না, সংখ্যাতত্ত্বের কচকচানিতে গিয়ে লাভ নেই। কারণ যে কোনো মহামারীতেইমৃত্যু একটা সংখ্যা মাত্র। মৃত্যু মানে প্রিয়জনকে হারানো নয়। কান্নাও নয়। এই সত্যটা চিরন্তন। ‘৭৬-এর মন্বন্তরেও ছিল এটাই সত্য। ‘৪৬- এর নরসংহারেও ছিল এটাই সত্য। এটাই সত্য এবারও এই করোনা ভাইরাসের আক্রমণে বিশ্বব্যাপী মহামারীতেও।
সমস্যা সেটা নয়। সমস্যা হলো—মৃত্যুটা বা আক্রান্তের সংখ্যাটাকে শাড়ির আঁচলের তলায় লুকিয়ে ফেলার মতো অপরাধ। গোটা বিশ্ব জুড়ে করোনা ভাইরাসের দাপাদাপি এবং লক্ষ লক্ষ যমদূতের হা-হা হি-হি-তে যখন কম্পমান ভূলোক, যখন কেউই সংখ্যা লুকিয়ে মুখ কালো করছেন না, এমনকী ইতালির মতো চিকিৎসাবিজ্ঞানের শ্রেষ্ঠতম দেশও, তখন পশ্চিমবঙ্গই একমাত্র একটি রাজ্য গুগল ম্যাপে যার অবস্থান বিন্দুর চেয়েও ছোটো, সে অবাধে নির্লজ্জের মতো লুকিয়ে চলেছে করোনা তথ্য।
মৃত্যু কত? বিশ্বের সবচেয়ে কম। আক্রান্ত কত? বিশ্বের সবচেয়ে কম।
বাড়ি ফিরেছেন কতজন? বিশ্বে সবচেয়ে বেশি।
চিকিৎসা হয়েছে কতজনের? বিশ্বের সবচেয়ে বেশি।
ব্যাপারটা অনেকটা এরকম। অথচ আপনি আমি এমনকী আপনার আমার বাড়ির সদ্য জ্ঞানপ্রাপ্ত শিশুটিও জানে, কোন পাড়ায় কতজন করোনায় আক্রান্ত। কোন পাড়ার কতজন করোনায় মারা গেছে। কোন পাড়ায় করোনা আক্রান্ত রোগীর ডেথ সার্টিফিকেটে লেখা হয়েছে নিউমোনিয়া অথবা ব্রঙ্কাইটিস। কোন পাড়ার কোন ডাক্তার, কোন নার্স, কোন স্বাস্থ্যকর্মী আচমকা শ্বাসকষ্টে ভুগছেন। কোন পাড়ার কোন বস্তিতে অবাধে চলছে মেলামেশার মহোৎসব। কোন পাড়ায় লকডাউনের রক্তচক্ষুকে ফুৎকারে উড়িয়ে দিয়ে নিজেরাই রক্তচক্ষুর কবলে পড়ে ‘রেড জোনের’ অধিবাসী হয়ে গেছেন। রাজ্যের কোন কোন হাসপাতালের কতজন চিকিৎসক, নার্স চলে গেছেন কোয়ারেন্টাইনে। কোনো হাসপাতালের কতগুলি ওয়ার্ড বন্ধ হয়ে গেছে। কোন হাসপাতালে প্রসূতি শিশু প্রসব করতে গিয়ে করোনার বিষে বিষাক্ত হয়ে মৃত্যুর কোলে ঢলে পড়েছেন। কতজন মানুষের করোনা টেস্ট হয়েছে। কতজন স্বাস্থ্যকর্মী বিশেষ পোশাক পিপিই এবং এন-৯০ মাস্ক পেয়েছেন। কোন রাজ্য করোনার সংক্রমণে সবচেয়ে বেশি সফল। কোন কোন রাজ্য ক্রমাগত সাফল্যের পথে। পশ্চিমবঙ্গের ক্ষেত্রে দুঃখজনক ঘটনা হলো এটাই—সবাই সব জানে। শুধু সরকার জানায় না। সরকার যেটা জানায় তা যে সাবলীল মিথ্যা, মানুষ সেটা জানে বলে সরকারি তথ্য বিশ্বাস করে না। আর তার ফলটা কী হচ্ছে?
রাজ্যে প্রতিদিন করোনা ভাইরাসের দাপাদাপি লাফিয়ে লাফিয়ে বাড়ছে। মানুষ আক্রান্ত হচ্ছে পাড়ায় পাড়ায়। অথচ আমি আপনি কেউই জানি না, আমরা কে করোনা পজিটিভ, কে নেগেটিভ। কারণ এ রাজ্যেই টেস্ট হয়েছে এখনও পর্যন্ত বিশ্বে সবচেয়ে কম। কেউ কখনও শুনেছেন, রোগীর চিকিৎসা করেন একজন ডাক্তার আর ডেথ সার্টিফিকেট দেয় সরকারি কমিটি? কেউ কখনও দেখেছেন, হাসপাতালে পৌঁছে চুড়ান্ত শ্বাসকষ্টে এবং জ্বরে আক্রান্ত রোগীকেও হাসপাতাল ফিরিয়ে দিয়ে বলছে, ঘরে যান। গৃহবন্দি থাকুন।
পশ্চিমবঙ্গ সেই আশ্চর্য রাজ্য যেখানে কেন্দ্রের পাঠানো ৯ লক্ষেরও বেশি টন চাল পচছে এফসিআই গুদামে। অথচ রাজ্যে গরিবের হাতে পৌঁছছে না রেশনের চাল। কোথাও শুনেছেন, করোনা হচ্ছে বলে ওষুধের দোকান থেকে উধাও শিশু খাদ্য, সদ্যোজাত শিশুর ভ্যাকসিন, ডায়াবেটিস আক্রান্ত বৃদ্ধ-বৃদ্ধার ইনসুলিন-সহ যাবতীয় জীবনদায়ী ওষুধ? কোথাও শুনেছেন, এতৎ সত্ত্বেও রাজ্য সরকার টেলিভিশন চ্যানেলগুলিতে ঘনঘন বিজ্ঞাপনের স্রোতে ভাসিয়ে দিয়ে প্রচার চালিয়ে যাচ্ছেন, পশ্চিমবঙ্গে খাদ্য এবং ওষুধের কোনো অভাব নেই?
হ্যাঁ, এসব কাকেশ্বর কুচকুচের আবোল তাবোল হযবরল কাণ্ড কারখানা দেখতে পাবেন, শুনতে পাবেন শুধু একটি লোকেশনেই। তার নাম পশ্চিমবঙ্গ। কারণ রাজ্যটা চালান যিনি তাঁর নাম মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়। যিনি সব জানেন। সব বোঝেন। সব জেনে সব বুঝেও তথ্য লুকোন শাড়ির আঁচলে। মুসলমান মহল্লায় মহোৎসব হয় করোনার লকডাউনকে উপেক্ষা করে। কোনও সংবাদপত্র সত্যি কথাটা লিখলে তাকে হুমকি শুনতে হয়। আর বিদেশের সংবাদপত্র নিউইয়র্ক টাইমস, সানডে গার্ডিয়ানের পাতায় পাতায় ছাপা হয়— ‘Bengal sitting on a coronavirus time bomb.’
আজ্ঞে হ্যা, এটাই আসল ছবি। আমরা বসে আছি টাইম বোমার ওপর। এভাবে চললে, সেই বোমা ফাটতে আর বেশি সময় লাগবেনা। দিদি, আমরা জানি, আপনি সেদিনও বলবেন – ‘করোনা সংক্রমণ রুখতেই আমরাই ফাস্ট।
আহা! কী আনন্দ আকাশে বাতাসে!
সুজিত রায়