পশ্চিমবঙ্গের বিধানসভা ভোটের দামামা বাজতে এখনও ঢের দেরি। কিন্তু ২০১৯-এর লোকসভা ভোটের অশনি সঙ্কেতে আতঙ্কিত তৃণমূল কংগ্রেস সুপ্রিমো ‘ত্রাহি ত্রাহি’ আর্তনাদ শুরু করেছেন।
গোদের ওপর বিষফোঁড়ার মতো বাড়তি চাপ হয়ে উঠেছে রাজ্যপাল জগদীপ ধনকরের সাংবিধানিক আচরণ। বাইরে সবুজ ভিতরে লাল তরমুজের মতো বাইরে জনপ্রেমী, ভিতরে একনায়িকা মুখ্যমন্ত্রীর পক্ষে মেনে নেওয়াটা অসম্ভব হয়ে উঠেছে। এও এক নতুন চ্যালেঞ্জ। এর আগে কখনও এত বড়ো চ্যালেঞ্জের মুখোমুখি হতে হয়নি। তাকে। কারণ তিনি সংবিধানকে পাশে সরিয়ে রেখে চলতে অভ্যস্ত। আর রাজ্যপাল যিনি কিনা এ রাজ্যের অতিথি— দুদিনের জন্য এসেছেন, দুদিন পরে চলে যাবেন, তিনি কিনা রাজ্য জুড়ে খবরদারি চালাবেন— এত বড়ো দুঃসাহস!
অতএব, যিনি নিজেকে শুধু রাজ্যের নয়, গোটা ভারতবর্ষের রাজনীতির একমেবাদ্বিতীয় মনে করেন, যিনি মনে। করেন, তার চেয়ে বড়ো উন্নতিকামী কোনো মুখ্যমন্ত্রী গোটা ভূ-ভারতে নেই, যিনি বিশ্বাস করেন, শুধুবঙ্গবাসী নয়, গোটা ভারতবাসীই তাকে ‘ভারতমাতা হিসেবে সম্মান করেন, তিনি আর্তনাদ শুরু করেছেন। স্বভাবসিদ্ধ ভঙ্গিতে তর্জনী তুলে প্রকাশ্য জনসভায় হুমকি দিচ্ছেন রাজ্যের সাংবিধানিক সর্বাধিনায়ককে— ‘অধিকারের সীমা ছাড়াবেন না। সমান্তরাল প্রশাসন চালানোর কোনো এক্তিয়ার আপনার নেই। দলের মহাসচিবকে দিয়ে বলাচ্ছেন—পর্যটক হয়ে এসেছেন। রাজ্যের আতিথেয়তা নিয়ে ঘুরে বেড়ান। আনন্দ করুন। মানুষের কাছে যাবার দরকার কী?
সত্যিই তো মা-মাটি-মানুষ’ স্লোগানটা তো তৃণমূল নেত্রীর তৈরি। পেটেন্ট নেওয়া নেই। তার ওপর একটি বাংলা যাত্রাপালা থেকে টুকলি করা। তাতে কী! ওটা এখন তৃণমূলের সম্পত্তি। তাতে ভাগ বসাবেন। রাজ্যপাল ? এত সাহস?
তা কী করেছেন রাজ্যপাল ?
১। জেলায় জেলায় গেছেন। প্রশাসনের কর্তাব্যক্তিদের বৈঠক ডেকেছেন।
২। জেলায় জেলায় গেছেন। গ্রামে গঞ্জে ঘুরেছেন। মানুষের সঙ্গে কথা বলেছেন।
৩। রাস্তাঘাট খারাপ দেখলে প্রকাশ্যে তা মেরামতির প্রয়োজনীয়তার পরামর্শ দিয়েছেন।
৪। পুলিশি প্রশাসনের অপদার্থতার প্রতি আঙুল তুলেছেন।
৫। কেন্দ্রীয় মন্ত্রীকে ঘিরে ধরে একদল যুবক মারধর করতে উদ্যত হলে রাজ্য প্রশাসনের নিষ্ক্রিয়তায় উদ্বিগ্ন রাজ্যপাল নিজে গিয়ে তাকে উদ্ধার করেছেন।
৬। হাসপাতালের অব্যবস্থা এবং ত্রুটি সংশোধনের পরামর্শ দিয়েছেন।
৭। বুলবুল ঝড়ে বিধ্বস্ত পশ্চিমবঙ্গের অবস্থা কতটা শোচনীয় তা রাজ্যের মন্ত্রীসভার কাছ থেকে জানতে চেয়েছেন।
৮। রাজ্যের ঐতিহাসিক স্থানগুলির ইতিহাস জেনে সেগুলির পর্যটন-সম্ভাবনার প্রসঙ্গ তুলেছেন।
৯। রাজ্য মন্ত্রীসভার সদস্যদের সমস্ত ওজর-আপত্তি নস্যাৎ করে দিতে বারবার বিবৃতি দিয়েছেন।
১০। প্রকাশ্যে স্বীকার করেছেন, তিনি বিজেপির প্রাক্তন সংসদ সদস্য এবং কেন্দ্রের সরকারের সংসদীয় মন্ত্রীর সঙ্গে যোগাযোগ করে তিনি কিছু অন্যায় করেননি।
অপরাধের পর অপরাধ। নিরপরাধ’ মুখ্যমন্ত্রী সহ্য করবেন কেমন করে! বিশেষ করে, পশ্চিমবঙ্গে এককেন্দ্রীয় শাসনব্যবস্থার এক নয়া নজির যিনি গড়ে তুলতে বদ্ধপরিকর। যেখানে পশ্চিমবঙ্গে তিনি প্রতিষ্ঠা করে ফেলেছেন তিনিই একমাত্র পদাধিকারী, বাকিরা ফিনফিনে ধুতির কোচানো কাছা দোলানো মোসাহেবের বেশি কিছু নয়। যেখানে গোটা রাজ্যের মিডিয়াকে তিনি সকাল বিকেল কান ধরে ওঠবোস করাচ্ছেন। যেখানে রাজ্যের গরিব-গুর্বো মানুষগুলোকে কেন্দ্রের ভরতুকির টাকায় দু’টাকা কেজি চাল আর মিড ডে মিলের ডিম ভাত খাইয়ে প্রচার করছেন, হাজার অর্থাভাবেও তিনি তার গোটা রাজ্যের কোষাগার তাদের জন্য উজাড় করে দিচ্ছেন। যেখানে রাজ্যের যুব সমাজের কোমর ভেঙে দিচ্ছেন বছর বছর ক্লাব প্রতি দু’ লক্ষ টাকা করে ঘুষ দিয়ে। যেখানে ‘কাটমানি’কে তিনি প্রশাসনিক চেয়ারে বসেই স্বীকৃতি দিয়ে দলীয় ভাই-বোনদের রাজনীতি নামক ব্যবসাটা শিখিয়ে দিয়েছেন। যেখানে রাজ্য প্রশাসনের জ্ঞানী-গুণী শিক্ষিত শিক্ষিতা আইএএস, আইপিএস অফিসারদের ‘বলদ’-এর বেশি সম্মান দেওয়াটা বাড়াবাড়ি মনে করেন। যেখানে তিনি সবচেয়ে বেশি খগহস্ত শিক্ষক অধ্যাপকদের আর সরকারি কর্মচারীদের আর্থিক ভাবে বঞ্চনা করতে। যেখানে রাজ্যের বেকার যুবক-যুবতীদের স্থায়ী জীবিকা অর্জনের ব্যবস্থা করায় তার তীব্র অনীহা, কারণ তাহলে নাকি তারা আর তার বশংবদ হয়ে থাকবেন না। যেখানে তিনি মনে করেন, প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদী তার পোষা চাকর এবং রাজ্যপাল মানে তার ছাত্র। তিনি জ্ঞান দেবেন আর রাজ্যপাল তা চোখ বুজে শুনবেন। কী করে মেনে নেবেন। এতগুলি অপরাধ ?
স্বপ্নেও ভাবেননি, জগদীপ ধনকরের মতো একটা রাজ্যপাল তাকেই শিখিয়ে দেবেন রাজ্যপালের প্রকৃত সাংবিধানিক সংজ্ঞা। অনেকটা সদ্য প্রয়াত দেশের প্রাক্তন মুখ্য নির্বাচন কমিশনার টি এন সেশনের মতো যিনি বুঝিয়ে দিয়েছিলেন, সাংবিধানিক আচার মেনে না চললে, তিনি কোনও রাজনৈতিক দলের এমনকী শাসক দলের, এমনকী সরকারেরও কোনো অন্যায় আবদার অথবা হুমকি শুনতে বাধ্য নন। রাষ্ট্রের নির্বাচন কমিশনারের পদের প্রকৃত সংজ্ঞা তিনিই প্রথম তুলে ধরেছিলেন দেশবাসীর সামনে। এমনকী সুপ্রিম কোর্টও তার মাথা নত করাতে পারেনি। ভারতীয় ভোটতন্ত্র তথা গণতন্ত্রে তিনি নির্বাচন কমিশনের ইতিহাস একটি নতুন অধ্যায় সংযোজন করে গেছেন। সে সময়ও সরকারি প্রশাসন এবং রাজনৈতিক নেতা-নেত্রীরা তার ডাকা বৈঠকে আসতেন না। এটা যে হবে, জেনেই তিনি ওই পদে যোগ দিয়েছিলেন কাঞ্চীপুরমের শঙ্করাচার্যের কথায়। যিনি তাকে গীতার একটা শ্লোক শুনিয়ে উপদেশ দিয়েছিলেন— ধর্মপালন, ধর্মরক্ষা এবং সত্যের শক্তির চরম মাহাত্ম্য। তাই ধর্মপালন, সত্যপালন এবং ধর্মরক্ষা করার জন্য তাঁর ওই পদে যোগ দিতে দ্বিধা করা উচিত নয়। তিনি যোগ দিয়েছিলেন। ধর্মরক্ষা করেছিলেন। সাহসের সঙ্গে বলতে পেরেছিলেন— ‘আমি সকালের প্রাতরাশ সারি রাজনীতিকদের নিয়ে। কারণ তখন সংবাদ পত্রের পাতায় প্রতিদিনই রাজনীতিবিদরা তাঁকে মেগালোম্যানিয়াক, পাগল, বুলডগ, খ্যাপা কুকুর, হোলি টেরর বলে সম্বোধন করে বিবৃতি দিতেন। কিন্তু সেশন সাহেব হাল ছাড়েননি। রাজনীতিবিদরা যদি হতেন বুনো ওল, তিনি ছিলেন বাঘা তেঁতুলের ভূমিকায়। এটাকে যদি ‘সেশনোম্যানিয়া’ বলে গালাগাল করা হয় তাহলেও কিছু যায় আসে না। কারণ তার গোটা প্রচেষ্টাটাই ছিল গণতন্ত্রকে পুনরুদ্ধারের জন্য এবং তা প্রতিষ্ঠার জন্য।
নির্বাচন কমিশনার হওয়ার আগেও সেশন সাহেব তামিলনাড়ুতে জোর করে হিন্দিভাষা চাপিয়ে দেবার বিরুদ্ধে। আন্দোলনকে কঠোর হাতে দমন করে ডিএমকে-র চক্ষুশূল হয়েছিলেন। হরিয়ানায় মুখ্যমন্ত্রী ভজনোল তাঁকে একেবারেই সহ্য করতে পারতেন না। তামিলনাড়ুর প্রাক্তন মুখ্যমন্ত্রী এম জি রামচন্দ্রনও তাকে পছন্দ করতেন না। তাতেও সেশন সাহেব পিছু হটেননি। কারণ পিছু হটাটা ছিল তার স্বভাব। বিরুদ্ধ।
পশ্চিমবঙ্গের রাজ্যপাল জগদীপ ধনকরও গতদু’মাসে বুঝিয়ে দিয়েছেন তিনি রাজ্যের সাংবিধানিক প্রধান। সংবিধানকে রক্ষা করার জন্য তিনি ধর্ম পালনে ব্রতী হয়েছেন। তিনি মানতে নারাজ মুখ্যমন্ত্রী হেডমিস্ট্রেস আর তিনি জরদগব ছাত্র। তার বেশি তার কোনও ভূমিকা নেই– তা মানবেন না। কারণ তিনি এর আগে কেন্দ্রীয় পরিষদীয় মন্ত্রীর ভূমিকাও পালন করে। এসেছেন। তার ওপর তিনি প্রাক্তন সাংসদ এবং সুপ্রিম কোর্টের আইনজীবী। তাকে বাগ মানানো এতটা সহজ নয়। আসল সত্যটা হলো, রাজ্যের কসমেটিক উন্নয়নের পিছনে যে গভীর অন্ধকার, রাজ্যপাল সেটাই উঘাটন করতে চাইছেন। দেখাতে চাইছেন, রাজ্যে হাজারো নতুন কলেজ, স্কুল, বিশ্ববিদ্যালয় হয়েছে। কিন্তু পরিকাঠামো নেই। তিরিশ শতাংশ শিক্ষকের পদ খালি। চেনাতে চাইছেন, অনেক নতুন হাসপাতাল হয়েছে। সবই নাকি অতি উন্নত মানের। কিন্তু চিকিৎসক নেই। ছাত্র-ছাত্রীদের হস্টেল আছে। ওয়ার্ডেন নেই। স্কুলে মিড ডে মিল আছে, মাস্টারমশাই, দিদিমণি নেই। জেলায় পুলিশ আছে। তাদের স্বাধীনতা নেই। বিরোধী রাজনৈতিক দলগুলির রাজনীতি করার সাংবিধানিক অধিকার নেই। প্রধানমন্ত্রী গ্রাম সড়ক যোজনা আছে— পথ নেই। মিশন নির্মল বাঙ্গলা আছে অথচ গত দু মাসে রাজ্যে ডেঙ্গু আক্রান্তের মৃত্যুর সংখ্যা ৪৪। রাজ্যে কন্যাশ্রী প্রকল্প যত ছড়ায়—স্কুল ড্রপ আউটের সংখ্যাও তত বাড়ে।
এসব দেখার অধিকার রাজ্যপালের নেই? এসব বলার অধিকার রাজ্যপালের নেই? মুখ্যমন্ত্রীকে পরামর্শ দেবার অধিকার রাজ্যপালের নেই? জেলা প্রশাসনের সঙ্গে বৈঠক করার অধিকার নেই রাজ্যপালের ? যদি না থাকে, রাজ্যপালের বিরুদ্ধে যান না সাংবিধানিক আদালতে। সেখানে অভিযোগ করুন রাজ্যপাল জগদীপ ধনকরের বিরুদ্ধে। শুধু আর্তনাদ করে রাজ্যের মানুষকে ভুল বুঝিয়ে কী লাভ?রাজ্যপাল রাজ্যকে চিনবেন না? জানবেন না? রাজভবনের জীবন। কাটাবেন আলস্যে?
ভুল করছে রাজ্য সরকার। মানুষটাকে চিনতে ভুল করছে। কারণ এই মানুষটাই প্রকাশ্যে বলেছেন— তার অধিকার সম্বন্ধে তিনি যতখানি সচেতন, ঠিক ততখানিই সচেতনতার অধিকারের সীমা সম্পর্কে। সে সীমা তিনি লঙ্ঘন করছেন না। তাই তাকে তার পথ থেকে সরানো যাবে না।
মানুষের সবচেয়ে বড়ো গুণ হলো সত্ত্ব গুণ। যুগে যুগে মনীষীরা একথাই বলে গেছেন। নিজেকে চেনা নিজেকে জানা। সততাই হলো জীবনের ভূষণ। তাহলে জীবনে কোনও গ্লানি থাকে না। পশ্চিমবঙ্গের নতুন মেজাজের রাজ্যপাল জগদীপ ধনকর সেই সত্ত্বগুণের অধিকারী বলেই গলা উঁচিয়ে কথা বলতে পারেন। আর কে-ইবা না জানে, ধর্মযোদ্ধারা এমনই হন— স্বাভিমানী, আত্মমর্যাদাসম্পন্ন, নির্ভীক এবং আত্মবিশ্বাসী। তার জন্য কাটআউটের প্রয়োজন হয় না। সততার প্রতিমূর্তি’ স্টিকারের প্রয়োজন হয় না। অনুপ্রেরণার হোর্ডিং লাগে না। মানুষ সঙ্গে থাকে। শিরদাঁড়াওয়ালা মানুষ। সেটাই যথেষ্ট।
সুজিত রায়
2019-12-05