আমাদের এই প্রিয় পৃথিবীর দু’হাজার বছরের ইতিহাসে বর্তমান ২০২০ সালটা বৃহত্তম মহামারীর কাল হিসেবে বিবেচিত হয়ে থাকবে। গুটিকয় হাতে গােনা দেশ ছাড়া এমন কোনাে দেশ নেই যারা এই অদৃশ্য মারণ ভাইরাসের সংক্রমণজনিত আতঙ্কে আতঙ্কত হয়নি। মহাকালের বিচারে এই বছরটা যেন ইট চাপা ঘাসের মতাে থেকে যাবে।
এই ঘটনার বাইরে এই বছরের যে দুটি ঘটনা ইতিমধ্যেই বিশেষ স্থান করে নিয়েছে সেগুলি হল তুরস্ক ও ভারতবর্ষে দুটি ধর্মস্থানের নবকলেবর যাত্রার পত্তন। দুই ক্ষেত্রেই ইতিহাসের পুনর্নির্মা ঘটল। একটি গােড়ায় যা ছিল না তাই হতে চলেছে, অন্যটি ফিরবে আদির টানে। সেই সঙ্গে বর্তমান কাঠামাের ভক্তদের ভক্তিভরে নবদেবালয় বানিয়ে দেওয়ার প্রতিশ্রুতি দিয়ে। এখানে রয়েছে সর্বোচ্চ ন্যায়ালয়ের ভুমিকা।
৫৩৭ খ্রিস্টাব্দে বাইজান্টাইন শাসনকালে নির্মিত বিস্ময়কর স্থাপত্যকীর্তির গির্জা ‘আয়া সােফিয়া’ ১৪৫৩ তে অটোমান রােমান শাসনকালে ‘হাজিয়া সােফিয়া’ মসজিদে রূপান্তরিত হয়, যেটি বিশ্বের আপামর পর্যটকদের কাছে ব্লু মস্ক নামে পরিচিত। ভ্রমণকারীদের কাছে যার হাতছানি প্রায় তাজমহলের মতােই অপ্রতিরােধ্য। আরও পরে ১৯৩৫-এ কামাল আতাতুর্ক পাশার হাতে ধর্মনিরপেক্ষ তুরস্ক গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠিত হওয়ার পর এটি মিউজিয়ামে পরিণত হয়। সযত্নে যথাসম্ভব রক্ষিত থাকে খ্রিস্টীয় ও ইসলামি স্থাপত্যের অমূল্য নিদর্শনগুলি।
কিন্তু তুরস্কের বর্তমান শাসক এগােয়ার্নোর গোঁয়ারতুমিতে ১০ জুলাই, ২০২০ সেখানকার সর্বোচ্চ ন্যায়ালয় জানালাে, সেকুলার মিউজিয়ামকে ইসলামিক উপাসনাগার হতে হবে। প্রার্থনাকালে ঢাকা থাকবে অনিন্দ্যসুন্দর মেরি যিশুর অবয়ব-সহ নবম শতকের বহুমূল্য মাস্টারপিসগুলিও। সেই সময় বিধর্মীদের জন্য বন্ধ হবে দরজা। তুরস্কের বর্তমান শাসক প্রমাণ করলেন কামাল পাশা নামক প্রহাদের দৈত্যকুলে কোনাে স্থান নেই। একদিন সেকুলার’ভারতবর্ষে স্যাটানিক ভার্সেস নিষিদ্ধ হলেও তুরস্কে নিষিদ্ধ হয়নি। ভাবা যেতেই পারে আগামীদিনে তুরস্কও‘সেকুলার’ ভারতের পথে হেঁটে রুশদির কিতাব নিষিদ্ধ করবে।
সেনজেন ভিসার মেয়াদকাল এখনাে বজায় থাকার কারণে ইজরায়েল ভিসা পাওয়া অনেক সহজ ও সুলভ। তাই সেই সঙ্গে কায়রাে আর ইস্তাম্বুলকেও জুড়েছিলাম। বসফরাসে ভাসা, সেই সঙ্গে ব্লু মস্ককে দুচোখ ভরে দেখার সাধ দীর্ঘ দিনের। সেই সঙ্গে সােক আরাবিকের পথে জেরুজালেমে হাঁটব, নীল নদের ক্রুজ সেরে চাদের আলােয় স্ফিংস দেখব। এই সব ভাবনায় জল ঢেলে দিল দুই ভাইরাস : করােনা আর এগােয়ার্নো। আয়া শােফিয়ার শীলিত দেহের অমূল্য সৌন্দর্যায়ন ঢেকে বসানাে হয়েছিল ইসলামের অলংকার। পুনর্মর্সজিদিকরণের পক্ষে উদ্ধত সওয়াল হতেই পারে। স্পেনে যখন মসজিদ ভেঙেছিল তার বেলায় ?
একথা ঠিক, ১৩৩৪-এর পর সার্বিয়া, বােসনিয়া, আলবানিয়া, এপিরাস, এশিয়া মাইনর—এগুলােকে ওটোমান সাম্রাজ্য একত্রিত করছিল। বেলগ্রেড ছুই ছুই। হাঙ্গেরি, ভিয়েনা, মাল্টা দখল কেবল সময়ের অপেক্ষা। ঠিক তখনই ক্যাথলিক পর্তুগাল এবং সঙ্গী এসপানিয়া রুদ্র রূপ ধারণ করেছিল। পােপ পঞ্চম নিকোলাস মন্তব্য করেছিলেন, ‘The war waged by the Portugese was a savage one admittedly, but it was a question of wiping out Mohamedan Plague’. 7601 বলা যায় ইউরােপের বামিয়ানরা রক্ষা পেয়েছে।
অযােধ্যায় যেটা ঘটেছে সেটা পুনর্মন্দিরীকরণ। মধ্যিখানে কোনাে মিউজিয়ামের গল্প নেই। ১৩৩৪ সালের তুলনায় মির বাকি নির্মিত সৌধটি সম্পদ, ঐশ্বর্য, সৌন্দর্য সুষমা কোনাে দিক দিয়েই আকর্ষণীয় ছিল না। কোনাে ধর্মপরায়ন মুসলমান সেখানে প্রার্থনা করত না। অযােধ্যার জনৈক মুসলমান তাজ দর্শনকালে আমাকে বলেছিল পশ্চিম মুখে না ঢুকে, মূর্তি ছাপা দেওয়ালের খণ্ডাহারে সে বাবরি মসজিদে নামাজ পড়তে অনিচ্ছুক।
১৯৮৩ সালে মুম্বাইয়ের এলফিনস্টোন কলেজ থেকে ভি টি স্টেশনে আসার পথে রাস্তা জোড়া এক বিশাল জুলুসের মুখােমুখি হয়েছিলাম। সেই মিছিল থেকে ছিটকে এসে এক যুবক রামচন্দ্রের কারাবন্দি একটা ছােট্ট রঙিন ছবি আমার হাতে দিয়েছিল। ছবির তলায় লেখা, “আগে বঢ়ো, জোরসে বােলাে, জনমভূমিকা তালা তােড়াে। সেদিনই অযােধ্যা মামলার কথা প্রথম জানি। তালা খুলিয়েছিলেন আমাদের অকালপ্রয়াত প্রধানমন্ত্রী রাজীব গান্ধী।
মাতামহর মতাে তিনি মেকিয়াভেলিপন্থী বােধ হয় ছিলেন না। থাকলে সমস্যাটিকে জিইয়ে রেখে আরাে পাঁচশাে বছর হয়তাে কাটানাে যেত। আযােধ্যায় মসজিদ বানানাে, মক্কায় কৃষ্ণমন্দির নির্মাণের সমতুল। কাশীর জ্ঞানবাপী মসজিদের প্লিন্থ-এ হিন্দু স্থাপত্যতাে প্রকাশ্যে দেখা যায়।
তুরস্ক মূলে যায়নি। ১৩৩৪-এ থেমেছে। ভারতের সমস্যা বাইনারি। নরেন্দ্র মােদী মূলে গেলেন। তাই চটেছেন ওয়াইসি নামক ভদ্রলােক। প্রধানমন্ত্রীকে তিনি ‘সেকুলার’ হতে বলেছেন, যে বিচিত্র শব্দটি আমাদের সংবিধানে ইন্টাপোলেট করেছেন ইন্দিরা গান্ধী। পৃথিবীর কোনাে সভ্য, আধুনিক, উন্নত দেশ এই আধিক্যে (আদিখ্যেতায় ?) ভােগে না। নিজের দেশকে সেকুলার বলাটা মানুষকে মনুষ্যত্ব যুক্ত মানুষ’ট্যাগ পৈতের মতাে বহন করার সমান। আধুনিক দেশ মাত্রই সেকুলার। বরং মুসলমান প্রধান কোনাে দেশে সেকুলারিজম চীনে গণতান্ত্রিক নির্বাচনের মতােই অনুপস্থিত।
অবশ্য ড্রিঙ্কিং ওয়াটার-কালার টিভির মতাে হসপিটাল বনাম মন্দিরের যুক্তিতে নাস্তিক ফ্যান্টাসি চর্চার অবকাশও এখানে থাকবে।
ড. কল্যাণ চক্রবর্তী