা সম্ভব নয়। তাই মহাজন তখনই শ্রীনগরে গিয়ে রাজার স্বাক্ষর নিয়ে। ফিরে আসেন। কেবি কেশওয়ানী লিখেছেন, “Thus the state become an integral part of India— (ইন্টার ন্যাশনাল রিলেশান্স, পৃ. ৫৬৬)।
তার ফলে ভারতীয় বাহিনী এক প্রশংসনীয় চেষ্টায় অধিকৃত অঞ্চলের অনেকটাই মুক্ত করেছে। ভি. এন. খান্নার 07977— “The Indian Army moved rapidly and the invader began to retreat’– ফরেন পলিসি অব ইন্ডিয়া, পৃ. ৬৯)। আর একটু সময় পেলেই বিজয়ী সেনারা কাশ্মীরকে পুরোপুরি মুক্ত করতে পারতেন। কিন্তু হঠাৎ ভারতের বুদ্ধিহীন প্রধানমন্ত্রী নেহরু যুদ্ধ থামিয়ে বিষয়টাকে রাষ্ট্রসঙ্ েপাঠিয়ে দেন, আর তখন থেকেই পাকিস্তান ও তার মিত্র দেশ এটাকে আন্তর্জাতিক বিষয়ে পরিণত করার চেষ্টা করছে। (আই জে প্যাটেল— সর্দার বল্লভভাই প্যাটেল, পৃ. ১১৮)। আর ১৯৫৯ সালের সেপ্টেম্বরে কাশ্মীরের গণপরিষদ কাশ্মীরের ভারতভুক্তি মেনে নিয়েছে“confirmed the accession to India'(অমিত কুমার সেন— ইন্টারন্যাশনাল রিলেশান্স, পৃ. ৬১৯)। তবে তার একটা অংশ রয়ে গেছে পাকিস্তানের দখলে। সেটা আদৌ আইনগত পদ্ধতিতে নয়— বন্দুকের জোরে এবং নেহরুর নির্বুদ্ধিতার ফলে। কাশ্মীরে পাকিস্তান হানাদার মাত্র তার কোনও নৈতিক বা আইনগত দাবি এক্ষেত্রে খাটে না।
পাকিস্তান সেসময় আইন লঙ্ঘন করেই কাশ্মীরের একটা অংশ দখলে রেখেছে— এটা ড. বিদ্যাধর মহাজনের ভাষায় ‘Pakinvasion-(দ্য কস্টিটিশান অব ইন্ডিয়া, পৃ. ৩৪৪)। আর সংবিধান বিশেষজ্ঞ দুর্গাদাস বসু লিখেছেন, যেসব দেশীয় রাজ্য ভারতের সঙ্গে যুক্ত হয়েছিল– তারা যে পদ্ধতি নিয়েছিল, ঠিক সেই ভাবেই কাশ্মীর ভারতে এসেছে— আইনগত পদ্ধতিটা ছিল একই রকম— in the same form’— (ইন্ট্রোডাকশান টু দ্য কনস্টিটিউশন অব ইন্ডিয়া, পৃ. ২২৮)। সুতরাং কাশ্মীরের ভারতভুক্তি একটা বৈধ, সাংবিধানিক ও ঐতিহাসিক সত্যি। পাকিস্তান এক্ষেত্রে হানাদার— তার কোনও বৈধ ভূমিকা এক্ষেত্রে নেই। তাই বলা যায় কাশ্মীর ভারতের অভ্যন্তরীণ বিষয়।
এটা ঠিক যে, কাশ্মীর একটা বিশেষ পরিস্থিতিতে— in peculiar circumstancess— ভারতে যোগ দিয়েছিল– (সহদেব গুপ্ত— দ্য ইন্ডিয়ান কস্টিটিউশান, পৃ. ২১৬)। কিন্তু তার বৈধতা নিয়ে কোনও প্রশ্নই উঠতে পারে না। ‘ইন্ডিয়ান ইন্ডেপেন্ডেন্স অ্যাক্ট অনুসারেই সেটা ঘটেছিল আর পরে কাশ্মীরের নির্বাচিত গণপরিষদও সেটা মেনে নিয়েছে। এ.জি. DETOT 16163694), “The state of Jammu and Kashmir acceded to the Union of India on October 26, 1947— (ইন্ডিয়া’জ কনস্টিটিউশান, পৃ. ৫৪৭)।
সুতরাং নিঃসন্দেহে দাবি করা যায় যে, কাশ্মীর একান্তভাবেই ভারতের একটা অঙ্গরাজ্য। সেই কারণেই এক্ষেত্রে দ্বিপাক্ষিক কোনও সমস্যা নেই। তার সংবিধান সংশোধনের ব্যাপারটাও ভারতের নিজস্ব বিষয়- এটা পাক-চীনের মর্জির ওপর আদৌ নির্ভর করে না। বিশেষ করে, ৩৭০ নং অনুচ্ছেদটা সংবিধান অনুসারেই অস্থায়ী ধারা, সেটা পূর্ববর্তী শাসকদের অবিবেচনার ফলেই এতকাল রয়ে গেছিল।
ড. নির্মলেন্দু বিকাশ রক্ষিত
2019-10-18