জওহরলাল নেহরু এবং তারাশঙ্কর বন্দ্যোপাধ্যায়

প্রধানমন্ত্রী জওহরলাল নেহরুর সময়ে সংঘটিত নানান সমস্যার এক অন্যতম উদাহরণ— অসম সমস্যা। ১৯৬০-৬১ সালের সেই দাঙ্গায় বাঙ্গালিদের প্রতি অসমীয়দের আমানুষিক নির্যাতন ও অত্যাচার এবং মাতৃভাষার অধিকার রক্ষায় তরুণ-তরুণীর মৃত্যুর কথা আমাদের জানা। সেই দাঙ্গার স্মৃতিচারণা সূত্রে তারাশঙ্কর বলেছেন—

“সেদিন কোনাে একটি সংবাদপত্রে এই বাঙ্গালি নিধন বা নির্যাতন আন্দোলনের কারণ বিশ্লেষণ করতে গিয়ে এবং এর জন্য দায়ী করতে গিয়ে দায়ী করেছিলেন অসমের প্রায় সবকটি রাজনৈতিক দলকেই সে কংগ্রেসের একটি গােষ্ঠী থেকে সব দলকেই। কমিউনিস্টদের নাম তাে ছিলই। তার সঙ্গে আরএসপি-র নামও করেছিলেন। কিন্তু গৌহাটি শিলংয়ে নিজে গিয়েছি এবং ওখানকার কর্মীদের সঙ্গে আলাপের সূত্রে যা জানতাম বা জানি তাতে অসমে আরএসপি খুব সবল বা সক্রিয় নয়। সক্রিয় আরএসপিআই, এঁদের গৌহাটি গ্রুপের উৎসাহী কর্মীটিকেও আমি চিনি। তিনি ওখানকার তরুণ উকিল।”

সেই দাঙ্গার প্রভাবে কলকাতাও উত্তপ্ত হয়ে ওঠে। সমগ্র শহর জুড়ে চাপা উত্তেজনা তখন থমথম করছে। অসমীয় ছাড়াও অন্যান্য অবাঙ্গালিদের মধ্যেও তখন আতঙ্ক। কলকাতার দেওয়ালে দেওয়ালে লেখা হয় বাংলাদেশকে অবাঙ্গালি মুক্ত করতে হবে। অসমীয়দের এই অন্যায়ের বিরুদ্ধে কলকাতায় প্রতিবাদ সভা ডাকা হয় ইউনিভার্সিটি ইনস্টিটিউট হলে। তারাশঙ্কর ছিলেন সেই সভার সভাপতি।

সভায় যথেষ্ট উত্তেজনা ছিল। মঞ্চে নেতাদের ভিড়। সভায় উপস্থিত ছিলেন। মনােজ বসু, সৌমেন্দ্রনাথ ঠাকুর, ত্রিদিব চৌধুরি, সিদ্ধার্থশঙ্কর রায়, বিবেকানন্দ মুখােপাধ্যায়, প্রফুল্লচন্দ্র ঘােষ, মন্মথকুমার চৌধুরি, অসমের নেতা স্বর্গীয় অরুণ চন্দ’র পত্নী জ্যোৎস্না চন্দ প্রমুখ। সভার উদ্যোক্তাদের মধ্যে প্রধান ছিলেন—পত্রিকা বাড়ির প্রফুল্লকান্তি বা শতদলকান্তি ঘােষ। এছাড়া কোনাে কংগ্রেস নেতা বা কমিউনিস্ট পার্টির কোনাে নেতা সভায় উপস্থিত ছিলেন না। সভার কাজ আরম্ভ হয়েছিল বরিশালের মুকুন্দদাস রচিত একটি গান দিয়ে। সে গানেও ছিল অগ্নিযুগের উত্তেজনা। সভার উদ্ধত, উদ্ধৃঙ্খল এবং হিংস্র চেহারা দেখে তারাশঙ্কর সভা আরম্ভের প্রারম্ভেই প্রচলিত নিয়ম অর্থাৎ সভাপতির বক্তব্য সর্বশেষে দেওয়ার নিয়মটি লঙ্ঘন করে আবেদন জানিয়ে বলেছিলেন- “আমাদের এই প্রতিবাদ যেন আমাদের বাঙ্গালির জাতীয় জীবনের ঐতিহ্যের গৌরব এবং মর্যাদাকে ক্ষুণ্ণ না করে। আমরা যেন রাজা রামমােহন রায়, থেকে বিশ্বমানব রবীন্দ্রনাথ এবং মহানায়ক নেতাজী সুভাষচন্দ্রকে মনে রেখে আজ এই সভায় আমাদের দুঃসহ দুঃখ ক্ষোভকে উপযুক্তভাবে প্রকাশ করি। একের অন্যায়ে তার জ্ঞাতি বা আত্মীয়কে নির্যাতিত করি।… সভা এতে আমার উপর ক্ষিপ্ত হয়ে উঠেছিল। তাতে আমি হাতজোড় করে বলেছিলাম, তাহলে আমাকে আপনারা মার্জনা করুন। এ সভায় সভাপতিত্ব করতে আমি পারব না। কারণ সংসারে বর্বরতার প্রতিবাদে বর্বর হব এই সংকল্প গ্রহণ করে ঘােষণা করবার জন্য কোনাে সভা সমিতির প্রয়ােজন হয় না।”

তারাশঙ্করের বক্তব্যের ব্যঞ্জনা আশ্চর্য প্রভাব বিস্তার করেছিল সভার উপর। উত্তেজিত জনতা মুহূর্তেই স্তব্ধ হয়ে গিয়েছিল। এরপর বিবেকানন্দবাবুর বক্তৃতায় সভা আবার জ্বলে ওঠে। তিনি বলেছিলেন, “সভাপতি যা বলেছেন এবং সৌমেনবাবু যা বলেছেন তা অবশ্যই ভালাে কথা—কিন্তু শিক্ষা ঠিক ভারতীয় নয়। আমার শিক্ষা মহাভারতের শিক্ষা। আমার শিক্ষা— দ্রৌপদীর অপমানে দুঃশাসনের বক্ষরক্ত পান করতে বলে ভীমকে। কৌরবদের সবংশে নিধন করতে বলে। বিবেকানন্দবাবুর বক্তৃতায় সভায় উপস্থিত মানুষের মধ্যে ক্ষোভের আগুন জ্বলে ওঠে। কলরব কোলাহলে পাগলের প্রমত্তপনা শুরু হয়। হাত-পা ছুড়ে শাসনের আস্ফালন শুরু হয়। তাদের লক্ষ্য ছিল তারাশঙ্কর। জ্যোৎস্না চন্দ হাতজোড় করে বলেন—“আপনারা এখানে ধৈর্য হারিয়ে এখানকার অসমীয় বা অবাঙ্গালির উপর অত্যচার করলে অসমে আমরা আরও অধিক পরিমাণে বিপন্ন হব”। উত্তেজিত সভায় হইচই করে তাঁকে বলতে দেওয়া হয় না— রূঢ়তম বাক্যে থামিয়ে দেওয়া হয় তাঁর কথা। এই ভাবেই পুরাে আড়াই ঘণ্টা ক্ষোভ প্রকাশের কোলাহলে এবং ঘুষি আস্ফালনের দৃশ্যের মধ্যে তারাশঙ্কর অপরাধীর মতাে সভাপতির আসনে বসেছিলেন। আড়াই ঘণ্টার পর সভা শেষ হয় কিন্তু কোনাে প্রস্তাব গৃহীত হয় না, এমনকী যাঁরা অসমে মারা গেছেন এবং লাঞ্ছিত হয়েছেন তাদের জন্য কোনাে সমবেদনাও প্রকাশ করা হয় না। মানসিক আঘাতে জর্জরিত তারাশঙ্কর উচ্চ রক্তচাপ নিয়ে বাড়ি ফিরে চিকিৎসকের সহযােগিতা নিতে বাধ্য হলেন, তথাপি চলতি ভাবতরঙ্গ বা হুজুগে নীরব থাকতে পারলেন না। পত্রমাধ্যম বা চিঠি লিখে তিনি সেই মর্মান্তিক ঘটনার অবসানে নীতির পথে অগ্রসর হলেন।।

২১ মে ১৯৬১ সালে প্রধানমন্ত্রী নেহরকে পরামর্শমূলক এক চিঠিতে তারাশঙ্কর লেঘেন—

“I am sure, that this tremendous but well founded faith of the people in you must be honored at all costs to ensure the stability, security and prosperity of a growing community of four hundred sixty million men and women. This is a great responsibility but you have seldom been found wanting to fulfill it.

The Silchar firing on Satyagrahis resultin in the death of nine (until today) including a teen-ager girl has reopened the wound which, so many of us wishfully thought, was healing. The eagerness of the state Government to maintain of law and or

der in the present case, so violently in contrast with their lasses-faire attitude last year, gives much support to the contention that State Government is determined in fragrant defiance of all ethical and patriotic principles to liquidate all democratic opposition to their linguistic chauvinism. Must this continue without opposition indefinitely? Is the autonomy of the State so much stronger than the balanving authority of the centre? Many like me are seeking anseers to these questions in bewilderment. I again approach you with my doubts and misgivings and very respectfully suggest that there sould be an open announcement at your level of the concrete measures that are proposed to be taken to redress the grievances of all sections of the minoritis in Assam and to prevent outrages be the majority and the State Govt. It also necessary to announce the ways and means of carrying out these assurances.

কেবলমাত্র পরাশই নয়, নেহরুজীর সিদ্ধান্ত গ্রহণের বিলম্বে একেবারে সরাসরি কৈফিয়ত তলব করে বাংলায় লেখা এবং ইতিপূর্বে অপ্রকাশিত একটি চিঠিতে তারাশঙ্কর লেখেন— পরম শ্রদ্ধাস্পদ নেহরুজী,

এই পত্র অসুস্থ শরীরে রােগশয্যা হইতে আপনাকে লিখিতেছি। চিকিৎসক সকল প্রকার মানসিক চিন্তা উৎকণ্ঠা আবেগ পরিহার করিতে নির্দেশ দিয়াছেন।কিন্তু তার পারেন যাঁহারা তাহারা যে স্তরের মানুষ আমি তাহা নই। অসমে নির্যাতিত বাঙ্গালি সমাজের জন্য উৎকণ্ঠায় সমগ্র বাঙ্গালি জাতির সহিত আমিও হৃদয়াবেগে পীড়িত। তাহা স্বংবরণের সাধ্য আমার নাই। আপনি স্বকীয় মানবিকতার আহ্বানে কর্তব্যের নির্দেশে অসম স্বচক্ষে পরিদর্শন করিয়াছেন। আমিও ওই মর্মে আপনাকে যে অনুরােধ জানাইয়াছিলাম, তাহাও ইহাতে রক্ষিত হইয়াছে। আপনাকে অসংখ্য ধন্যবাদ। আপনি ভারতবর্ষের ন্যায়বােধে দৃঢ়তা, সততা ও সাহসের আশ্রয়স্থল কেন্দ্রবিন্দু। আমাদের মতাে অসংখ্য মানুষের সমর্থনে তাহা আজ বিশ্ববন্দিত। তাই আপনি অসমের জনসভায় যে সমস্ত উক্তি করিয়াছেন তাহা অসস্থ রুগ্ন অবস্থাতেও সযত্নে শ্রদ্ধার সহিত পড়িয়াছি, বুঝিতে চাহিয়াছি। শুধু আমি নই— সমস্ত বাঙ্গালি জাতিই চাহিয়াছে। আপনি পূর্বে কলিকাতার জনসমাজের আবেগ-প্রবণতার সমালােচনা করিয়াছেন— সেই জনসমাজ কী অসীম ধৈর্য ও সংযমের সহিত শােকদিবস পালন করিয়াছে তাহা অবশ্যই লক্ষ্য করিয়াছেন। আপনি অসম যাইতেছেন—এটাই ছিল এক্ষেত্রে বাঙ্গালির বড়াে প্রত্যাশা। আপনি অসমের জনসভায় বলিয়াছেন—কংগ্রেস কর্মীদের কর্তব্য কর্মীরা যথােপযুক্তভাবে পালন করেন নাই, তাহাতে কর্মীরা গুঞ্জন তুলিয়াছে। তাহা লক্ষ্য করিয়াছি। মনে মনে বলিয়াছি— মানুষের স্বার্থান্ধতা যখন স্থির মস্তিষ্কের বিশ্লেষণ এবং বিবেকের বাণীতে উগ্র হইয়া প্রতিবাদ তােলে তখন মানুষের যে আত্মিক সর্বনাশ হয়, অসম কংগ্রেসের তাহাই ঘটিয়াছে। কারণ আপনি আজও কংগ্রেসের স্থির মস্তিষ্ক স্বরূপ। তাহার বিবেক বাণী আপনার কণ্ঠেই উচ্চারিত হয়। ভারতবর্ষ- একবার ধর্মবিদ্বেষ… (ছিন্ন) খণ্ডিত হইয়াছে, আবার ভাষা-বিদ্বেষের বিষময় ছুরিকা সুত্রপাত অসমে অসমীয়রা টানিলেন তাহাতে সেই সূত্র বিরাট ফাটলে পরিণত হইয়া ভারতবর্ষকে কত খণ্ডে কত মর্মান্তিক কলহে দীর্ণ করিবে তাহা সংবিধান সম্মত চৌদ্দটি ভাষার সূচি অনুযায়ী চৌদ্দটি কলহেই শেষ হইবে না।।

আপনি বলিয়াছেন— অসমে অসমীয় ভাষাই প্রাদেশিক ভাষা হওয়া উচিত। এ কথাও আমরা অত্যন্ত শ্রদ্ধার সঙ্গে বিবেচনা করিয়া গ্রহণ করিতে চেষ্টা করিয়াছি। বিক্ষুব্ধ বিচারপার্থীর মনস্তুষ্টি করিয়া বিচার হয় না মানি, তাহাও আমরা অন্তত আমি বলি না। বি. …(ছিন্ন) এমআরসি-র প্রস্তাব সম্মুখে রাখিয়া বলি— যে যেখানে অসমীয়া ভাষা শতকরা ৭০ জনের ভাষা হওয়া দুরে থাক—

মাত্র ৪০ জনের ভাষা এবং বাংলা যেখানে অন্তত ২৪-২৮ জনের ভাষা সেখানে তাহা মানি কী করিয়া? এই দশ বৎসরে অসমীয়া ভাষার বৃদ্ধি… (ছিন্ন) একমাত্র জাদুবিদ্যার প্রভাব ব্যতিরেকে এবং জাদুবিদ্যায় যাহা সম্ভব কঠোর বাস্তব বিচারে তাহাকে—তাহা সম্ভবত আদমসুমারির কর্তাদের মন্তব্যেও স্বীকৃত হইয়াছে। অবশ্য পরে আপনি বলিয়াছেন, সকল সম্প্রদায় মিলিয়া এ সমস্যার সমাধান করিবেন। এবং ৩১ জুলাই অসমীয়া ছাত্রবৃন্দের সভায় ভাষা সপ্তাহ কাৰ্য্যকর্ম নির্ণয়ে যদি হিংসাত্মক পন্থা গৃহীত হয় তবে সমস্ত শিক্ষা প্রাথমিকভাবে বন্ধ করিয়া দিবেন বলিয়াছেন। ইহা অবশ্যই আমাদিগকে কিঞ্চিৎ সাহস দিয়াছে। আপনি অসমে তিন সপ্তাহ সময় দিয়াছেন— নিরাপত্তা সূচক মনােভাব সৃষ্টি করিয়া নিপীড়িত পলায়িত বাঙ্গালিদের ফিরাইয়া আনিবার জন্য। কিন্তু তাহা সৃষ্টিহইল কিনা— বাঙ্গালি ফিরল কিনা নিজেদের নিরাপদ ভাবিল কিনা— কে বলিয়া দিবে? বর্তমান অসম সরকার ?

যাহারা এতবড়াে নির্মম অতাচারে বাঙ্গালিকে উৎখাত করিতে গিয়া ভারতবর্ষে ভাষা সমস্যা লইয়া ঐক্যকে বিপন্ন করিবার দৃষ্টান্ত স্থাপন করিল— তাহার বিচার হইল কই?

তিন সপ্তাহে যদি বাঙ্গালি না ফিরিতে সাহস করে তবে কী বাঙ্গালি দায় হইবে? আজ রােগশয্যায় শুইয়া— সমস্ত চিন্তাকে একত্র করিয়া কূল পাইতেছিনা, আপনাকেই প্রশ্ন করিতেছি আমরা কী করিব? তিন সপ্তাহ পর— আপনি কী করিবেন ?

শ্ৰদ্ধানত তারাশঙ্কর বন্দ্যোপাধ্যায়

১৯৬২ সালে তারাশঙ্কর বাংলা সাহিত্যসৃষ্টিতে অতুলনীয় অবদানের জন্য ভারত সরকার প্রদত্ত ‘পদ্মশ্রী’ উপাধি পান। ‘সাহিত্য আকাদেমির ন্যায় পদ্মশ্রী’সম্মানও তারাশঙ্করের হাতে তুলে দেন প্রধানমন্ত্রী নেহরু।।

নেহরুজীর আমলে আর এক গুরুত্বপূর্ণ সমস্যা ১৯৬২ সালে চীন-ভারত সীমান্ত সংঘর্ষ। এই যুদ্ধে বিপর্যয়ের ইতিহাস যেমন রচিত হয় তেমই দেশজুড়ে গড়ে ওঠে জাতীয় ঐক্য। এ বিষয়ে তারাশঙ্কর বলেন, “ গােটা ভারতবর্ষে যেন আশ্চর্যবেগে কম্পন বয়ে গেল। একটা যেন জাদুর খেলা ঘটে গেল।অসংখ্য রাজনৈতিক দলে বিভক্ত, নানান প্রশ্নে— ভাষার প্রশ্নে, ধর্মের প্রশ্নে, সীমান্তের প্রশ্নে দেশটা যেন এক মুহূর্তে সকল বিবাদ পাশে ঠেলে, সকল প্রশ্নে ধামাচাপা দিয়ে এক হয়ে দাঁড়িয়ে গেল।

পার্লামেন্টে একটা আইন পাশ হয়ে গেল বিশেষ ক্ষমতাবলে। এদেশের অধিবাসী যারা তাদের পক্ষে ভারতের বর্তমান সীমান্তরেখায় সংশয় প্রকাশ করা দেশদ্রোহিতার অপরাধ হিসেবে গণ্য করা হবে। সংশয় প্রকাশ করার অর্থটার মধ্যে বিশ্বাস-অবিশ্বাসের প্রশ্ন ছিল না। ছিল চীন অথবা ভারতবর্ষকে সমর্থনের প্রশ্ন।

চীন ভারত আক্রমণ করেছে সেজন্য ভারতের গ্রামে-শহরে গড়ে ওঠে প্রতিবাদ সভা। তারাশঙ্করের জন্মস্থান বীরভূমের লাভপুরে প্রতিবাদ সবায় জনসমাগম হয়েছিল প্রচুর। সেই সভায় তারাশঙ্কর তাঁর ভাষণে বলেছিলেন, “ কালে কালে যুগে যুগে মহাপ্রকাশ হয় দেশের। বিশেষ করে ভারতবর্ষের, মা ভারতবর্ষের মৃন্ময়ীরূপের মধ্যে চিন্ময়ী ধ্যানস্থ। চিন্ময়ী হলেন মহাশক্তি মহিমার উৎস, মাটি থেকে বেরিয়ে এসে চোখের সামনে দাঁড়ান, মানুষকে জাগান।। বলেন, ওঠো জাগাে, অন্যায়কে দূর করাে। ন্যায়ের জন্য জীবন দাও। অমর হও। আমার পায়ে প্রাণ বলিদান, সর্বস্ব দান করে আমার হাতের অমৃত পাত্র থেকে অমৃত প্রসাদ গ্রহণ কর। চিতােরে একবার এমনই সংকটে মা বলেছিলেন, ম্যায় ভুখা হুঁ। আজ চীনের আক্রমণের সংকটের মধ্যে তেমনই ভাবে মা জেগেছেন।”

চিন্ময়ী ভারতবর্ষের সেই মহাপ্রকাশ সেদিন ভারতের প্রধানমন্ত্রী দেখেছিলেন। পার্লামেন্টে বসে তারাশঙ্কর নিজের কানে শুনেছিলেন নেহরুজীর ভাষণ। বলেছেন, “সেদিন লােকসভায় প্রধানমন্ত্রী বলেছেন, আমি চোখের সামনে দেখছি বিচিত্র দৃশ্য। ভারতমাতার মুখের ওপর একটা আবরণ ছিল সেটা সরে যাচ্ছ। ভিতর থেকে এবং দিব্যমূর্তিতে মা জাগছেন। আমি দেখছি তার মূর্তি। তার ললাটে বহ্নি, নয়নে বহ্নি, হাতে বরাভয়, খঙ্গ ও বর্ম। তিনি বলছেন, পূজা আন্ ওরে পূজা আন্। ধন আন্, মান আন, প্রাণ আন্। পূজা দে।”

ভারত-চীন যুদ্ধের কিছুদিন পর, ১৯৬৪ সালের মে মাসে প্রধানমন্ত্রী নেহর তিরােধান ঘটে। তারাশঙ্করের কথায়, “ পণ্ডিতজী মারা গেলেন। লােকে বলে। পার্লামেন্টের স্পেশাল সেশনে চীন-ভারত সংঘর্ষ সংকট সম্পর্কে তাঁর যে একটি স্টেটমেন্ট দেবার কথা ছিল, তা নিয়ে চিন্তা করতে করতেই তার মৃত্যু ঘটে। তিনি সহ্য করতে পারেননি। সারা ভারতবর্ষ হায় হায় করে উঠেছিল। ভারতবর্ষ, এই মাটির ভারতবর্ষের আত্মা কেঁদেছিল।”তিরােধানের পর তারাশঙ্করের বক্তব্য ছিল—

“এ মানুষ যে এমন অসাধারণ যার। তুলনা ভারতবর্ষের রাষ্ট্রের ইতিহাসে দূরদূরান্তে সন্ধান করেও ঠিক মেলে না। সম্রাট অশােক, হর্ষবর্ধন, সমুদ্রগুপ্ত, ইসলাম শাহির মধ্যে সম্রাট আকবর শাহ সমগ্র ভারতবকে একগ্রন্থনে গ্রন্থন করে তাদের রাজত্বকালে একটি শান্তিসমৃদ্ধ ও শৃঙ্খলাবদ্ধ ভারতবর্ষের সৃষ্টি করতে পেরেছিলেন। যে ভারতবর্ষে সম্রাটের নাম শ্রদ্ধার সঙ্গে উচ্চারিত হয়েছে, কৃতজ্ঞতার সঙ্গে স্মৃতিলােকে স্থান পেয়েছে। ইংরেজের আমলের ভারতবর্ষ নিষ্ঠুর শাসনে শাসিত ও একান্তভাবে পীড়িত মানুষের দুঃখের সূত্রে ঐক্যবদ্ধ। কিন্তু পণ্ডিত জওহরলাল নেহরু যে ভারতবর্ষকে সৃষ্টি করেছেন সে ভারতবর্ষে প্রতিটি ব্যক্তি স্বাধীন, সকল প্রকার শাসন ও ত্রাস থেকে মুক্ত, অথচ সারাটি দেশ প্রেমের দ্বারা পরস্পরের সঙ্গে যুক্ত ব্যক্তিসমষ্টি জাতীয় প্রেরণায় উদ্বুদ্ধ। তুচ্ছ বাদবিসংবাদ, বিরােধী রাজিৈতক প্ররােচনায় কিছু অশান্তির সৃষ্টি হয়েছে কিন্তু তাকে মিথ্যা বা কৃত্রিম বলে প্রতিপন্ন করেছে। ভারতবর্ষের জনসমষ্টি এই চীন আক্রমণের সময়। দেশের প্রতি ভারতবাসীর যে আশ্চর্য অনুরাগ ভালােবাসা তা স্বর্ণাক্ষরে লিখিত থাকবে ভারতবর্ষের ইতিহাসে। এই ভারতবর্ষ পণ্ডিত জওহরলালের সৃষ্টি। এর মূলে যে প্রেম তার উৎস ছিলেন তিনিনিজে। তিনি আপন বিশাল হৃদয়ের ভালােবাসায় ভারতবর্ষের মানুষকে অভিসিক্ত করে দিয়েছিলেন বলেই ভারতবর্যর প্রতিটি মানুষ তাঁকে প্রগাঢ়তম শ্রদ্ধা ও প্রেমের সঙ্গে ভালােবেসেছিলেন। ভারতবর্ষের প্রতিটি ব্যক্তিই ছিল তার কাছে ভারতবর্ষ। একটি ব্যক্তির দুঃখও তাকে স্পর্শ করেছে এবং সে দুঃখকে তিনি ভারতবর্ষের দুঃখ ভেবেছেন। তাই ভারতবর্ষের মানুষের কাছে তিনিই হয়ে উঠেছিলেন ভারতবর্ষ।”

জওহরলাল নেহরুর এমন ঐতিহাসিক কৃতিত্বময় আদর্শের প্রতি আন্তরিক শ্রদ্ধা নিবেদন করেন তারাশঙ্কর। যা সত্যই তাকে শ্রদ্ধার সঙ্গে বরণ করে নেওয়া এবং উচ্চকণ্ঠে তার মহিমা ঘােষণা করা তারাশঙ্করের স্বভাবধর্ম ছিল। কিন্তু বাস্তবিক যা অসত্য এবং আপাত সত্যের অন্তরালবর্তী যে দৃষ্টিকে তাঁর অসত্য বলে মনে হতাে তাকে নিরঙ্কুশ কণ্ঠে প্রকাশ করতেও তিনি জড়িতকণ্ঠ হননি কোনােদিনই। ভারত নির্মাণ প্রসঙ্গে নেহরুর ঐতিহাসিক কৃতিত্বময় আদর্শের প্রতি শ্রদ্ধা নিবেদন করলেও তার পূর্ণতার অভাবের কথাও নির্দ্বিধায় তুলে ধরেন তিনি। বলেছেন—

“১৯৪৭ থেকে ১৯৬৫ সাল পর্যন্ত ভৌগােলিক ভারতের বহু সংগঠন সত্ত্বেও ভারতে মানুষের চরিত্র যে মেরুদণ্ডহীনের মতাে ভেঙে বিপর্যস্ত হয়ে পড়ে বর্তমান শােচনীয় অবস্থায় উপনীত হয়েছে তা আজ জীবনের প্রতিটি ক্ষেত্রে পরিস্ফুট। পরিস্ফুট শব্দটি এক্ষেত্রে মৃদু। হিংস্র ভঙ্গিতে দস্তুর প্রকাশে এ কদর্যতা মুখ বাড়িয়ে একটা বিভীষিকার সৃষ্টি করেছে। মহাত্মাজীর তিরােধানের পর পণ্ডিত জওহরলালজী প্রাণপণে চেষ্টা করেছেন ভারত জীবনকে গঠন করতে। তিনি শুধু ভৌগােলিক ভারতবর্ষের সংগঠন করতে সমর্থ হয়েছেন।

অনেক কিছু গড়ে উঠেছে ভারতবর্ষে, এ অস্বীকার কেউই করবেন না। কিন্তু মানুষের মধ্যে আত্মিক সংগঠনে চরিত্রবান মানুষ সৃষ্টি হয়নি এবং দৃঢ়চরিত্র আদর্শবাদী সমাজেরও সৃষ্টি হয়নি। কারণ গান্ধীজীর আত্মিক ও আধ্যাত্মিক শক্তি পণ্ডিতজীর ছিল না— একথা পরম শ্রদ্ধেয় পণ্ডিতজীর প্রতি অকুণ্ঠ শ্রদ্ধা নিবেদন করে বললেও তার আত্মা প্রণীত হবে না বা তাঁর স্মৃতির প্রতি অশ্রদ্ধা প্রকাশ করা হবে না।”

জওহরলাল নেহরুর প্রয়াণের পর প্রধানমন্ত্রী হন লালবাহাদুর শাস্ত্রী। তারাশঙ্কর আরও কিছুকাল রাজ্যসভার সাংসদ ছিলেন । তারাশঙ্করের ভায়ায়—“সৎ লােক, শান্ত। লােক — কিন্তু মৃদু মানুষ। জ্বলে উঠে জ্বালিয়ে দিতে জানেন।”

ড. দেবাশিস মুখােপাধ্যায়

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

This site uses Akismet to reduce spam. Learn how your comment data is processed.