ক্রিং ক্রিং….
– হ্যালো কোথা থেকে বলছেন?
—আমি স্বপ্নলোক নার্সিং হোম থেকে বলছি। ইন্দ্রজিৎ সেন কে হয় আপনার?
আমার বাবা। আমি ওনার ছেলে বলছি, কুমারজিৎ।
–আচ্ছা মিঃ সেন, বলতে খারাপ লাগছে তবু খবরটা তো আপনাকে দিতে হবে।
উগ্রীব ভাবে প্রশ্ন করলাম। কিন্তু কি হয়েছে বাবার? বাবা সুস্থ আছেন তো?’আমার পা দুটো কাপছে।
-না না আপনার বাবা আগের মতোই আছেন। এই মুহূর্তে ওনার সোয়াব টেস্টের রিপোর্ট এসেছে তাতে দেখা যাচ্ছে ওনার কোভিড ১৯ পজেটিভ।
-কী বলছেন? রিপোর্টটা ইন্দ্রজিৎ সেনের তো?
–আপনি আপনার ডাক্তারের সঙ্গে কনসাল্ট করে এখানে আসুন।
ফোনটা কেটে গেল। মাথায় যেন আকাশ ভেঙে পড়ল। মা ছুটে এলো। সে কী রে, কী করে হলো! মা আমি কী করব? কেমন করে বাবাকে বাঁচাবো? মাকে জড়িয়ে ধরে হাউ হাউ করে কাঁদতে লাগলাম। কিছুক্ষণ নিঃশব্দে দুজনের চোখের জলে বুক ভেসে গেল।
তারপর নিজেকে কিছুটা সংবরণ করে নিয়ে মা বলল তোর সেজ কাকারঅনেক হাসপাতালে যোগাযোগ আছে ওকে একবার ফোন কর।
কুমারজিৎ প্রথমে স্থির করল যে নার্সিং হোমে যে ডাক্তার বাবাকে দেখছেন তাঁকেই একবার ফোন করে কথা বলে।
তিনি বললেন—আমার কাছেও রিপোর্টটা এসেছে কিন্তু আমি এখানে খুব একটা ভরসা পাচ্ছি না। একটা বড়ো কোনো সেটআপে ওনাকে ভর্তি করানোর ব্যবস্থা করো। যেখানে কমপক্ষে ভেন্টিলেটর আছে।
সেজকাকা কয়েক জায়গায় চেষ্টা করে হাল ছেড়ে দিল। বলল – না কোথাও বেড নাই।
যেখানে আছে ওখানেই রাখো। একান্তই যদি স্থানান্তর করাতে হয় তবে মেডিক্যাল কলেজে ভর্তি করে দিতে হবে। মনে হলো যেন একটা দায়সারা গোছের সাজেশান।।
ন-কাকা বলল, দেখ আমি ওখানে যেতে পারব না। কারণ আমার অফিস জানতে পারলে ১৪ দিন অফিসে কাজ করতে দেবে না। যদি টাকাপয়সার প্রয়োজন হয় বলিস লোক দিয়ে পাঠিয়ে দেবো।
মা বলল এখন জেঠকে খবর দিস না, কারণ তার শরীর খারাপ। কান্নাকাটি করবে।
কী করব দিশেহারা অবস্থা। কাকে বলব? কে ভর্তির ব্যবস্থা করবে? কোথায় বেড় পাওয়া যাবে? মনের মধ্যে তোলপাড় হয়ে চলেছে। হঠাৎ অমানিশদার কথা মনে পড়ল। আমার শিক্ষক। ওনার কাছে প্রাইভেটে মেডিসিন পড়তাম। উনি এম.আর.সি.পি। দুঃসময় যখন আসে দিশেহারা অসহায় মনে হয় নিজেকে। কোথাও কোনো ব্যবস্থা করা যাচ্ছে না কিন্তু তার মধ্যে যেন একটু আলোর উঁকি। দুর্যোগপূর্ণ তমসাছন্ন অন্ধকারে মনে হলো যেন ক্ষণপ্রভার প্রভাদান।
কিন্তু কী আশ্চর্য! একটা ফোনেই স্যারকে পেয়ে গেলাম। এক নিঃশ্বাসে মনের সমস্ত আবেগ, কান্না সব উজাড় করে দিলাম। স্যার শান্তভাবে সব শুনলেন তারপর আমাকে বললেন, তোকে অত চিন্তা করতে হবে না। আমি তো আছি। আমি দু-তিনটা নার্সিং হোমে যুক্ত আছি , কোথাও একটা বেডের ব্যবস্থা হয়ে যাবে। তোকে ফোন করতে হবে না। আমি ব্যবস্থা করে তোকে ফোন করব। ত ওনাকে Refered discharge করাবি।
বোধ হয় ৭ মিনিট বাদে স্যার ফোন করলেন। এই সময়টা আমাদের কাছে ৭ ঘণ্টা বলে মনে হলো। তারমধ্যে কাকাদের নানা রকম সাজেশান। কিছুই কান দিয়ে মাথায় পৌঁছচ্ছে। না। তারা অকৃপণ ভাবে সাজেশানের বন্যা বইয়ে দিচ্ছে। অবশেষে স্যার ফোনে বললেন যে আমি যেহেতু জীবনতরীতে বেশিক্ষণ থাকি তাই ওখানেই বেডের ব্যবস্থা করেছি। তোদের কি এখানকার অ্যাম্বুলেন্স লাগবে তাহলে বলে দিচ্ছি। আমি বললাম হ্যা হ্যা লাগবে। কারণ রাত্রি হয়ে গেছে। কোথায় পাবো ঠিক নাই।
–ঠিক আছে অ্যাম্বুলেন্সে নিয়ে চলে আয়।
আমি ঠিক করলাম যেমন করেই হোক যত রাত্রি হোক আজই সিফট করতে করাতে হবে। কারণ আগমীকাল পাড়ায় জানাজানি হবে আর আমাদের গৃহবন্দি করে দেবে। বেরোতে দেবে না। আমার জেঠুর ছেলে দাদাকে ফোন করলাম। এক কথায় দাদা বলল যে আমি স্বপ্নলোকে পোঁছচ্ছি। ছোট কাকা বলল যে ঠিক আছে। আমিও যাচ্ছি।
রাত্রি সাড়ে ১১টায় জীবনতরীতে ভর্তি করে সাড়ে ১২টা নাগাদ বাড়ি ফিরলাম। ছোটকাকা তো এলই না, একটা ফোন করেও জানালো না যে পারছি না। আমার মনে পড়ে গেল যেদিন বাবাকে স্বপ্নলোকে ভর্তি করেছিলাম সেদিনও ফোনে ছোট কাকাকে বলেছিলাম তুমি কি বাড়িতে আছো? তাহলে বাবার সুগারের ওষুধগুলো এরা চাইছেন তুমি দিয়ে যেতে পারবে। ছোট কাকা বলেছিল, হ্যা একটু বাদে নিয়ে যাচ্ছি। কিন্তু আসেনি। অগত্যা সঙ্ঘের একজন কার্যকর্তাকে পাঠালাম। সেই বাড়ি থেকে ওষুধ নিয়ে পৌঁছালো।
ক ফেরার সময় দাদাকে সেদিনের ঘটনাটা বলেছিলাম।মনে একটা শান্তি অনুভব হচ্ছে যে এরপর আমাদের উপর যা টর্চার হবে তোক কিন্তু বাবার একটা বড়ো সেটআপে চিকিৎসার সুযোগ হয়ে গেলো। পরের দিন তখনো পাড়ার কেউ জানে না। সেই জন্য নার্সিংহোম থেকে ফোন আসাতে ছুটলাম।
অফিসিয়াল কিছু কাজ বাকি ছিল, শেষ করে যখন বেরোচ্ছি তখন স্যারের সঙ্গে দেখা হয়ে গেলো। বলল তোমার বাবাকে দেখলাম। Lung এ Ingury আছে, তবে কেস মোডারেট। ঠিক হয়ে যাবে। বাবাকে দেখবে নাকি? লোভ সামলাতে পারলাম না। স্যার সঙ্গে করে নিয়ে বাবার সঙ্গে দেখা করালেন। বাবাকে দেখে মন অনেক শান্ত হলো।
পরেরদিন প্রথম ভারত সরকারের আয়ুশ মন্ত্রালয় থেকে ফোন এলো যে বাবার করোনা পজিটিভ। তারপর কলকাতা পৌরসভা। এবার তড়িঘড়ি পাড়ায় ব্যবস্থা আরম্ভ হয়ে গেলো। মনে হলো যেন পাকিস্তানের এক দুর্ধর্ষ জঙ্গি এই বাড়িতে ঢুকেছে। বাড়িটা আটকাও। প্রথমে হুমকি তোমাদেরও টেস্ট করাতে হবে। শুরু হলো আমাদের উপর পাড়ার লোকেদের নজরদারি। প্রথম যেটা হলো বাড়ির কাজের সহায়ককে বারণ করে দেওয়া হলো। পাশের বাড়ির কাকিমা রোজ দুবেলা জানালা দিয়ে মায়ের সঙ্গে গল্প করত, কিন্তু আজ থেকে দরজা জানালা বন্ধ। মনে হয় জানালা দিয়ে করোনা ঢুকে পড়বে।
শুনলাম কাল পৌরসভাতে টেস্ট ক্যাম্প হচ্ছে। পাড়ার এক বন্ধু বলল যে তোরা এখান থেকে টেস্ট করালেই ভালো হবে। পরের দিন পৌরসভা থেকে লোক এলো দুটো পলিপ্যাক নিয়ে। একটায় মাস্ক, গ্লাভস রাখতে হবে, অন্যটায় আনাজের খোসা ও অন্যান্য জঞ্জাল রাখতে হবে। প্রথমটা এককেজি ৫০০ টাকা প্লাস জিএসটি ১৮ শতাংশ এবং পরেরটা প্রতি কেজি ৫০ টাকা প্লাসজিএসসি ১৮ শতাংশ দিতে হবে। মেনে নেওয়া ছাড়া উপায় নাই। টেস্ট করালাম মা ও আমি। ওখান থেকে বলাহলো যে একজন আত্মীয়ের ফোন নম্বর দিতে যার সঙ্গে তারা যোগাযোগ করবে। আমি ছোটকাকাকে ফোনে জিজ্ঞাসা করলাম তোমার নম্বর দেবো? ছোটোকাকা সঙ্গে সঙ্গে না বলল। এবার সঙ্ঘের কার্যকর্তা এগিয়ে এসে বলল আমার নম্বর দিয়ে দে। আমি বুঝে নেবো।।
হঠাৎ আমাদের সিল করে দিতে আতান্তরে পড়লাম। মাসের প্রথম, বাজার নাই, খাবো কী? বাবার পরিচত সঙ্ঘের এক কার্যকর্তা বন্ধুকে বললাম। তিনি নিজের পয়সায় বাজার, তরিতরকারি সব কিনে দিয়ে গেলেন। তখন উনার ছেলের জ্বর তা সত্ত্বেও তিনি এ বিপদে আমাদের পাশে এসে দাঁড়ালেন। সত্যি, অবাক লাগে সঙ্ঘা ১ ঘন্টার শাখায় কেমন করে এই
মানসিকতার জন্ম দেয়। যখন আমার আত্মীয়স্বজন ভয়ে অন্যদিকে ছুটছেন, যখন পাড়ার লোকেরা আমাদের বয়কট করছে ,তখন এই স্বয়ংসেবকরানিজের ও নিজের পরিবারের কথা চিন্তা না করে আমাদের মতো দুর্গতদের পাশে এসে দাড়িয়েছেন। সাহায্যের হাত বাড়িয়ে দিয়েছেন।
বাবা হাসপাতালে লড়াই করে চলেছেন। দুরূহশ্বাসকষ্টের মধ্যেও আমাদের কথা জিজ্ঞাসা করছেন। আমি চোখের জল লুকিয়ে কান্না চেপে রেখে কৃত্রিম হেসে বাবাকে বলছি আমরা ভালো আছি। আমাদের আত্মীয়স্বজন থেকে শুরু করে পাড়ার লোকেরা আমাদের মহা অপরাধীর চোখে দেখছে। যেন আমরা মধ্যযুগের সেই অস্পৃশ্য শ্রেণীর মানুষ, যাদের ছায়া মাড়ালে জাত যাবে। আসলে করোনা সম্বন্ধে অজ্ঞানতাই মানুষকে আরও নির্দয় করে তুলেছে। যতই প্রচার হোক রোগের বিরুদ্ধে লড়তে হবে রোগীর বিরুদ্ধে নয়। কিন্তু বাস্তবে রোগী তো ছেড়েই দিলাম তার পরিবারের বিরুদ্ধে লড়াই করা হচ্ছে। বাবার এক বন্ধু সূর্যকাকা গত এক সপ্তাহ আগে করোনায় আক্রান্ত হয়ে মারা গেছেন। সেদিন ওদের খবর নেবো বলে ফোন করলাম। কাকিমা কেমন আছেন? ওনাদের একমাত্র সন্তান মেয়ে ফোন ধরল। আমাকে জিজ্ঞাসা করল কাকা কেমন আছে? আমি বললাম বাবার শ্বাসকষ্টটা আরও বেড়েছে, অক্সিজেন চলছে। মেয়েটি যাদবপুরে মাস্টারস্ করছে। আমাকে বলল মনে হচ্ছে আঙ্কেল তোমাদের আরও ভোগাবে। সেক্ষেত্রে বাবা আমাদের বাঁচিয়ে দিয়ে গেছে যে হাসপাতালে মারা গেছে। হাসপাতাল থেকে ফোন করেছিল যে আপনারা কি বডি দেখবেন ? আমরা কেউ। যাইনি। বলে দিয়েছি যে কেউ যাবে না। আপনারা আপনাদের নিয়ম অনুসারে কাজ করে নিন। সেইজন্যই পাড়াতে আমরা অচ্ছুত নই। অপঘাতে মৃত্যুর বিধান নিয়ে তিনদিনে গঙ্গায় গিয়ে কাজ করে নিয়েছি।
কোনোক্রমে হা হা করে ফোনটা রাখলাম। আমি অশ্চর্য হয়ে গেলাম নিজের বাবার প্রতি ওর মনোভাব দেখে। আমার খুব ভালো মনে আছে যে ২০১৭ তে মেয়েটির ডেঙ্গু হয়েছিল। তখন সূর্যকাকু বাবার কাছে এসে কী কান্নাকাটি। আমার বাবা যোগাযোগ করে একটি নার্সিং হোমে ভর্তি করালো। কাকুতো বাড়ি আসতেন না। ওখানেই নীচে বসে থাকতেন। বাবা গিয়ে ওনাকে সঙ্গ দিতেন। দুবেলা ওখানে হোটেলে খেতেন।তিনদিন বাদে যখন মেয়ের প্লেটলেটটা বাড়তে আরম্ভ করল সেদিন বাবা অনেক বুঝিয়ে সুজিয়ে বাড়িনিয়ে এসেছিল কাকুকে। আজতার সেই মেয়ের এই মনোভাব আমাকে যেন আরও বেশি করে আমার বাবাকে ভালোবাসতে ইচ্ছা করল। বাবার ওই লড়াইয়ের কথা মনে পড়তে চোখ জলে ভিজে উঠল। এগুলি দেখেই মনে হয় মানুষ বোধ হয় পরিবেশের দাস।
আমার এক সহপাঠী শিবব্রত হাজরা। পাঁচ বছর ধরে পাইকপাড়ায় একটি ঘর ভাড়া নিয়ে পড়াশোনা করছিল। একই সঙ্গে থাকার সুবাদে বাড়িওয়ালার বিপদে আপদে সবেতেই পাশে থাকত। ওদের পরিবারের কারো শরীর খারাপ হতো হাসপাতালে নিয়ে এসে চিকিৎসা করানো থেকে আরম্ভ করে বিনামূল্যে ওষুধের ব্যবস্থা পর্যন্ত করে দিত। কথায় কথায় বাড়ির মালিক সবাইকে বলতেন এটি আমার এক ছেলে। এহেন মালিক একদিন তাকে নোটিশ দিয়ে দিল যে তোমাকে ঘর ছাড়তে হবে। অপরাধ একটা তুমি হাসপাতালের ডাক্তার। করোনা নিয়ে ঘরে আসতে পারো না।
সেদিন খবরে শুনছিলাম যে হাওড়ায় একজন মহিলা ব্যাঙ্ক কর্মী করোনা আক্রান্ত। হয়েছেন। ডাক্তার বলেছেন বাড়িতে থেকে চিকিৎসা করা যাবে। কোয়ারন্টাইনে থাকুন। কিন্তু পাড়ার লোকেরা শুনবে কেন? তাকে বাড়ি ছেড়ে যাওয়ার জন্য হুমকি, পরে বাঁশ দিয়ে পেটালো রোগীকে। আমি পড়েছি যে প্লেগ মহামারীর সময় রোগীকে ফেলে রেখে পরিবারের লোকেরা পালিয়ে যেত। সেই সমস্ত রোগীর সেবা শুশ্রুষা করতেন ভগিনী নিবেদিতা। সাতসমুদ্র তেরো নদী পার হয়ে এসে আমাদের এই আত্মসর্বস্ব লোকেদের দ্বারা অপমানিত হয়েছেন, মার খেয়েছেন, তবু তাদের ফেলে যাওয়া আত্মীয়দের সেবা করেছেন। এই মানসিকতা কোথায় পাওয়া যাবে? এরই উত্তরসূরী বলতে গেলে সঙ্ঘের স্বয়ংসেবকরা। তারা এই মন্ত্রে বিশ্বাসী যে একান্তে সাধনা-লোকান্তে সেবা।
যেদিন আমি ডাক্তারি পাশ করলাম সেদিন বাবা আমাকে বলেছিলেন যে মানুষের পাশে দাঁড়িয়ে মানুষের সেবা করতে হবে তবেই তোমার ডাক্তার হওয়া সার্থক হবে। কারণ রোগীরাই তোমাকে আত্মীয় বলে মনে করবে। একদিন হয়তো এই দুর্যোগ কেটে যাবে কিন্তু আমি আমার নিজের লোকদের চিনে নিয়েছি – স্বয়ংসেবকরাই আমার পরমাত্মীয়।
জয়ন্ত পাল