২০ জুন ১৯৪৭ পশ্চিমবঙ্গের জন্মলগ্নের পর, ১৫ আগস্ট ১৯৪৭-এর মধ্যরাত্রের স্বাধীনতার পথ ধরে স্বাধীন দেশের যুক্তরাষ্ট্রীয় কাঠামাের মধ্যে হিন্দু হােমল্যান্ডের’যাত্রা শুরু হয়। ১৯৬৭ সালে অগ্নিগর্ভ বামপন্থী আন্দোলনে রাজ্যের পশ্চাদপসারণের যাত্রা শুরু হয়।
১৯৭১-এর বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধে জর্জরিত উদ্বাস্তু স্রোত, ১৯৭১-এর নির্বাচনের নামে প্রহসন এবং ১৯৭২-এর ভােট লুটের পর সিদ্ধার্থশঙ্কর রায়ের নেতৃত্বে পশ্চিমবঙ্গে সরকার গঠিত হয়। ২৫ জুন ১৯৭৫ জরুরি অবস্থার কালাে রাত্রি সারা দেশের সঙ্গে পশ্চিমবঙ্গেও নেমে আসে। বামপন্থী দলতন্ত্রের আগলে শ্বেত সন্ত্রাসকে অতিক্রম করে ১৯৭৭ সালে পশ্চিমবঙ্গ নিমজ্জিত হয়। ৩৪ বছরের বাম অপশাসনে। বাম জমানার শেষলগ্নে সিঙ্গুরকে বাস্তবায়নের অক্ষমতা ও নন্দীগ্রামের হাড়হিম’করা সন্ত্রাসের পথ ধরে পরিবর্তনের ধ্বজা তুলে ২০১৯ সালে মা-মাটি-মানুষের সরকার পশ্চিমবঙ্গের ক্ষমতায় অধিষ্ঠিত হয়। বদলানয় বদল চাই’ প্রভৃতিমুখরােচক স্লোগানের আড়ালে জরুরি অবস্থার গহ্বর থেকে উঠে আসা নেত্রীর দাঁত নখ বেরিয়ে আসতে বেশি সময় লাগেনি। পশ্চিমবঙ্গকে অনতিবিলম্বে দলতন্ত্রের বজ্ৰআটুনি, রাজনৈতিক সন্ত্রাস, অর্থনৈতিক দুর্নীতি ও স্বজনপােষণ, অনুপ্রবেশ, সংখ্যালঘু তােষণ ও জিহাদি কারবারিদের আঁতুড়ঘরে পরিণত করতে নেত্রী সময় নেননি। ড. শ্যামাপ্রসাদ মুখার্জির হিন্দু হােমল্যান্ড হিন্দু নিধনের পরীক্ষাগারে পরিণত হয়। নারী পাচার, নারী নির্যাতন, ধর্ষণ মহিলা মুখ্যমন্ত্রী শাসিত পশ্চিমবঙ্গের রােজনামচা। দিল্লির নির্ভয়ার ঘটনার থেকেও ভয়ংকর ঘটনা ঘটতে থাকে উত্তর চব্বিশ পরগনার কামদুনি থেকে উত্তর দিনাজপুরের চোপরার সদ্য মাধ্যমিক উত্তীর্ণ ছাত্রীর সঙ্গে। লাভজিহাদের নামে পশ্চিমবঙ্গের প্রজ্ঞা দেবনাথ আয়েশা জন্নত মােহনায় পরিণত হয়ে নব্য জেএমবি-র মহিলা শাখার দায়িত্ব গ্রহণ করে কিন্তু সে পশ্চিমবঙ্গে গ্রেপ্তার হয় না, গ্রেপ্তার হয় বাংলাদেশে। বর্ধমানের খাগড়াগড় বিস্ফোরণের আগে এই তথ্য আমাদের অজানা ছিল যে এখানে বসে জেএমবি জঙ্গিরা খারিজি মাদ্রাসার আড়ালে বৃহত্তর ইসলামিক বাংলাদেশ গঠনের পরিকল্পনা করে চলে। গয়া বিস্ফোরণ কিংবা ঢাকার হােলি আর্টিসান। বেকারি বিস্ফোরণের নামকরা উগ্রপন্থীদের। চারণভূমি পশ্চিমবঙ্গে ধরা পড়ে। বাংলাদেশের গণহত্যার নায়করা কলকাতা ও তার পার্শ্ববর্তী অঞ্চলে নিশ্চিন্তে রাত কাটায়।
পুরুলিয়ার ত্রিলােচন মাহাতাে থেকে হেমতাবাদের বিধায়ক দেবেন্দ্র রায়কে মেরে ঝুলিয়ে দিয়ে আত্মহত্যার তকমা লাগিয়ে দেওয়া হয়। মাওবাদী ছত্রধর মাহাতাের ছাতার নীচে বড়াে হওয়া নেত্রী ছত্রধরকে রাজ্য কমিটিতে জায়গা দিয়ে বুঝিয়ে দেন তিনি অতি বামপন্থতেও আছেন আবার অহিংস গান্ধীর কংগ্রেসেও আছেন। ঝাড়গ্রামের একের পর এক রাজনৈতিক হত্যা ও জ্ঞানেশ্বরী এক্সপ্রেসের বিস্ফোরণের দায়ে তবে কার? রাজনৈতিক হত্যার বধ্যভূমিতে পরিণত হয়েছে পশ্চিমবঙ্গ। এখানে শুধুমাত্র প্রতিপক্ষ বিজেপি কর্মী-নেতারা খুন হন না; কংগ্রেস, সিপিএম এমনকী তৃণমূলের গােষ্ঠী সংঘর্ষে প্রতিনিয়ত রক্তাক্ত হয় আমার রাজ্য। পাড়ুইয়ের সাগর ঘােষ, কৃষ্ণগঞ্জের সত্যজিৎ বিশ্বাস, নােয়াপাড়ার বিকাশ বসু, ভদ্রেশ্বরের মনােজ উপাধ্যায়, বাগনানের শেখ আসাফুল রহমান এই হত্যাগুলি স্বপক্ষে রক্তক্ষয়ের কয়েকটি উদাহরণ মাত্র।
বিচারবিভাগীয় কমিশনের রিপাের্ট হিমঘরে পাঠাতে মমতার জুড়ি মেলা ভার। ১৯৯৩-এর ২১ জুলাইয়ের গুলি চালানাের ঘটনায় ২০১১ সালে বিচারপতি সুশান্ত চট্টোপাধ্যায়ের গঠিত কমিটি রিপাের্ট জমা দেয় কিন্তু শােনা যায় মূল অভিযুক্ত মণীশ গুপ্ত প্রথমে মন্ত্রী ও পরে রাজ্যসভার সদস্য হন। ২০১১ সালে বিচারপতি অরুণাভ বসুকে নিয়ে গঠিত সাঁইবাড়ি হত্যালীলার রিপাের্ট জমা পড়ে কিন্তু কার্যকর হয় না। বিজন সেতুতে আনন্দমার্গী হত্যা তদন্তে ২০১২ সালে বিচারপতি অমিতাভ লালার নেতৃত্বে কমিশনের রিপাের্ট এখনও দিনের আলাে দেখেনি। কাশীপুর বরানগর গণহত্যায় ২০১২ সালে গঠিত প্রথমে বিচারপতি এ কে বিশি ও পরে বিচারপতি ডি পি সেনগুপ্ত কমিশনের রিপাের্ট মুখ থুবড়ে পড়ে। শুধু কমিশনের রিপাের্ট কেন, উচ্চন্যায়ালয়ের রায় কার্যকর করতে মমতা সরকারের অনীহা সুবিদিত।
ইতিপূর্বে ভারতে প্রায় ১২৫ বার এবং পশ্চিমবঙ্গে ৫ বার রাষ্ট্রপতি শাসন জারি হয়। ১৯৫১ সালে ২০ জুন পঞ্জাবে প্রথম রাষ্ট্রপতি শাসন জারি হয়। ১৯৫৯ সালে কেরলে নাম্বুদ্রিপাদ সরকার এবং ১৯৬৭ সালে পশ্চিমবঙ্গে অজয় মুখার্জির নেতৃত্বে প্রথম যুক্তফ্রন্ট সরকার ফেলে দিতে রাষ্ট্রপতিশাসন জারি করা হয়।
ভারতীয় সংবিধানের ৩৫৬ ধারা অনুসারে কোনাে রাজ্যে নির্বাচিত সরকার সরিয়ে রাষ্ট্রপতি শাসন জারি করা যেতে পারে। এস আর বােম্বাই বনাম ভারত সরকার মামলার রায় দান প্রসঙ্গে সুপ্রিম কোর্টঅভিমত ব্যক্ত করেন যে কতগুলাে বিশেষ পরিস্থিতিতে রাজ্যে রাষ্ট্রপতি শাসন জারি করা যেতে পারে—
(১)রাজ্যে আইনশৃঙ্খলার চূড়ান্ত অবনতি ঘটলে ও জনজীবন বিপর্যস্ত হলে।
(২) রাজ্যে সরকার রাজ্য শাসনে। চূড়ান্তভাবে ব্যর্থ হলে।।
(৩) সরকার দুর্নীতিগ্রস্ত হয়ে পড়লে বা রাজ্য সরকার ক্ষমতার অপব্যবহার করলে।
(4) জাতীয় সংহতি জাতীয় নিরাপত্তার ক্ষেত্রে হানিকর পরিস্থিতির উদ্ভাবন ঘটলে অথবা সার্বভৌমত্ব বিপন্ন হলে।
(৫) সংবিধান লঙ্ঘিত হলে, সংবিধান বিরােধী কাজ করলে অথবা সামাজিক-রাজনৈতিক প্রেক্ষাপটে জনগণের মধ্যে চূড়ান্ত অনৈক্য দেখা দিলে।।
সারকারিয়া কমিশনের মত অনুসারে রাজ্যে রাষ্ট্রপতি শাসন চূড়ান্ত বা সর্বশেষ পদক্ষেপ হিসেবে গণ্য করা যেতে পারে। সর্বোপরি রাজ্যে তখনই রাষ্ট্রপতিশাসন জারি করা যায় যদি রাজ্যপাল মনে করেন যে রাজ্যের সাংবিধানিক ব্যবস্থা সম্পূর্ণরূপে কাজ করতে ব্যর্থ। পশ্চিমবঙ্গের পরিপ্রেক্ষিতে মহামান্য সুপ্রিম কোর্টের পর্যবেক্ষণ পর্যালােচনা করে দেখা যাবেসবক্ষেত্রে রাজ্যে রাষ্ট্রপতি শাসন জারির অনুকূল পরিস্থিতি বর্তমান।
প্রথমত, রাজ্যে আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতির চূড়ান্ত অবনতি ঘটেছে। বিরােধী রাজনীতির পরিসর যেমন সংকুচিত তেমনি শাসক দলের মন্ত্রী, নেতা বা মন্ত্রীদের যে কোনাে প্রতিবাদী কণ্ঠস্বর রাজনৈতিক হত্যা বা মিথ্যা ‘বাংলার গর্বের’ নামে স্তব্ধ করে দেওয়া হয়।
দ্বিতীয়ত, প্রশাসনের সর্বোচ্চ স্তর থেকে সর্বনিম্ন স্তর পর্যন্ত পাহাড় প্রমাণ দুর্নীতি, রেশন দুর্নীতি, পেন-পেনসিলে শিক্ষক। নিয়ােগে দুর্নীতি, ছাত্র ভর্তিতে দুর্নীতি, সরকারি চাকরিতে স্বজনপােষণের দুর্নীতি নিত্যদিনের ঘটনাতে পরিণত হয়েছে।
চতুর্থত, মাওবাদী থেকে অনুপ্রবেশকারীদের দেশ-বিরােধী কার্যকলাপকে প্রচ্ছন্ন মদত দেওয়া। পশ্চিমবঙ্গকে কখনাে মাওবাদী, কখনাে হুজি, কখনও-বা জেএমবি-র অবাধ মৃগয়াক্ষেত্রে পরিণত হতে দেওয়া। নাগরিকত্ব বিল সংসদের নিম্নকক্ষ ও উচ্চকক্ষে পাশ হয়ে রাষ্ট্রপতি স্বাক্ষরের পর নাগরিকত্ব আইনে পরিণত হওয়া সত্ত্বেও জম্মু ও কাশ্মীরের দেশ। বিরােধী সংগঠনের মতাে রাষ্ট্রসঙ্গে নিয়ে। যাওয়ার হুমকি দেন মাননীয়া। গণতন্ত্রের চতুর্থ স্তম্ভ সংবাদপত্রের কণ্ঠ রােধ করার নিরন্তর প্রচেষ্টা চলে। কখনাে প্রতিষ্ঠিত সংবাদপত্রের সম্পাদককে জেরার নামে। ঘণ্টার পর ঘণ্টা থানায় বসিয়ে রেখে পদত্যাগে বাধ্য করা। আরামবাগ টিভির মালিককে গ্রেপ্তার করা, সরকার বিরােধী মন্তব্যের জন্য কলকাতা নিউজের সম্প্রচার বন্ধ করা ইত্যাদি অনুপ্রেরণার হাতিয়ার হিসেবে ব্যবহার হচ্ছে।
পঞ্চমত, পঞ্চায়েত থেকে বিধানসভা দখলের স্বার্থে শাসকদল পশ্চিমবঙ্গকে ব্লাড আইল্যান্ডে পরিণত করছে। ২০২১-এ পশ্চিমবঙ্গের পরিবর্তনকামী উন্নয়নমুখী গণতান্ত্রিক পরিসরে সরকার গড়তে অবাধ ও শান্তিপূর্ণ নির্বাচন অত্যন্ত জরুরি। মমতা ব্যানার্জির নেতৃত্বে মা-মাটি-মানুষের সরকার অবাধ ও শান্তিপূর্ণ নির্বাচনে বিশ্বাসী নয়।তাই পশ্চিমবঙ্গকে রক্ষা ও পশ্চিমবঙ্গের জনগণের সােনালি ভােরের তাগিদে অবাধ ও শান্তিপূর্ণ নির্বাচনকেনিশ্চিত করতে এবং হার্মাদ থেকে, উন্মাদকে দূরে রেখে জনগণের ভােটাধিকার প্রয়ােগের বাস্তবতা সৃষ্টিতে রাষ্ট্রপতি শাসন ছাড়া কোনাে বিকল্প নেই।।
ড. পঙ্কজ কুমার রায়
(লেখক অধ্যক্ষ, যােগেশ চন্দ্র চৌধুরী কলেজ, কলকাতা)