ভারতের সব থেকে চর্চিত মামলার অবশেষে যবনিকাপাত হলো। কিন্তু আইন বিষয়টাই এমন জটিল যে, যে কোনো বক্তব্যের পরস্পর বিরোধী তত্ত্ব উদ্ভাবন করা যায়। অযোধ্যা রায়ের দুটি বক্তব্যকে ঘিরে এক শ্রেণীর তথাকথিত বুদ্ধিজীবী একে হিন্দু আধিপত্যবাদের বিচার বিভাগীয় স্বীকৃতি বলে প্রচার করতে শুরু করেছেন। এক হলো ১৯৯২ সালে তৎকালীন মুসলমান পক্ষের দাবি অনুযায়ী বাবরি ধাঁচার উপরে আক্রমণের নিন্দা এবং দ্বিতীয়টি হলো অযোধ্যা ভূখণ্ডের মধ্যেই কোনও এক স্থানে ৫ একর জমিতে মসজিদ নির্মাণ করার আদেশ দেওয়া। রায় ঘোষণার পর পরই বিভিন্ন প্রথম শ্রেণীর সংবাদপত্রে একাধিক লেখা প্রকাশিত হয় যেখানে এই রায়কে হিংসার দ্বারা জোর করে আস্থার প্রতিষ্ঠা হিসেবে ব্যাখ্যা করা হয়। কিন্তু ঘটনা হলো ঠিক উল্টো, অযোধ্যা মামলা আসলে একটি শাশ্বত সত্যকে ভোটব্যাঙ্ক নির্ভর রাজনীতি রূপ পাথরের নীচে চাপা দিয়ে রেখে হিন্দুদের কয়েক প্রজন্মকে তাদের আরাধ্য দেবতাকে তার জন্মভূমি ও পুণ্যভূমিতে গিয়ে দর্শন ও পুজো করার অধিকার থেকে বঞ্চিত করে রাখার চেষ্টা। কীভাবে?
১. বাবরি ধাঁচা যা নাকি প্রথম মুঘল শাসক বাবর ১৫২৮ সালে তার সেনাপতি মির বাকিকে দিয়ে নির্মাণ করিয়েছিলেন তার কোনো প্রামাণ্য দলিল নেই। বাবরের আত্মজীবনী বাবরনামাতে বাবরি মসজিদের কোনো উল্লেখ নেই, ১৫৭৪ সালে রচিত তুলসীদাসের রামচরিতমানসে অযোধ্যায় শ্রীরামচন্দ্রের জন্মোৎসব পালনের সুদীর্ঘ বর্ণনা থাকলেও সেখানে কোনও মসজিদের উপস্থিতির কথা বলা হয়নি। ১৫৯৮ সালে আবুল ফজল যখন আইন-ই-আকবরি-রতৃতীয় খণ্ডের সংকলন সম্পূর্ণ করেছেন সেখানেও অযোধ্যায়মহা ধুমধামের সঙ্গে রাম জন্মোৎসব পালনের উল্লেখ থাকলেও কোনও মসজিদের উল্লেখ নেই। ১৬১১ সালে ইংরেজ পরিব্রাজক উইলিয়াম ফিংচ অযোধ্যা ভ্রমণ করেছিলেন, তিনি অযোধ্যায় বহু তীর্থযাত্রী এবং পাণ্ডাদের উপস্থিতিও লিপিবদ্ধ করেছিলেন কিন্তু কোনও মসজিদের কথা উল্লেখ করেননি।
২. পৌরাণিক যুগ থেকেই অযোধ্যা হিন্দুদের কাছে অত্যন্ত পুণ্যস্থান। গরুড় পুরাণে অযোধ্যাকে সপ্তপুরীর অন্যতম হিসেবে বর্ণিত করা হয়েছে, যেখানে ভ্রমণ করলে মোক্ষ লাভ করা যায়। প্রাচীন ষোড়শ মহাজনপদের অন্যতম কোশল মহাজনপদের রাজধানী ছিল অযোধ্যা। তখন এর নাম ছিল সাকেত নগর, একাধিক বৌদ্ধ, জৈন, গ্রিক এবং চীনা গ্রন্থে এর উল্লেখ আছে। গুপ্তযুগে অযোধ্যা তার কৌলিন্যের শিখরে পৌঁছায়। দ্বিতীয় চন্দ্রগুপ্তের কন্যা প্রভাবতী গুপ্ত রামভক্ত ছিলেন এবং তাঁর পুত্র প্রভারসেনা সেতুবন্ধ নামক গ্রন্থ রচনা করেছিলেন যেখানে শ্রীরামকে ভগবান বিষ্ণুর অবতার হিসেবে বর্ণনা করা হয়। এছাড়াও তিনি নাগপুরের কাছে রামটেকনামক স্থানে একটি রামমন্দির প্রতিষ্ঠা করেন। গুপ্তযুগের মহান কবি কালিদাস রচিত রঘুবংশ নামক মহাকাব্যের রঘু হলেন শ্রীরামচন্দ্রের প্রপিতামহ। শুধু হিন্দুদের কাছেই নয়, গৌতম বুদ্ধ এবং মহাবীর জৈন তাদের জীবনের অনেকটা সময় এই অযোধ্যায় কাটিয়েছেন। পাঁচ জন জৈন তীর্থঙ্কর যথাক্রমে ঋষভনাথ, আজিতনাথ, অভিনন্দননাথ, সুমতিনাথ এবং অনন্তনাথ এই পুণ্যভূমিতে জন্মগ্রহণ করেছেন। গুপ্ত যুগের পর গাড়োওয়াল যুগে অর্থাৎ একাদশ শতাব্দীতে অযোধ্যা ও সন্নিহিত অঞ্চলে কয়েকশো মন্দির স্থাপিত হয় যার বেশিরভাগই আওরঙ্গজেবের শাসনকালে ধ্বংস করা হয় যার বর্ণনা স্বয়ং আওরঙ্গজেবের এক পৌত্রী রচিত গ্রন্থ সাহিফা-ই-চাহিল-নাসিহ বাহাদুরশাহী-র ছত্রে ছত্রে আছে।
৩. ১৯৫০ সালে গোপাল সিংহ বিশারদ ফৈজাবাদ দেওয়ানি আদালতে অযোধ্যার বিতর্কিত জমিটির স্বত্ব সম্পূর্ণভাবে হিন্দুদের পক্ষে দাবি করে যে মামলাটি করেছিলেন, তার পরিপ্রেক্ষিতে ১ এপ্রিল, ১৯৫০ সালে কোর্ট শিবশঙ্কর লাল নামক ব্যক্তিকে কমিশনার নিযুক্ত করে বিতর্কিত স্থানটির সরেজমিনে খতিয়ে দেখে তার রিপোর্ট দিতে বলে। ২৫ জন কমিশনার তার রিপোর্ট পেশ করেন। সেখানে তিনি মসজিদ বলে দাবি করা অংশটির চারপাশে ১২টি স্তম্ভ দেখতে পান যার কোনোটিতে তাণ্ডবনৃত্যরত ভগবান শিব, কোনোটিতে হনুমানজী, কোনোটিতে ভগবান শ্রীকৃষ্ণের অবয়ব দেখতে পান। ১৭৬৬ সালে জোসেফ টিফিন্থাটার এই স্তম্ভগুলির কথাই বলেছিলেন, ১৯৫০ সালে জোসেফ বর্ণিত ১৪টি স্তম্ভের মধ্যে ২টি ধ্বংস হয়ে গিয়েছিল।
৪. অযোধ্যা মামলা চলাকালীন যতগুলি প্রত্নতাত্ত্বিক খননকার্য হয়েছে। তার মধ্যে এলাহাবাদ হাইকোর্টের নির্দেশে ২০০৩ সালে যে খননটি হয়েছিল তার রিপোর্টটিকে কালানুক্রমিক ভাবে সাজালে দেখা যাবে তাতে প্রাগৈতিহাসিক যুগ থেকে সুলতানি শাসনকাল পর্যন্ত কোনও ইসলামিক স্থাপত্য নেই। বরং বিভিন্ন সময়ে ক্ষুদ্র থেকে বৃহদাকার হিন্দু স্থাপত্য পাওয়া গেছে। সুতরাং সুপ্রিম কোর্ট সংবিধানের ১৪২ ধারা প্রয়োগ করে যে ৫ একর জমি মসজিদ নির্মাণের জন্য বরাদ্দ করার নির্দেশ দিয়েছে তা এদেশের ধর্মনিরপেক্ষতার কাঠামোটিকে সুদৃঢ় করার জন্য। তাকে ধর্মীয় নিপীড়নের ক্ষতিপূরণের বৈধতা হিসেবে দেখা ঠিক নয়।
সোমনাথ গোস্বামী
2019-11-22