রাজ্য সরকারের স্বার্থপ্রণোদিত নিষ্ক্রিয়তার বিরুদ্ধে রাজ্যপাল সক্রিয় হতে পারেন

এটা লক্ষণীয় যে, বেশ কয়েক বছর ধরে রাজ্যপাল পদটা বিতর্কের কেন্দ্রবিন্দু হয়ে উঠেছে। স্বাধীনতার পর বহুকাল কেন্দ্রে ও রাজ্যগুলোতে কংগ্রেসের একাধিপত্য থাকায় এই ধরনের বিরোধের অবকাশ ছিল না— রাজ্যপাল ও মুখ্যমন্ত্রী সমঝোতা করেই চলেছেন। কিন্তু ১৯৬৭ সাল থেকে কেন্দ্রে ও রাজ্যে বহুদলীয় ব্যবস্থা দেখা দেওয়ার। ফলে অনেক ক্ষেত্রেই সম্পর্কের জটিলতা সৃষ্টি হয়েছে— দেখা দিয়েছে রাজ্যপালমুখ্যমন্ত্রীর দ্বন্দ্ব।
কোনো কোনো ক্ষেত্রে রাজ্যপাল প্রশাসনের অপদার্থতা দেখে আধিকারিক বা পুলিশ অফিসারকে ডেকে খোঁজখবর করেছেন, কেউ কেউ সরকারের নিষ্ক্রিয়তা নিয়ে মুখ খুলেছেন, কেউ আবার অকুস্থলে গিয়ে অবস্থার সামাল দিয়েছেন।
এতে কিন্তু মুখ্যমন্ত্রী, শাসকদলের নেতা-কর্মীরা ভীষণ ক্ষুন্ন হয়েছেন, রাজ্যপালের বিরুদ্ধে অতি সক্রিয়তা, সাংবিধানিক সীমা লঙ্ঘন ইত্যাদির অভিযোগ তুলেছেন।
কার কতটা সীমা, সেটা অবশ্য সংবিধানের বিষয়। তার জন্য সংবিধান বইয়ের মলাট ওল্টাতে হয় বলেই জানি।
প্রথমেই বলি— এম. এল. সিক্রি মন্তব্য 76516201, ‘he (The Governor) is not a mere ornamental emblem but a functionary designed to play a dynamic and active role’– (Elena গভর্নমেন্ট অ্যান্ড পলিটিক্স, পৃ. ২৩৬)। কথাটা অনেকের পছন্দ না হলেও এটাই নির্মম সত্যি। সংবিধানের ১৫৪ (১) নং অনুচ্ছেদে বলা হয়েছে- তিনিই রাজ্যের শাসক-প্রধান। তবে তাকে পরামর্শ দেওয়া ও সাহায্য করার জন্য (to aid and advise) রাজ্যে একটা মন্ত্রীসভা থাকে এবং আমরা ব্রিটেনকে অনুসরণ করে ক্যাবিনেট ব্যবস্থা গ্রহণ করেছি বলে অলিখিত নীতি অনুসারে রাজ্য পাল কিছুটা নেপথ্যে থাকেন— প্রত্যক্ষভাবে শাসন চালায় মন্ত্রীসভাই।
বলা হয়, তার ভূমিকা অনেকটা ব্রিটিশ রাজা-রানির মতো। কিন্তু কথাটার অর্থ স্পষ্ট নয়। প্রথম ও দ্বিতীয় জর্জ যেভাবে নিষ্ক্রিয় ছিলেন, রানি ভিক্টোরিয়া, তৃতীয় ও পঞ্চম জর্জ সেভাবে ছিলেন না। তাঁরা অনেক ক্ষেত্রেই সদর্থক ভূমিকা নিয়েছেন— প্রয়োজনে প্রধানমন্ত্রীকে তিরস্কার করেছেন। ভিক্টোরিয়া ১৮৫৭ সালে ভারতের মহাবিদ্রোহ নিয়ে প্রধানমন্ত্রী লর্ড পামারস্টোনকে সতর্কও করেছেন। স্যার আইভর জেনিংস লিখেছেন, “She dose not steep the ship, but he must make it certain that there is a man at the wheel-(দ্য কুইন’স গভর্নমেন্ট, পৃ. ৪৩)। ওয়াল্টার বেজটে মন্তব্য করেছেন, রাজা-রানির তিনটে বিশেষ ক্ষমতা আছে— উৎসাহ দেওয়া, খবর নেওয়া ও সতর্ক করা। সুতরাং আমাদের রাজ্যপালও কোনো কোনো ক্ষেত্রে এগিয়ে আসতে পারেন পর্দার আড়াল থেকে। ড. এ.সি. কাপুরের ভাষায়— ‘It is his duty to see that the sate Government functions in accordance with the constitutionn’-(ws Efestar পলিটিক্যাল সিস্টেম, পৃ. ৩৬৭)। সুতরাং সরকারের স্বার্থ- প্রণোদিত নিষ্ক্রিয়তার ক্ষেত্রে তিনি সক্রিয় হতে পারেন– এটা আদৌ অতি সক্রিয়তা নয়।
দ্বিতীয়ত, তাঁকে কলের পুতুল বলে দাবি করা হয়ে থাকে। তবে সব চেয়ে মজার কথা হলো— যাঁরা বিরোধী আসনে থাকার সময় বারবার সরকারের নীতি ও কাজের বিরুদ্ধে হস্তক্ষেপ করার জন্য তার কাছে ধরনা দেন, তারা ক্ষমতায় বসার পর তার পায়ে শিকল পরাতে চান, মুখ বন্ধ রাখতে বলেন।
একটা কথা মনে রাখা দরকার, রাজ্যপাল সব ক্ষেত্রে মন্ত্রীর কথায় চলতে বাধ্য নন। মন্ত্রীরা পরামর্শ দেন, কিন্তু সংবিধান বলেনি যে, সেটা শুনতেই হবে। তার আসল। কারণ তিনি শপথ নেন, তিনি সংবিধান ও আইনকে রক্ষা করবেন এবং রাজ্যের মানুষের কল্যাণের জন্য সচেষ্ট থাকবেন (১৫৯ নং অনুচ্ছেদ)। তিনি আদৌ বলেন না যে, তিনি বর্ণে বর্ণে ক্যাবিনেটের কথায় চলবেন— তার দায় সংবিধান ও আইনের কাছে, তার লক্ষ্য জনকল্যাণ। সুতরাং তার যদি মনে হয় সরকারের কোনও কাজ বা নীতি সংবিধান ও আইনকে লঙ্ঘন করছে। বা জনকল্যাণের বিরোধী, তাহলে তিনি তার বিরোধিতা করতেই পারেন।
এটাও লক্ষ্য করতে হবে যে, ১৬৩ (১) নং অনুচ্ছেদের মতোই রাষ্ট্রপতির ক্ষেত্রে বলা হয়েছিল রাষ্ট্রপতিকে সাহায্য করা ও পরামর্শ দেওয়ার জন্য কেন্দ্রে একটা ক্যাবিনেট থাকবে- (৭৪ নং অনুচ্ছেদ)। কিন্তু সেই পরামর্শ রাষ্ট্রপতি মানতে বাধ্য কিনা, সেটা স্পষ্ট ছিল না। কিন্তু সংবিধানের ৪২তম সংশোধন এটাকে বাধ্যতামূলক করে দিয়েছে ১৯৭৬ সালে। ড. বিদ্যাধর মহাজন তাই লিখেছেন, রাষ্ট্রপতি তার ক্যাবিনেটের পরামর্শ এখন শুনতে বাধ্য—He has to do what the Ministers want him to do’ (দ্য কনস্টিটিউশান অব ইন্ডিয়া পৃ. ১৮৭)। কিন্তু রাজ্যপালের ক্ষেত্রে এই ধরনের কোনও ব্যবস্থা নেওয়া হয়নি।
আরও বড়ো কথা হলো— সংবিধানের ১৬৩ (১) নং অনুচ্ছেদ তাঁকে স্বেচ্ছাধীন ক্ষমতা দিয়েছে। যে যে বিষয়ে তিনি স্বেচ্ছাধীন ক্ষমতা (discretionary power’) ব্যবহার করবেন না, সেগুলোর ক্ষেত্রেই ক্যাবিনেট পরামর্শ দেবে। সুতরাং একটা বিরাট ক্ষেত্রে আছে যেখানে তিনিই সিদ্ধান্ত লেখেন। লক্ষণীয় বিষয় হলোসংবিধান এটা নির্দিষ্টকরে দেয়নি, বরং ১৬৩ (২) নং অনুচ্ছেদে বলা হয়েছে— রাজ্যপালই সেটা নির্ধারণ করবেন। যাঁকে স্বেচ্ছাধীন ক্ষমতা দেওয়া হয়, তাকে কিন্তু নামমাত্র শাসক বলা যায় না।
ড. পি.সি. রাউতের মতে, he is expected to exercise his discretionary power(ডেমোক্র্যাটিক কনস্টিইটউশান অব ইন্ডিয়া, পৃ. ২২২)। সেই জন্যই তিনি নিছক ‘figurahead’ নন।
ড. এম. ভি. পাইলি মনে করেন— রাজ্যপাল নিম্নলিখিত ক্ষেত্রে তার এই ক্ষমতা প্রয়োগ করতে পারবেন—
(১) জটিল অবস্থায় মুখ্যমন্ত্রীর মনোনয়ন।
(২) মন্ত্রীসভার পদচ্যুতি।
(৩) বিধানসভা আহ্বান ও ভেঙে দেওয়া।
(৪) ক্যাবিনেটের কাছ থেকে তথ্য জানা।
(৫) বিলে ভেটো দেওয়া বা রাষ্ট্রপতির কাছে পাঠানো।
(৬) অর্ডিনেন্সে স্বাক্ষর দেওয়ার আগে রাষ্ট্রপতির সঙ্গে পরামর্শ করা, এবং
(৭) জরুরি অবস্থা জারির জন্য রাষ্ট্রপতিকে পরামর্শ দেওয়া।
তাঁর মতে, এভাবেই তিনি রাজ্য শাসনে একটা ‘vital role’ নিতে পারেন, কারণ তিনি আদৌ ঠুটো জগন্নাথ নন— (অ্যান ইন্ট্রোডাকশান টু দ্য কনস্টিটিউশন অব ইন্ডিয়া, পৃ. ২০৪-৫)।
তবে প্রখ্যাত সংবিধান বিশেষজ্ঞ দুর্গাদাস বসু এভাবে স্বেচ্ছাধীন ক্ষমতাকে তালিকাবদ্ধ করতে চাননি। তাঁর মতো এটা নির্ভর করে পরিস্থিতির ওপরে (acceording to circumstances’) — fofa 67 6716 বিষয়কে তাঁর স্বেচ্ছাধীন ক্ষমতার অন্তর্ভুক্ত বলে জানাতে পারেন (ইন্ট্রোডাকশান টু দ্য কনস্টিটিউশান অব ইন্ডিয়া, পৃ. ২১০)। আসল কথা হলো—সংবিধান তাকে এভাবে ব্যাপক ক্ষমতা দিয়েছে প্রয়োজনে তিনি তা ব্যবহারও করতে পারেন। ড. এস.সি. কাশ্যপের ভাষায়—‘the Governor may have to use his own wisdom and discretion(আওয়ার কনস্টিটিউশান, পৃ. ২১৪)।
এটা ঠিক যে, সংবিধানের মুখ্য রচয়িতা ড. বি. আর. আম্বেদকর খসড়া সংবিধানের শেষ দিকে একটা অধ্যায় রেখেছিলেন—তার শিরোনাম ছিল ‘ইন্সটু মেন্ট অব ইন্সট্রাকশান্স’। তাতে ছিল রাষ্ট্রপতি ও রাজ্যপাল কোন পরিস্থিতিতে কীভাবে চলবেন। সেটা থাকলে রাজ্যপালের ক্ষমতাও খর্ব হয়ে যেত। কিন্তু শেষ পর্যন্ত সেই অধ্যায়কে বাদ দেওয়া হয়েছে। আসলে কেন্দ্রে ও রাজ্যে ক্যাবিনেট ব্যবস্থা গৃহীত হলেও একটা পার্থক্য রয়েছে। রাজ্যপালকে মনোনীত করেন রাষ্ট্রপতি তিনি তাঁকে সরিয়েও দিতে পারেন যে-কোনও মুহূর্তে। ডাবলিউ. এইচ. মরিস জোন্স মনে করেন, এভাবেই রচয়িতারা দেশের ‘structural unity’রক্ষা করতে চেয়েছেন—(গভর্নমেন্ট অ্যান্ড পলিটিক্স অব ইন্ডিয়া, পৃ. ৮০)। সুতরাং কোনো বিষয়ে কেন্দ্রের নির্দেশ ও রাজ্য-ক্যাবিনেটের পরামর্শ ভিন্নধর্মী হলে রাজ্যপাল কেন্দ্রের নির্দেশই পালন করতে বাধ্য। কেন্দ্রীয় সরকার তাকে বরখাস্ত করতে পারে— রাজ্য তা পারে না।
এই সব কারণে অনেক সময় কোনও কোনও রাজ্যপাল কিছুটা সক্রিয়তা দেখাতে পেরেছেন। ১৯৬৯ সালে কেরলের রাজ্যপাল কেরল অ্যাডুকেশন বিল’-এ স্বাক্ষর দেননি, তার ধারণাটা সুপ্রিম কোর্টেও অনুমোদিত হয়েছিল। ১৯৬৭ সালে পশ্চিমবঙ্গের রাজ্যপাল ধর্মবীর মুখ্যমন্ত্রীকে বরখাস্ত করেছিলেন। সেটাও হাইকোর্টের অনুমোদন পেয়েছিল। একবার মধ্যপ্রদেশের রাজ্যপাল বিধানসভা থেকে এক সদস্যকে বহিস্কৃত করেছিলেন। ১৯৮২ সালে হরিয়ানার রাজ্যপাল জি.ডি, ভাপাসে মুখ্যমন্ত্রী-পদের দুই দাবিদার ভজনলাল ও দেবীলালকে রাজভবনে অনুগামীদের সংখ্যা গণনার জন্য হাজির হতে বলেছিলেন– (জি. এস. পাণ্ডে— কনস্টিটিউশান ল অব ইন্ডিয়া, পৃ. ২৪১)। পশ্চিমবঙ্গের প্রাক্তন রাজ্যপাল উমাশঙ্কর দীক্ষিত বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য নিয়োগের ব্যাপারে ক্যাবিনেটের পরামর্শ অগ্রাহ্য করেছিলেন। কেশরীনাথ ত্রিপাঠী তিক্ত মন্তব্য করেছিলেন রাজ্যের আইন-শৃঙ্খলা নিয়ে। অনেক রাজ্যপাল বৃহত্তম দলের নেতার দাবি অগ্রাহ্য করে কোয়ালিশন সরকার গড়েছেন।
এগুলো আদৌ ক্ষমতার সীমা লঙ্ঘন নয়। আরও বড়ো কথা হলো— রাজ্যপাল তার গণ্ডি ছাড়িয়েছেন কিনা, সেটা মন্ত্রী-নেতার বিচারের কথা নয়— কাজটা সংবিধানই করে রেখেছে।
ড. নির্মলেন্দু বিকাশ রক্ষিত

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

This site uses Akismet to reduce spam. Learn how your comment data is processed.