রাজনীতি বিজ্ঞানে মানুষের অধিকারের আলোচনা আজ বহু যুগ ধরে চলে আসছে। যখনই শাসকের একনায়কতান্ত্রিক মনোভাব মানুষের স্বাধীন জীবনধারার পথে বাধা হয়ে দাঁড়ায় মানুষ তার অধিকারের দাবিকে জোরের সঙ্গে তুলে ধরে, সেগুলিকে রক্ষার জন্য জীবনকে বাজি রেখে সংগ্রাম করে। মানব ইতিহাসে সাধারণ মানুষের লড়াই অধিকাংশ ক্ষেত্রেই পরিচালিত হয়েছে অধিকার রক্ষার লক্ষ্যে, স্বাধীনতা অর্জনের ইচ্ছায়। সুদূর ইংল্যান্ডে ১২১৫ সালে Magna Carta Libertatum (কথাগুলি মধ্যযুগীয় ল্যাটিন যার অর্থ হলো ‘the great charter of Liberties’)-এর মাধ্যমে রাজা জন (John) ব্যারনদের বেশকিছু অধিকারকে স্বীকৃতি দেন। স্বীকৃতি দেন চার্চের কিছু অধিকারকেও। যদিও এই সমঝোতা অচিরেই ব্যর্থ হয়েছিল, কিন্তু শাসিতের কিছু অধিকারকে শাসক স্বীকৃতি দেবে এই ভাবনাটাই এরপর ক্রমশ গুরুত্বলাভ করে। শাসক যদি শাসিতের অধিকারকে স্বীকৃতি না দেয় তবে তাকেও তার পরিণতির জন্য প্রস্তুত থাকতে হবে এই ধারণা সত্যি হয়ে গেল ১৬৮৮ সালের গৌরবময় বিপ্লবের মধ্য দিয়ে। গৌরবময় বিপ্লবের মাধ্যমে ইংল্যান্ডের বিদ্রোহী প্রজাবর্গ স্টুয়ার্ট রাজবংশের উচ্ছেদ ঘটিয়েছিল, কারণ প্রজারা মনে করেছিল মানুষের স্বাধীনতা এবং অধিকারের পথে এই রাজবংশ সবচেয়ে বড়ো বাধা। এরপর থেকে রাজনীতি বিজ্ঞান আলোচনার একটা বড়ো অংশ জুড়ে আছে অধিকারের ধারণা।
গণতান্ত্রিক সমাজে মানুষের অধিকারের ধারণা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ সন্দেহ নেই। কিন্তু ‘সমাজ’– ধারণাটির সঙ্গে যা যুক্ত হয়ে আছে। তা হলো সমষ্টির ধারণা, সমাজ হলো একটি বৃহৎ সমষ্টি বা গোষ্ঠী যা মানুষের যৌথ জীবনকে সম্ভব করে। মানুষের পক্ষে এককভাবে বা বিচ্ছিন্ন ভাবে বেঁচে থাকা অসম্ভব। সমাজ হলো বিচ্ছিন্ন মানবীয় সত্তাগুলিকে সম্মিলিত জীবনে নিয়ে আসার একটি ক্ষেত্র। মানুষের ব্যক্তিত্বের পূর্ণ বিকাশের জন্য প্রয়োজন এই সঙ্বদ্ধতা এবং এটা সম্ভব হয়েছে সামাজিক জীবন গড়ে ওঠার মাধ্যমে। কিন্তু সমাজে বাস করতে গেলে ব্যক্তির স্বাতন্ত্রকে কিছু পরিমাণে সংকুচিত করতেই হয়। এবং সেটা সম্ভব কর্তব্যের মাধ্যমে। কারণ অপরের অধিকার নিশ্চিত করতে গেলে নিজের অধিকার সংকুচিত করতে হয়। সমাজের প্রতি, রাষ্ট্রের প্রতি, সমাজস্থ অন্যান্য ব্যক্তির প্রতি নিজের কর্তব্য পালনের মাধ্যমে সমাজ জীবনকে সফল করা সম্ভব। শাশ্বত ভারতীয় সামাজিক ঐতিহ্যে এটা মনে করা হয় যে কিছু গ্রহণ করলে কিছু দান করাও উচিত। অধিকারের ধারণা আলোচনা করতে গিয়ে রাজনীতি বিজ্ঞানী লিপসন (Lipson)-ও 1616301, “He who gives takes and he who takes, gives.” (The Great Issues of Politics)। প্রাচীন গ্রিক নগররাষ্ট্রে কেবল নাগরিকরাই পরিপূর্ণ রাজনীতির অধিকার ভোগ করেছে কিন্তু রাজনৈতিক কার্যকলাপে অংশগ্রহণের মাধ্যমে নগররাষ্ট্রের প্রতি তাদের কর্তব্যও সম্পাদন করতে হতো। কিন্তু ইউরোপে ষোড়শ শতক থেকে পুঁজিবাদের। উত্থান এবং পরবর্তী সময়ে উদারনৈতিক গণতান্ত্রিক ব্যবস্থার প্রতিষ্ঠা ও তা ক্রমেই ইউরোপের সীমা ছাড়িয়ে গোটা পৃথিবীর আধুনিক সমাজে কাঙ্ক্ষিত ব্যবস্থা হয়ে ওঠার পর ব্যক্তিস্বাতন্ত্র্যবাদ ক্রমেই মানুষের মধ্যে জনপ্রিয় হয়েছে। মানুষ আরও বেশি করে নিজের অধিকার সম্পর্কে সচেতন হয়ে। উঠেছে। কিন্তু একবিংশ শতকে এসে আবার নতুন করে রাজনৈতিক ভাবনা এবং মতাদর্শগুলিকে ফিরে দেখা শুরু হয়েছে। কারণ মুক্ত সমাজ, উদারনীতি, মানুষের। অধিকার প্রভৃতি ধারণাগুলিকেই আজ চ্যালেঞ্জের মুখে ফেলে দিয়েছে মৌলবাদ ও সন্ত্রাসবাদ। এই সন্ত্রাসবাদ এবং মৌলবাদের মূল লক্ষ্য মুক্ত সমাজ এবং উদারবাদী রাষ্ট্রব্যবস্থার মূল কাঠামোটিকে ধ্বংস করা। এককভাবে কোনো ব্যক্তি বা রাষ্ট্রের পক্ষে এর মোকাবিলা প্রায় অসম্ভব। প্রয়োজন দেখা দিচ্ছে যৌথ প্রচেষ্টার। যে পশ্চিমি উদারবাদী সমাজ এতদিন মানুষের অধিকারের উপর অতিরিক্ত গুরুত্ব আরোপ করতো সেখানেও দাবি উঠেছে মানুষ অধিকার ভোগের পাশাপাশি সমাজ ও রাষ্ট্রের প্রতি তার কর্তব্য পালন করুক। অধিকারের পাশাপাশি কর্তব্যের গুরুত্বের কথা স্মরণ করিয়ে দিয়েছেন ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র দামোদরদাস মোদী। গত ২৬ নভেম্বর, ২০১৯-এ ভারতীয় পার্লামেন্টের সেন্ট্রাল হলে সংবিধান দিবস উপলক্ষ্যে আয়োজিত এক অনুষ্ঠানে প্রধানমন্ত্রী বলেছেন যে ভারতের সংবিধান নাগরিকদের অধিকারের পাশাপাশি কর্তব্যের উপরও গুরুত্ব আরোপ করেছে। ১৯৪৯ সালের ২৬ নভেম্বর ভারতীয় গণপরিষদ আনুষ্ঠানিক ভাবে ভারতের সংবিধান গ্রহণ করে। সেই হিসেবে ২০১৯ সালের ২৬ নভেম্বর ছিল ভারতীয় সংবিধান। গৃহীত হওয়ার ৭০ বছর পূর্তি। সেই উপলক্ষ্যে সংসদের দুটি কক্ষের যৌথ অধিবেশনে বক্তব্য রাখতে গিয়ে প্রধানমন্ত্রী মোদী বলেন, ‘অধিকার এবং কর্তব্য হাতে হাত রেখে চলে। মহাত্মা গান্ধী এই সম্পর্ককে সুন্দরভাবে ব্যাখ্যা করেছেন… আমাদের ভাবতে হবে কীভাবে সংবিধানে উল্লিখিত কর্তব্যগুলো আমরা পালন করবো। প্রধানমন্ত্রী মোদীর মতে, ‘গান্ধীজী। বলেছিলেন আমরা তখনই সমস্ত অধিকারগুলি আশা করবো যখন আমরা সঠিকভাবে কর্তব্যগুলি পালন করবো। অর্থাৎ জাতির জনক মনে করতেন কর্তব্য এবং অধিকারগুলি প্রত্যক্ষভাবে পরস্পরের সঙ্গে সম্পর্কিত। জাতীয় এবং বিশ্বরাজনীতির সাম্প্রতিক ঘটনাপ্রবাহের প্রেক্ষাপটে প্রধানমন্ত্রীর এই বক্তব্য অত্যন্ত তাৎপর্যপূর্ণ।
পশ্চিমি দেশগুলির সংবিধানের মতো ভারতীয় সংবিধানেও শুরতে মৌলিক কর্তব্যের কোনো উল্লেখ ছিল না। ১৯৭৬ সালে সংবিধানের ৪২তম সংশোধনীর মাধ্যমে নাগরিকদের মৌলিক কর্তব্য ভারতীয় সংবিধানে অন্তর্ভুক্ত করা হয়েছে। এই উদ্দেশ্যে চতুর্থ অধ্যায়—ক নামে একটি নতুন অধ্যায় এবং ৫১ (ক) নামে একটি নতুন ধারা সৃষ্টি করা হয়। এই ধারায় ভারতীয় নাগরিকদের দশটি মৌলিক কর্তব্য উল্লেখ করা হয়। ২০০২ সালে ৮৬তম সংবিধান সংশোধনী আইনের মাধ্যমে ৫১ (ক) ধারায় আরও একটি মৌলিক কর্তব্য সংযোজিত হয়। প্রসঙ্গত উল্লেখযোগ্য যে, ১৯৭৬ সালে স্মরণ সিংহের নেতৃত্বে একটি কমিটি গঠিত হয় যে কমিটি সবিধানে মৌলিক কর্তব্যগুলিকে অন্তর্ভুক্ত করার সুপারিশ করে এবং সেই সুপারিশ অনুযায়ী ভারতীয় সংবিধান মৌলিক কর্তব্যগুলি অন্তর্ভুক্ত হয়।
ভারতীয় সংবিধানে উল্লিখিত মৌলিক কর্তব্যগুলি হলো :
(ক) সংবিধানকে মান্য করতে হবে এবং সংবিধানের আদর্শ, প্রতিষ্ঠানসমূহ, জাতীয় পতাকা এবং জাতীয় সংগীতের প্রতি শ্রদ্ধা জানাতে হবে;
(খ) যে সকল মহান আদর্শ দেশের স্বাধীনতার জন্য জাতীয় সংগ্রামকে অনুপ্রাণিত করেছিল, সেগুলিকে পোষণ এবং অনুসরণ করতে হবে;
(গ) ভারতের সার্বভৌমিকতা, ঐক্য এবং সংহতিকে সমর্থন ও সংরক্ষণ করতে হবে;
(ঘ) দেশরক্ষা ও জাতীয় সেবাকার্যে আত্মনিয়োগের জন্য আহূত হলে সাড়া দিতে হবে;
(ঙ) ধর্মগত, ভাষাগত, অঞ্চলগত বা শ্রেণীগত বিভেদের ঊর্ধ্বে থেকে সমস্ত ভারতবাসীর মধ্যে ঐক্য ও ভ্রাতৃত্ববোধকে সম্প্রসারিত করতে হবে এবং নারীজাতির মর্যাদাহানিকর সকল প্রথাকে পরিহার করতে হবে;
(চ) আমাদের দেশের বহুমুখী সংস্কৃতির গৌরবময় ঐতিহ্যকে মূল্যপ্রদান ও সংরক্ষণ করতে হবে;
(ছ) বনভূমি, হ্রদ, নদী, বন্যপ্রাণী-সহ প্রাকৃতিক পরিবেশের সংরক্ষণ ও উন্নতি এবং জীবজন্তুর প্রতি মমত্ববোধ প্রকাশ করতে হবে;
(জ) বৈজ্ঞানিক দৃষ্টিভঙ্গি, মানবিকতাবোধ, অনুসন্ধিৎসা, সংস্কারমূলক। মনোভাবের প্রসার ঘটাতে হবে;
(ঝ) জাতীয় সম্পত্তি রক্ষণাবেক্ষণ ও হিংসার পথ পরিহার করতে হবে;
(ঞ) সকল ক্ষেত্রে জাতীয় উন্নতির উৎকর্ষ এবং গতি বজায় রাখার উদ্দেশ্যে ব্যক্তিগত ও সমষ্টিগত সকল কাজে চরম উৎকর্ষের জন্য সচেষ্ট হতে হবে;
(ট) ২০০২ সালের ৮৬তম সংশোধনী আইন অনুসারে নতুন সংযোজিত কর্তব্যটি হলো, ‘ছয় থেকে চৌদ্দ বছর বয়সের প্রত্যেক শিশুকে শিক্ষাদানের ব্যবস্থা করতে হবে। এ হলো মাতা-পিতা বা অভিভাবকদের মৌলিক কর্তব্য।
সাধারণভাবে পশ্চিমের উদারনৈতিক গণতান্ত্রিক রাষ্ট্রব্যবস্থায় মৌলিক কর্তব্যের উল্লেখ নেই। কিন্তু অন্য অনেক দেশের সংবিধানে মৌলিক কর্তব্যের উল্লেখ আছে। আসলে সংবিধানে তাদের অন্তর্ভুক্তি দেশের সাংস্কৃতিক ঐতিহ্যের দ্বারাই প্রভাবিত হয়। পশ্চিমের সমাজগুলি ব্যক্তিস্বাতন্ত্রের উপর অনেক বেশি গুরুত্ব আরোপ করে। অন্যদিকে প্রাচ্যের সমাজে যৌথ জীবনের গুরুত্ব অনেক বেশি। ফলে সমাজ এবং রাষ্ট্রের প্রতি ব্যক্তির কর্তব্যগুলির মধ্যে কয়েকটির যথেষ্ট নৈতিক মূল্য আছে। যেমন দ্বিতীয় মৌলিক কর্তব্য সেখানে দেশের জাতীয় আন্দোলনকে যে মহান আদর্শ অনুপ্রাণিত করেছিল তাকে। পোষণ ও অনুসরণ করার কথা বলা হয়েছে। আবার কতগুলি মৌলিক কর্তব্য পৌর (civil) প্রকৃতির। যেমন জাতীয় পতাকা ও জাতীয় সংগীতকে শ্রদ্ধা করা। এ প্রসঙ্গে আর একটি মৌলিক কর্তব্যের উল্লেখ করতে হয়। এটি হলো বনভূমি, হ্রদ, নদী, প্রাকৃতিক পরিবেশের সংরক্ষণ সম্পর্কিত মৌলিক কর্তব্য। ১৯৭২ সালে সুইডেনের রাজধানী স্টকহোমে প্রথম বিশ্ব বসুন্ধরা সম্মেলন অনুষ্ঠিত হয়। সেই সম্মেলনে বিশ্বপরিবেশের অবনতি সম্পর্কে উদ্বেগ প্রকাশ করা হয় এবং পরিবেশ ও বন্যপ্রাণ সংরক্ষণে উদ্যোগী হতে দেশগুলিকে অনুরোধ করা হয়।তারই প্রভাবে ভারতীয় সংবিধানে এই মৌলিক কর্তব্যের অন্তর্ভুক্তি। এই প্রসঙ্গে দুটি আইনেরও উল্লেখ করা যায়। এগুলি হলো ১৯৭২ সালের The Wildlife (protection) Act এবং ১৯৮০ 116615 The Forest (Conservation) Act। প্রথম আইনে দুষ্প্রাপ্য এবং অবলুপ্ত প্রায় প্রাণীসমূহের ব্যবসা-বাণিজ্য নিষিদ্ধ করা হয়েছে। দ্বিতীয় আইনে বনাঞ্চলের বেহিসেবি ধ্বংসসাধন এবং বনভূমিকে অন্য কোনো কাজে ব্যবহারের উদ্যোগকে নিষিদ্ধ করা হয়েছে। অর্থাৎ পরিবেশ সংরক্ষণের যে ভাবনা ভারতীয় সমাজে বহুদিন ধরে আছে মৌলিক কর্তব্যে তারই প্রতিফলন ঘটেছে। ভারতের সুপ্রিম কোর্টও তাদের একাধিক রায়ে (৫১-ক) ধারার প্রায়োগিক ক্ষেত্রটিকে প্রসারিত করেছেন। অশোক কুমার ঠাকুর বনাম ভারত সরকার মামলায় (২০০৮) বিচারপতি ভাণ্ডারি অভিমত দেন যে ৫১ (ক) ধারা রাষ্ট্রের উপর কোনো মৌলিক কর্তব্য ন্যস্ত করেনি একথা ঠিক। কিন্তু সকল নাগরিকের সমন্বয়ে গড়ে ওঠে রাষ্ট্র। তাই ভারতের প্রত্যেক নাগরিকের কর্তব্য হলো রাষ্ট্রের সমষ্টিগত কর্তব্য। আবার জর্জ ফিলিপ বনাম ভারত সরকার মামলায় (২০০৬) সুপ্রিম কোর্ট এই অভিমত প্রকাশ করে যে আদালতের উচিত নয় সংবিধানের চতুর্থ অধ্যায়-ক অংশের অন্তর্নিহিত উদ্দেশ্য ও মূল নীতির পরিপন্থী কোনো সিদ্ধান্ত গ্রহণ করা।
একথা ঠিক যে চতুর্থ অধ্যায়ের নির্দেশমূলক নীতিগুলির মতো চতুর্থ অধ্যায়-ক অংশের মৌলিক কর্তব্যগুলিও আদালত কর্তৃক বলবৎযোগ্য নয়। আদালত সরাসরি কর্তব্যগুলিকে কার্যকর করতে পারে না। কর্তব্যগুলি অমান্য করলে কোনো শাস্তির ব্যবস্থাও নেই। তবে ভারতের সংসদ প্রয়োজনীয় আইন প্রণয়ন করে মৌলিক কর্তব্যগুলি বলবৎ করার ব্যবস্থা করতে পারে। কিন্তু এর নৈতিক গুরুত্ব এবং প্রভাবটিকে অস্বীকার করা যায় না। সংবিধানে সন্নিবিষ্ট মৌলিক কর্তব্য নিয়ে আলোচনা ক্রমেই বৃদ্ধি পাচ্ছে। ফলে জনমানসে এগুলি সম্পর্কে ভাবনাও বাড়ছে। মৌলিক কর্তব্যগুলি ভারতীয় সংবিধানে কেবল শোভাবর্ধনকারী অংশ হিসেবে যাতে না থাকে সে বিষয়ে সরকারও বিভিন্ন সময়ে ভাবনা চিন্তা করেছে। ১৯৯৮ সালে কেন্দ্রীয় সরকার মৌলিক কর্তব্যগুলিকে কীভাবে কার্যকরী করা যেতে পারে সেই বিষয়টি বিবেচনার জন্য বিচারপতি জে. এম. ভার্মার নেতৃত্বে একটি কমিটি গঠন করে। ভার্মা কমিটি ১৯৯৯ সালে তার সুপারিশ পেশ করে। কমিটি মনে করে যে নির্বাচনে ভোট দেওয়া, গণতান্ত্রিক প্রক্রিয়ায় সক্রিয়ভাবে অংশগ্রহণ করা এবং কর প্রদান করাকে ৫১ (ক) ধারায় মৌলিক কর্তব্য হিসেবে অন্তর্ভুক্ত করা উচিত। প্রসঙ্গত উল্লেখযোগ্য, ১৯৭৬ সালে স্মরণ সিংহ কমিটিও কর প্রদান সম্পর্কিত বিষয়টিকে মৌলিক কর্তব্যের অন্তর্ভুক্ত করার কথা বলেছিল, যদিও ৪২তম সংশোধনীতে এই কর্তব্যটিকে অন্তর্ভুক্ত করা হয়নি। ১৯৯৯ সালে ভার্মা কমিটি কতগুলি আইনকে চিহ্নিত করে যেগুলি মৌলিক কর্তব্যসমূহকে কার্যকর করার ক্ষেত্রে সহায়ক হতে পারে। যেমন ১৯৫১ সালের জনপ্রতিনিধিত্ব আইন, ১৯৫৬ সালের The protection of Civil Rights Act, ১৯৬৭ সালের বেআইনি কার্যকলাপ প্রতিরোধ আইন, ১৯৭১ সালের জাতীয় সম্মানের প্রতি অসম্মান প্রতিরোধ আইন (The Prevention of Insults to National Honour Act), ১৯৭২ সালের The Wild life (Protection) Act, Sabo সালের The Forest Conservation Act প্রভৃতি। নাগরিকরা যাতে তাদের মৌলিক কর্তব্যসমূহ পালন করে তা সুনিশ্চিত করার জন্য প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ গ্রহণের জন্য সুপ্রিম কোর্ট ২০০৩ সালে ১১ আগস্ট কেন্দ্রীয় সরকারের উপর এক নির্দেশ জারি করে। এই নির্দেশে ভার্মা কমিটির সুপারিশগুলোকে বিশেষ গুরুত্ব দিয়ে বিবেচনা করা এবং সেগুলিকে কার্যকর করার কথা বলা হয়। সুপ্রিম কোর্ট এ-ও মনে করেন যে, এ বিষয়ে জনগণের মধ্যে সচেতনতা সৃষ্টির প্রয়োজন।
রাজনীতি বিজ্ঞান আলোচনার মূল জায়গায় আবার ফিরে যাওয়া দরকার। অধিকার যদি কর্তব্যের সঙ্গে সম্পর্কহীন হয় তবে সুস্থ সমাজ গঠনের পথে তা এক বড়ো অন্তরায় হবে। সম্প্রতি ভারতে একটি কেন্দ্রীয় আইনের প্রতিবাদ করতে গিয়ে কিছু মানুষ যেভাবে সরকারি সম্পত্তির ক্ষতি সাধন করেছে তাতে সমাজস্থ মানুষকে তার মৌলিক কর্তব্য সম্পর্কে সচেতন করার প্রয়োজনীয়তা আবার নতুন করে অনুভূত হচ্ছে। গোটা বিশ্বজুড়ে মৌলবাদ ও সন্ত্রাসবাদ মিলে গিয়ে এক বিপজ্জনকশক্তি তৈরি হয়েছে যা উদারনৈতিক গণতন্ত্র এবং মুক্ত সমাজের সামনে এক ভয়ংকর বিপদ নিয়ে আসছে। এই প্রেক্ষাপটে মৌলিক কর্তব্য সম্পর্কে এক সার্বিক সচেতনতা জরুরি। এই সচেতনতাই মানবজাতিকে তার আশু বিপদের হাত থেকে রক্ষা করবে।
বিমলশঙ্কর নন্দ
2020-01-17