মানব সেবায় স্বামী প্রণবানন্দজী মহারাজ অস্পৃশ্যতা দূরীকরণ ও হিন্দুসমাজের জাগরণ প্রচেষ্টায় ব্রতী হয়েছিলেন। ভারত সেবাশ্রম সঙ্ঘের প্রতিষ্ঠাতা আচার্য প্রণবানন্দজীর সেই মহাসত্যের আর একটি দিব্য অভিব্যক্তি— হরিজন নয়, অচ্ছুত নয়, দরিদ্র নারায়ণ সেবা— এই ভাবনা নিয়েই তার জয়যাত্রা। গ্রামে শহরে সর্বত্র সর্বশ্রেণীর হিন্দুদের নিয়ে তিনি স্থাপন করেন হিন্দু মিলন মন্দির। তাঁর গঠনমূলক সংগঠন চিন্তা হিন্দুর মহাজাগরণ আজ ভারতের সর্বত্র পরিলক্ষিত। কেবল ধর্মগুরু হয়েই থাকা নয়, তার চিন্তা হিন্দু সমাজকে তথা ভারতবর্ষের ঋষি পরম্পরাকে রক্ষা করা। সব শহরে আশ্রম, মঠ, হিন্দু মিলন মন্দির; গড়ে উঠেছে চারণ দল, রক্ষীদল, ব্রহ্মচারী, সন্ন্যাসীদল। এই ভূমিকা শতবর্ষ ধরেই চলছে। তার অমর বাণী প্রতিধ্বনিত হচ্ছে আজও সর্বত্র। আমরা দেখেছি তার বাণী সত্যে পরিণত হয়েছে—এ যুগ মহাজাগরণের যুগ, এ যুগ মহাসমন্বয়ের যুগ, এ যুগ মহামিলনের যুগ, এ যুগ মহামুক্তির যুগ।
১৮৯৬ খ্রিস্টাব্দে ২৯ জানুয়ারি (বাংলা ১৩০২) তার জন্ম। বাল্য নাম ছিল বিনোদ। বাবা ডাকতেন বুধো বলে। তার জন্মের পর পিতা বিষ্ণু ভুইয়া জমি সংক্রান্ত মামলায় জয়লাভ করেন। তাই তার নাম রাখেন জয়নাথ। এই রুদ্র অবতার পুরুষ ছোটো থেকে থাকতেন ধ্যানমগ্ন সমাজ সংস্কার ও হিন্দু রক্ষার চিন্তায় মগ্ন।
স্কুলজীবনে শিক্ষকদের স্নেহধন্য ছিলেন। গভীর বিষয়ে ডুবে থাকতেন। আলুসিদ্ধ ভাত আর ব্রহ্মচর্য সাধনায় হস্তির বল তার গুণগ্রাহীগণের আলোচ্য বিষয় ছিল। দুর্বলের উপর মুসলমান দুবৃত্তের হামলার প্রতিকার, প্রতিরোধ ও উচিত শিক্ষাদানের মাধ্যমে সিংহ বিক্রমের সমস্ত পদক্ষেপ তাঁর বাল্যকালেই পরিলক্ষিত হয়। স্বদেশী আন্দোলনে সহায়তা, পথ প্রদর্শন, জেলে গমন সবই ঘটেছে তার জীবনে। মাত্র ১৭ বছর বয়সে ১৯১৩ খ্রিস্টাব্দে বিজয়া দশমীর পরেরদিন গোরক্ষপুর মঠের গম্ভীরানাথজীর নিকট সাধন দীক্ষাগ্রহণ করেন। তার অন্যতম কাজ তীর্থসংস্কার। তীর্থক্ষেত্রে পাণ্ডাদের শোষণ মূলক আচরণ তাকে ব্যথিত করে। তাই দেশের বিভিন্ন প্রদেশ থেকে আসা তীর্থযাত্রীদের ঠিকমতো ধর্মাচরণ ও ধর্মীয় রীতি পালনের অধিকার প্রদানের জন্য তীর্থপাণ্ডাদের অপচেষ্টা বন্ধ করেন। তীর্থযাত্রীদের ওপর উৎপীড়ন বন্ধ করার কাজ তার জীবনের এক বড়ো কলঙ্ক মোচন অধ্যায়।
সত্যদ্রষ্টা যুগপুরুষ ছিলেন শ্রীমৎস্বামী প্রণবানন্দজী। অখণ্ড বঙ্গদেশের পরিস্থিতি হিন্দু জীবনের সংকটকালে তাঁর প্রতিষ্ঠিত ভারত সেবাশ্রম সঙ্ঘ মৃতপ্রায় হিন্দু জাতিকে পুনরুজ্জীবিত করেছে।
রাষ্ট্রীয় স্বয়ংসেবক সঙ্ঘের প্রতিষ্ঠাতা ডাঃ কেশব বলিরাম হেডগেওয়ার এবং ভারত সেবাশ্রম সঙ্ঘের প্রতিষ্ঠাতা আচার্য স্বামী প্রণবানন্দজী মহারাজের অনুগামীরা এ যুগে সম্পূর্ণ হিন্দু সমাজের ভাষা-প্রান্ত-জাতিবর্ণ-উঁচু-নীচু ভাব ভুলে জাতি গঠনের কাজে রত। ড. শ্যামাপ্রসাদ মুখার্জির সঙ্গে বহুবার আলাপ-আলোচনা করেছেন স্বামী প্রণবানন্দজী। তিনি নিজের গলার মালা শ্যামাপ্রসাদের গলায় পরিয়ে তাকে হিন্দুদের নেতা ঘোষণা করেছিলেন। তাঁর কথাতেই শ্যামাপ্রসাদ জাতির সেবায় নিজেকে উৎসর্গ করেছিলেন। স্বামী প্রণবানন্দজী বুঝেছিলেন সংগঠন ছাড়া সমাজকে গড়ে তোলা অসম্ভব। সেইজন্য ডাক্তার হেডগেওয়ার এবং প্রণবানন্দজীর আহ্বান মানুষ হতে হবে। সত্যিকারের মানুষের মতো মানুষ হওয়া, আচরণে তা প্রকাশিত করা। স্বামী বিবেকানন্দ ঘোষণা করেছিলেন মানুষ চাই, মানুষ হলেই সবকিছু হয়ে যাবে। স্বামী প্রণবানন্দজী ধর্মগুরু হয়ে শুধু উপদেশ নয়, জাতির কল্যাণের জন্য বেছে নিয়েছিলেন কঠিন দুর্গম পথ। স্বামী প্রণবানন্দজীর ভাবনায় ছিল– নমঃশূদ্র, ধীবর, রজক কিংবা সাঁওতাল, বাউরী, সবার উন্নয়নের প্রচেষ্টা। সবার বৈদিক মন্ত্রচারণের অধিকার আছে, সবার যজ্ঞ বেদীতে আহুতি দেবার অধিকার আছে। হিন্দু যুবকদের জাতিগত ভেদভাব ভুলে সমস্ত হিন্দু সমাজ রক্ষার সংকল্প গ্রহণ। ব্যায়াম করেশক্তি অর্জন করে অস্ত্র সঞ্চালনের অভ্যাস করা। তার আশা, সমস্ত হিন্দু গুরুগোবিন্দ সিংহের মতো শক্তির আরাধনা করবে। তার সংকল্প ছিল স্বাবলম্বী সংগঠিত হিন্দু সমাজ জাতিগত ভেদভাব ভুলে এক অখণ্ড সমাজের স্বপ্ন দেখবে।
অদ্বৈত দত্ত
2020-02-05