গোলাভরা ধান কাদের জন্য ফেলে এলেন কমরেড?

কলকাতার ডার্বি চলছে।‘রক্ত দিয়ে কেনা মাটি, কাগজ দিয়ে নয়’ লেখা একটি ব্যানার শোভা পাচ্ছে ইস্টবেঙ্গল গ্যালারির মাথায়। ম্যাচ শেষ হতে না হতেই নেট দুনিয়ায় ব্যাপক আলোড়ন। কে জিতলো, কে হারলো সেটা হয়ে গেল গৌণ। বাঙ্গালির ফুটবলের আবেগ রূপ নিল রাজনীতির তরজায়।
এই ব্যানারটা লাগিয়েছিল ইস্টবেঙ্গল আল্টাস নামের একটি গ্রুপ। এরা মূলত বামপন্থীদের একটা গোষ্ঠী। যদিও বামপন্থীরা বর্তমানে লুপ্তপ্রায়, তবে যে ক’জন টিকে আছে। তারা কুমিরের ছানার মতো সময় ও সুযোগ বুঝে বিভিন্ন মঞ্চে হাজির হয়ে নিজেদের অস্তিত্ব জানান দেওয়ার চেষ্টা করে চলেছে। কারণ তাদের দীর্ঘজীবী বিপ্লব’ এখন সাত পার্সেন্টে এসে ঠেকেছে। আর সংশোধিত নাগরিকত্ব আইন প্রণয়নের পরে তারা এখন একেবারে চোরাবালির উপর দণ্ডায়মান। এই সাত পার্সেন্ট কমতে কমতে ২০২১-এ যে দুই পার্সেন্টেও টিকবে না— এটা তারা ভালোভাবেই বুঝতে পারছে। তাই এখন যে কোনো ভাবে ভেসে থাকতে হবে, খবরে থাকতে হবে, চর্চায় থাকতে হবে। তাই কিছুটা অক্সিজেন পাওয়ার আশায় ডার্বির মাঠে নাগরিকত্ব আইন বিরোধী ব্যানার টাঙানো।
আমাদের ছোটোবেলায় পাড়ার কিনুকাকা আমাদের জোকস্ শোনাতেন। আমরাও আগ্রহ সহকারে সেগুলো রীতিমতো গিলতাম। একদিন কিনুকাকা শুরু করলেন; বুঝলি, একবার একটা ইন্টারন্যাশনাল লেভেলে একটা প্রতিযোগিতার আয়োজন করা হয়েছে কলকাতায়। বিষয় হলো কার টেকনোলজি কত উন্নত। জাপানের বৈজ্ঞানিকরা এমন একটা সুঁচ তৈরি করে। ফেললো যে সেটা খালি চোখে দেখাই যায় না। তখন আমেরিকার বৈজ্ঞানিকরা এগিয়ে এলো। সবাইকে আশ্চর্য করে দিয়ে তারা সেই সুচের মধ্যে একটা ফুটো করে দিল। ব্যাস্। পৃথিবীর সব দেশের বৈজানিকরা হাত তুলে দিল। সেরা পুরস্কার আমেরিকার সেই বৈজ্ঞানিকের হাতে তুলে দেওয়া হবে, ঠিক সেই মুহূর্তে আমাদের ১০ নং ওয়ার্ডের সর্বহারার নেতা কমরেড বিভাসদা বিড়ি ফুকতে ফুকতে একেবারে মঞ্চের উপরে এসে হাজির। দাদা একটা চান্স দেবেন আমায় ? না হলে কিন্তু ইউনিয়নের লোক ডেকেসব ভণ্ডল করে দোবো বলে দিলাম। অগত্যা, সেই সুচ তুলে দেওয়া হলো কমরেড বিভাসের হাতে। কারণ রাজ্যে তখন মানুষের শরীরের রক্ত বাদে সবকিছুই লাল। কমরেড তখন পকেট থেকে বিড়ির প্যাকেটটা বের করে তার মধ্যে উঁচটা ঢুকিয়ে দিল আর সেই প্যাকেটের উপরে লিখে দিল Made in China’। তারপর হাত মুঠো করে আকাশে ঘুষি মেরে বললো চীনের চেয়ারম্যান, আমাদের চেয়াম্যান! এটাই বামবামাতিদের সংস্কৃতি। অন্যের প্রডাক্টে নিজেদের ট্রেডমার্ক লাগিয়ে বেচে দেওয়াটাই তাদের বিপ্লবের কঠিন পথ। আপনি দুর্গাপূজা করুন, এরা সেই আসরে নিজেদের ধর্ম মানে আফিম’ শীর্ষক বই বেচতে চলে আসবে। আপনি পাড়ায় সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান করুন, সঙ্গে সঙ্গে পাড়ার দুজন কমরেডকে মঞ্চে তুলে ‘ওরা জীবনের গান গাইতে দেয় না’ অথবা ‘হেনরির হাতুড়ি’ গাইয়ে আপনার মঞ্চটাকেই ওদের বিপ্লবী মঞ্চে পরিণত করার চেষ্টা করবে। একই ভাবে ডার্বির মাঠে ওদের প্রথম লক্ষ্য ছিল মিডিয়া অ্যাটেনশন, আর দ্বিতীয় লক্ষ্য ছিল নিজেদের মতামতটাকে গোটা ইস্টবেঙ্গল ক্লাবের মতামত বলে চালিয়ে দেওয়া, যেন গোটা ইস্টবেঙ্গল ক্লাবের সভ্যসমর্থক তথা বৃহত্তর ইস্টবেঙ্গল সমাজ (ওপার বাংলা থেকে আসা উদ্বাস্তু সমাজ)-এর প্রতিনিধিত্ব ওরাই করছে। এটা ছিল গোটা ইস্টবেঙ্গল ক্লাবের উপরে ‘সিএএ বিরোধী তকমা লাগিয়ে দেওয়ার একটা অপচেষ্টা।
এতো গেল বাম-বামাতিদের দুর্বুদ্ধির কথা। এবার আসি রক্ত দিয়ে মাটি কেনার বিষয়ে। বলুন তো এপারে এসে মাটি কিনতে কতজনকে ক’ফোটা রক্ত দিতে হয়েছে। উদ্বাস্তুদের এপারে থাকার জন্য কার সঙ্গে লড়াই করতে হয়েছে? যদি কেউ এই উদ্বাস্তুদের রক্ত ঝরিয়ে থাকে, তারা হলো এই বামপন্থীরাই। মরিচঝাপির ইতিহাস নিশ্চয়ই আর নতুন করে বলার অপেক্ষা রাখে না! আজকে তারাই বলছে রক্ত দিয়ে কেনা মাটি! তাই এই রক্ত দিয়ে মাটি কেনার দাবি বাম-বামাতিদের মুখে শোভা পায় না। আর যদি পরিশ্রম ও কষ্টকে রক্তমূল্য ধরা হয়। তাহলে এই কষ্টের কারণ কী? এই পরিশ্রম কেন? কেন গোলাভরা ধান আর পুকুর ভরা মাছ ওপারে ফেলে এপারে আসতে হলো? কারা সেগুলো কেড়ে নিয়েছিল? কারা তাদের বাড়িতে আগুন দিয়েছিল? কারা তাদের বাপ-ঠাকুরদাকে খুন করেছিল? কারা তাদের পরিবারের মহিলাদের ধর্ষণ করেছিল? কারা তাদের রক্ত ঝরিয়েছিল? এই প্রশ্নগুলোর উত্তর কি তাদের অজানা? যারা আজ বড়ো গলায় বলছে রক্ত দিয়ে কেনা মাটি তাদের বলতে চাই, রক্ত দিয়ে মাটি তোমরা কেনোনি ভাই, আমাদের রক্ত সিঞ্চিত মাটি মুসলমান জেহাদিরা তোমাদেরই উস্কানিতে কেড়ে নিয়েছে। আজ একথা স্বীকার করার মতো সাহসও নেই। মাস্টারদা সূর্যসেন, লোকনাথ বল, প্রীতিলতাদের রক্তসিঞ্চিত সেই জালালাবাদের মাটির অধিকার দাবি করার সৎসাহস আছে তোমাদের? বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধে তোমাদের পূর্বপুরুষ যাঁরা আত্মবলিদান দিয়েছিলেন, তাদের রক্তস্নাত মাটির অধিকার দাবি করার সৎসাহস আছে ভাই? তাঁদের রক্তের মূল্য কি তোমরা কোনও দিন দিয়েছে বা ভবিষ্যতেও কোনও দিন দিতে পারবে?তাই রক্তদানের কথা আজ তোমাদের মুখে শোভা পায় না। তোমরা আগাপাশতলা ভণ্ড।
রইলো কাগজের কথা। আজও ঠাকুরদার পুরোনো টিনের বাক্সটা হাতিয়ে দেখো। যশোর কিংবা ময়মনসিংহে ফেলে আসা ভিটের কাগজটা সযত্নে রাখা আছে হয়তো। আজও আশা আছে, যদি কোনোদিন এই কাগজের মূল্য পাওয়া যায়। আমি শুনেছি একটা রিফিউজি সার্টিফিকেটের জন্য হন্যে হয়ে সরকারি অফিসের দ্বারে দ্বারে ঘুরে বেড়ানোর ইতিহাস। আমি দেখেছি এনিমি প্রোপার্টির কাগজ নিয়ে সরকারি অফিসের সামনে লম্বা লাইন দিয়ে মানুষকে দাঁড়িয়ে থাকতে। যদি এই কাগজের বিনিময়ে ক্ষতিপূরণ বাবদ কিছু অর্থমূল্য পাওয়া যায়। ওপার থেকে এপারে এসে একটা জাল রেশন কার্ড, একটা জাল ভোটার কার্ড, নিদেনপক্ষে একটা ভুয়ো স্কুল সার্টিফিকেটের জন্য কী পরিমাণ ছোটাছুটি, মনে নেই? সেগুলোও তো নিছক কাগজই, তাই নয় কি? সুতরাং ওপার থেকে এপারে আসার পর আজ তোমরা যে জায়গায় দাঁড়িয়ে আছো, তোমাদের পূর্বসূরীদের মেধা এবং পরিশ্রমকে সম্মান করেই বলছি, তার বেশিরভাগটাই কাগজের মুল্যে, রক্তের মুল্যে নয়।
সংশোধিত নাগরিকত্ব আইন জাতীয়তাবাদী শক্তি (Making India Force) এবং জাতীয়তাবিরোধী শক্তি (Breaking India Force) —Gż ufo শিবিরে ভাগ করে দিয়েছে। আজ সময়। এসেছে, আমাদের সঠিক পক্ষ বেছে নেওয়ার। বন্ধ্যা নারীর যেমন গর্ভযন্ত্রণার বিবরণ দেওয়া বাতুলতা মাত্র, ঠিক সেইভাবেই সেকুলার বাঙ্গালদের মুখ দিয়ে ‘রক্তের মূল্য সম্পর্কে বেশি কিছু প্রকাশিত না হওয়াই ভালো। যারা বৈধ নাগরিকত্বের প্রস্তাবের বিরোধিতা করে এবং জাল কাগজের ভিত্তিতে বেঁচে থাকাকে সম্মানজনক মনে করে, তাদের কাছেরক্তেরমূল্য সম্পর্কে শিক্ষা নিতে হবে? এরা আসলে ‘টুকরে টুকরে গ্যাংয়ের স্লিপার সেল। এদের চিহ্নিত করতে হবে এবং এদের বিরুদ্ধে উপযুক্ত ব্যবস্থা নিতে হবে। পরিশেষে বলতে চাই, সংশোধিত নাগরিকত্ব আইনকে দু’হাত তুলে স্বাগত জানান এবং নিশ্চিতভাবে জানুন, এই আইনই বাস্তবে ছিন্নমূল ভারতপ্রেমীদের রক্তের মূল্য এবং মর্যাদা দিয়েছে।
দেবতনু ভট্টাচার্য
(লেখক হিন্দু সংহতির সভাপতি)

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

This site uses Akismet to reduce spam. Learn how your comment data is processed.