পৃথিবীর অর্বুদ বর্ষের জীবনকালে প্রজাতির পর প্রজাতি পালা করে তার বুক থেকে মুছে গেছে, বারবার ঘটেছে সে ঘটনা। এগুলোকে বলে ‘এক্সটিংশন লেভেল ইভেন্ট’। বাংলায় বলা যায়—মন্বন্তর। এরকম ছ’টি মন্বন্তরের প্রমাণ পাওয়া গেছে পৃথিবীর ভূতাত্ত্বিক ইতিহাসে। দেখা গেছে, সেই যুগে যেটা ছিল সবচেয়ে শক্তিশালী প্রজাতি, মন্বন্তরে ঝাড়েবংশে নির্মূল হয়ে গেছে সেটা। নতুন প্রজাতির আবির্ভাব ঘটেছে তাদের ফসিলের বুক চিরে।
পুরাণে একটা গল্প আছে, মধকৈটভের গল্প। ব্রহ্মা যখন আপন সৃষ্টির ধ্যানে নিমগ্ন, তখন বিষ্ণুর কানের ময়লা থেকে জন্ম হলো মধু ও কৈটভ নামে দুই দৈত্যের। তারা ব্রহ্মার অস্তিত্ব বিনাশে উদ্যত হলো। ব্রহ্মাকে রক্ষা করতে বিষ্ণু জেগে উঠলেন, মধু ও কৈটভকে হত্যা করলেন। ব্রহ্মা আবার সৃষ্টির ধ্যানে মগ্ন হলেন। এই গল্পটা থেকে আমি কী বুঝেছি, সেটা বলি। ব্রহ্মা হলেন সৃষ্টিকর্তা, বিষ্ণু হলেন পালনকর্তা, এ তো আমরা জানি। এখন দেখা যাক, কারা মধু-কৈটভ। মধু অর্থে জীবনদায়ী তরল পদার্থ, কৈটভ অর্থে কীট বা পোকা। অর্থাৎ মধু-কৈটভ হলো একরকমের জলকীট। তারা কি একসময় নব নব জীবনের সৃষ্টির পদ্ধতিটাকেই থামিয়ে দিয়েছিল?‘ব্রহ্মার অস্তিত্ব বিনাশ’মানে কী তাই?তখন কী পালনের শক্তি জেগে উঠে সেই জলকীটের প্রজাতিকে পৃথিবী থেকে মুছে দিয়েছিল? পৃথিবীর ইতিহাস বলছে, এরকম একটি জীব সত্যিই ছিল। নাম তাদের ট্রাইলোবাইট। একসময় পৃথিবীর প্রতিটি সমুদ্র গিজগিজ করত অযুত নিযুত ট্রাইলোবাইটে। কল্পনা করতে ভয় হয়, কেমন ছিল সেই সমুদ্র। হয়তো সে থকথকে সমুদ্র ঢেউ উঠত না। বদ্ধ জলার মতোই গা-ঘিনঘিনে, দমবন্ধ-করা! তারপর কী হলো? রাতারাতি সব ট্রাইলোবাইট মুছে গেল পৃথিবী থেকে।
আমরা মানুষরা ভাবি, এই পৃথিবীটা হলো জড়পদার্থ মাত্র। সেটাই আধুনিক সভ্যতার সবচেয়ে বড়ো ভুল। পৃথিবীমাতা জড় নন, তিনি সচেতন। বস্তুত, জড়। বলে কিছুই নেই এই ব্রহ্মাণ্ডে, সবকিছুই সচেতন। পৃথিবীমাতা এক অতি সচেতন সত্তা, তার সচেতনতা অন্য মাত্রার। প্রাচীন ভারতের মুনিঋষিরা ছাড়া আর কেউই সেই সচেতনতাকে অনুধাবন করতে পারেননি। এই সচেতন মাসদাবৎসলা, সদা ক্ষমাশীলা। কিন্তু যদি তার একটি সন্তান অন্য সব সন্তানের জীবনহানির কারণ হয়ে ওঠে, তখন মা নির্দয় হস্তে সেই অবাধ্য সন্তানকে কালপটল থেকে মুছে দেন। এটাই নির্মম সত্য। নিরপেক্ষভাবে দেখলে পরিষ্কার হয়ে যাবে। আমরা মানুষরা কিন্তু আজ মধু-কৈটভেরও অধম। ‘নব নব জীবনের সৃষ্টি’র সহায়ক হওয়া তো দূরস্থান, আমাদের ভোগের অত্যাচারে প্রতি বছর বহু প্রজাতি বিলুপ্ত হয়ে যাচ্ছে পৃথিবী থেকে। এর বিপরীত ক্রিয়া তো একদিন না একদিন মানবজাতির ওপর এসে পড়বেই। আমরা ভাবি, মেঘের আড়ালের কোনো অদৃশ্য শক্তি এই পৃথিবীটাকে আমাদের ভোগের জন্য বানিয়েছে। ভুল, মস্ত বড়ো ভুল। লক্ষ কোটি কীটপতঙ্গের মতোই আমরাও বিবর্তনের পথে জন্মেছি। পৃথিবীটা আমাদের নয়, উলটে আমরা পৃথিবীর। এই অতিকায় ভুলের মাশুল আজ প্রজাতির বিলুপ্তি দিয়ে দিতে হতে পারে মানবজাতিকে। করোনা মহামারীতে মানুষ যবে থেকে গৃহবন্দি হয়েছে, তবে থেকে পৃথিবীর প্রতিটি প্রান্ত থেকে খবর আসছে, প্রকৃতি যেন ঘুম ভেঙে জেগে উঠেছেন। কোয়েম্বাটোরের পথেঘাটে ময়ুর ঘুরে বেড়াচ্ছে। ফ্রান্সের বন্দরে তিমির দল জলকেলি করছে। সিঙ্গাপুরের জাতীয় উদ্যানগুলোতে ভেঁদড়েরা সপরিবারে চড়ুইভাতি করছে। বহু যুগ পরে কলকাতা বন্দরে ফিরে এসেছে গঙ্গা-শুশুকের। ঝক। বাতাস পরিষ্কার, হিমালয় দেখা যাচ্ছে দূরদূরান্ত থেকেও। এসব দেখে আমাদের আনন্দের চেয়েও বেশি লজ্জা পাওয়া উচিত। পৃথিবীর প্রতিটা প্রজাতি এভাবে আমাদের ভয়ে দিনের পর দিন লুকিয়ে পালিয়ে বেড়ায়? ধিক আমাদের!
এর আগে ছ’টি মন্বন্তর ঘটেছে। প্রশ্ন জাগছে, মা কি সপ্তম মন্বন্তরের জন্য প্রস্তুতি নিচ্ছেন ? চারপাশে যা কিছু দেখছি, সেসব কি তারই পূর্বাভাস? আগামী যুগের বুদ্ধিমান কোনো জীব কি মানুষদের নিয়ে আরেকটা মধু-কৈটভের কাহিনি লিখবে?
মা, আমরা তোমার লোভী নীচ অবোধ সন্তান। অনেক ভুল করেছি। কিন্তু একটু একটু করে সে ভুলগুলো বুঝতে পারছি। হয়তো আমরা শুধরে যাবো। আর একটা সুযোগ দাও মা। মা, তোমার ওই উদ্যত খঙ্গ আমাদের ওপর নেমে আসার আগে একবার ভেবে দেখো। আমাদের ছাড়া তোমার ছবিটা কী সম্পূর্ণ হবে? তোমার ওই মন্দিরটা ছাড়া কি তোমার সৃষ্টি অপূর্ণ থেকে যাবে না? আমরা শুধরে যেতে পারি। সেই ইচ্ছাশক্তি আমাদের রয়েছে। মা, আমরা তোমার পথভ্রষ্ট সন্তান, আমাদের এখনই বাদের খাতায় লিখে ফেলো না।
প্রবাল চক্রবর্তী