বীরভূমের জেলার এক গ্রাম থেকে উঠে আসা স্বাধীনতা সংগ্রামী পরিবারের সন্তান একজন বাঙ্গালি ব্রাহ্মণ অধ্যাপকের ঘাত প্রতিঘাত কুশলতার সঙ্গে সামলে রাজনীতির বিভিন্ন পদ, সরকারের বিভিন্ন মন্ত্রকের দায়িত্ব সাফল্যের সঙ্গে পালন করে তিনি হয়ে উঠেছেন দেশের সবচেয়ে সফল বাঙ্গালি রাজনীতিক।
প্রথমে বলি যে, তার বিচারধারা ও কর্মপদ্ধতির আলােচনা করলেও অন্তরের অন্তস্থলে তার কর্মের ‘ঠিক-ভুল’ বিশ্লেষণ করতে বসিনি। পশ্চিমবঙ্গে কংগ্রেসের দুরবস্থার জন্যে তার সক্রিয়তা যতটা দায়ী, অন্যদের নিষ্ক্রিয়তা ততটাই দায়ী। নয়তাে প্রিয় র ঞ্জন-কুমুদ ভটচাজদের মতাে ‘নীতিবাগীশ’ নেতৃত্ব থাকতে মমতা ব্যানার্জিকে কংগ্রেস ছাড়তে হয়েছিল কেন? একমাত্র অধীর রঞ্জন চৌধুরী এই ব্যবস্থার বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নিতে চেয়েছিলেন। কিন্তু কুরুক্ষেত্র যুদ্ধের ‘অভিমন্যু’ রূপে বারংবার একা হয়ে যেতেন।
কিন্তু তবুও তার রাজনৈতিক ক্রিয়াকর্মাদি ঠিক না বেঠিক তা সম্পর্কে সিদ্ধান্ত ঘােষণার আমি কেউ নই। সেটি ভবিষ্যৎ প্রজন্ম ঠিক করবে। আমি নৈর্ব্যক্তিক এবং নির্মোহ বিশ্লেষণ করতে চেষ্টা করি কোনােরকম পক্ষপাতিত্ব না রেখেই। দিনের শেষে বিরাট কোনাে বিদ্বেষ বা ভালােবাসা কোনােটাই নেই। হে মহাজীবন’ বলে ডাকবাে না… আবার ‘মহিষাসুর’-ও বলবাে না… ভালাে রাজনৈতিক বিশ্লেষক হতে গেলে নির্মোহ ও নৈব্যক্তিক বিশ্লেষণ জরুরি।
আমি ‘রাজনৈতিক প্রণব’-এর চেয়ে। ‘ব্যক্তি প্রণব’-কেই বিশ্লেষণ করবাে বেশি। যদিও এতাে দীর্ঘ রাজনৈতিক জীবন এক প্রবন্ধে ধরা কঠিন। আমি সােজা করে লেখার চেষ্টা করছি।
প্রথমেই একটি দৃশ্যপট কল্পনা করতে বলবাে।
উত্তাল সমুদ্র। তার মধ্যে একটি ছােটো সার্ফিং বাের্ডে সার্ফিং করছেন একজন। সাফার। বিরাট বিরাট ঢেউ উঠছে। আর তার মধ্যে কখনাে ঢেউয়ের আড়ালে ঢাকা পড়ে যাচ্ছেন সাফার। হারিয়ে গেলেন নাকি?
… পরক্ষণেই আবার ঢেউয়ের আস্তরণ সরিয়ে প্রকট হচ্ছেন। পদস্খলন মানেই অবশ্য মৃত্যু। এই অবস্থায় সাফারকে কিন্তু সমুদ্রের ঢেউয়ের দিকে তাকালে চলবে না, সার্ফিং বাের্ডের সঙ্গে আটকে থাকতে হবে এই আত্মবিশ্বাস নিয়ে যে লক্ষ্যে পৌঁছনাে যাবেই ঢেউকে পেরিয়ে। স্বার্থপর বলা যাবে কিনা জানি না, কিন্তু সারভিবর-ও বটে।
কংগ্রেস তথা ভারতীয় রাজনীতির উত্তুঙ্গ সমুদ্রে ওই ‘সাফারটিই প্রণব মুখার্জি।
তিনটি বৈশিষ্ট্য দিয়ে প্রণববাবুর চরিত্র বিশ্লেষণ করবাে রাজনৈতিক ছাত্রদের সুবিধার্থে।
১. নিজের সীমাবদ্ধতা সম্পর্কে সঠিক ধারণা : সিদ্ধার্থশংকর রায়ের মতাে পারিবারিক ঐতিহ্য তাঁর ছিল না, বরকত গণিখান চৌধুরীর মতাে উত্তাল জনসমর্থন অর্জনের কোনােদিন চেষ্টাও গরেননি, অতুল্য ঘােষের মতাে মহাজ্ঞানীও ছিলেন না।
কিন্তু তিনি জানতেন, তাঁর কোথায় দুর্বলতা। তাই দুর্বলতাগুলিকে ঢেকে শক্তিশালী জায়গাগুলিকে আরও শক্তিশালী করার চেষ্টা করেছেন চিরকাল। আঁকড়ে ধরেছেন ‘সার্ফিং বাের্ডটিকে। সেই ‘সার্কিং বাের্ডটি হলাে, দলের সর্বোচ্চ নেতৃত্ব’ ‘বাংলা কংগ্রেস’-এ থাকতে আঁকড়ে ধরেছিলেন অজয় মুখােপাধ্যায়কে, তার জোরেই রাজ্যসভাতে পৌঁছেছিলেন ১৯৬৯ সালে। গিয়েই আঁকড়ে ধরেন ইন্দিরা গান্ধীকে। তারপরে নরসিংহ রাও, সােনিয়া গান্ধী, মমতা ব্যানার্জি, অধীর রঞ্জন চৌধুরী, নরেন্দ্র মােদী—একে একে আঁকড়ে ধরেছেন। বিভিন্ন নেতাকে। যখনই বুঝেছেন যে সেই নেতা তার উত্থানের পক্ষে অপরিহার্য, তিনিও হয়ে উঠতে চেয়েছেন সেই নেতার কাছে অপরিহার্য।
কিন্তু ‘সর্বোচ্চ নেতার কাছে পৌঁছনাে এতই কী সহজ?
উত্তর : যদি সাংগঠনিক পথে যাওয়ার চেষ্টা হয়, তাহলে সারাজীবন লেগে যায়। কিন্তু রাজনৈতিক দলে থাকে অন্য একটি ‘পথ’— রাজনৈতিক দলে শিক্ষিত লােকের সংখ্যা বেশি থাকে না। থাকলেও তারা বিশেষ কল্কে পায় না লবি না বুঝলে, সুতরাং সঠিক ইংরেজিতে চিঠিপত্র লেখার লােক নেহাতই কম থাকে। প্রণববাবু অজয় মুখার্জি ও ইন্দিরী গান্ধীর কাছে পৌঁছন ওই চিঠি ড্রাফটিং করার দায়িত্ব মাথায় নিয়ে। সেখান থেকে কোনােদিন সরেননি। কংগ্রেসের সব গুরুত্বপূর্ণ চিঠি ড্রাফট করার দায়িত্ব নিজের কাঁধে নিয়ে নিতেন। এর ফলে পার্টি সংগঠনে অপরিহার্য হয়ে ওঠেন। কিন্তু সেখানেই নিজেকে থামিয়ে রাখেননি। খুব দ্রুত বুঝে গেছিলেন যে, রাজনীতিতে গুরুত্বপূর্ণ হয়ে উঠতে গেলে অর্থনীতির ক্ষেত্রটিতে প্রভাব ফেলতে হবে। নিজে ছিলেন ইতিহাস ও রাষ্ট্রবিজ্ঞানের ছাত্র। অর্থনীতি’ তার বিষয় ছিল না, কিন্তু রাজ্যসভায় পৌঁছতেই ‘অর্থনীতি’কেই আঁকড়ে ধরলেন। একটু সুবিধা হয়েছিল ইন্দিরা গান্ধী ওই ১৯৬৯-৭২ সময়টায় বামেদের বুদ্ধি নিয়ে অর্থনীতি পরিবর্তন করছিলেন বলে– উপদেষ্টাদের বেশিরভাগই ছিলেন বাঙ্গালি। আর ‘বাংলা কংগ্রেস’করার ফলে প্রণববাবুর এই বামেদের সঙ্গে সখ্য ছিল। ফলে ‘সমাজতান্ত্রিক অর্থনীতি’ বােঝার অনেক ভালাে শিক্ষক’ পেয়েছিলেন।
ইন্দিরা গান্ধী শান্তিনিকেতনে পড়ার কারণে বাংলা ও বাঙ্গালিপ্রেমী ছিলেন। বাংলা বুঝতেন। সামান্য বলতেও পারতেন। রবীন্দ্রসংগীত শুনতে ভালােবাসতেন। আনন্দময়ী মা ও ভরত মহারাজের সঙ্গে বাংলাতেই বাক্যালাপ করতেন। প্রণববাবুর স্ত্রী শুভ্রা মুখােপাধ্যায়কে (যাঁকে প্রণববাবু ‘গীতা’ নামে ডাকতেন) নিয়মিত ইন্দিরা গান্ধীকে রবীন্দ্রসংগীত শােনাতেন। বাঙ্গালি খাবার রান্না করে নিয়ে যেতেন। ইন্দিরা গান্ধীকে তিনি ছাড়েননি, বােঝার চেষ্টা করতেন কোনাে নেতার জোর আছে, তারপরে সর্বতােভাবে চেষ্টা করতেন যাতে তাঁর গুডবুকে থাকা যায়।
তিনি একের পর এক কোয়ালিটি আহরণ করেছেন এবং একের পর এক নেতার সঙ্গে সুসম্পর্ক রেখেছেন।
২. কঠোর পরিশ্রম এবং একমুখী মানসিকতা : প্রণব মুখার্জি আমাদের দেখা কংগ্রেসের সব নেতার চেয়ে বেশি পরিশ্রমী ছিলেন। রাজনীতিতে সর্বোচ্চ স্তরে যেতে গেলে বুদ্ধিজীবী হতে হয়, তিনি প্রচুর পড়াশুনা করতেন। এতে বহিরঙ্গ ও অন্তরঙ্গভাবে বুদ্ধিজীবী’ হয়ে ওঠার চেষ্টার কোনাে খামতি ছিল না। তিনি ‘সংসদীয় রাজনীতি’র সংসদটিকে আঁকড়ে ধলেছিলেন। একগাদা কমিটির মধ্যে ঢুকে থাকতেন এবং ওই কমিটিগুলির মাধ্যমে। দেশের রাজনীতির গতি প্রকৃতি এবং পলিসি তৈরি অত্যন্ত পরিশ্রমের সঙ্গে আয়ত্ত করেছিলেন। যেগুলি পরবর্তীকালে তাঁর খুব কাজে লেগেছিল।
তার লেখা বইগুলি পড়ে দেখলেই বােঝা যাবে। আবার অত্যুলবাবু, নরসিমহা রাও, ড. মনমােহন সিংহ, অশােক মিত্র, ভবানী সেনগুপ্ত, হিরেন মুখার্জি, মােহিত সেন কিংবা জওহরলাল নেহরুর লেখায় বুদ্ধির ছাপ স্পষ্ট, প্রণববাবুর লেখা নিতান্ত কেজো লেখা। কেউ ওইগুলাে পড়ে বিরাট তৃপ্ত হতে পারবে না বােঝাই যায়, তার জ্ঞান আহরণ’ চরম পরিশ্রমের ফল এবং লেখার মধ্যে তার ছাপ স্পষ্ট।
‘একমুখী মানসিকতাটি আগেই ব্যাখ্যা করেছি। আমাকে টিকে থাকতেই হবে– যে কোনাে উপায়ে সকল সহযােগী দলকে ম্যানেজ করে ইউপিএ সরকার চালানােয় তা স্পষ্ট। বামেরা সমর্থন প্রত্যাহার করলেও ইউপিএ টিকে গেছিল সমাজবাদী সাংসদদের সমর্থনে।
‘যােগ্যতা’র বদলে ‘আনুগত্যকে গুরুত্ব দিতেন বলেই প্রিয়রঞ্জন দাশমুন্সির চেয়ে সােমেন মিত্র তাঁর কাছের ছিলেন বেশি।
৩. ‘সময়’ বােঝার ক্ষমতা : প্রণববাবুর সময় বােঝার ক্ষমতা ভালাে ছিল কিন্তু সেটি তার ওই পরিশ্রম ও একমুখী মানসিকতার ফলাফল। তিনি খেলােয়াড় হওয়ার বদলে খেলা নিয়ন্ত্রণ করতে বেশি পছন্দ করতেন। সেই কারণেই প্রধানমন্ত্রী হতে পারেননি। সােনিয়া গান্ধীর জনসমর্থন ছিল, ড. মনমােহন সিংহের ছিল পাণ্ডিত্য। দুটোতেই প্রণববাবু সেকেন্ড বেস্ট’ছিলেন।
সেই কারণেই প্রধানমন্ত্রী হতে পারেননি বা হতে দেয়নি। কিন্তু তিনি বেশ ভালােই বুঝতে পারতেন যে কখন নরসিমহা রাওয়ের সময়। শুরু ও গান্ধী পরিবারের শেষ, আবার কখন সােনিয়া গান্ধীর সময় শুরু ও সীতারাম কেশরীর শেষ, কখন মমতার সময় শুরু ও সােমেন মিত্রের শেষ, কখন নরেন্দ্র মােদীর সময় শুরু ও সােনিয়া গান্ধীর শেষ।
কংগ্রেসের ক্রাইসিস ম্যানেজার (নিন্দুকেরা বলেন এর অনেকগুলি ক্রাইসিস তারই সৃষ্টি নিজেই সমাধান করার জন্য), সুবক্তা, চণ্ডীপাঠ, দুর্গাপুজো করা, গীতার শ্লোক আউড়ে বিরােধী হিন্দুনেতাকে চুপ করানাে এসব ছিল তাঁর চরিত্রের নানান দিক, ব্যক্তিগত ক্যারিশমা। নাগপুরে রাষ্ট্রীয় স্বয়ংসেবক সঙ্ঘের অনুষ্ঠানে প্রধান অতিথি রূপে আমন্ত্রণ গ্রহণ এবং সেই সভায় গিয়ে। ভারতীয় সংস্কৃতি ও জাতীয়তাবােধের ভাবনা সম্পর্কে তার ভাষণ একটি মাইলফলক।
সবচেয়ে সফল বাঙ্গালি রাজনীতিক ?
তাঁর সাফল্যটি ‘ব্যক্তিগত’, ‘বাঙ্গালি’ বলে নয়। সেই কারণেই তাঁর ‘ভারতরত্ন’ আমবাঙ্গালির মনে বিরাট কোনাে উদ্বেলতা তােলেনি। সুভাষচন্দ্র বসু কিংবা ডাঃ বিধানচন্দ্র রায় প্রধানমন্ত্রী বা রাষ্ট্রপতি হননি। কিন্তু বাঙ্গালির মনে তাদের গুরুত্ব বেশি।
প্রণব মুখার্জি রাষ্ট্রপতি হবার ভােটে নিজের রাজ্যের তৃণমূল সরকারের সমর্থন। পাননি, অথচ বিরােধী অনেক দল শিবসেনা ইত্যাদির সমর্থন পেয়েছেন। মনে আক্ষেপ ছিল ভােটে লড়ে জিতে লােকসভায় যেতে পারেননি। রাজ্যসভার সাংসদ হতে হতাে বারবার। সে দুঃখ ঘােচে অধীরবাবুর উদ্যোগে জঙ্গীপুর থেকে পরপর জয়ে। অপবাদ ছিল পশ্চিমবঙ্গের বাম সরকার ফেলতে তেমন উদ্যোগী নন, সে দাগ ঘােচে ২০১১-তে সার্থক তৃণমূল-কংগ্রেস জোটের মাধ্যমে জয়লাভের পর।।
ব্যর্থতা : বড়াে মানুষের জীবনেও ব্যর্থতা থাকে। থাকে বলেই সে জীবনে বড়াে সাফল্য আসে। রাজীব গান্ধীর সময় কংগ্রেস ছেড়ে আলাদা দল গড়েন, সে দল চূড়ান্ত ব্যর্থ হয়, ফলে পুনরায় কংগ্রেসে ফিরে আসতে হয়। ছেলে অভিজিৎবাবুর রাজনৈতিক ক্যারিয়ার এখনও সার্থক বা প্রতিষ্ঠিত নয়, মেয়ে শর্মিষ্ঠা দেবী দিল্লি কেন্দ্রিক রাজনীতি করতে গিয়ে চূড়ান্ত ব্যর্থ। প্রণবাবুর সমস্ত সম্ভাবনা থাকা সত্ত্বেও প্রধানমন্ত্রী হতে না পারা বা পশ্চিমবঙ্গের মুখ্যমন্ত্রীর কুর্সিতে একবারও বসতে না পারা বেদনাদায়ক।
সবশেষে বলি, কলকাতা থেকে দুরবর্তী জেলা বীরভূমের এক গ্রাম থেকে উঠে আসা স্বাধীনতা সংগ্রামী পরিবারের সন্তান একজন বাঙ্গালি ব্রাহ্মণ অধ্যাপকের ঘাত প্রতিঘাত কুশলতার সঙ্গে সামলে রাজনীতির বিভিন্ন পদ, সরকারের বিভিন্ন মন্ত্রক সামলানাে এবং শেষে দেশের রাষ্ট্রপতিরপে সার্থক – নিরপেক্ষ অবস্থান তাকে রাজনৈতিক মহীরুহে পরিণত করেছে। তার আত্মার চিরশান্তি কামনা করি।
সৈকত চ্যাটার্জী
(লেখক সিভিল ইঞ্জিনিয়ার, পশ্চিম বর্ধমান)
2020-09-07