বাদী-বিবাদী পক্ষের অতি দীর্ঘসূত্রী বিক্ষোভ আন্দোলনের পর্ব পার করে মন্দির-মসজিদ বিতর্ক নিয়ে সর্বোচ্চ আদালতের রায় এই ভারতে নতুন প্রভাতের সূচনাকারী। ভারতের মানুষের হৃদয়ে রামের পরিচয় ‘মর্যাদা পুরুষোত্তম’ হিসেবে। নীতিবোধ ও মর্যাদাই তার জীবনচর্যা ও দর্শনে প্রস্ফুটিত। বিগত হাজার হাজার বছর ব্যাপী তাঁর জীবনকথাই সমস্ত ভারতবাসীকে মুগ্ধ ও অনুপ্রাণিত করে আসছে। একইসঙ্গে রামকথাই সাধারণ ভারতবাসীর চিরকালীন সাংস্কৃতিক, ঐতিহাসিক ও আধ্যাত্মিক উত্তরাধিকার হিসেবে গণ্য হয়।
এই পরিপ্রেক্ষিতে এমন একটি দীর্ঘদিন ধরে আটকে থাকা অতিগুরুত্বপূর্ণ মামলা যার বিষয়বস্তু শ্রীরামের জন্মস্থান অযোধ্যার নির্দিষ্ট কোন স্থানে তাই নিয়ে তার পাকাপাকি নিষ্পত্তি হওয়া বিশেষ গৌরবের। মামলাটির চূড়ান্ত ও দ্রুত নিষ্পত্তির জন্য সর্বোচ্চ আদালত টানা ৪০ দিনের নিরবিচ্ছন্ন শুনানির পর ৫ বিচারকের সর্বসম্মতিতে রায়দান করেছে। এই বিষয়টি শুরু থেকেই বিতর্কিত হয়ে ওঠে—পারস্পরিক স্বার্থ সঙ্তের পরিণতিতে মাঝে মধ্যেই চরম বিরোধিতা, এমনকি সংঘর্ষও ঘটেছে। এতদিনে আমাদের গরিমাময় সংবিধানের সঙ্গে সাযুজ্য রেখে আদালত সম্পূর্ন আইনী পদ্ধতিতে এই উত্তেজনাপ্রবণ বিতর্কের মীমাংসা করেছে। অত্যন্ত আনন্দ এই কারণে অনুভূত হচ্ছে যে সমগ্র ভারতবাসী একজোট হয়ে এই রায়কে স্বীকার করে নিয়েছে। এ বিষয়ে কোনো অসন্তোষ, বিরুদ্ধাচার কেউই করেনি।
প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদী নেতা হিসেবে এই সাফল্যের পূর্ণ প্রশংসার যোগ্য। ভারতবাসীর কাছে তাঁর সংযত ও মিলে-মিশে থাকার আবেদন এই শান্তির বাতাবরণ জারি রাখতে বড় ভূমিকা নিয়েছে। একই সঙ্গে প্রয়োজনীয় প্রশাসনিক তৎপরতার সফল প্রয়োগে দেশে নিশ্চিত এক নতুন প্রভাতের সূচনা হয়েছে।
এবার ইতিহাসের কথায় ফিরব। মূলত আদালতে ছিল চারটি মামলা। (১) পূজারী গোপাল সিংহ, (২) নির্মোহী আখড়ার তরফে, (৩) উত্তর প্রদেশ কেন্দ্রীয় সুন্নী ওয়াকফ বোর্ড, (৪) ভগবান শ্রীরাম স্বয়ং অর্থাৎ রামলালা বিরাজমান। এই চার পক্ষই বিবাদিত জমিতে তাদের অধিকার প্রতিষ্ঠার মালিকানা দাবী করে ও একই সঙ্গে অন্য পক্ষদের বিপক্ষে ইনজাংশনও প্রার্থনা করে।
ইলাহাবাদ উচ্চ আদালত হিন্দু পক্ষকে সমগ্র অঞ্চলের কেন্দ্রীয় স্থলে পূজা অর্চনার অধিকার দেওয়ার সঙ্গে সঙ্গে ওই স্থানটিও হিন্দুদের অর্পণ করে কিছুটা রিলিফ দেয়। এছাড়া সমগ্র বিবাদিত অঞ্চলটিকে তিন ভাগে ভাগ করে হিন্দু সম্প্রদায়, নির্মোহী আখড়া ও মুসলিমদের মধ্যে সমবন্টন করার আদেশ দেয়। এই রায়কে সর্বোচ্চ আদালতে চ্যালেঞ্জ জানানো হয়। এরই পরিণতিতে সর্বোচ্চ আদালতের এই চূড়ান্ত রায়দান। মামলা চলাকালীন প্রমাণ হিসেবে বিপুল পরিমাণনথিপত্রের মধ্যে মৌখিক ও সরকারি তথ্যাদি যুক্ত প্রমাণপত্র উভয়ই ছিল। যেগুলির সামগ্রিক পরিমাণ হাজার হাজার পাতা। এই বিপুল তথ্যাদির পারস্পরিক প্রামাণ্যতা ও যুক্তিগ্রাহ্যতা সমস্ত কিছুই আদালত বিচার বিশ্লেষণ করে নেয়। দু’ একটি উদাহরণ তুলে ধরব।
১৭৪০ সালে জোসেফ টিয়েফেনথালার নামে একজন জে্যুইট পাদ্রি ভারতবর্ষ ভ্রমণ করেছিলেন। উচ্চারণের অসুবিধে হেতু তিনি অযোধ্যাকে ‘এ্যাডজুডিয়া’ বলে বর্ণিত করলেও এটি যে পবিত্র স্থল তা লিখতে ভোলেননি। তিনি নির্দিষ্টকরে একটি বেদীর উল্লেখ করেছিলেন। তিনি খানিকটা দোলনা আকারের কিছুকে বোঝাতে চেয়েছিলেন যেখানে ‘Beschan’ অথাৎ ভগবান বিষ্ণু রাম রূপে জন্মগ্রহণ করেছিলেন। ভারতীয় পুরাতত্ত্ব পর্যবেক্ষণ পর্ষদের ইংরেজ আমলের মহানির্দেশক আলেক্সজান্ডার কানিংহাম তার ১৮৬২ সালের দেওয়া সমীক্ষা রিপোর্টে জানান অযোধ্যায় শ্রীরামের জন্মস্থান।
ফৈজাবাদের প্রাচীন কমিশনার ও ইংরেজ সেটেলমেন্ট আধিকারিক পি. কারনেগি তার ১৮৭০ সালের প্রতিবেদনে 671019 “Ajudhia is to Hindus what Mecca is to Mohammedans” আদালত তার রায়ের ৭৮৬ নং অনুচ্ছেদে চূড়ান্ত পর্যবেক্ষণে জানিয়েছে বিদেশিরা তাদের লেখায় বিশদভাবে হিন্দুদের বিশ্বাস ও রামজন্মভূমির প্রতি আত্মিক সমর্থনের ও নির্দিষ্ট জন্মস্থান স্থির করেই তাদের আরাধ্য দেবতার পূজা করে আসছে।
একই সঙ্গে বিচার পতিরা এটাও বিবেচনাধীন করেছেন যে ৩২৫ বছর আগে মসজিদ নির্মাণের পর থেকে ইংরেজরা ওই অঞ্চলে একটি লৌহ প্রাচীর (grill wall) তৈরি করা পর্যন্ত মুসলিমরা ওই বিবাদিত মসজিদের যে স্বত্ত্বাধিকারী ছিল ও তাদের অধিকার বজায় রেখেছিল এমন উপযুক্ত প্রমাণ তারা দিতে পারেনি।
অপরপক্ষে মৌখিক ও লিখিত প্রমাণ ভিত্তিক সূত্রে এটাই প্রতিষ্ঠিত হয় যে হিন্দুরা অনাদি কাল ধরে দৃঢ় বিশ্বাসে রামের অনুগত ভক্ত হিসেবে ও নির্দিষ্ট স্থানটিকে তারা নিশ্চিতভাবে তাদের আরাধ্য দেবতার জন্মস্থান বলে মনে করে নিরবচ্ছিন্নভাবে পূজা অর্চনা করে এসেছে। অত্যন্ত তাৎপর্যপূর্ণভাবে আদালত বহু মুসলিম ধর্মবলম্বী সাক্ষী আদালতে তিন গম্বুজ সম্বলিত ধাঁচা সংলগ্ন অঞ্চলে হিন্দুদের ধর্মীয় পরিচয়ের প্রতীক জয়-বিজয়, গরুড় জাতীয় পক্ষীর প্রস্তর নির্মিত প্রতিরূপ পাওয়ার তথ্যকে মান্যতা দিয়েছেন। এই আদালত তার পর্যবেক্ষণে এই প্রমাণগুলি কেবলমাত্র ধর্মবিশ্বাস ও দেবতার অস্তিত্বের প্রমাণ স্বরূপ নয়, এগুলি শতাব্দীর পর শতাব্দী ধরে ওখানে পূজা অর্চনা যে হয়ে এসেছে তারই পর্যাপ্ত প্রমাণ বলে মনে করে। এ থেকে সন্দেহাতীতভাবে প্রমাণ হয় যে ইট চুন দিয়ে তৈরি সৌধই মাত্র ধ্বংস করা হয়নি— ধ্বংস করা হয়েছিল একটি যুগ যুগান্ত ধরে চলে আসা প্রাণবন্ত ধর্মবিশ্বাস ও তার পুজ্যকে আরাধনা করার নিরন্তর প্রবাহকে।
মনে রাখতে হবে আদালত বিবাদিত স্থানটি উপযুক্ত প্রমাণের ভিত্তিভূমি থেকে মামলাকারী হিন্দুদের অধিকারে দেওয়ার পাশাপাশি মুসলিমরা যাতে বঞ্চিত বা একতরফা বিচার না মনে করেন, সেই কারণে অপর মামলাকারী সুন্নী ওয়াকফ বোর্ডকে ৫ একর জমি যাতে সরকার দেয় তারও সমান্তরাল নির্দেশ দিয়েছে। আদালত কেন্দ্রীয় সরকারকে একটি ট্রাস্ট গঠন করে তার মাধ্যমেই মন্দির নির্মাণের আদেশ দিয়েছে। আদালত আরও বলেছে মন্দির নির্মাণের প্রয়োজনীয় জমি বন্টনের পর এমন ব্যবস্থা যেন রাখা হয় যাতে উদ্বৃত্ত জমি জনহিতকর কাজে নিয়োজিত হয়। এই সূত্রে এলাহাবাদ উচ্চ আদালতের রায়ের ভিত্তিতে আনা নির্মোহী আখড়ার মামলাও শীর্ষ আদালত খারিজ করে দেয়। তাৎপর্যপূর্ণ। ভাবে, ধর্মীয় আচরণেরও (উভয় পক্ষেরই) বিশ্লেষণ করে। সব বিশ্লেষণই সাংস্কৃতিক ও সামাজিক পটভূমিও আলোচনার পরিসরে আসে। ধর্মীয় অভ্যাসের ক্ষেত্রে সংস্কৃতির মিলনও যে উল্লেখযোগ্য ভূমিকা নেয় সেই বিষয়টিও আদালতের নজর এড়ায়নি। আদালতের চোখে পারস্পরিক সংস্কৃতির মিলনে কখনই কোনও ধর্মীয় তত্ত্ব ধ্বংস বা খারিজ হয়ে যায় না।
উপসংহারে বলা যায়, এই রায়দানের ফলে কবির ও রহিমের বক্তব্যই সিদ্ধ হলো। তবে, আমার ব্যক্তিগত সম্মান ও গর্ব যে বেড়েছে তা জানাতে দ্বিধা নেই কেননা আমি এলাহবাদ আদালতে হিন্দুদের হয়ে ‘রামলালার’ পক্ষে সওয়াল করতে পেরেছিলাম।
রবিশঙ্কর প্রসাদ
(লেখক বর্তমানে কেন্দ্রীয় আইনমন্ত্রী)
2019-11-21