ট্রাম্পকে ব্যবসায়িক লেনদেনের গণ্ডির ঊর্ধ্বে উঠে আমেরিকায় নিজের স্বার্থেই ভারতকে সমর্থন দিতে হবে। করোনা ভাইরাসের আতঙ্ক ঝেড়ে ফেলে নমস্তে ট্রাম্প অনুষ্ঠান মঞ্চে মোদী-ট্রাম্পের ঘনিষ্ঠ আলিঙ্গন নিশ্চিত উভয় দেশের সম্পর্কের উষ্ণতার প্রামাণ্য সাক্ষী। মার্কিন রাষ্ট্রপতির প্রথম ভারত সফরের প্রথম দিনটি মানবিক সম্পর্ক নির্মাণের প্রচেষ্টায় তাই ছিল ভরপুর।
দ্বিতীয়দিনে তুলনায় সরকারি আচার অনুষ্ঠানের বাধ্য বাধ্যকতা মেনে দুই রাষ্ট্রপ্রধানের মধ্যে ব্যবসায়িক ভঙ্গির পারস্পরিক করমর্দন ও দ্বিপাক্ষিক চুক্তির পুঙ্খানুপুঙ্খতায় ব্যয়িত হয়েছিল। সামগ্রিকভাবে দুই রাষ্ট্রপ্রধানের শরীরী ভাষা, আপাত মানসিক নৈকট্য প্রদর্শন, একে অপরের ভূয়সী প্রশংসার বাক্যজাল নতুন করে দু’দেশের মধ্যে একটি স্থায়ী, শক্তিশালী ও এযাবৎ অনুপস্থিত এক অভূতপূর্ণ সম্পর্ক নির্মাণেরই ঈঙ্গিতবাহী।
অতীত অভিজ্ঞতা অনুযায়ী ভারত-মার্কিন সম্পর্ক তৈরির প্রশ্নে বরাবরই এক ধরনের। বিপদে আঁচ করে নেওয়া হতো। এমন কী খুব নিরাপদ রাজনৈতিক পরিস্থিতিতেও এ নিয়ে। জল্পনা কখনও শেষ হতো না। আমেরিকার সন্নিকটের বেশিরভাগ দেশের মধ্যে আবার এ নিয়ে ভগবানকেও টেনে আনার চেষ্টা চলত। ১৯৯০-এর শেষাশেষি থেকে অবস্থাটা বদলানো শুরু হয়। বিগত ২২ বছরে পরপর ভারতের প্রধানমন্ত্রীরা দেশকে আমেরিকা ঘনিষ্ঠ করে তোলার প্রয়াস শুরু করেন। এর মধ্যে ঠাণ্ডা যুদ্ধের সময়কাল ধরে উভয় দেশের মধ্যে সম্পর্কের যে ব্যবধান তথাশীতলতা ছিল। বর্তমান প্রধানমন্ত্রী তাঁর কার্যকালের শুরু থেকেই তা বদলাতে উঠে পড়ে লাগেন।
আলিঙ্গনের চাক্ষুষ হওয়া তৃপ্তিদায়ক দৃশ্যগুলির অভ্যন্তর কিন্তু অন্তঃসারশূন্য নয়। এর অন্তরালে বরং রয়েছে বিগত বেশ কিছু সময় ধরে ভারতের একটি সম্ভবনাময় শক্তিকেন্দ্র হয়ে ওঠা। একইসঙ্গে উভয়দেশের জনগণের মধ্যে দীর্ঘস্থায়ী সুসম্পর্কের ধারবাহিক বৃদ্ধি। মনে করা যায় ঠাণ্ডা যুদ্ধের সময় যখন ভারতকে মূলত সোভিয়েত ঘেঁষা দেশ হিসেবেই ধরা হতো তখনও কিন্তু যত ভারতীয় রাশিয়ায় যেত তার চেয়ে ঢের বেশি ভারতীয় আমেরিকামুখী হতো। সেখানে তারা সাগ্রহে গৃহীতও হতো। এরই দীর্ঘকালীন পরিণতিতে আমেরিকা আজ ৪০ লক্ষ এমন ভারতীয়ের আবাসস্থল যারা সে দেশটিকে নিজেদের কর্মভূমি বলে মনে করে। এর সঙ্গে বছরের যে কোনো সময়কে রেনডম হিসেবে ধরলে ২ লক্ষ ভারতীয় ছাত্র সেখানে পড়াশোনা করে। পৃথিবীর অন্য কোনো দেশই এত বিপুল সংখ্যক মানুষকে গ্রহণের পর তাদের নিজ দেশে স্থায়ী বসবাসকারী হিসেবে মান্যতা দেয়নি। এর প্রত্যক্ষ প্রমাণ হিসেবে বিশ্বের সর্ব প্রসিদ্ধ মার্কিন বহুজাতিক কোম্পানি Microsoft, Google বা IBM-এর আজকের কর্ণধাররা জন্মসূত্রে সকলেই ভারতীয়।
এতদ সত্ত্বেও, ভারত -আমেরিকার অর্থনৈতিক সম্পর্ক কিন্তু পূর্ণভাবে বিকশিত হতে পারেনি। যেটা হওয়া আদৌ অভিপ্রেত ছিল না। বিশেষ করে চীনের সঙ্গে যদি প্রতিতুলনা করা যায়। উল্লেখিত সময়টায় কিন্তু ভারতে অতি দ্রুত বৃদ্ধি ঘটেছিল। অথচ চলতি শতাব্দীর শুরুতে দ্বিপাক্ষিক বাণিজ্যের যে বহর ছিল ১০ বিলিয়ন ডলার তা উলম্ফন দিয়ে ২০১৫ সালে এসে ১০০ বিলিয়ন ডলার ছুঁয়ে ফেলে। কিন্তু আমেরিকা এই নাগাড়ে বৃদ্ধি ও ভারতের উন্নয়নকে যথাযোগ্য পরিপ্রেক্ষিতে নিয়ে গিয়ে ভারতকে একটি বিশ্বশক্তিধর দেশ হয়ে ওঠার পথে কৌশলগত সহযোগিতায় বিরত ছিল। তারা সেভাবে ভাবেনি যে চীনের মহাশক্তিধর হয়ে ওঠার বিপরীতে মার্কিন সহযোগিতায় ভারতও প্রতিস্পর্ধী হয়ে ওঠে আসতে পারে।
বাস্তবে ওবামা-বিডেন-কেরি-ক্লিন্টন আমলে দ্বিপাক্ষিক বাণিজ্যের পরিমাণ বাড়িয়ে ৫০০ বিলিয়ন ডলার করার পরিকল্পনা নেওয়া হলেও তা সুদূর পরাহত থেকে যায়। যেমন। ভারতের ৫ ট্রিলিয়ন ডলারের অর্থনীতি হয়ে ওঠা নিয়ে অনেকে নিরাশা ব্যক্ত করছেন। এই বিতর্কিত বিষয়ে রাষ্ট্রপতি ট্রাম্প যিনি নিজে একজন সফল উচ্চাভিলাষী শিল্পবান্ধব ও দ্রুত ব্যবসায়িক চুক্তি সম্পাদনে সিদ্ধহস্ত বলে নিজেকে উপস্থাপিত করেন তিনি কি সফল হবেন?
অবশ্যই তিনি সফল হওয়ার ক্ষমতা ধরেন। কিন্তু তার মানে এই নয় যে ভারত একপক্ষীয় ভাবে চীনের মতো অস্ত্রশস্ত্র ও প্রচুর অপ্রয়োজনীয় বাণিজ্যিক বস্তু তাঁর কাছ থেকে কিনে বাণিজ্য ঘাটতি ভরাট করে দেবে। এটাই কিন্তু তার একটা গুরুত্বপূর্ণ মনোবাঞ্ছর মধ্যে। পড়ে। নিজের ভাবমূর্তি অটুট রাখতে ও আত্মবিশ্বাস বাড়াতে এই ভারত সফর নিঃসন্দেহে তাকে সাহায্য করবে। কিন্তু আরও মজবুত সম্পর্ক তৈরি করতে গেলে অর্থনৈতিক বিষয়টি উভয় দেশের পক্ষেই মঙ্গল তথা লাভজনক হওয়া দরকার।
এই নিরিখে ‘আমেরিকা ফার্স্ট’ ও ‘বিশ্বশক্তি হিসেবে আমেরিকাই প্রধান এই দৃষ্টিভঙ্গির সঙ্গে মেক ইন ইন্ডিয়া ও নতুন দিল্লিরও বিশ্বের দরবারে শক্তিধর দেশ হয়ে ওঠার আকাঙ্ক্ষার উপযুক্ত সম্মানজনক সংমিশ্রণ ঘটাতে হবে। সে কারণে ভারতের ক্ষেত্রে আমেরিকাকে কিছুটা নমনীয় হতে হবে একই সঙ্গে ভারতের বৃদ্ধিকে সর্বতোভাবে সাহায্য করার ক্ষেত্রে দ্বিধা রাখলে হবে না। এর মধ্যে বিশেষ গুরত্বের ক্ষেত্রে হবে ভারতের সর্বপেক্ষা বড়ো সম্পদ দেশের অতি দক্ষ মানবশক্তি।
কথাটা বলা বা সাজেশন দেওয়া সোজা হলেও চা ও ঠোটের মধ্যে পর্যাপ্ত ব্যবধান রয়েছে। গোটা বিষয়টিকে কীভাবে কার্যকরী করে তোলা যায় তা নিয়ে চিন্তাস্তরে অনেক প্রভেদ বিদ্যমান। আমেরিকাকে একটা জিনিস মানতে হবে যে সৌহার্দের আদর্শ পরিবেশ তৈরি হওয়া সত্ত্বেও অর্থনীতির ক্ষেত্রে সব সময়ই যে উভয়দেশের মধ্যে সমস্ত খুঁটিনাটি বিষয় নিয়ে পূর্ণ সহমত তৈরি হবে এমনটা নয়। শক্তি ক্ষেত্রের কথাই ধরা যায়। ট্রাম্পের হাইড্রো কার্বন নিঃসরণ নিয়ে এক ধরনের তীব্র বিরাগ আছে। চলতি সফরের ৩৬ ঘণ্টার (কাজের সময়) পুনর্নবীকৃত শক্তি নিয়ে কিন্তু কোনো উচ্চবাচ্যও হয়নি। যদি ধরে নেওয়া যায় ২০২০-র নির্বাচনে বা তারও পরে আমেরিকায় আরও একজন একই রকম হাইড্রোকার্বন নিয়ে। বায়ুগ্রস্ত ব্যক্তি আমেরিকার সর্বোচ্চ পদে বসলেন সেক্ষেত্রে ভারতের প্রতি অবস্থান কী হবে? হাইড্রোকার্বনের প্রভাবে ভারতের রাজধানী ও সারা পৃথিবীর বহু দেশই যে প্রকাশ্য দিবালোকেও ধোঁয়াসাচ্ছন্ন, ছায়া ছায়া প্রতীয়মান হচ্ছে তা তো তিনি চাক্ষুষ করেই গেলেন। এই অবস্থায় আমেরিকার বন্ধুত্ব অটুট রাখতে renewable energy সংক্রান্ত কোনো আলোচনা না করে বিপুল বিষাক্ত বিষবাষ্পকে বিনা বাক্যে হজম করে কেন ভারত উপসাগরীয় অঞ্চলের দেশগুলির সঙ্গে তার সুসম্পর্ক খোয়াবে? বিশেষ করে এদের মধ্যে কেউ কেউ পাকিস্তানের সঙ্গে ভারতের অবস্থান সহজ করতে প্রায়শই মধ্যস্থতাকারীর ভূমিকা নেয়।
এরপর দুগ্ধজাত পণ্যের প্রশ্ন। যেহেতু আমেরিকানরা তাদের প্রাচুর্যের সুবাদে আজকাল গোরু মোষের দুধ ও দুগ্ধজাত বস্তু ছেড়ে দিয়ে গাছপালা থেকে উৎপন্ন দুধ খাওয়ার অত্যাধুনিক অভ্যাস শুরু করেছে তাদের দেশে বাড়তি দুধের বন্যা হয়ে যাচ্ছে। প্রচলিত দুধ ব্যবহার ৪০ শতাংশ কমে গেছে। আর আমেরিকার দুধরাজধানী Wisconsin-এর ভোট ট্রাম্প নিজের পকেটে আনতে চান। সেক্ষেত্রে ভারত দুধের বোঝা কিন্তু হজম করতে পারবে না। ভারত কঠিন পরিশ্রমে সবে মাত্র দুধ ও দুগ্ধজাত পণ্যে স্বয়ংসম্পূর্ণ হয়ে। উঠেছে। এগুলি প্রকট সমস্যা এবং এর সমাধান সূত্রে নিয়ে গভীর বিশ্লেষণ জরুরি। বিশ্বে এখন চিরস্থায়ী বন্ধু বাশত্রু কেউ নয়। কিন্তু নিজনিজ দেশের স্বার্থ চিরস্থায়ী। এতদসত্ত্বেও পারস্পরিক বিশ্বাস ও নির্ভরযোগ্যতার আবহে একটি দীর্ঘস্থায়ী মজবুত সম্পর্ক গড়ে ওঠার উপযুক্ত পরিস্থিতি অবশ্যই তৈরি হয়েছে। মোদী ও ট্রাম্প কেউই বরাবর নেতৃত্বে থাকবেন না, কিন্তু উভয় দেশের মানুষ থাকবে। তারা এক সুদৃঢ় বন্ধনে আবদ্ধ হতে চায়।
চিদানন্দ রাজঘাট্টা
(লেখক প্রবীণ সাংবাদিক)
2020-03-10