তফশিলি নেতা যোগেন্দ্রনাথ মণ্ডল অবশেষে শ্যামাপ্রসাদ সৃষ্ট পশ্চিমবঙ্গেই আশ্রয় নিয়েছিলেন

ভারতের সংসদে নাগরিকত্ব সংশোধনী আইন (সিএএ) পাশ করার প্রেক্ষিতে প্রধানমন্ত্রী গৃহমন্ত্রী-সহ কেন্দ্রের শাসক দলের একাধিক নেতাকে পাকিস্তানের প্রথম আইন মন্ত্রী তথা তৎকালীন তফশিলি নেতা যোগেন্দ্রনাথ মণ্ডলের কথাকে রেফারেন্স হিসেবে ব্যবহার করতে দেখা গেছে।

যোগেন্দ্রনাথ মণ্ডল ছিলেন অবিভক্ত বাঙ্গলার তফশিলি জাতির (এখনকার পরিভাষায় ‘দলিত’) নেতা। যেমন সর্ব ভারতীয় ক্ষেত্রে ছিলেন ড. বি আর আম্বেদকার। ড. আম্বেদকার ছিলেন অসাধারণ জ্ঞানী, প্রজ্ঞাবান ব্যক্তিত্ব। তিনি পিছিয়ে পড়া মানুষের সামাজিক ও রাজনৈতিক অধিকারের জন্য বহু আন্দোলন করেছিলেন। যোগেন্দ্রনাথ মণ্ডল বা যোগেন মণ্ডল ড. আম্বেদকারের মতো প্রজ্ঞাবান ব্যক্তিত্ব ছিলেন না বাড. আম্বেদকারের মতো পিছিয়ে পড়া মানুষের সামাজিক অধিকার রক্ষার জন্য ধারাবাহিক আন্দোলনের কোনো ইতিহাস ছিল না। তিনি ছিলেন ক্ষমতালিপ্পু স্বার্থান্বেষী রাজনৈতিক ব্যক্তি। তিনি নিজের রাজনৈতিক ক্ষমতা অর্জনের লক্ষ্যেই রাজনীতিতে প্রবেশ করেছিলেন।

যোগেন মণ্ডল জন্মেছিলেন তৎকালীন পূর্ববঙ্গের বরিশাল জেলার এক নমঃশূদ্র পরিবারে, ১৯০৪ সালের ২৯ জানুয়ারি। ১৯২৯ সালে তিনি বিএ পাশ করেন। ১৯৩৪ সালে তিনি কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে আইন ডিগ্রি লাভ করেন। ১৯৩৭-এ তিনি সক্রিয় রাজনীতিতে আসেন। তিনি দলিত-মুসলমান সখ্যে বিশ্বাসী ছিলেন। তাই মুসলিম লিগের পক্ষালম্বন করে পাকিস্তানের দাবিতে লড়েছিলেন। দেশ ভাগের পরে পাকিস্তানের আইন মন্ত্রী হয়েছিলেন। ক্রমে

তার ভ্রান্ত রাজনীতির ফল তিনি ভোগ করেন। তিনি উপলব্ধি করেছিলেন কীভাবে মুসলিম লিগ তাকে ঢাল হিসেবে ব্যবহার করে। হিন্দুদের ধ্বংস করে তাদের ইসলামিক রাজত্ব কায়েম করার পথকে সুগম করেছিল।

মুসলিম-দলিত ঐক্যের স্বপ্ন তার চুরমার হয়ে গিয়েছিল। তিনি ভারতে পালিয়ে এসে পাকিস্তানের মন্ত্রিত্ব থেকে পদত্যাগ করেন। ১৯৫০ সালের ৮ অক্টোবর। যে মাটিকে তিনি অবহেলা করেছিলেন, ঘৃণা করেছিলেন সেই ভারতের মাটিতে তিনি প্রাণ ত্যাগ করেন১৯৬৮ সালে।

ভারতের সামাজিক পরিবেশে তপশিলি জাতিভুক্ত লোকেদের বর্ণহিন্দুদের প্রতি স্বাভাবিক ঘৃণার কারণে তারা নিজেদের মুসলমানদের স্বাভাবিক মিত্র বলে মনে করে। তাদের নেতারাও তাই ভাবেন। তারা মনে করেন— “তফশিলি ও মুসলমানদের মধ্যে রাজনৈতিক ঐক্যের চেয়ে বড়ো কোনো স্বাভাবিক ঘটনা নেই পৃথিবীর বুকে’ (মরনিং নিউজ-পৃঃ-৪, ৭/৬/৪৭)। যোগেন মণ্ডলও তাই ভাবতেন। যদিও তাদের সর্বভারতীয় নেতা ড. ভীমরাও আম্বেদকর এইমত পোষণ করতেন না। ড. আম্বেদকর বলেছিলেন, “তপশিলিদের একটা অভ্যাস হয়ে দাঁড়িয়েছে যে তারা হিন্দুদের অপছন্দ করেন বলেই মুসলমানদের বন্ধু বলে মনে করেন। এই চিন্তাধারা ভুল।” তিনি বলেছেন, ‘বাস্তববাদীরা নিশ্চয়ই লক্ষ্য করে থাকবেন। যে মুসলমানরা হিন্দুদের কাফের হিসেবেই গণ্য করে, তাদের মতে এই কাফেরদের রক্ষা করার চেয়ে মেরে ফেলাই উচিত।” ড. আম্বেদকার সুস্পষ্ট ভাবে মনে করতেন ‘মুসলমান রাজনীতিবিদরা ধর্মনিরপেক্ষ জীবনযাত্রাকে তাদের রাজনীতির ভিত্তি বলে স্বীকার করেন না’ (Dr. Ambedkar Vol. 8/236)। যোগেন মণ্ডল বাবাসাহেবের মতো এত প্রজ্ঞাবান ব্যক্তি ছিলেন না।তফশিলিদের (দলিত) নিয়ে রাজনীতি করে ক্ষমতা দখলের জন্যই তিনি রাজনীতিতে এসেছিলেন। এখনো বেশির ভাগ তফশিলি নেতা মুসলমানদের সঙ্গে গাঁটছড়া বেঁধে রাজনৈতিক ক্ষমতা দখলের প্যাচপয়জার কষেন। আসলে মুসলমান ও পিছিয়ে পড়া সমাজের নেতারা পরস্পর পরস্পরকে ব্যবহার করার চেষ্টা করেন।

আগেই বলেছি যোগেনবাবুর রাজনীতিতে প্রবেশ ১৯৩৭ সালে। ১৯৩৫-এর ‘ভারত শাসন আইন অনুযায়ী সাম্প্রদায়িক বাঁটোয়ারার নিয়ম মেনে ১৯৩৭-এর ফেব্রুয়ারিতে ভারতের ১১টি ব্রিটিশশাসিত প্রদেশে প্রাদেশিক আইন সভার সাধারণ নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়েছিল। এই সময় যোগেনবাবু পূর্ববঙ্গের বরিশাল থেকে বিক্ষুব্ধ কংগ্রেসিদের সমর্থনে নির্দল প্রার্থী হয়ে বাঙ্গলার প্রাদেশিক আইন সভায় জয়লাভ করেছিলেন।

এই সময় অবিভক্ত বঙ্গপ্রদেশে মুসলমানরা ছিল সংখ্যাগরিষ্ঠ। কিন্তু তাদের দুটি দল ছিল—জিন্নারমুসলিম লিগ, ফজলুল হকের কৃষক প্রজা পার্টি। কংগ্রেস সমেত কোনো দলই এই নির্বাচনে সংখ্যাগরিষ্ঠতা পায়নি। ফজলুল হক প্রথমে কংগ্রেসের সঙ্গে মিলে প্রাদেশিক সরকার গড়তে চেয়েছিলেন। কিন্তু শর্ত ছিল তিনি প্রধানমন্ত্রী হবেন (তখন প্রদেশের প্রধানকে প্রধানমন্ত্রী বলা হতো)। কংগ্রেস সেই শর্তে রাজি না হওয়ায় ফজলুল হক মুসলিম লিগের সঙ্গে মিলে বঙ্গপ্রদেশে সরকার গঠন করেন। ফজলুল হকের কৃষক প্রজা পার্টিমুসলিম লিগের মতো সাম্প্রদায়িক দল ছিল না। অনেক রাজনৈতিক বিশ্লেষকের মতে কংগ্রেসের এই ভুল রাজনীতির ফলে বঙ্গপ্রদেশে মুসলিম লিগ ফজলুল হকের ঘাড়ে ভর করে তাদের সাম্প্রদায়িক রাজনীতির থাবা বসিয়ে দিতে সক্ষম হয়েছিল।

১৯৪০ সালের মার্চ মাসে মুসলিম লিগ তাদের লাহোর অধিবেশনে মুসলমানদের জন্য পাকিস্তান গঠনের জন্য প্রস্তাব পাশ করলো। তখন ভারতের ভারতের কমিউনিস্টরা কিন্তু মুসলিম লিগের পাকিস্তান দাবিকে সমর্থন জানিয়েছিল। ১৯৪১ সালে রাজনীতিতে জটিল অবস্থার সৃষ্টি হয়। ফজলুল হকের সঙ্গে জিন্নার মতভেদ সৃষ্টি হলো। জিন্নার কলকাঠি নাড়ার ফলে দেখা গেল ১ ডিসেম্বর মুসলমান মন্ত্রীরা সকলে এক সঙ্গে হক মন্ত্রীসভা থেকে সমর্থন প্রত্যাহার করে নিল। ফজলুল হক পদত্যাগ করতে বাধ্য হলেন। ঠিক হয়েছিল গভর্নর। মুসলিম লিগ নেতা নাজিমুদ্দিনকে পরবর্তী সরকার গড়তে ডাকবেন। কিন্তু মুসলিম। লিগের পাকা খুঁটি কঁচিয়ে দিলেন হিন্দু মহাসভার নেতা ড. শ্যামাপ্রসাদ মুখোপাধ্যায়। তিনি সাম্প্রদায়িক মুসলিম লিগকে বাঙ্গলার শাসনব্যবস্থা থেকে দূরে রাখার জন্য অসাম্প্রদায়িক ফজলুল হকের কৃষক প্রজা পার্টির সমর্থনে প্রয়োজনীয় সংখ্যক সদস্যের। সমর্থন জোগাড় করতে সমর্থ হয়েছিলেন নিজের রাজনৈতিক কৌশলের জোরে। ফলে গভর্নর হারবার্ট ১০ ডিসেম্বর ফজলুল হক-কে আবার সরকার গড়ার জন্য ডাকতে বাধ্য হন। ফজলুল হকের নেতৃত্বে আবার তৈরি হয়— প্রোগ্রেসিভ কয়ালিশন সরকার। লোকে বলত—শ্যামা-হক সরকার।

আবার মুসলিম লিগ নানারকম কূটকাচালি আরম্ভ করলো এই সরকারের পতন ঘটাবার জন্য। মুসলিম লিগের এই কাজে বাঙ্গলার গভর্নর জন হারবার্টের প্রচ্ছন্ন মদত ছিল। ৪২-এর শেষের দিকে যোগেন। মণ্ডল মুসলিম লিগের খুব কাছের মানুষ হয়ে উঠলেন। তিনি ইতিমধ্যেই হক-বিরোধী। সদস্য বলে পরিচিত হয়ে গেছেন। যোগেনবাবু তাঁর তফশিলি সদস্যদের নিয়ে লিগের সমর্থনে দাঁড়িয়ে গেলেন এবং দেখা গেল তিনি ২১ জন তফশিলি সদস্যের সমর্থন জোগাড় করে হক-মন্ত্রীসভার বিরুদ্ধে অনাস্থা প্রস্তাব আনলেন। ফলে ১৯৪৩ সালে শ্যামা-হক মন্ত্রীসভার পতন ঘটে। ১৯৪৩ সালের ২৮ মার্চ নাজিমুদ্দিনের নেতৃত্বে মুসলিম লিগ বঙ্গপ্রদেশে সরকার গঠন করে। যোগেন মণ্ডল ও তার দল ওই মন্ত্রীসভায় তিনটি আসন পান। যোগেন্দ্রনাথ মণ্ডল সমবায় ও ঋণ দান, প্রেমহরি বর্মণ বন ও আবগারি, পুলিনবিহারী মল্লিক প্রচার বিভাগ পেলেন।

১৯৪৩ সালের মে মাসে যোগেনবাবু গঠন করেন বঙ্গীয় তফশিলি ফেডারেশন। যদিও এর আগে ১৯৪২ সালে ড. আম্বেদকর গঠন করেছিলেন নিখিল ভারত তফশিলি ফেডারেশন। যোগেনবাবু জাগরণ নামে একটি পত্রিকাও প্রকাশ করতে আরম্ভ করলেন। তার দলের মুখপত্র হিসেবে। এর পর যোগেনবাবু তাঁর কাগজ ও দল নিয়ে পুরোপুরি সাম্প্রদায়িক মুসলিম লিগের হাত শক্ত করার জন্য উঠেপড়ে লেগে গেলেন।

১৯৪৫-এর ২৮ মার্চ কৃষি বাজেট পাশ করতে না পারার জন্য নাজিমুদ্দিন মন্ত্রীসভার পতন ঘটে এবং গভর্নরের শাসন চালু হয়। এক বছর পর ১৯৪৬ সালে আবার নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়। এবার মুসলিম লিগ একক সংখ্যাগরিষ্ঠতা অর্জন করে সরকার গঠন করে সুরাবর্দির নেতৃত্বে। সুরাবর্দির ক্যাবিনেটে মন্ত্রীর পদ পেলেন যোগেনবাবু। আসলে মুসলিম লিগ নেতা জিন্না ছিলেন ধুরন্ধর রাজনীতিবিদ। তিনি যোগেনবাবুকে মন্ত্রীপদ, ক্ষমতা ইত্যাদি দান করে দেখাতে চাইলেন যোগেনবাবুই ভারতে তফশিলিদের অবিসংবাদিত নেতা। যোগেনবাবু তার দল নিয়ে পুরোপুরি জিন্নার পিছনে থাকায় জিন্না দাবি করেন তফশিলি (এখন বলা হয় দলিত) ওমুসলমান জনগোষ্ঠী মিলিয়ে সারা ভারতের প্রায় ৫০ শতাংশ মানুষের প্রতিনিধি তিনিই। কাজেই তার দাবি মানতে হবে। ১৯৪৬ সালের মার্চ মাসে ক্যাবিনেট মিশন ভারতে এসেছিল ভারতের বিভিন্ন দলের নেতৃবৃন্দের সঙ্গে আলাপ-আলোচনা করে ক্ষমতা হস্তান্তরের একটি বাস্তবসম্মত পথ খুঁজে বের করতে। জিন্না তার পাকিস্তান দাবির পক্ষে অনড় থাকেন। যোগেনবাবু জিন্নার পাকিস্তান। দাবিকে জোরাল ভাবে সমর্থন করেন।

জিন্না যখন দেখলেন আলাপআলোচনার মাধ্যমে তার পাকিস্তান দাবির বাস্তবায়ন সম্ভব হচ্ছে না, তখন তিনি। জিহাদের পথ অবলম্বন করবেন ঠিক করলেন। ১৯৪৬ সালের ২৭-২৯ জুলাই বোম্বেতে অনুষ্ঠিত মুসলিম লিগের সর্বভারতীয় সভায় সিদ্ধান্ত হয় যে তাদের পাকিস্তান দাবি মানা না হলে ১৬ আগস্ট থেকে ডাইরেক্ট অ্যাকশন করে তারা পাকিস্তান আদায় করে নেবে। যোগেনবাবু লিখিত ঘোষণার মাধ্যমে মুসলিম লিগের ডাইরেক্ট অ্যাকশনকে সমর্থন জানিয়েছিলেন।

আসলে ডাইরেক্ট অ্যাকশন ছিল চতুর শব্দবন্ধের আড়ালে ইসলামিক জিহাদ, যার মাধ্যমে কাফেরদের (অমুসলমান) ধ্বংস করে ইসলামের রাজত্ব দার-উল-ইসলাম কায়েম করা হয় এবং জিহাদ করা মুসলমানদের কাছে পবিত্র কাজ; জিহাদ করলে জান্নাতে (স্বর্গে) গিয়ে সুখসম্ভোগের অঢেল ব্যবস্থা পাকা। আমাদের সেকুলার নেতারা হয়তো ভেবেছিলেন ডাইরেক্ট অ্যাকশন’মানে হরতাল বা ওই জাতীয় কিছু তীব্র আন্দোলন হবে, তাই সেটাকে তেমন গুরুত্ব দেননি।

অবশেষে ৪৬-এর ১৬ আগস্ট এসে গেল। ওটা ছিল রমজান মাসের শুক্রবার, মুসলমানদের পবিত্র দিন। হিন্দুদের ধারণা ওইদিন ওরা ভালো পবিত্র কাজ করবে। যাদের ইসলাম সম্বন্ধে পড়াশুনা করা নেই তারা জানেই না যে কাফের (অমুসলমান)দের নিধন করা তাদের একটি পবিত্র কাজ। ওইদিন জুম্মার নমাজের পরে মুসলমানরা শহিদ মিনার ময়দানে জমায়েত হলো। মুসলিম লিগের নেতারা গরম গরম উত্তেজক বক্তৃতা দিয়ে চলে গেলেন। তার পরেই জেহাদি মুসলমান জনতা নানারকম অস্ত্রশস্ত্র নিয়ে কলকাতা জুড়ে হিন্দুদের উপর ঝাপিয়ে পড়ল। শুরু হয়ে গেল হিন্দুদের ঘরবাড়ি দোকানপাট, মন্দিরে লুটতরাজ, অগ্নিসংযোগ, হিন্দু হত্যা, নারীর ইজ্জত লুণ্ঠন। তিনদিন ধরে চলেছিল ডাইরেক্ট অ্যাকশন নামক এই নারকীয় পৈশাচিক কাজ। প্রায় ৫ হাজার মানুষ মারা যায় , আহত হয় ১৫ হাজার। ইতিহাসে একে ‘দ্য গ্রেট কালকাটা কিলিংস’ নামে অভিহিত করা হয়েছে। এখানে উল্লেখ করা যেতে পারে যে, এত বড়ো ঘটনার পরেও অহিংসার পূজারি গান্ধীজী ছিলেন আশ্চর্য রকমের নীরব।

বাঙ্গলার শাসনব্যবস্থায় তখন মুসলিম লিগ সরকার। সুতরাং পুলিশকে নিষ্ক্রিয় করে রাখা হয়েছিল। মুসলিম লিগ ক্যাবিনেটের মন্ত্রী যোগেনবাবু ক্ষমতার মোহে আশ্চর্য অবস্থান নিয়েছিলেন। তিনি বলেছিলেন এই দাঙ্গা মুসলমান আর উচ্চবর্ণের হিন্দুদের মধ্যে সীমাবদ্ধ, এই দাঙ্গা তফশিলিদের বিরুদ্ধে নয়। সুতরাং এই ব্যাপারে তার বলার কিছু নেই। যদিও জিহাদিরা যখন হিন্দু নিধন করে তখন। কে উচ্চবর্ণ আর কে নিম্নবর্ণ তা দেখে করে না। সব হিন্দুই তাদের মতে কাফের, সুতরাং বধযোগ্য।

এই ভয়াবহ ঘটনার পরে বঙ্গীয় প্রাদেশিক আইন সভায় সাম্প্রদায়িক মুসলিম লিগ সরকারের বিরুদ্ধে অনাস্থা প্রস্তাব এনেছিলেন ড. শ্যামাপ্রসাদ মুখোপাধ্যায়, কিরণশঙ্কররায় প্রমুখ। তখন মুসলিম লিগ সরকারকে বাঁচিয়ে দিয়েছিলেন যোগেনবাবু। তিনি চারজন অ্যাংলো ইন্ডিয়ান সদস্য এবং কংগ্রেস থেকে চারজন তফশিলি সদস্যের সমর্থন জোগাড় করে মুসলিম লিগ সরকারের পক্ষে ভোট দিয়েছিলেন।

কংগ্রেসের পক্ষ থেকে পাকিস্তান দাবির ব্যাপারে কোনো সদুত্তর মিলছে না দেখে আবারও ডাইরেক্ট অ্যাকশনের পরিকল্পনা করে মুসলিম লিগ। এবার স্থান ঠিক হয় তৎকালীন পূর্ববঙ্গের নোয়াখালি। ১৯৪৬ সালের ১০ অক্টোবর কোজাগরী লক্ষ্মীপূজার দিন থেকে নোয়াখালিতে অ্যাকশন করে মুসলিম লিগের জিহাদি বাহিনী। হাজার। হাজার হিন্দুর ঘরবাড়ি দোকানপাট লুঠ, মন্দিরে লুটপাট ও অগ্নি সংযোগ করা হয়। হাজার হাজার হিন্দু খুন করা হয়, হাজার হাজার হিন্দুমেয়ে অপহরণ ও ধর্ষণ করা হয়। শত শত হিন্দুকে জোর করে ধর্মান্তরিত করা হয়। প্রায় দু’সপ্তাহ ধরে চলে এই হিন্দু নরসংহার। সরকারি সমর্থন না থাকলে এরকম পৈশাচিক কাজ করা সম্ভব হতো না। ইতিহাসে একে নোয়াখালি জেনোসাইড নাম দেওয়া হয়েছে।

মুসলমান জিহাদিদের নৃশংসতার হাত থেকে তফশিলি হিন্দুরাও কিন্তু ছাড় পায়নি। সব অমুসলমানই তাদের কাছে কাফের। লিগের ক্যাবিনেট মন্ত্রী যোগেন্দ্রনাথ মণ্ডল তার দলের লোকদের মাধ্যমে তফশিলি মানুষদের আক্রান্ত হওয়ার খবর পাচ্ছিলেন কিন্তু ক্ষমতালিম্পু যোগেনবাবু না দেখার ভান করে থাকলেন। ঘটনার পরে লোক দেখানো তদন্তের জন্য কয়েকজন মন্ত্রী ও লিগ নেতার একটি সরকগারি দল নোয়াখালি পরিদর্শনে গিয়েছিলেন। যোগেনবাবুও ছিলেন সেই দলে। যোগেনবাবুর নেতৃত্বাধীন তদন্তকারী সরকারি দল নোয়াখালি পরিদর্শন করে এসে মিথ্যে রিপোর্ট দিলেন— ‘পরিস্থিতি তেমন জরুরি বা ভয়াবহ নয়। তফশিলিদের একজন লোকও নিহত বা আহত হয়নি। কী ভয়ানক মিথ্যা! এখনকার মতো মিডিয়া তখন ছিল না। কয়েকটি কাগজ যাও-বা ছিল সরকারি নিষেধাজ্ঞা জারি করা ছিল তাদের উপর। তাই প্রকৃত খবর সাধারণ মানুষ জানতে পারেনি।

জিন্নার অনমনীয় মনোভাবের কাছে অবশেষে আত্মসমর্পণ করল কংগ্রেস। ভারত ভাগের সিদ্ধান্ত হলো। অবিভক্ত বঙ্গে মুসলিম সংখ্যাধিক্যের কারণে মুসলিম লিগের সরকার চলছে, তাই জিন্না পুরো বঙ্গপ্রদেশকেই পাকিস্তানের অন্তর্ভুক্ত করতে চাইলো। কিন্তু হিন্দু মহাসভার সভাপতি এবং বাঙ্গলার প্রাদেশিক আইন সভার সদস্য ড.শ্যামাপ্রসাদ মুখোপাধ্যায় উপলব্ধি করতে পেরেছিলেন যে পুরো বঙ্গপ্রদেশ যদিমুসলমানদের শাসনাধীন হয় তবে হিন্দু বাঙ্গালির ভবিষ্যৎ ধ্বংস হয়ে যাবে। তাই তিনি বঙ্গ বিভাগ করে হিন্দুবহুল অংশকে ভারতভুক্ত করার জন্য তীব্র আন্দোলন সংগঠিত করেছিলেন। যোগেন্দ্রনাথ মণ্ডল পুরো উলটো কাজ আরম্ভ করলেন। তিনি সমগ্র বাঙ্গলা ঘুরে ঘুরে তফশিলিদের মধ্যে বঙ্গভাগের বিপক্ষে এবং পাকিস্তানের পক্ষে জনমত গঠনের কাজে ঝাঁপিয়ে পড়েছিলেন। মুসলিম লিগের জয়গান গেয়ে তিনি বলতেন, “তফশিলি জাতি হিন্দুদের আওতায় থেকে ঘৃণিত জীবন যাপন করার চেয়ে মুসলমান অথবা অন্য কোনো জাতির আওতায় স্বাধীন ও সম্মানের সঙ্গে বাস করতে বেশি পছন্দ করে”। যাই হোক, ড.শ্যামাপ্রসাদের আন্দোলনই জয়যুক্ত হয়েছিল। বঙ্গ ভাগ করে হিন্দু বাঙ্গালিদের জন্য পশ্চিমবঙ্গের ভারতভুক্ত হওয়ার সিদ্ধান্ত পাশ হলো।

পুরো বঙ্গপ্রদেশ হস্তগত করার জন্য জিন্না আর একটি নতুন চাল চেয়েছিলেন, তার অনুগত সুরাবর্দির মাধ্যমে বাঙ্গালি সেন্টিমেন্টে সুড়সুড়ি দিয়ে। এ ব্যাপারে সঙ্গে পেয়েছিলেন শরৎচন্দ্র বসু, কিরণশঙ্কর রায় প্রমুখ কিছু নেতা এবং তাদের অনুগামীদের। তারা বাংলা ভাষাভাষীদের জন্য একটি স্বতন্ত্র স্বাধীন সার্বভৌম বাঙ্গলা’ গঠন করার প্রস্তাব দিয়েছিলেন। জিন্নার ধান্দা ছিল একবার পুরো স্বাধীন বাঙ্গলা বানাতে পারলে তারপর নির্জীব হিন্দু বাঙ্গালিদের মেরেকেটে ধর্মান্তরিত করে ইসলামিক দেশ বানাতে কঠিন হবেনা। জিন্নার এই চালটিও ব্যর্থ করতে সমর্থ হয়েছিলেন ড. শ্যামাপ্রসাদ।

অবশেষে ৩ জুন ১৯৪৭-এ ব্রিটিশ প্রধানমন্ত্রী ক্লিমেন্ট অ্যাটলি ভারত ভাগ করে পাকিস্তান ও ভারতের নেতাদের হাতে ক্ষমতা হস্তান্তরের দলিল ঘোষণা করেন ব্রিটিশ পার্লামেন্টে।

১৪ আগস্ট ১৯৪৭-এ পাকিস্তানের স্বাধীনতা দিবস। ৫ আগস্ট যোগেনবাবু করাচির উদ্দেশে দিল্লি ত্যাগ করেন। পাকিস্তান। গণপরিষদের প্রথম বৈঠক বসে ১০ আগস্ট। ওইদিন যোগেনবাবৃতার ভাষণে মহম্মদ আলি জিন্নাকে পৃথিবীর শ্রেষ্ঠতম রাজনীতিবিদ এবং মহত্তম ব্যক্তিত্ব বলে আখ্যায়িত করেন।

মুসলমানদের জন্য আলাদা দেশ পাকিস্তান গঠিত হয়ে গেল। এবার। দার-উল-ইসলাম গঠনের পরবর্তী ধাপের কাজ। অমুসলমানদের হয় তাড়াতে হবে নয়তো তাদের ধর্ম পরিবর্তন করে মুসলমান বানাতে হবে। শুরু হলো পরিকল্পিত ভাবে এথনিক ক্লিনজিং-এর কাজ। ১৯৫০ সাল নাগাদ পূর্ব পাকিস্তানে তা ভয়াবহ আকার ধারণ করল। রাষ্ট্রীয় ধর্মান্তরকরণের কাজ। তাতে উচ্চবর্ণ, নিম্নবর্ণ, তফশিলি কেউ বাদ গেল না। প্রায় ৫০ হাজার হিন্দু খুন হলো। লক্ষ লক্ষ হিন্দু ঘরবাড়ি ছেড়ে ভারতে পালিয়ে আসতে বাধ্য হলো। যোগেনবাবু নানারকম ভাবে চেষ্টা করলেন তফশিলিদের বাঁচাতে। যেমন করাচিতে তিনি একটি অদ্ভুত নিয়ম চালু করেছিলেন— যে সমস্ত তফশিলি কাজকর্মে বাইরে বেরুবে তারা পোশাকে সঁদ-তারা শোভিত একটি ব্যাজ পরবে এবং তাতে ‘ডিপ্রেসড ক্লাস’কথাটি লেখা থাকবে। যাতে মুসলমানরা তাদের চিনতে পারে এবং তাদের শুভাকাঙ্ক্ষী মনে করে কিছু না করে। কিন্তু যোগেনবাবুড. আম্বেদকরেরমতো ইসলামের তত্ত্ব সম্পর্কে ওয়াকিবহাল ছিলেন না। মুসলমানদের চোখে অমুসলমান মাত্রেই কাফের এবং হত্যার যোগ্য। দার-উল-ইসলামে তাদের কোনো জায়গা নেই। হয় মুসলমান হও না হয় মর। কাজেই তফশিলিরাও রেহাই পেল না। যোগেনবাবু আইনমন্ত্রী হয়েও তাদের রক্ষা করতে পারছিলেন না।

ভারতেও এই ঘটনার তীব্র প্রতিক্রিয়া আরম্ভ হলো। ড. শ্যামাপ্রসাদ মুখোপাধ্যায়, ড. বি আর আম্বেদকর, মহীশূর থেকে নির্বাচিত সাংসদ হনুমান্তাইয়া প্রমুখ নেতা জনবিনিময়ের দাবি তুললেন ভারতের সংসদে। পরিস্থিতি সামাল দেওয়ার জন্য ভারতের প্রধানমন্ত্রী নেহরু পাকিস্তানের প্রধানমন্ত্রী লিয়াকতআলি খানকে দিল্লিতে আমন্ত্রণ করে এনে ১৯৫০-এর ৮ এপ্রিল একটি চুক্তি করেন। যাকে ‘নেহরু -লিয়াকত চুক্তি’বলা হয়। এই চুক্তির বলে ঠিক হয় উভয় দেশের সরকার নিজ নিজ দেশের সংখ্যালঘুদের যাবজীয় নাগরিক অধিকার এবং নিরাপত্তা সুনিশ্চিত করবে। সংখ্যালঘুরা যাতে ভীতসন্ত্রস্ত হয়ে দেশ ছেড়ে না যান সরকার সেটা দেখবেন। যারা ইতিমধ্যেই দেশ ছেড়ে গেছেন তারা যাতে আবার নিজ নিজ দেশে ফিরে যেতে উৎসাহিত হয় সরকার সে ব্যাপারে উদ্যোগী হবেন ইত্যাদি। ড. শ্যা পাপ্রসাদ মুখোপাধ্যায় উপলব্ধি করেছিলেন যে ভারত সরকার এই সমস্ত ব্যাপার যথাযথ ভাবে পালন করলেও পাকিস্তান তাদের দেশের সংখ্যালঘুদের অর্থাৎ হিন্দু শিখদের জন্য এই চুক্তি পালন করবে না এবং এতে মুসলমানদের অবস্থা ভালো হলেও হিন্দুদের কোনো সুরাহাই হবে না। এই চুক্তির প্রতিবাদে তিনি নেহরু মন্ত্রীসভা থেকে পদত্যাগ করেন।

প্রকৃতপক্ষে দেখা গেল ড. শ্যামাপ্রসাদের অনুমানই ঠিক হলো। ভারত নিষ্ঠার সঙ্গে চুক্তি পালন করে সংখ্যালঘুদের নিরাপত্তা ও তাদের যাবতীয় অধিকার রক্ষা করলেও পাকিস্তান ওই চুক্তিকে গুরুত্ব না দিয়ে তাদের পরিকল্পিত ইসলামাইজেশন চালিয়ে যেতে লাগলো। যোগেনবাবু ওই চুক্তি দেখিয়ে পাকিস্তানে বিশেষ করে পূর্ব পাকিস্তানে তার ভরসায় থেকে যাওয়া মুসলমানদের দ্বারা নির্যাতিত তফশিলিদের মনোবল বাড়াবার চেষ্টা করতে থাকলেন। চুক্তির যথাযথ মান্যতা দিয়ে পাকিস্তানে তফশিলিরা যাতে মানসম্মান নিয়ে বাঁচতে পারে তাই নিয়ে পাকিস্তান সরকারের কাছে নানারকম প্রস্তাব, নানারকম সুপারিশ নিয়ে তৎপরতা আরম্ভ করলেন। পাকিস্তান সরকার হিন্দুদের বাঁচাবার জন্য যোগেনবাবুর এই তৎপরতায় যথেষ্ট বিরক্ত হলো এবং যোগেনবাবু এই নিয়ে যাতে অতিরিক্ত বাড়াবাড়ি না করেন তাই নিয়ে হুঁশিয়ারি দিল। যোগেনবাবু তার রাজনৈতিক অভিজ্ঞতায় উপলব্ধি করলেন পাকিস্তানের কাছে তাঁর প্রয়োজন শেষ হয়ে গেছে, তার কথায় কোনো কাজই হচ্ছে না। সুতরাং তিনি পাকিস্তানের মন্ত্রীসভা থেকে পদত্যাগের সিদ্ধান্ত নিলেন। তিনি এও উপলব্ধি করলেন পাকিস্তানে থেকে পদত্যাগ করলে তার প্রাণ সংশয় হতে পারে বা বাকি জীবন কারাগারে কাটাতে হতে পারে। তাই ভারতে অবস্থানরত অসুস্থ ছেলেকে দেখতে আসার নাম করে ভারতে আসেন। এবং ভারত থেকেই তার দীর্ঘ পদত্যাগ পত্র পাঠিয়ে দেন। তাঁর রাজনৈতিক জীবনে তিনি কীভাবে মুসলিম লিগের সেবা করেছেন, মুসলিম লিগকে কোন কোন রাজনৈতিক সংকটে কী কী ভাবে সাহায্য করেছেন, এই সমস্ত করেও তিনি যে হিন্দু বা অন্যান্য সংখ্যালঘু লোকেদের কোনো উপকারই করতে পারেননি, বরং তারা মুসলিম আগ্রাসনের শিকার হচ্ছে ইত্যাদির বিস্তারিত বিবরণ ও ব্যাখ্যা তিনি ওই পদত্যাগ পত্রে বিবৃত করেছেন। তিনি আক্ষেপ করে বলেছেন— “দীর্ঘ বিবেচনার পর আমি এই

সিদ্ধান্তে উপনীত হয়েছি যে, পাকিস্তান হিন্দুদের বসবাসের পক্ষে উপযুক্ত নয়। উচ্চবংশীয় এবং রাজনৈতিকভাবে সচেতন তফশিলি গোষ্ঠীভুক্ত অনেক লোক ইতিমধ্যেই পূর্ববঙ্গ ছেড়ে চলে গেছে। যে সকল অভিশপ্ত হিন্দু পাকিস্তানে থেকে যাবে আমার আশঙ্কা ধীরে ধীরে পরিকল্পনামাফিক তাদের ইসলামে ধর্মান্তরিত করা হবে, নয়তো তাদের ধ্বংস করে দেওয়া হবে।”

যে ভারতকে ঘৃণা করে তফশিলি নেতা যোগেন্দ্রনাথ মণ্ডল ভারতকে ত্যাগ করেছিলেন, অবশেষে শ্যামাপ্রসাদ সৃষ্ট পশ্চিমবঙ্গেই আশ্রয় নিয়ে ২৪ পরগনা জেলার বনগাঁয় বাকি জীবন কাটান। আত্মঘাতী রাজনৈতিক নেতাদের যোগেন মণ্ডলের জীবন থেকে শিক্ষা নেওয়া প্রয়োজন।

প্রণব দত্ত মজুমদার

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

This site uses Akismet to reduce spam. Learn how your comment data is processed.