প্রবাসী শ্রমিকদের নিয়ে অন্তর্বর্তী নির্দেশ দিল সুপ্রিম কোর্ট। স্বতঃপ্রণোদিত হয়ে মামলা গ্রহণ করার পর ২৯ মে শীর্ষ আদালতে শুনানি হয়। সব পক্ষের সওয়াল জবাব শোনার পর অন্তর্বর্তী নির্দেশ দেয় সুপ্রিম কোর্ট। শীর্ষ আদালত তার অন্তর্বর্তী রায়ে বলে— | ১. বিভিন্ন রাজ্য সরকার যখন ট্রেনের জন্য আবেদন করবে, রেলওয়েকে তখনই ট্রেনের ব্যবস্থা করতে হবে। বাসে কিংবা টেনে প্রবাসী শ্রমিকদের কাছ থেকে ভাড়া বাবদ এক টাকাও নেওয়া যাবে না। রেল বা বাসের ভাড়া রাজ্য সরকার দেবে।
২.আটকে পড়া প্রবাসী শ্রমিকদের খাবার ও জলের বন্দোবস্ত করতে হবে সংশ্লিষ্টরাজ্যকেই। কোথায় সেই ব্যবস্থা হচ্ছে তা প্রকাশ্যে জানাতে হবে।
৩. ট্রেন যাত্রার সময় যেখান থেকে ট্রেন ছাড়ছে সেই রাজ্যকে খাবার ও জল সরবরাহ করতে হবে। রেলকেও জল ও খাবারের ব্যবস্থা করতে হবে। বাস যাত্রার সময়ও খাবার ও জলের ব্যবস্থা রাখতে হবে। | ৪. রাজ্য সরকারগুলো প্রবাসী শ্রমিকদের নথিভুক্তকরণের প্রক্রিয়ায় অংশ নেবে। রেজিস্ট্রেশনের পর যাতে তারা দ্রুত বাস বা ট্রেনে উঠে পড়তে পারেন তার ব্যবস্থা করতে হবে। যাঁরা যাত্রা করছেন, তাদের সম্পূর্ণ তথ্য থাকতে হবে কর্তৃপক্ষের কাছে।
৫. যে সমস্ত প্রবাসী শ্রমিক হেঁটে বাড়ি ফেরার চেষ্টা করছেন, তাদের দ্রুত উদ্ধার করে নিরাপদ জায়গায় রাখতে হবে এবং তাদের খাবার ও অন্যান্য সুযোগ সুবিধার ব্যবস্থা করতে হবে।
এই রায়ের পর শ্রমিক এক্সপ্রেসের নামে ভারতীয় রেলপথ ‘করোনা এক্সপ্রেস’ চালাচ্ছে। এমনটাই বলে গত ২৯ মে পশ্চিমবঙ্গের মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় কেন্দ্রের বিরুদ্ধে তীব্র ভাবে আক্রমণ শানালেন। প্রথমে কেন্দ্র সরকার রাজ্যের অনুমতিক্রমেই প্রবাসী শ্রমিকদের ঘরে ফেরানোর ব্যবস্থা চালু করেছিল। কিন্তু মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের মতো কিছুমুখ্যমন্ত্রী সমস্যাকে জিইয়ে রেখে প্রবাসী শ্রমিকদের মৃতদেহ নিয়ে রাজনীতির ধারায় বিরতি টানতে কেন্দ্র নতুন নিয়ম চালু করে জানায় এবার থেকে রাজ্যের অনুমতি ছাড়াই রেল প্রবাসী শ্রমিকদের নিজ নিজ রাজ্যে পৌঁছে দেবে। কেন্দ্র ও সেই সঙ্গে সুপ্রিম কোর্টের সঙ্গে লড়াইয়ে পেরে না উঠে কেন্দ্র সরকারের বিরোধিতার নামে এবার সরাসরি প্রবাসী শ্রমিকদের সামাজিক বিদ্রোহের মুখে ফেলার প্রয়াস করলেন। মুখ্যমন্ত্রীর এই বক্তব্যের পর গ্রাম থেকে গ্রামান্তরে ‘করোনা এক্সপ্রেসের যাত্রীদের নিয়ে ক্ষোভ বিক্ষোভ ছড়াচ্ছে। আসলে প্রবাসী শ্রমিকদের নিয়ে মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় কোনো পরিকল্পনাই করেননি। রাজ্য সরকারের ওয়েবসাইট বলছে, ১ মে রাজ্যে সরকারি কোয়ারেন্টাইন সেন্টারের সংখ্যা ছিল ৫৮২ এবং ১ জুনেও সেই সংখ্যা ৫৮২-তেই দাঁড়িয়ে। অর্থাৎ রাজ্যে ফিরে আসা হাজার হাজার প্রবাসী শ্রমিকদের জন্য পশ্চিমবঙ্গ সরকার কোনো বাড়তি ব্যবস্থা করেনি। ফলে প্রবাসীরা আসছেন কোনোরকম পরীক্ষানিরীক্ষা ছাড়াই গ্রামে ফিরেই বিক্ষোভের মুখে পড়ছেন। নিজের ব্যর্থতা ঢাকার জন্য দীর্ঘদিন পরে ঘরে ফিরে আসা নিজের রাজ্যের প্রবাসী শ্রমিকদের প্রতি একটা সরকার এতটা অমানবিক হয়ে উঠতে পারে এটা ভাবাই যায় না।
মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের অবস্থানকে সমর্থন করতে একদল মানুষ প্রশ্ন তুলছেন, লকডাউনের শুরুতেই কেন শ্রমিকদের ফেরানো হলো না? সাধারণ মানুষকে বিভ্রান্ত করতেই যে এই ধরনের প্রশ্ন তোলা হচ্ছে এই বিষয়ে কোনো সন্দেহ নেই। লকডাউনের শুরুতে দেশে করোনা চিকিৎসার কোনো রকম পরিকাঠামো ছিল না। পর্যাপ্ত সংখ্যক পিপিই কিট, সেনিটাইজার, ভেন্টিলেটর, কোয়ারেন্টাইন সেন্টার ছিল না। মানুষ সচেতন ছিল না করোনা সংক্রমণ সম্পর্কে। এই পরিস্থিতিতে কোনো ভাবেই করোনার বিরুদ্ধে দেশ লড়তে পারতো না। দীর্ঘ লকডাউনে দেশজুড়ে সেই পরিকাঠামো অনেকটাই গড়ে উঠলেও পশ্চিমবঙ্গে তেমন কোনো প্রস্তুতি দেখা যায়নি। এই পরিস্থিতিতে সংক্রমণ ছড়ালেও এর বিরুদ্ধে লড়ার করার পরিকাঠামোগত দক্ষতা দেশে তৈরি হয়েছে। নিজেদের অক্ষমতা ঢাকতেই যে মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের এই ধরনের অমানবিক অবস্থান এই বিষয়ে কোনো সন্দেহ নেই।
করোনা মোকাবিলায় সর্বক্ষেত্রে ব্যর্থ হলেও মুসলমান তোষণ নিয়ে মমতা সরকারের ক্রিয়াশীলতায় কোনো ঘাটতি নেই। দিল্লির মরকজ ফেরত করোনা জেহাদি ভিসা আইন লঙ্গনকারী যে সমস্ত বিদেশি তবলিগির নামে লুকআউট নোটিশ দেওয়া হয়েছিল তাদের একটা অংশ পশ্চিমবঙ্গে আশ্রয় নিয়েছিল। এই মামলায় তদন্তে মমতা সরকার কেন্দ্রকে কোনো রকম ভাবেই কোনো সহযোগিতা করেনি। ১ জুন ইকোনোমিক টাইমসের রিপোর্ট বলছে দিল্লির মরকজ ফেরত ১৯ জন বাংলাদেশি তবলিগি জামাতি কলকাতার নিউটাউনে মদিনাত-উল-উজ্জাই কোয়ারেন্টিন সেন্টার থেকে বাসে করে সরাসরি হরিদাসপুর চেকপোস্ট দিয়ে বাংলাদেশে পালিয়ে যাওয়ার প্রয়াস করছিল। কিন্তু তাদের নামে লুকআউট নোটিশ থাকায় বিএসফের হাতে ধরা পড়ে যায়। তদন্ত হলে ধরা পড়বে যে, কাদের সহায়তায় এই করোনা জেহাদিরা পালানোর সুযোগ পেয়েছিল। তবে সাধারণ বোধ বলছে ক্ষমতাসীন দল ও সরকারের কৃপাদৃষ্টি ছাড়া এই বাংলাদেশিরা কখনোই এভাবে পালানোর সাহস করতো না।
কথায় বলে মরার উপর খাড়ার ঘা। করোনা বিপর্যয় সামলাতে গিয়ে পশ্চিমবঙ্গের ভেঙে পড়া স্বাস্থ্য ব্যবস্থা, রেশন ব্যবস্থা ও প্রশাসনিক ব্যবস্থাগুলিকে ঘূর্ণিঝড় আমফান লণ্ডভণ্ড করে দিয়ে গেল। ঝড়ে বিধ্বস্ত গ্রামীণ এলাকাগুলির কথা নাহয় ছেড়েই দিলাম, কিন্তু ঝড় বয়ে যাওয়ার ৭ দিন পরেও খোদ কলকাতা শহরের অনেক জায়গাতেই জল নেই, বিদ্যুৎ নেই, গাছ উপড়ে রাস্তাঘাট বন্ধ হয়ে আছে। ঝড় আছড়ে পড়ার সাতদিন আগে থেকেই পূর্বাভাষ ছিল। বিপর্যয় পূর্ব, বিপর্যয়কালীন এবং বিপর্যয়োত্তর ব্যবস্থাপনার জন্য যথেষ্ট সময় পাওয়া গেছে। কিন্তু বিপর্যয়োত্তর পরিস্থিতি দেখে মনে হচ্ছেরাজ্য প্রশাসন মুখ্যমন্ত্রীর ভাষণ শোনানো ছাড়া এই বিপর্যয় সামলানোর জন্য কার্যত কোনো পরিকল্পনাই করেনি। ফলে রাস্তায় বের হলেই ক্ষমতাসীন দলের নেতামন্ত্রীরা বিক্ষোভের মুখে পড়েছেন। চারদিকে হাহাকার। ঝড়ের পরপরই ক্ষয়ক্ষতির বিবরণ দিতে গিয়ে কার্যত বিধ্বস্ত চেহারা নিয়ে মুখ্যমন্ত্রী বিপদের সময় রাজনীতি ঊর্ধ্বে উঠে পাশে দাঁড়ানোর যে আবেদন জানিয়েছিলেন। তাতে সাড়া দিয়ে আবেদনের ৩৬ ঘণ্টারমধ্যে প্রধানমন্ত্রী রাজ্যে এসে হেলিকপ্টারে করে ঘূর্ণিঝড় বিধ্বস্ত এলাকা দেখে এক হাজার কোটি টাকার প্যাকেজ, সেই সঙ্গে সবরকম ভাবে পাশে থাকার আশ্বাস দিয়ে গেলেন।
ভাবা গিয়েছিল, সাধারণ মানুষের চরম দুঃখদুর্দশা দেখে হয়তো মুখ্যমন্ত্রী ও তার দলের মানসিকতার পরিবর্তন হয়েছে। কারণ করোনা বিপর্যয়ের সময় আমরা দেখেছি বিজেপির এমপিদের ত্রাণ বিতরণ করতে বাধা দেওয়া হয়েছে এবং তারা যাতে কোনো ভাবেই মানুষকে সহায়তা করতে না পারে। সেজন্য প্রথম দিকে তাদের কোয়ারেন্টাইনের নামে গৃহবন্দি করে রাখা হয়েছে এবং চোদ্দদিন পরেও কোনোরকম কারণ না দেখিয়ে পুলিশ দিয়ে বাড়ি ঘিরে রাখা হয়েছে যাতে এমপিরা। কোনোরকম জনসংযোগ করতে না পারেন। বিভিন্ন স্বেচ্ছাসেবী সংস্থার পক্ষ থেকে অনাহারে থাকা মানুষের পাশে দাঁড়াতে গিয়ে তৃণমূলের লোকেদের দ্বারা হেনস্থা এমনকী মিথ্যে মামলার সম্মুখীন হতে হয়েছে। তৃণমূল কংগ্রেস ছাড়া অন্য কোনো সংস্থা ত্রাণ দিতে গেলে পুলিশ অনুমতি পত্র চাইছে। লকডাউন ভাঙার দায়ে বিপর্যয় মোকাবিলা আইনে মামলা করে দিচ্ছে। অনেক জায়গাতেই তৃষ্ণার্ত ক্ষুধার্থ পথ চলতি পরিযায়ী শ্রমিকদের খাবার দিতে গিয়ে বাধার সম্মুখীন হয়েছে স্থানীয় বাসিন্দারা। ভারতবর্ষে রাজনীতির এমন অমানবিক মুখ কখনো দেখা যায়নি।
প্রধানমন্ত্রী রাজ্য ছাড়ার ২৪ ঘণ্টা কাটতে কাটতেই মুখ্যমন্ত্রী স্বমহিমায় প্রত্যাবর্তন করে আবার দুর্গত এলাকায় প্রশাসনিক বৈঠকের নামে লাইভ টিভি শো-তে প্রশাসনের কর্তাদের ধমকানো, হুঁশিয়ারি দিতে শুরু করলেন। যখন মুখ্যমন্ত্রী এই প্রশাসনিক নাটক করছেন সে সময় একই সঙ্গে পুলিশ বিজেপির রাজ্য সভাপতি দিলীপ ঘোষের। গাড়ি আটকে দিয়েছেন। আমফান বিধ্বস্ত এলাকায় মানুষের পাশে দাঁড়াতে কলকাতা থেকে দক্ষিণ চব্বিশ পরগনায় যাওয়ার পথে পাটুলিতে দিলীপ ঘোষের গাড়ি আটকে দেয় পুলিশ। অভিযোগ উঠেছে তৃণমূল কংগ্রেসের লোকজন জমায়েত হয়ে পাথর ছুঁড়েছে। পর পর দুদিন একই ঘটনা ঘটেছে। সাংবিধানিক। ও মানবিক রীতিনীতির তোয়াক্কা না করে একজন নির্বাচিত জনপ্রতিনিধিকে বিপদের সময় তার নির্বাচন ক্ষেত্রের মানুষের পাশেও দাঁড়াতে দেওয়া হচ্ছে না।
প্রশ্ন হচ্ছে, বিপদের সময় মানুষকে মানুষের পাশে দাঁড়াতে দেওয়া হচ্ছে না কেন? বিপদের সময় স্বাভাবিক নিয়মেই মানুষ দলমত ধর্ম বর্ণ ভুলে গিয়ে বিপদগ্রস্ত মানুষের পাশে দাঁড়ায়। মানবিক সংবেদনার জন্যই একজন মানুষ মুহূর্তের জন্য হলেও সব পরিচয় ভুলে গিয়ে অন্যের বিপদে ছুটে আসে। গত ২৬ মে জি ২৪ ঘণ্টার সংবাদ প্রতিবেদন বলছে, নন্দীগ্রাম ২ নম্বর ব্লকের। আমদাবাদে ১৬১ নম্বর বুথে আমফান ঝড় বিধ্বস্তদের মধ্যে ত্রাণ বণ্টন করেছিলেন বিজেপি কর্মীরা। পরের দিন সকালবেলা তৃণমূল কংগ্রেস কর্মীরা বাড়ি বাড়ি ঢুকে সবাইকে বিজেপির কাছ থেকে ত্রাণ নেওয়ার জন্য এলাকা ছাড়া করার হুমকি দেয়। এটা কোনো বিচ্ছিন্ন ঘটনা নয়, এরকম ঘটনাসমস্ত পশ্চিমবঙ্গ জুড়েই ঘটে চলেছে। ইতিহাস ও ধারাবাহিক ঘটনাবলি বলছে, মমতা ব্যানার্জির অভিধানে রাজনৈতিক স্বার্থবর্জিত স্বাভাবিক মানবিক সংবেদনা বলে কিছু নেই।
গত বছর অর্থাৎ ২০১৯ সালে মে মাসে সাইক্লোন ফনি এ রাজ্যে ধ্বংসলীলা চালিয়েছিল। কেন্দ্রের তরফে পশ্চিমবঙ্গের ফেনি দুর্গতদের পাশে দাঁড়ানোর জন্য প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদী টেলিফোনে অনেকবার চেষ্টা করেছেন মমতা ব্যানার্জির সঙ্গে কথা বলার জন্য। মুখ্যমন্ত্রী কোনোরকম সাড়া দেননি। আবার প্রধানমন্ত্রীকে পাল্টা ফোনও করেননি। কেন্দ্রের তরফে ফেনি দুর্গত মানুষের সাহায্যের জন্য এই তৎপরতার জবাবে সে সময় মুখ্যমন্ত্রী মমতা ব্যানার্জি সংবাদমাধ্যমকে বলেছেন, তিনি কেন্দ্রের দেওয়া ভিক্ষে নেবেন না। তাছাড়া তিনি নরেন্দ্র মোদীকে প্রধানমন্ত্রী হিসেবে গণ্যও করেননি। সে সময় লোকসভা নির্বাচনের দামামা বেজে গিয়েছিল। বলার অপেক্ষা রাখে না যে, ভোটের অঙ্কে মেলানোর জন্যই মমতা ব্যানার্জি দুর্গত মানুষদের তাদেরন্যায্য পাওনা থেকে বঞ্চিত করেছিলেন। এখানেই শেষ নয়, সেদিন মমতা ব্যানার্জি সদর্পে ঘোষণা করেছিলেন লোকসভা নির্বাচনের ফলাফল প্রকাশের পর তিনি নতুন প্রধানমন্ত্রীর সঙ্গে কথা বলবেন। কথায় কথায় সংবিধানের | দোহাই দেওয়া, যুক্তরাষ্ট্রীয় কাঠামোর স্বঘোষিত রক্ষক একজন মুখ্যমন্ত্রী একজন নির্বাচিত প্রধানমন্ত্রীকে সেদিন যে ভাষায় আক্রমণ করেছিলেন এক কথায় তা নজিরবিহীন। এই ঘটনা থেকে এটা স্পষ্ট যে, নিজের ক্ষুদ্র রাজনৈতিক স্বার্থে মমতা ব্যানার্জি ফনি দুর্গতদের কেন্দ্রের সাহায্য থেকে বঞ্চিত করেছিলেন।
সবচেয়ে বেদনাদায়ক ঘটনাটি ঘটেছিল ১৯৯০ সালে। তখন তিনি বিরোধী নেত্রী। রাজ্যে ক্ষমতায় বামফ্রন্ট এবং কেন্দ্রে কংগ্রেস নেতৃত্বাধীন ইউপিএ। ভয়ংকর আয়লা ঝড় বয়ে গিয়েছিল রাজ্যের উপর দিয়ে। তৃণমূল নেত্রী কেন্দ্রের কাছে আবেদন করেছিলেন যাতে আয়লার সহায়তা বাবদ পশ্চিমবঙ্গে একটিও পয়সাও না আসে। কারণ হিসেবে সে সময় তিনি বলছিলেন ত্রাণের জন্য টাকা এলে সিপিএম লুটেপুটে খেয়ে নেবে। সে সময় তৃণমূল নেত্রীর বাম বিরোধিতা সাধারণ মানুষের স্বার্থের বিরোধিতায় পর্যবসিত হয়েছিল। | লকডাউন ঘোষিত হওয়ার পর অনেক মানুষ কাজ হারিয়েছেন। ফলে দেশ জুড়ে এক অনাহারের পরিস্থিতি তৈরি হয়েছিল। এই অবস্থা মাথায় রেখে কেন্দ্র সরকার থেকে সমস্ত রেশন কার্ডধারীকে মাথাপিছুপাঁচ কেজি চাল ও এক কেজি ডাল দেওয়ার কথা ঘোষণা করেছিল। কেন্দ্রের চাল মানুষের কাছে পৌঁছালে যদি মানুষ বিজেপিমুখী হয়ে যায়। সেই ভয়েই হয়তো সেই চাল রেশন থেকে বিতরণ করতে গড়িমসি করছিল রাজ্য সরকার। কিন্তু এ ব্যাপারে যখন চারদিক থেকে প্রতিবাদের ঝড় উঠতে শুরু করল তার পর এক মাস পর অর্থাৎ মে মাস থেকে সেই চাল বিতরণ শুরু হলো। কিন্তু এই লেখা শেষ হওয়া পর্যন্ত দেশের সমস্ত রাজ্য পেলেও কেন্দ্রের দেওয়া ডালের মুখ দেখতে পায়নি পশ্চিমবঙ্গবাসী।
চাষিদের ন্যূনতম আয় সুনিশ্চিত করতে কেন্দ্রীয় সরকার ব্যয় করছে ১৬ হাজার কোটি টাকা। এই প্রকল্পের সুবিধা পাবেন ৮.৭ কোটি কৃষক। প্রধানমন্ত্রী কৃষি যোজনার আওতায় যে ৬ হাজার টাকা করে কৃষকদের দেওয়া কথা, লকডাউনের মতো বিশেষ পরিস্থিতিতে ২ হাজার টাকা অগ্রিম এপ্রিলে দিয়ে দেওয়া হয়েছে। এই ৮.৭ কোটির মধ্যে পশ্চিমবঙ্গের একজ কৃষকও নেই। কারণ মমতা ব্যানার্জী নিজের ক্ষুদ্র রাজনৈতিক স্বার্থ রক্ষার জন্য পশ্চিমবঙ্গের কৃষকদের নাম এই প্রকল্পে নথিভুক্ত হতে দেননি। কেন্দ্র সরকারের চিকিৎসা বিমা আয়ুস্মান প্রকল্প পশ্চিমবঙ্গে লাগু হতে দেননি। ফলে করোনা বিপর্যয়ে চিকিৎসা ক্ষেত্রে একটি বড়ো সুবিধা থেকে রাজ্যের মানুষ বঞ্চিত ট্রেনের ব্যবস্থা করলেও পরিযায়ী শ্রমিকদের ঘরে ফেরানোর ব্যাপারে মমতা সরকারের চরম অনিহা। মমতা ব্যানার্জির রাজনৈতিক জীবনে এরকম অমানবিক, অসংবেদনশীল আচরণের দৃষ্টান্তের অভাব নেই।
মমতা ব্যানার্জির এই অমানবিক রাজনীতির প্রভাব রাজ্য প্রশাসন এবং তৃণমূল কংগ্রেসের নীচু তলাতেও সংক্রামিত হয়েছে। এ রাজ্যে কাটমানি ছাড়া কোনো কাজ হয় না। যে কোনো ধরনের চাকরির ক্ষেত্রে ঘুষ অবশ্যম্ভাবী। রাজ্য প্রশাসনের সর্বত্র রন্ধ্রে রন্ধ্রে শুধু দুর্নীতি আর দুর্নীতি। ইলেকট্রনিক মিডিয়ার দৌলতে মানুষ দেখেছে সর্বস্ব খোয়ানো পরিযায়ী শ্রমিকদের থেকেও পশ্চিমবঙ্গ রাজ্য পুলিশ তোলা তুলছে। তৃণমূল কংগ্রেসের নেতারা করোনা বিপর্যয়ের সময় রেশনের চাল চুরি করছে। গরিব কল্যাণ যোজনার মাধ্যমে গরিব মানুষ যে পাঁচশো টাকা পেয়েছে নানা ছলচাতুরি করে সেখানেও ভাগ বসাচ্ছেতৃণমূল কংগ্রেসের নেতারা। এই সমস্ত ঘটনার প্রতিবাদ করতে গেলে হয় মিথ্যে কেসে ফাসিয়ে হেনস্থা করা হচ্ছে অথবা সরাসরি উত্তম মধ্যম জুটছে। ফলে মানুষ এখন তিতিবিরক্ত, এটা বুঝতে পেরেই হয়তো মমতা ব্যানার্জি কেন্দ্রীয় স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী অমিত শাহকে বলেছিলেন যদি মনে হয় আমরা পারছি না তাহলে আপনারাই রাজ্যটা চালান। পশ্চিমবঙ্গে এখন প্রশাসনিক, রাজনৈতিক ব্যবস্থা নেই বললেই চলে। পরিস্থিতি থেকে ঘুরে দাঁড়ানোর কোনো উপায়ও হয়তো আর অবশিষ্ট নেইমমতার ঝুলিতে। সবমিলে বলা যায়, স্বখাতসলিলে ডুবছেন মমতা।
সাধন কুমার পাল