জন্মাষ্টমীর সন্ধ্যা ৭টা। বেঙ্গালুরু। সিলিকন ভ্যালিতে শান্তির পরিবেশ। হঠাৎ রাস্তায় উন্মত্ত জেহাদি জনতার ‘আল্লাহ আকবর’ ও ‘নারা-এ-তকদীর’-এ খানখান হয়ে গেল শান্তির বাতাবরণ। ভেঙে পুড়িয়ে ফেলা হলাে কংগ্রেস বিধায়ক অখণ্ড শ্রীনিবাস মূর্তির বাংলাে। আক্রান্ত হলাে থানা ও পুলিশ। জ্বালিয়ে দেওয়া হলাে অসংখ্য বাড়ি। থানা তছনছ হয়ে গেল যা আইন রক্ষাকারীদের জায়গা।
কারণ : একটা ফেসবুক পােস্ট। এক শান্তির ছেলে বশীর আদিয়ার বশীর প্রথমে হিন্দু দেবী লক্ষ্মী ও তার সঙ্গে প্রধানমন্ত্রীর ‘মফড পিকচার’ পােস্ট করেছিল। সেই ফটো অত্যন্ত আপত্তিকর ছিল। পােস্ট কন্নড় ভাষায় বিখ্যাত ভজন ‘ভাগ্যদা লক্ষ্মী বড়াম্মা’ সহ ছিল। এই ভজন অন্যান্য অনেক শিল্পী-সহ বিখ্যাত ধ্রুপদী সংগীত শিল্পী ভীমসেন যােশীও গেয়েছেন। এই পােস্টের কমেন্টে কংগ্রেস বিধায়ক অখণ্ড শ্রীনিবাসর মূর্তির ভাগ্নে নবীন একটি ফটো কমেন্ট পােস্ট করে যা মহম্মদ সম্বন্ধীয়। পােস্টে মহম্মদ ও আয়েশার ফটো দেখানাে হয়। মহম্মদ সম্বন্ধে কোনাে ফটো নাকি ইসলাম বিরুদ্ধ।
পরিণতি : কেজি হাল্লি ও ডিজি থাল্লি থানা আক্রমণ করে জেহাদি জনতা। দলিত বিধায়কের বাড়ি ভেঙে ফেলা হয় প্রথমে। তারপর আগুন লাগানাে হয়। দমকলের গাড়িও পােড়ানাে হয়। এই ঘটনায় ৩ জন মৃত। ১০০ জন আহত। এদের মধ্যে বেশ
কয়েকজন পুলিশও আছে। কর্ণাটকের মন্ত্রী এ. অশােকের বিবৃতি অনুযায়ী ডিসিপিকে বন্দি করে রাখা হয়। তাঁর গাড়িতে আগুন লাগানাে হয়। এমনকী পুলিশ কোয়ার্টারেও আক্রমণ করা হয়। রাস্তা অবরােধ করা হয়। পাথর ছোঁড়া হয় যথেচ্ছ। আশেপাশে প্রচুর গাড়িতে আগুন লাগানাে হয়।
কিছু প্রশ্ন :
• এই ঘটনা কি নিছক এক দিনের আক্রোশের বহিঃপ্রকাশ?
• একটা ফেসবুক পােস্টের জন্য পুলিশ প্রশাসনের উপর ভরসা না করে আইন নিজের হাতে তুলে নেওয়া কতটা যুক্তিযুক্ত?
• হঠাৎ করে এত এত লােকজন এত কম সময়ের নােটিশে জোগাড় করা কতটা সম্ভব?
• সাইবার পুলিশে অভিযােগ করে আইনি ব্যবস্থার জন্য অপেক্ষা করা হলাে না। কেন?
• কেন এই সম্প্রদায়ের দেশের আইনের উপর বিশ্বাস নেই?
• ধর্ম রক্ষার নামে জাতীয় সম্পত্তি বা মানুষের ক্ষতি করার অধিকার কোন সংবিধান দিয়েছে?
• এত এত লােককে এত তাড়াতাড়ি জড়াে কারা করলাে?
• এত লােকজনের হাতে লােহার রড থেকে অস্ত্রশস্ত্র, পাথর কারা সরবরাহ করলাে?
• এই অস্ত্রশস্ত্রের টাকা কে দিল? সেই টাকা এলাে কী ভাবে?
• কোনাে অথােরিটির সঙ্গে কথা না বলে ডাইরেক্ট অ্যাকশন কেন হলাে?
• হিন্দুদের আঘাত করতে পােস্ট করেছিল বশীর আদয়ার বশীর, তার বিরুদ্ধে এরা কী ব্যবস্থা গ্রহণ করেছিল?
•দলিত বিধায়ককে আক্রমণ করা হলে দলিত মুসলমান ঐক্যের বাজনা কে বাজাবে?
•কংগ্রেস নিজের বিধায়ক না মুসলমান – কার পক্ষ নিয়েছে?
• বেছে বেছে বিজেপি শাসিত রাজ্যে হলে তার ব্যাখ্যা আলাদা হয় কেন?
• কংগ্রেস বিধায়কের ভাগ্নে হঠাৎ এই পােস্ট করল কী কারাের থেকে নির্দেশ পেয়ে ?
•সাধুদের পিটিয়ে যখন মারা হয়েছিল, হিন্দুরা কাউকে আঘাত করলে কীভাবে তার বিশ্লেষণ করা হতাে?
না, এর কোনাে যথাযথ উত্তর অফিসিয়ালি এখনও পাওয়া যায়নি, হয়তাে যাবেও না। এরকমটাই এদেশে হয়ে আসা দস্তুর। এটাইইতিহাস, এটাই ভবিষ্যৎ। ওদের ধর্মানুভূতি বজায় রাখার দায়িত্ব ওদের, আইনেরও নয়। দেশের আইনশৃঙ্খলা
শুধুমাত্র সংখ্যাগরিষ্ঠের জন্য যারা আইন মেনে চলে। আর যারা আইনকে বৃদ্ধাঙ্গুলি দেখিয়ে চলেছে বরাবর, তারা অবশ্য কখনও দাঙ্গার দায়িত্ব নেয়নি।
অন্য ধর্মের প্রতি এত বিদ্বেষ, এত ঘৃণা নিয়ে এরা দিল্লি থেকে বেঙ্গালুরু, যে কোনাে শহরে অনায়াসে দাঙ্গা লাগিয়ে দেয়। ১০ জানুয়ারি টাইমস নাউ চ্যানেলে একটি ভিডিয়াে ফুটেজ দেখানাে হয়েছে যাতে রামমন্দির নির্মাণের বদলা হিসেবে দেশে অস্থিরতা সৃষ্টিকরবে। ওরা পৃথক মুসলমান স্টেট’ দাবি করছে। প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মােদী যাতে স্বাধীনতা দিবসের দিন জাতীয় পতাকা উত্তোলন করতে না পারেন, তার প্রচেষ্টা চলেছে সর্বতােভাবে। মুসলমান। ভাই-বােনদের আহ্বান জানানাে হয়েছে এর উদ্দেশ্যে। ওই দিন রাত্রে ১০-৪৫ নাগাদ সিসিটিভি ফুটেজে দেখা যাচ্ছে লেন-দেনের ছবি। ফান্ডিং তাে আছেই, কেরলের গােল্ড স্মাগলিংমনে করিয়ে দেয় অনেক কিছু। প্রশ্ন অনেক, উত্তর নেই।
১১ ও ১২ আগস্টের মাঝখানের রাত দুটোর সময় কংগ্রেসের ন্যাশনাল সেক্রেটারি ও আইটি-ইন-চার্জ জাকিয়া খান একটি ভিডিয়াে পােস্ট করেন। যাতে দেখা যায়। একটি মন্দিরের বাইরে মুসলমান ছেলেরা মানববন্ধন করে মন্দিরটিকে বাঁচানাের জন্য শৃঙ্খলাবদ্ধ হয়ে দাঁড়িয়ে আছে। সেখানে তাড়াতাড়ি আপলােড করার কথা পরিষ্কার শােনা যাচ্ছে। অর্থাৎ যা হয়েছে সবটাই উদ্দেশ্যপ্রণােদিত। এমন ঘটনা আমরা আগে দেখেছি দিল্লির দাঙ্গা, অ্যান্টি সিএএ আন্দোলনের সময়। এমন মানববন্ধন কিছু নতুন নয়। অভিনব তাে মােটেই নয়। যারা সন্ধ্যেবেলায় এমন তছনছ করল পুরাে শহর, পুলিশ ও তাদের পরিবারের আর্তনাদ যাদের মধ্যে একটুও দয়ামায়া তৈরি করেনি, যারা এটিএম থেকে গাড়ি, ভাঙচুর করেছে সব। পুলিশকে ধাওয়া করে বেসমেন্টেও চড়াও হয়েছে, যাদের জন্য শান্ত একটা শহরে কারফিউ জারি হয়ে গেল, তারা হঠাৎ করে একটা মন্দিরের বাইরে মানববন্ধন করে তাকে বাঁচানাের ভিডিয়াে শুধু ভাইরাল হলাে। আবার বাঁচাবে তাদের সম্প্রদায়ের হাত থেকেই। মন্দির হিন্দু ভাঙবে না। শুধু তাই নয়, প্রতিটি নিউজে তাদের ধর্মের উল্লেখ পরিষ্কার ভাবে করে দেওয়া হলাে। অথচ কারা মেরেছিল, কারা প্রথমে পােস্ট করেছিল, না তাদের নাম প্রকাশ করা হয়েছে, না তাদের ধর্ম প্রকাশ করা হয়েছে। এই ঘটনায় যারপরনাই উৎফুল্ল হয়েছে লিবারেল ও সেকুলার গােষ্ঠী। মানববন্ধনের জয়গান গাইতে গিয়ে হ্যাজের পর হ্যাজ নেমে গেছে। অথচ দাঙ্গার জন্য ন্যূনতম নিন্দাসূচক একটা বাক্য খরচ করেনি।
বেঙ্গালুরুর মানববন্ধনের আগে আরও মানববন্ধন হয়েছে।
প্রথম ঘটনা : এই বছর ফেব্রুয়ারি মাসে দিল্লিতে দাঙ্গার সময় মুসলমানরা মন্দির বাঁচাতে এমনই এক মানববন্ধন তৈরি করেছিল। তাদের ভয় ছিল যে পাছে হিন্দুরা নিজেরাই নিজেদের মন্দির ভেঙে মুসলমানদের দায়ী করে।
দ্বিতীয় ঘটনা : জানুয়ারি ২০২০ সালে সিটিজেনশিপ অ্যামেন্ডমেন্ট অ্যাক্টে শরণার্থীদের নাগরিকত্ব প্রদানের আইনি স্বীকৃতি দেওয়া হয়, সেখানে অনুপ্রবেশকারীদের নাগরিকত্ব বাতিল করা হবে বলে উল্লেখ করা হয়। কিন্তু এই আইনের ভুল ব্যাখ্যা করে বিভিন্ন ইসলামি সংগঠন দিল্লির শাহিনবাগে প্রতিবাদের নামে দেশের রাজধানীর জনজীবন স্তব্ধ করে দেয়। এই প্রতিবাদ চলাকালীন এক আম আদমি পার্টির সমর্থক গুলি চালালে মুসলমান মহিলারা মানববন্ধন তৈরি করেছিল।
হিন্দু এলাকায় এদের খাবার সরবরাহ করা, কোথাও হিন্দু বিধবাকে বাঁচানাে, কোথাও মন্দির ভাঙার পর মূর্তির পুনঃপ্রতিষ্ঠা করার খবর মিডিয়া ফলাও করে প্রকাশ করে। কিন্তু ওই খাবার সরবরাহ করার কারণ যে দাঙ্গা সেটা ওই মুসলমানরা করেছিল একথা কেউ বলে না। মন্দির ভাঙার খবর বেরােলেও কারা ভেঙেছিল তাদের ধর্ম পাওয়া যায় না কোনাে ময়নাতদন্তে। কিন্তু মূর্তি পুনঃপ্রতিষ্ঠার সময় ধর্মের উল্লেখ থাকে পরিষ্কার হরফে। দিল্লির দাঙ্গার সময় মুসলমানরা দায়ী এ কথা না লিখলেও কত দয়ালু মুসলমান যে কত হিন্দুর প্রাণ বাঁচিয়ে ‘মসিহা হয়েছে, সে খবরের প্রচার চলেছে জোর কদমে।
কোন মিডিয়া প্রথম ফেসবুক পােস্টে হিন্দুধর্ম ও প্রধানমন্ত্রীর ঘৃণ্য যে ভুয়াে ফটো পােস্ট হয়েছিল, তার উল্লেখ পর্যন্ত করেনি। নিজেদের বেলায় ফেসবুক পােস্টে এরা নিজেদের কাজকে জাস্টিফাই করে আর অন্যদের আক্রমণ করে নিজেরা ভিকটিম সাজে এবং অন্যদের বেলায় চুপ থাকে। প্রথম যখন পােস্ট হলাে তখন প্রধানমন্ত্রীর গরিমা, হিন্দুদের ধর্মীয় অনুভূতির জন্য কারাের কাছে কোনাে মূল্য ছিল না। এরা নিজেদের বেলায় এত রিজিড কিন্তু অন্যের বেলায় নীরব, নিজের বেলায় দাঁতকপাটি, পরের বেলায় আঁটি শুটি’। আইনি প্রক্রিয়ার জন্য সংখ্যাগরিষ্ঠ সমাজ অপেক্ষা করতে
পারে, সংখ্যালঘু হলে ‘নারা-এ- তকদীর’ বলে নিজেদের হাতে আইন তুলে নেবার এই দ্বিচারিতার অধিকার দেওয়া হয়েছে। যেন। তারা তাদের ধর্ম রক্ষা করবার জন্য অন্য সমাজকে আক্রমণ করতে পারে, সরকারি সম্পত্তি ধ্বংস করতে পারে, লুট করতে পারে, দাঙ্গা করতে পারে, আগুন জ্বালাতে পারে, দেশে অস্থির পরিবেশ তৈরি করতে পারে। সাংবিধানে মৌলিক অধিকার যেখানে সুস্পষ্টভাবে বলে দেওয়া হয়েছে। এই দেশের সমস্ত নাগরিক তাদের ধর্ম পালন করতে পারবে। কিন্তু সেটা শুধু এদের ক্ষেত্রে প্রযােজ্য হয়। মালদার কালিয়াচকে দু’ লক্ষ জেহাদি জনতা ধর্ম রক্ষাথে বেরিয়ে পুলিশ থানা জ্বালিয়ে দেয়। অ্যান্টি সিএএ আন্দোলনের সময় আমরা দেখেছি আইনের ভুল ব্যাখ্যা করে তারা দু’মাস ধরে রাজধানী অচল করে রেখেছিল। এদিকে সাধুদের পিটিয়ে মেরে ফেললেও আমরা দুদিন সােশ্যাল মিডিয়ায় কিছু পােস্ট করার পর
ভুলে যাই। জম্মুর এক অখ্যাত কাঠুয়ার এক মন্দিরে আসিফা নামে একটি মেয়েকে ধর্ষণ করে মেরে ফেলে কত সহজে সমগ্র হিন্দু সমাজ, মন্দির সবাইকে ধর্ষক বানিয়ে দেওয়া হয়েছিল। হিন্দু সন্ত্রাস’ বলে একটা অধ্যায় শুরু হয়েছিল মালেগাঁও ব্লাস্টের মিথ্যা ঘটনাকে কেন্দ্র করে শুধু হিন্দুর যাতে বদনাম হয়। যে কোনাে মিডিয়ায় মুসলমান দাঙ্গাকারীর নাম থাকে না, হিন্দু হলে উল্লেখ করা হয়। কিন্তু মানববন্ধন হলে সেখানে মুসলমান উল্লেখ করা হয়, খুব সচেতন ভাবে।
এই প্রসঙ্গে মনে পড়ে, ছােটোবেলায় রিফিউজি কলােনি থেকে কেউ এলেই গল্পের বিষয় হতাে,“ওঃ ভাগ্যিস আমাদের রহমত, জুবের ছিল, তাই প্রাণ হাতে করে ইন্ডিয়া চলে আসতে পেরেছিলাম সবাই।” যেন যারা তাড়িয়েছিল তাদের নাম ‘রাম, শ্যাম, যদু’ ছিল। স্বীকার করে নাও, রহিম তাড়িয়েছিল, রহমত রাতের অন্ধকারে সীমান্ত পার করিয়ে দিয়েছিল। আসলে সবটাই অধিকারের খেলা, কখনাে ধর্মের অধিকার, কখনাে ধর্মরক্ষার অধিকার, কখনাে সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ের স্বার্থ রক্ষার অধিকার। আর এই করতে করতে কখন যে দাঙ্গার অধিকার পেয়ে যায়, আমরা জানতেই পারি না।
আমাদের এই সব মানববন্ধন চাই না। আমাদের মন্দির বাঁচানাের কোনাে দরকার নেই। মন্দির ওদের নয় আমাদের “আমানত। মন্দির ভাঙছে যারা তাদের এই সব বুজরুকি করে বিদ্বেষ ছড়ানাে বন্ধ করার দিকে নজর দিক, মন্দির ভাঙার মতাে পরিস্থিতি উদ্ভব হবে না। এই দেশে দাঙ্গার অধিকার যার, মানববন্ধন নামে মন্দির বাঁচানাের ভণ্ডামি তাদের না করাই ভালাে। নিজেদের ইমেজ ঠিক করতে মানববন্ধনের গল্প না তৈরি করে পাথর ছোঁড়া থেকে বিরত হলেই দেশে প্রকৃত শান্তি বজায় থাকবে। একপক্ষ সবসময় আগুন জ্বালাবে আর আরেক পক্ষ শুধু ক্ষতিগ্রস্ত হবে, এটা কোনাে কাজের কথা নয়। হয় মানসিকতার পরিবর্তন হােক, নাহলে এইসব মানববন্ধন নামে নাটকের পটকথা তৈরি বন্ধ হােক। দাঙ্গার অধিকার যার, দাঙ্গার দায়িত্ব তাকেই নিতে হবে।
দেবযানী হালদার