প্রায় পক্ষকাল আগে মূলধারার প্রচারমাধ্যম এড়িয়ে গেছে বা নিতান্তই অনিচ্ছা সহকারে একটা ফুটনোটে হয়তো উল্লেখ করেছে যে অযোধ্যায় যুগ প্রতিক্ষিত। এক দিব্য রামমন্দির নির্মাণের কাজ শুরু হয়ে। গেছে। ভারতের ইতিহাসে এ এক স্বর্ণময়। অধ্যায়ের সূচনা।
অন্য সময় হলে এই সূচনাপর্বের মতো অনুষ্ঠান মূল মিডিয়ায় চূড়ান্ত প্রাধান্য তো পেতই , একই সঙ্গে আন্তর্জাতিক মহলেও সাড়া ফেলে দিত। মনে রাখতে হবে, অযোধ্যার তথাকথিত ‘বিতর্কিত ভূমিতে রামমন্দির নির্মাণ নিয়ে বিক্ষোভ, আন্দোলন। সারা ভারতের মানসভূমিকে ১৯৯০ সাল থেকেই আলোড়িত করেছে। এই আন্দোলন। গোটা দেশে রাজনীতির প্রচলিত চোহারাটাই বদলে দিতে থাকে। শুরু হয় বিজেপির। উত্থান। কোণঠাসা হতে থাকে কংগ্রেস। অবশ্যই রাজনীতির কেন্দ্রস্থলে ও জনজীবনে। প্রতিষ্ঠিত হয় রাজনৈতিক হিন্দু নামে। এযাবৎ অচেনা দেশের গরিষ্ঠ প্রজাতি। উত্তরকালের ইতিহাসবিদদের কাছে এই অযোধ্যা আন্দোলন নেহরু পরবর্তী ভারতের উত্থানের যুগান্তকারী সন্ধিক্ষণ হিসেবেই বিবেচিত হবে।
বর্তমানে ক্ষমতায় থাকা বিজেপি দলের কাছে দ্বিতীয় মোদী সরকারের প্রথম বর্ষপূর্তি উৎসবের সূচিতে রামমন্দির নির্মাণ শুরু হওয়ার ঘটনা নিঃসন্দেহে অন্যতম সেরা। পটভূমি হতে পারত। হ্যা, এটা কেউই অস্বীকার করতে পারেন না যে মহামান্য সর্বোচ্চ আদালতের সর্বসম্মতিক্রমে মন্দির নির্মাণের পক্ষে রায়দান একটি নির্ণায়ক ভূমিকা নিয়েছিল। কিন্তু যে সমস্যা বহুকাল ধরে সমাধান-ঊর্ধ্বে বলেই ধরে নেওয়া হয়েছিল বিশেষ করে এক শ্রেণীর সর্বজ্ঞ বুদ্ধিজীবী দেশবাসীকে সদা সন্ত্রস্ত করে তুলতেন এই বলে যে রামমন্দির নির্মাণ স্বীকৃত হলে দেশ টুকরো টুকরো হয়ে যাবে। কিন্তু এমন অসম্ভবও সম্ভব হয়েছে মোদী সরকারের ধীর অথচ দৃঢ় রাজনৈতিক সদিচ্ছার ফলে। এটা নিশ্চত করে বলা যায় অন্য কোনো সরকার যারা এই বিষয় ও এই জাতীয় আবেগ সম্পর্কে তেমন সহমর্মী নয়, তারা আদালতের রায় নিয়ে গড়িমসি করে এর বাস্তাবয়ন অনির্দিষ্টকালের জন্য ঝুলিয়ে রাখত। ২০১৯ সালের মে মাসে দ্বিতীয়বার ক্ষমতায় আসা থেকে দ্বিতীয় মোদী সরকারের প্রথম দশ মাসের উল্লেখযোগ্য কাজগুলির মধ্যে রামমন্দির বিষয়টি অত্যন্ত তাৎপর্যপূর্ণ। ভারতের ক্ষেত্রে এটা প্রায়ই ধরে নেওয়া হয় যে এখানে নির্বাচিত হয়ে আসার পর প্রথম ১৮ মাসই মাত্র সেই সরকারটি যা কিছু প্রধান পরিকল্পিত কাজ তা সেরে নেওয়ার চেষ্টা করে। ধরে নেওয়া হয় ৫ বছর মেয়াদের বাকি সাড়ে তিন বছর সময়টা তাকে সমাপ্ত করা কাজগুলির জন্য রাজনৈতিক অগ্নি পরীক্ষায় ব্যস্ত থাকতে হবে। অর্থাৎ বিরোধীদের তীব্র মোকাবিলা করতে হবে।
তবে এটাও ঠিক প্রথম মোদী সরকার তাদের প্রধান প্রধান যেমন বিমুদ্ৰীকরণ, জিএসটি বা পাকিস্তানের বিরুদ্ধে বালাকোটে সার্জিক্যাল স্ট্রাইকের মতো প্রবল প্রতিক্রিয়া উদ্রেককারী সিদ্ধান্ত গুলি সরকার পরিচালনার মধ্যম পর্বে বা তারও পরে নিয়েছিল। তবুও যে সমস্ত সিদ্ধান্ত প্রবল বিতর্ক ও বিক্ষোভের সৃষ্টি করতে পারে সেগুলি সরকারের ‘হানিমুন পর্বের মধ্যেই নিয়ে নেওয়া ভালো। | রাজীব গান্ধী ১৯৮৪ সালে বিপুল জনসমর্থন নিয়ে জিতে আসার পর তার কার্যকালের প্রথম ১৮ মাসের মধ্যেই বহু প্রতীক্ষিত পঞ্জাব, অসম ও মিজোরামের সঙ্গে শান্তিচুক্তি স্বাক্ষর করার কাজে হাত লাগান। দলত্যাগ বিরোধী বিল প্রণয়নের কাজও তিনি এই সময়েই করেছিলেন। কিন্তু নজর করলে দেখা যাবে এর পরবর্তী সময়ে তাঁর কাজের খতিয়ান নিছক ভুল সিদ্ধান্ত, সুযোগ হারানো ও দেশের পক্ষে ক্ষতিকারক চরম বিতর্কিত সিদ্ধান্ত গ্রহণে ভরা।
এই দ্বিতীয় মোদী সরকার তার প্রথম ১০ মাসেই যে তিনটি সিদ্ধান্ত নিয়েছে তা এক কথায় যুগান্তকারী। বিশেষ করে এই সিদ্ধান্তগুলি বিজেপি দলের মূল ভাব ও ভাবনার পরিপূরক। ভারত সম্পর্কে এযাবৎ টিকে থাকা ধারণা বা কল্পনা যা বলবৎ রয়েছে এগুলি তার বিকল্প হিসেবেই বরাবর লালিত হয়ে এসেছে। নির্দ্বিধায় বলা যায় সেগুলি বিতর্কিত ও এতকাল যে বিষয়গুলিকে বরাবরের জন্য স্বীকৃতি ও মান্যতা দিয়ে দেশ চলছিল তার বিপরীত। এক কথায় যেগুলি ছিল অলঙ্, বিভিন্ন আইন প্রণয়নের মাধ্যমে সেগুলির মূলে কুঠারাঘাত করা হয়েছে। সেই জন্য পর পর দু’বার অত্যন্ত উল্লেখযোগ্য নির্বাচনী জয় পাওয়ার পর প্রতিশ্রুতি রূপায়ণের এই সাফল্যকে নরেন্দ্র মোদী নিশ্চয় বলতে পারেন যে বিজেপির নির্বাচনী ইস্তাহারে দেওয়া প্রতিশ্রুতিগুলি শুধু পাতা ভরানোর জন্য সুন্দর সুন্দর বাক্যবিন্যাস নয়, তার কার্যক্ষেত্রে প্রয়োগে সরকারের দায়বদ্ধতা আছে।
প্রথম সিদ্ধান্তটি ছিল বহু প্রতীক্ষিত জম্মু ও কাশ্মীরে ধারা ৩৭০ ও ৩৫-এ’র বিলোপ। দেশব্যাপী এই নিয়ে সরকারকে অভিনন্দিত করা হয়। দেশের মোট ৫৪৩টি সংসদীয় ক্ষেত্রের মধ্যে মাত্র তিনটি এই সিদ্ধান্তে বিমর্ষ হয়ে পড়ে।
দ্বিতীয়ত, মুসলমান মহিলাদের অবমাননাকর ও দুর্দশার মুখে ঠেলে দেওয়ার বরাবরের প্রচলিত ‘তিন তালাক’ রীতি বেআইনি ঘোষণা করে সাজার ব্যবস্থা করা। মুসলমান সমাজে পুরুষ ও মহিলাদের মধ্যে লিঙ্গবৈষম্য বিলুপ্ত করতে এই আইন ছিল অত্যন্ত সময়োপযোগী। শুধু তাই নয়, বিভিন্ন সম্প্রদায়ের মধ্যে বলবৎ থাকা ব্যক্তিগত আইনগুলি সকল সম্প্রদায়ের মধ্যেই কোনো ব্যতিক্রম ছাড়াই সমসাময়িক সময়ের পক্ষে যা মঙ্গলজনক বা ক্ষতিকারক তা বিচার করে নিয়মিত পরিবর্তন ও পরিমার্জন করা উচিত। এই আইন প্রণয়ন এই নীতিকেই প্রতিষ্ঠিত করেছে।
সর্বশেষে নাগরিকত্ব সংশোধনী আইন। বিশেষ করে পূর্ব ভারতে দেশভাগ হওয়ার পর যে জ্বলন্ত সমস্যা দীর্ঘদিন ধরে ধূমায়িত হচ্ছে তার একটি নীতিগত ও মানবিক সমাধানের ব্যবস্থা করা। অনেকে দীর্ঘদিন ধরে পাশ কাটিয়ে যাওয়া এই দেশরই মূল অধিবাসীদের হিতে লাগু হওয়া আদ্যন্ত মানবিক এই আইনকে উদ্দেশ্যপ্রণোদিত ভাবে বিভেদমূলক আখ্যা দিচ্ছেন। আদতে এটি একটি নির্ণায়ক সিদ্ধান্ত যার ফলে প্রতিবেশী দেশ থেকে আসা শরণার্থীরা অন্যান্য ভারতীয়দের মতোই নাগরিকত্ব পাবে।
১৯৪৭ সালের আগস্ট মাসের সংযুক্ত আইনসভায় তার মধ্যরাতের ঐতিহাসিক ভাষণে জওহরলাল নেহরু ইঙ্গিতবহভাবে বলেছিলেন, একটি দীর্ঘ পদানত, অবদমিত জাতির আত্মাকে মূর্ত রূপ দেবার সময় এসেছে।আজ ভাবতে অবাক লাগে ভারতে ইতিপূর্বে এত কম সময়ের মধ্যে একটি সম্মিলিত নাগরিকত্ব (composite citizenship) প্রদানের ভাবনাকে বাস্তব রূপ দিয়ে এক বৃহৎ জাতি গঠনে সম্ভাবনাকেই সফল করে তুলতে আদৌ কোনো সরকার কখনও চেষ্টা করেছিল কিনা?
দেশের মধ্যে সরকারের নাগরিকদের মঙ্গলের জন্য লাগু করা বিভিন্ন প্রকল্পগুলির দ্রুত সফল রূপায়ণের জন্য সর্বাধুনিক প্রযুক্তির প্রয়োগ করে নাগরিকদের জীবনযাত্রার মানোন্নয়ন ঘটিয়ে তাদের স্বাভিমানী জাতীয়তাবাদী ভাবধারায় উদ্বুব্ধ করে তুলতে তাঁর সরকার সদা সচেষ্ট। অনুমান অনুযায়ী সরকারের এই লক্ষ্যের সঙ্গে দেশের বিভিন্ন রাজ্যগুলিকে আধা বিচ্ছিন্ন রেখে কিছুটা এলোমেলো ভাবে চলতে দেওয়া মতাবলম্বীদের সঙ্গে বিরোধিতা অবশ্যম্ভাবীই ছিল। আজকের তারিখে দ্বিতীয় মোদী সরকারের ভবিষ্যৎ কর্মপন্থা ঠিক কোন পথে চলবে তা নিশ্চিত করে বলা মুশকিল। তবে এটা নিশ্চিত বিগত ৩০ বছর ধরে ভারতীয়রা ক্রমাগত সমৃদ্ধির সোপানে ওঠার যে পথ অনুসরণ করছিল সাময়িকভাবে এই কোভিড-১৯ মহামারীর প্রকোপে তাতে কিছুটা ছেদ পড়বে। কিন্তু বাস্তবের সঙ্গে কতদুর খাপ খাওয়াতে হবে তা সঠিক করে কিছু বলা যাচ্ছে না।
আমার ধারণায় মোদী যে ‘আত্মনির্ভর ভারতের রূপরেখা দিয়েছেন তা বাস্তবে সরকারের প্রথম ১০ মাসে নেওয়া সুদূরপ্রসারী সিদ্ধান্তগুলির মতোই বিভিন্ন ক্ষেত্রে সম্প্রসারিত হবে। কোভিডের আক্রমণে অবশ্যই পরিস্থিতির মোকাবিলার পন্থা বদল হবে, গাড়ির গিয়ার বদলানোর মতো কর্মপদ্ধতিতে কিছু এদিক ওদিকও হয়তো হবে, কিন্তু এটা নিশ্চত অভিষ্ট লক্ষ্যপথে কোনো পরিবর্তন হবে না।
স্বপন দাশগুপ্ত