১৯৬২ সালের ৫ সেপ্টেম্বর ভারতে এবং ভারতের বাইরে শিক্ষক দিবস পালনের রীতি শুরু হয়। এই দিনটি বিশ্ববিখ্যাত অধ্যাপক ও দার্শনিক ড. সর্বপল্লী রাধাকৃষ্ণনের জন্মদিন। এই দিনটিতে ভারতের বিজ্ঞান ভবনে স্বনামধন্য শিক্ষকদের ভারতের রাষ্ট্রপতি স্বহস্তে পুরস্কার দিয়ে সম্মানিত করেন। ড. রাধাকৃষ্ণনের দার্শনিক চিন্তার মূল ভিত্তি ছিল ভারতীয় সনাতন ধর্ম, সংস্কৃতি ও দর্শন।
দক্ষিণ ভারতকে আমরা মানব মনীষার অন্যতম কেন্দ্র বলে থাকি। ভারতীয় সংস্কৃতিতে দক্ষিণ ভারতের অবদান অবিস্মরণীয়। নৃত্যকলা, শিল্পকলা, স্থাপত্য— সর্বত্রই দক্ষিণ ভারতীয়দের গৌরবজনক ভূমিকার কথা আমরা অবগত। রাধাকৃষ্ণন ছিলেন দক্ষিণ ভারতের এক সুসন্তান। তাঁর জন্ম মাদ্রাজ (অধুনা চেন্নাই) শহরের তিরুনির এক মধ্যবিত্ত গোঁড়া। ব্রাহ্মণ পরিবারে। আর্থিক অসচ্ছলতা সত্ত্বেও এই পরিবারের লােকজন পড়াশােনা করতেন এবং ধর্ম, সংস্কৃতি, শিক্ষা প্রভৃতি বিষয়ে চর্চা করতেন। এই বাতাবরণের মধ্যেই রাধাকৃষ্ণনের প্রাথমিক শিক্ষা সম্পূর্ণ হয়। তারপর তিনি এলেন তিরুপতি শহরে। এই শহরটিও ধর্মকেন্দ্রিক সংস্কৃতির ধারক ও বাহক হিসেবে প্রসিদ্ধ। ১৮৬৯ থেকে ১৯০০ খ্রিস্টাব্দ পর্যন্ত তিনি সেখানকার খ্রিস্টান মিশনারি বিদ্যালয়ের ছাত্র ছিলেন এবং এখানে প্রথম পাশ্চাত্য সভ্যতা ও শিক্ষার সংস্পর্শে এলেন। ১৯০০ খ্রিস্টাব্দে এলেন ভেলাের কলেজে। সেখানে ৪ বছর পড়াশােনা করলেন ; তামিল সংস্কৃতির সঙ্গে পরিচয় আরও বাড়ল। এরপর দক্ষিণ ভারতের সাংস্কৃতিক রাজধানী মাদ্রাজে তার আগমন। রাধাকৃষ্ণনের জীবনীকাররা বলেন, তার জীবন পরিক্রমায় কৈশােরের বছরগুলির আলাদা গুরুত্ব আছে। এ মন্তব্য বােধহয়। স্বামী বিবেকানন্দ ও নেতাজী সুভাষচন্দ্র বসুর ক্ষেত্রেও অনেকাংশেই সত্য। কারণ মনােবিদরা বলেন, মানুষের বড়াে হওয়া পিছনে পরিবেশ অন্তঃসলিলা ফল্গুধারার মতাে অপ্রত্যক্ষভাবে ক্রিয়াশীল থাকে। নিজের জীবন আলােচনা করতে গিয়ে তিনি বলেছেন, ধার্মিক ব্রাহ্মণ পরিবারের পরিবেশ তঁাকে নানাভাবে সাহায্য করেছিল। তীর্থস্থানে থাকার দরুন তিনি ধর্মের সঙ্গে ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক রাখতে সক্ষম হয়েছিলেন। এখানে উল্লেখ্য, খ্রিস্টান মিশনারি বিদ্যালয়ে ও মহাবিদ্যালয়ে অধ্যয়ন করার ফলে তাকে বাধ্যতামূলক ভাবে বাইবেল পড়তে হতাে। এর ফলে তিনি খ্রিস্টধর্মের আকর্ষণ অনুভব করতেন। সেখানে মিশনারিরা কথায় কথায় হিন্দুধর্মকে আক্রমণ করতেন। হিন্দু সভ্যতাকে এক ঘুমন্ত সভ্যতা হিসেবে চিহ্নিত করতেন। কিন্তু এ বিষয়টি তিনি মন থেকে মানতে পারতেন না। এই বিষয়টি তার মনকে গভীরভাবে নাড়া দিয়েছিল। জীবনের এই সন্ধিক্ষণে তিনি স্বামী বিবেকানন্দের নামের সঙ্গে পরিচিত হলেন। কারণ, শিকাগােতে বিশ্বধর্ম সম্মেলনে স্বামী বিবেকানন্দ সনাতন হিন্দুধর্মের উপর যে বক্তব্য রেখেছিলেন তা সকলকে মুগ্ধ করেছিল। সনাতন হিন্দু ধর্ম বিশ্ববাসীকে যে অনেককিছু দিতে পারে তা তিনি গৌরবজনক ভাবে প্রতিষ্ঠিত করেছিলেন। বিভিন্ন নামিদামি পত্রিকায় তাই স্বামী বিবেকানন্দকে বলা হলাে— The Cyclonic Hindu Monk’ifcopacons রচনাবলী তিনি পাঠ করলেন এবং সেগুলি তঁাকে দারুণভাবে অনুপ্রাণিত করলাে। তার সমস্ত দ্বিধা দূর হয়ে গেল। তিনি বুঝলেন যে, হিন্দু ধর্মের ভিতর এমনকিছু মৌলিকত্ব আছে, যার আবেদন বিশ্বজনীন। তিনি এও উপলব্ধি করলেন যে, বেদকে কেন মানব-মনীষার আকর গ্রন্থ বলা হয়। তার এই উপলব্ধির প্রথম সােনালি ফসল কিছুদিনের মধ্যেই পাওয়া যায়।।
রাধাকৃষ্ণন যখন মাদ্রাজ বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র তখন বিশ্ববিদ্যালয়ের পাঠক্রমে একটি মৌলিক প্রবন্ধ লেখার ব্যবস্থা ছিল। এই সুযােগ কাজে লাগিয়ে মাত্র কুড়ি বছর বয়সে তিনি লিখলেন, ‘Ethics of Vedanta’। মাদ্রাজ খ্রিস্টান কলেজের অধ্যক্ষ জগ-সাহেব এই প্রবন্ধটি পড়ে আনন্দে অভিভূত হয়েছিলেন। ১৯০৮ সালে এই মৌলিক প্রবন্ধটি মাদ্রাজ বিশ্ববিদ্যালয় থেকে প্রকাশিত হয়। রাধাকৃষ্ণন পাশ্চাত্য ভাবধারায় কিছুটা উদ্দীপ্ত হয়েছিলেন ঠিকই, কিন্তু ভারতীয়ত্বকে কখনােই বিসর্জন দেননি। পরবর্তীতে অধ্যাপক ও দার্শনিক হিসেবে বিভিন্ন লেখা ও বক্তৃতার মাধ্যমে এই ভারতীয়ত্ব— যার মূল শিকড় সনাতন হিন্দু ধর্ম ও সংস্কৃতির মধ্যে প্রােথিত, তা তুলে ধরেছেন।
ড. রাধাকৃষ্ণন যখন ছাত্র ছিলেন তখন পাঠক্রমে হিন্দুশাস্ত্র ও দর্শনকে গুরুত্ব দেওয়া হতাে না। পড়ানাে হতাে পাশ্চাত্য ধর্ম ও দর্শনের বই। তাছাড়া খ্রিস্টান মিশনারিরা বলতেন হিন্দু ধর্মে নৈতিকতার কোনাে স্থান। নেই এবং জীবন সম্পর্কে কোনাে বােধ নেই। রাধাকৃষ্ণন একথা সত্য বলে বিশ্বাস করতেন না। এর মধ্যে তিনি শ্রীঅরবিন্দের হিন্দু ধর্ম সম্পর্কে বিভিন্ন লেখা ও ভাষণ অধ্যয়ন করেন। শ্রীঅরবিন্দ Inclusive Hinduism and Social Inclusion বিষয়ে যে মতামত রাখেন তা পড়ে তার অনেক দ্বিধা দূর হয়ে যায়।শ্রীঅরবিন্দ হুগলী জেলায় উত্তরপাড়ায় ১৯০৯-এর ৬ মে ভাষণে বলেন, ‘Other religions are preponderatingly religion of faith & profession, but the Sanatan Dharma is life it-self…”. শ্রীঅরবিন্দ বিশ্বাস করতেন যে ভারতবর্ষ ও সনাতন ধর্ম এক ও অভিন্ন। তার ওই ভাষণে একথা সুস্পষ্টভাবে প্রকাশ পেয়েছে। তিনি 76646991, “when…it is said that India shall rise, it is the Sanatan Dharma, that shall rise when it is said that India shall be great, it is the Santan Dharma that shall be great…”
১৯০৯ সালের এপ্রিল মাসে মাদ্রাজ কলেজের অধ্যাপক হিসেবে শিক্ষকতার জীবন শুরু করলেন। খুব শীঘ্রই তিনি ছাত্রদের কাছে খুবই জনপ্রিয় হয়ে উঠলেন। তার আলােচনা ও অসাধারণ বাচনভঙ্গি সকলকে মন্ত্রমুগ্ধ করে রাখত। তাই কৃতিত্বস্বরূপ ১৯১১ সাল তাকে ‘লরিয়েট ইন টিচিং’ উপাধি দেওয়া হয়। মাদ্রাজ কলেজের অধ্যাপনা জীবনের স্মৃতি রােমন্থন করতে গিয়ে তিনি বলেন, “..এই কলেজে আমি সাত বছর ধরে অধ্যাপনা করি। তখন আমি গীতা, উপনিষদ, ব্রহ্মসূত্র প্রভৃতি প্রাচীন হিন্দুশাস্ত্র গুলি পাঠ করেছিলাম। এইসব শাস্ত্রের উপর শঙ্কর, রামানুজ, মধ্ব, লিম্বাৎ প্রমুখ আচার্যদের ভাষ্যগুলি পাঠ করি।। বুদ্ধদেব যে বিশ্লেষণাত্মক ভাষণ এবং উপদেশ প্রদান করেছেন, হিন্দুধর্মের পরিপ্রেক্ষিত্রে তার অন্তর্নিহিত অর্থ জানার চেষ্টা করি।”
১৯১২ সালে রাধাকৃষ্ণনের জীবনে একটি স্মরণীয় ঘটনা ঘটলাে। ইংরেজি অনুবাদের মাধ্যমে রবীন্দ্রনাথের কবিতার সঙ্গে পরিচিত হলেন। গীতাঞ্জলি’ ও ‘সাধনাকাব্য’ পড়ে তিনি উপলব্ধি করলেন যে রবীন্দ্রনাথ শুধু একজন কবি নন, তিনি একজন ঋষি। তিনি এও উপলব্ধি করলেন যে, রবীন্দ্রনাথ ঋষির চোখ দিয়ে ভারতের সংস্কৃতিকে বিশ্লেষণ করার চেষ্টা করেছেন। পরবর্তীতে ‘Quest’ পত্রিকাতে ১৯১৭ সালের এপ্রিল ও জুলাই মাসে তিনি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের জীবনদর্শন ও সাহিত্যধর্ম সম্বন্ধে দুটি গবেষণামূলক প্রবন্ধ লেখেন। রবীন্দ্র-প্রতিভা মূল্যায়নে এই দুটি প্রবন্ধকে আমরা দুটি হীরকখণ্ডের সঙ্গে তুলনা করতে পারি। স্বয়ং রবীন্দ্রনাথ এই প্রবন্ধ দুটি পাঠ করে একটি চিঠির মাধ্যমে রাধারকৃষ্ণনের প্রশংসা করেছিলেন। রবীন্দ্রনাথ বলেন, “রাধাকৃষ্ণন এক তরুণ গবেষকের দৃষ্টিতে রবীন্দ্র দর্শনের অনুধ্যান করেছেন। তিনি একপেশে মতবাদ পেশ করেননি। নির্মোহ দৃষ্টিভঙ্গিতে সবকিছু বিচার-বিশ্লেষণ করার চেষ্টা করেছেন। ১৯১৮ সালে ‘Philosophy of Rabindranath Tagore’ শীর্ষক তাঁর একটি বই প্রকাশিত হয়। সুখ্যাত প্রকাশন সংস্থা ম্যাকমিলন কোম্পানি এই বইটির প্রকাশক।।
ধর্ম বিষয়ে বিশ্লেষণ তঁার দর্শনের এক অবিচ্ছেদ্য অংশ।‘Reign of Religion in Contemporary Philosophy’তার একটি বিখ্যাত বই। এটি কতকগুলি প্রবন্ধের সংকলন। এই প্রবন্ধ সংকলনের শেষের দিকে ‘উপনিষদ’ থেকে একটি উদ্ধৃতি দিয়েছিলেন। এই উদ্ধৃতিটি তার দার্শনিক অভীক্ষার পরিচয় দেয়। রাধাকৃষ্ণন বিশ্বাস করতেন যে, আদিতসত্তার স্বরূপ বিকশিত করার জন্য উপনিষদ যেভাবে ক্রিয়াশীল থেকেছে, অন্য ধর্মগুলি করেনি। অন্যান্য ধর্মগ্রন্থ মানবজীবনের প্রাত্যহিক জীবনচর্যার প্রতি গুরুত্ব দিয়েছে এবং উপনিষদ জীবনচর্যা বাদেও মানবসত্তার অন্তরালে লুকিয়ে থাকা বিশ্বসত্তার সন্ধানে মগ্ন থেকেছে। এই পুস্তকটি পাশ্চাত্য জগতের পাঠক-পাঠিকার মধ্যে দারুণ আলােড়ন সৃষ্টি করেছিল। বারট্রান্ড রাসেলের মতাে বিশ্ববিখ্যাত মনীষী চিঠি লিখে রাধাকৃষ্ণনকে অভিনন্দিত করেছিলেন। পরবর্তীকালে রাধাকৃষ্ণন দেশে-বিদেশে শিক্ষাব্রতী হিসেবে অনেক স্মরণীয় বক্তৃতা দিয়েছেন। এমন কয়েকটি বক্তৃতার মূল বিষয়বস্তু এখানে উল্লেখ করা হচ্ছে। হিন্দুধর্মের সঙ্গে তাঁর দার্শনিক মানসিকতার যে নিবিড় সম্পর্ক তা তাঁর ম্যাঞ্চেস্টার কলেজে অ্যাপ্টন বক্তৃতায় ফুটে উঠেছে। সেখানে বলেন, “হিন্দু জীবনদর্শন সম্পর্কে অ্যাপ্টন বক্তৃতামালায় আমি হিন্দু ধর্মকে একটি ঐতিহাসিক প্রগতিশীল আন্দোলন হিসেবেই দেখতে চেয়েছি। এই সঙ্গে আমি বােঝাতে চেয়েছি যে, এই মুহূর্তে ওই আন্দোলনের গতিপ্রকৃতির ধারা কিছুটা পরিবর্তিত হলেও এখনও তা বহমান স্রোতস্বিনীর মতাে বিদ্যমান। আমি আরও একটা কথা বলতে চাই যে, হিন্দু ধর্মাবলম্বীরা নদীগর্ভের পলিমাটির কোনাে অনড় পদার্থের রক্ষক নন, তারা হলেন ধাবমান মশালধারী পথনির্দেশকের দল। পরিবর্তিত পরিস্থিতির সঙ্গে তাল মিলিয়ে তাঁরা চলতে পারেন। তবে অন্যায়ের সঙ্গে আপােশ করেন না।” ১৯২৭ সালে অ্যাপ্টন বক্তৃতামালাতে প্রদত্ত ভাষণগুলি ‘The Hindu view of life’নামে পুস্তক আকারে ইংল্যান্ডের বিখ্যাত প্রকাশন সংস্থা জর্জ অ্যালেন দ্বারা প্রকাশিত হয়। রাধাকৃষ্ণন বিদেশের ভাষণগুলিতে জীবনবােধ উন্মােচনের বিষয়ে মনােনিবেশ করেন। লন্ডন ও ম্যাঞ্চেস্টার বিশ্ববিদ্যালয়ে প্রদত্ত ভাষণগুলিকে কেন্দ্র করে “An Idealistic view of life’ নামে একটি বই প্রকাশিত হয়। এই ভাষণগুলির মাধ্যমে আমরা বুঝতে পারি যে, তিনি একজন অত্যন্ত দূরদৃষ্টিসম্পন্ন দার্শনিক ছিলেন। এই ভাষণগুলির একটিতে তিনি বলেন, “বর্তমান যুগে মানব আত্মার অবমানা চোখে পড়ছে। এখন রাজনীতি ও অর্থনীতিতে দুবৃত্তায়ন ঘটে যাচ্ছে। যে কোনাে প্রকারে মানুষ ক্ষমতা মুঠিবদ্ধ করার চেষ্টা করছে। দেখা গিয়েছে এক নব্য ঔপনিবেশিকতাবাদ। মানুষ আর শুধুমাত্র রাজনৈতিক আধিপত্য স্থাপন করেই ক্ষান্ত হচ্ছে না। সে বৌদ্ধিক জগতে প্রভাব বিস্তার করতে চাইছে। অন্যায় ভাবে অন্যের সৃষ্টিশীল ভাবনাকে আক্রান্ত করছে। এই অবস্থা বেশিদিন চলতে থাকলে, আমাদের সভ্যতার শেষের প্রহর ঘনিয়ে আসবে। এখন আমাদের উচিত হারানাে আস্থাকে পুনঃপ্রতিষ্ঠিত করা।…” বর্তমান পৃথিবীর বিভিন্ন দেশ এবং ভারতের দিকে দৃষ্টিপাত করলে রাধাকৃষ্ণনের এই দূরদর্শিতার প্রমাণ মেলে। তাঁর এই দূরদর্শিতায় বিভিন্ন দিকের ও বিষয়ের বাস্তব অভিজ্ঞতার অবদান রয়েছে।
১৯৪৬ সালে ড. রাধাকৃষ্ণন UNESCO-এর সদস্য নির্বাচিত হলেন তার পাণ্ডিত্য ও মেধার জন্য। এই সংস্থা আয়ােজিত এক ভাষণে তিনি বলেন, “আমাদের উচিত এমন এক আন্তর্জাতিক সংস্কৃতির রূপরেখা নির্ধারণ করা যার সাহায্যে আমরা রাজনৈতিক হানাহানিকে দূরীভূত করতে পারবাে।” এরপর তিনি ১৯৪৮ সালে UNESCO-র চেয়ারম্যানের পদ অলংকৃত করেন। তখন কর্মব্যস্ততার মধ্যেও ‘Religion and Society’ নামে একটি বই রচনা করেন। এই বইয়ের বিভিন্ন অধ্যায়ে তিনি বােঝাতে চেয়েছেন কীভাবে ধর্ম আমাদের সামাজিক নীতিকথাকে প্রভাবিত করতে পারে এবং কীভাবে ধর্ম ধর্মীয় অন্বেষণের মাধ্যমে সমাজ নীরব বিপ্লব সংঘটিত করতে পারে। তার আরও বিশ্বাস যে, ধর্ম অন্বেষণের সঙ্গে সমাজ সংস্কারকেও যুক্ত করা উচিত। এছাড়া তিনি বিশ্বাস করতেন যে, বিজ্ঞান মানুষকে বহুলাংশে নির্মোহী ও যুক্তিবাদী করে তােলে। বিজ্ঞানসম্মত চিন্তাধারা ছাড়া কেউই স্বয়ংসম্পূর্ণ হতে পারে না। ১৯৫২ সালে আমরা একজন শিক্ষক ও দার্শনিককে রাষ্ট্রনেতা হিসেবে তাকে পাই। উপরাষ্ট্রপতি হিসেবে তিনি অসাধারণ বাস্তববােধ ও রাজনৈতিক প্রজ্ঞার পরিচয় দিয়েছেন। ১৯৫৬ সালের ২৫ ফেব্রুয়ারি তিনি লােকসভার কক্ষে গণতন্ত্র সম্বন্ধে একটি ঐতিহাসিক ভাষণ দেন। তিনি বলেন, ‘গণতন্ত্রের আসল অর্থ হলাে এমন একটি সরকার গঠন করা, যার হাতিয়ার হবে সাধারণ মানুষের অর্থনৈতিক ও সামাজিক উন্নতি। গণতন্ত্রকে তিনি বিভিন্ন রাষ্ট্রের সমস্যা সমাধানের একমাত্র পন্থা হিসেবে চিহ্নিত করেছেন। ১৯৬২ সালে তিনি রাষ্ট্রপতি পদে আসীন হলেন। অ্যারিস্টটল বলেছিলেন, ‘দেশ তখনই সুখী হবে যখন রাজা হবেন দার্শনিক এবং দার্শনিক হবেন রাজা। সর্বপল্লী রাধাকৃষ্ণন এই উক্তির এক উজ্জ্বল দৃষ্টান্ত। তিনি রাষ্ট্রপতি হয়েই দুটি গুরুত্বপূর্ণ সিদ্ধান্ত গ্রহণ করলেন। সরল জীবনযাপনে অভ্যস্ত রাষ্ট্রপতি দশ হাজার টাকা বেতনের মধ্য থেকে দু’হাজার টাকা রেখে বাকি টাকা দেশ গড়ার তহবিলে দান
করতেন। আরেকটি সিদ্ধান্ত হলাে যে, পূর্বে ভারতের বড়লাট গ্রীষ্মকালীন অবকাশ যাপনের জন্য সিমলায় যে বিলাসবহুল প্রাসাদ নির্মাণ করেছিলেন তা উচ্চশিক্ষা ও গবেষণার জন্য খুলে দেওয়ার ব্যবস্থা করলেন। কারণ ওই ব্যয়বহুল প্রাসাদটির জন্য অকারণে মাত্র কিছুদিনের জন্য খােলা থাকলেও প্রচুর ব্যয় হতাে। এই প্রসাদটি ‘Indian Institute of Advanced Study’ নামে একটি স্বয়ংশাসিত আবাসিক সংস্থা। এই সংস্থাটিকে আমরা ভারতীয় সারস্বত চিন্তার অন্যতম কেন্দ্র বলতে পারি। ১৯৬২ সাল ভারত-ইতিহাসে চীন-ভারত যুদ্ধের জন্য স্মরণীয় হয়ে থাকবে। চীন-ভারত যুদ্ধে আধুনিক অস্ত্রের অভাবে বীরত্বের সঙ্গে যুদ্ধ করেও ভারতীয় জওয়ানরা পরাজিত হয়েছিল।
যুদ্ধে পরাজয়ের জন্য রাধাকৃষ্ণন অনেকাংশে নেহরুর অদূরদর্শিতাকে দায়ী করেছিলেন। নেহর বিশ্বব্যাপী শান্তিস্থাপনের ব্যাপারে মত্ত থাকায় এবং চীনা মতলব বুঝতে ব্যর্থ হওয়ায় ভারতীয় সেনাবাহিনীকে সেভাবে গড়ে তুলতে পারেননি। এইজন্য ড. রাধাকৃষ্ণন নেহরুর নীতিকেই দায়ী করেছিলেন।
রাষ্ট্রপতির পদ থেকে অবসর গ্রহণের পর তিনি বৌদ্ধিক জগতে ডুবে ছিলেন। বয়স বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে তার দেহ দুর্বল হতে লাগল। ১৯৭৫ সালে নিউমােনিয়া রােগে আক্রান্ত হয়ে নার্সিংহােমে ভর্তি হলেন। তখনই তার হাতে Templeton পুরস্কার প্রদান করা হয়। এই পুরস্কার বিশ্বমানবতার সঙ্গে যুক্ত মহান ব্যক্তিদের দেওয়া হয়। ছ’হাজার পাউন্ড মূল্যের এই পুরস্কার তিনি এক অনাথ আশ্রমকে দান করেন। ১৯৭৫ সালের ১৬ এপ্রিল রাত ১২-৪৫ মিনিটে তার জীবনদীপ নির্বাপিত হয়। পরেরদিন ভারত-সহ সারা পৃথিবীর সংবাদপত্রে অত্যন্ত গুরুত্ব সহকারে সম্মানের সঙ্গে তার মৃত্যুখবর প্রকাশিত হয়। রাধাকৃষ্ণন আজ আর নেই, কিন্তু তাঁর জীবনাদর্শ, কর্মাবলী, ভারতীয় ধর্ম, দর্শন ও সংস্কৃতিবোেধ ভারতবাসীকে এক নতুন ভারত গড়ার দিক প্রদর্শন করবে।
ড. তরুণ কান্তি চক্রবর্তী
2020-08-31