দেশ আজ একটি আপৎকালীন পরিস্থিতির মুখােমুখি। দেশকে টিকাকরণের মাধ্যমে নিরাপদ করে পূর্বাবস্থায় ফিরিয়ে আনা সময়ের দাবি। এটি কোনাে নির্দিষ্ট ডিপার্টমেন্টের কাজ নয়, সমগ্র সরকারি বিভাগকে একযােগে হাত লাগিয়ে এটিকে “মিশন মােড-এ প্রয়ােগ করতে হবে।
আজকের যা পরিস্থিতি তাতে সমস্ত রকম পদ্ধতির সাবধানতা অবলম্বনের পরও দেশে করােনার বৃদ্ধি জারি আছে। সকলের উৎকণ্ঠিত দৃষ্টি প্রতিষেধক টিকার ওপর। কখন সেটি হাতে পাওয়া যাবে।
এখন প্রশ্ন উঠবে, হাতে পেলেই কি এত বড়াে জনসংখ্যার দেশে রাতারাতি টিকাকরণ সম্ভব? ১৩০ কোটিকে টিকা দিতে আমাদের। সিস্টেম কতটা প্রস্তুত। এ প্রসঙ্গে সরকারকে প্রথম পদক্ষেপ হিসেবে কোন কোন টিকাগুলি অনুমােদিত হয়েছে তার পঞ্জীকরণ করতে হবে। কিন্তু এর মধ্যে থেকেও যে কোনাে সময় কোনােটি বাদ যেতে পারে এবং আরও উন্নত কোনাে অন্তর্ভুক্ত হতে পারে। টিকা আবিষ্কারের প্রচেষ্টা বিশ্বব্যাপী অব্যাহত।
দ্বিতীয়ত, সরকার প্রত্যেক রকমের টিকার নির্দিষ্ট দাম বেঁধে দেবে। এরপর যথােপযুক্ত ব্যবস্থা নিয়ে কোন কোন সংস্থা টিকা দেওয়ার অধিকার পাবে তার তালিকা তৈরি করবে। এগুলি সরকারি হাসপাতাল, নামকরা। বেসরকারি হাসপাতাল, ডায়গনস্টিক সেন্টার যার মান প্রতিষ্ঠিত এমনকী সুনামের সঙ্গে কাজ করে আসা ওষুধের দোকানগুলিও হতে পারে। কয়েক লক্ষ মানুষকে উপযুক্ত প্রশিক্ষণ দিয়ে টিকা কীভাবে মানব শরীরে দেওয়া হবে সে বিষয়ে প্রশিক্ষিত করে তােলার বিষয়টিও আছে। নাগরিকদের জন্য নির্দিষ্টকরে কোথায় কোন প্রতিষ্ঠানে টিকাকরণ হচ্ছে তা প্রচারপত্র মাধ্যমে জানাতে হবে। এই স্থানগুলি প্রতিষ্ঠিত, চটজলদি তৈরি করে নেওয়া বা বিভিন্ন এলাকায় চলমান স্টেশনও হতে পারে। অর্থাৎ টিকা যেন দেশের সর্বত্র উপলব্ধ হয়। সরকার এই মর্মে নির্দিষ্টটিকাকরণ সংক্রান্ত সফ্টওয়ার তৈরি করবে যা স্মার্টফোন ও ল্যাপটপে সংযুক্ত করে ব্যবহার করা যায়। এগুলি নির্দিষ্ট স্থানগুলিতে বিতরণ করা হবে যাতে একেবারে প্রতিটি টিকাকরণ সঠিকভাবে সেই মুহূর্তে নথিবদ্ধ ও ক্যামেরাবন্দি হয়। এরপরই তা দ্রুত কেন্দ্রীয় ডাটা সেন্টারে পাঠানাে হবে অবশ্যই গােপনীয়তা নিরাপত্তা ও তথ্যভুক্তির সঙ্গে। এই পদ্ধতির মাধ্যমে ১ বছরের মধ্যে দেশে ১ লক্ষ টিকাকরণ কেন্দ্র তৈরি করে নেওয়া যাবে। অন্যদিকে দেশের অভ্যন্তরে টিকার উৎপাদন ক্রমবর্ধমান হারে চলবে।
এক্ষেত্রে অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ হয়ে উঠবে সরবরাহ শৃঙ্খল যার মধ্যে টিকা যথাযথ সংরক্ষণের জন্য কোল্ড চেইন তৈরির পরিকাঠামােও আবশ্যিক। টিকার বিক্রি নিয়ন্ত্রিত হবে অনুমােদিত বিক্রেতা ও অনুমােদিত প্রদানকারী সংস্থার মধ্যে সরাসরি। প্রদানকারীদের অবশ্যই কোল্ড চেইন-এর পরিকাঠামাে থাকতেই হবে। টিকাকরণকে কেন্দ্র করে অর্থনীতিতে একটা বড়াে জোয়ার আসতে পারে। নতুন মােবিল কোল্ড চেইন। তৈরি হলে অজস্র বাতানুকূল ট্রাকের প্রয়ােজন হবে। বর্তমানে যে কোল্ড চেইনগুলি ততটা ব্যবহৃত হয় না সেগুলিকে সফল করে ব্যবসার নতুন গতিমুখ খুলে দেওয়া যাবে। পরিকাঠামাে এমন হবে যে, দেশের মানুষ যেন যে কোনাে মুহূর্তে যে কোনাে অঞ্চলে উপযুক্ত টিকাকরণ কেন্দ্র পেয়ে যেতে পারে। তারা আবার সুবিধে মতাে সময়ে টিকা নেওয়ার জন্য অনলাইনে বুকিংও করে নিতে পারে। তবে কোনাে টিকাকরণ কেন্দ্রে গেলে প্রথমেই নিজের পরিচয় নিশ্চিত করতে হবে। তাদের আধার বা ফোন নাম্বারের মতাে কোনাে পরিচয়পত্র দিতে হবে সেগুলি কেবল ডিজিটালি পরীক্ষা করা যায়। একজন অনুমােদিত প্রশিক্ষিতই টিকা দেওয়ার অধিকারী। এই তথ্য টিকাকরণের সঙ্গে সঙ্গেই আপলােড হবে। এর মধ্যে টিকা প্রদানকারী ও গ্রহীতার নাম ও পরিচয়পত্রের অনুলিপি থাকবে। থাকবে টিকাটির নিজস্ব ব্যাচ নম্বর থেকে অন্য বিশদ তথ্য। গ্রহীতাকে যে অর্থ এ বাবদ দিতে হবে। তা সঙ্গে সঙ্গেই টিকা প্রদানকারী সংস্থার অ্যাকাউন্টে জমা পড়ে যাবে। সেই মুহূর্তেই কেন্দ্রীয় তথ্যভাণ্ডার থেকে এই মর্মে গ্রহীতার নামে একটি সার্টিফিকেট তৈরি হয়ে যাবে। এই প্রমাণপত্র স্মার্টফোনে ডাউনলােড করে নেওয়া যাবে, প্রয়ােজনে প্রিন্ট আউট নেওয়া চলবে বা ডিজিটাল লকারেও রেখে দেওয়া যেতে পারে। এই গােটা প্রক্রিয়াটা কিন্তু ১০ মিনিটের মধ্যে শেষ হবে। প্রত্যেকটি টিকাকরণ কেন্দ্রে দিনে ৫০টি টিকাকরণ করতে পারলে (যা মােটেই অসম্ভব নয়) ভারত প্রতিদিন ৫০ লক্ষ নাগরিকের টিকাকরণ সফলভাবে করতে সক্ষম। হবে।
এই ডিজিটাল সার্টিফিকেট কিন্তু বিশ্বব্যাপী মান্য হবে এবং যে কোনাে সময় মূল ডাটা বেসের সঙ্গে চেক করে নেওয়া যাবে। কোনাে ব্যক্তির কোনাে রােগ প্রতিরােধ ক্ষমতা আছে কিনা তা অনেক সময়ই আন্তর্জাতিক ক্ষেত্রে প্রশ্নের মুখে পড়েছে। এ বিষয়ে ইয়ােলাে ফেভারের ক্ষেত্রে আন্তর্জাতিক স্বাস্থ্য নিয়ামক সংস্থা প্রমাণপত্র চেয়েছিল। এটিই হবে সেই প্রমাণপত্র। সংশ্লিষ্ট ব্যক্তি প্রমাণপত্র নিয়ে বিশ্বের যে কোনাে অঞ্চলে নিশ্চিন্তে ভ্রমণ করতে পারবেন। আবার যদি দেখা যায় টিকার প্রতিরােধ ক্ষমতা নির্দিষ্ট সময়সাপেক্ষ সেক্ষেত্রে প্রমাণপত্রের ওপর এক্সপায়ারি ডেট লেখা থাকবে। ওই ব্যক্তিকে পুনর্টিকাকরণ করতে হবে। টিকা যদি ২ ডােজের হয় সেক্ষেত্রে প্রভিশনাল সার্টিফিকেট দিয়ে পরবর্তী তারিখ উল্লেখ করে দেওয়া হবে। যে সমস্ত নাগরিকের আর্থিক সামর্থ্য আছে তারা নিজ খরচে টিকাকরণ করবে। সরকারের তরফে নিখরচায় সমস্ত স্বাস্থ্যকর্মী, অন্যকর্মী ও তাদের পরিবারের সঙ্গে সঙ্গে গরিব ও‘কোভিডে’সংক্রমিত হওয়ার বেশি সম্ভাবনাময় লােকজনকে অগ্রাধিকারের ভিত্তিতে টিকাকরণ করার ব্যবস্থা করতে হবে। বিভিন্ন কোম্পানিগুলি তাদের কর্মী ও পরিবারের টিকার খরচের দায়িত্ব নেবে। বিভিন্ন দাতব্য সংস্থা ও করপােরেট ফাউন্ডেশন ব্যাপকভাবে অংশগ্রহণ করতে পারে। গরিব নাগরিকের তরফে তারা প্রয়ােজনীয় অর্থ জমা করে তাদের টিকাকরণের পথ সুগম করতে পারে।
একটি টিকার কার্যকারিতার সময়কাল সবসময়ই পর্যবেক্ষণের মধ্যে রাখার দরকার হয়। এর পার্শ্বপ্রতিক্রিয়াগুলি সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিরা নিজেদের টিকাকরণ কেন্দ্রে জানিয়ে দিলে সমগ্র দেশের পক্ষে ডিজিটাল রেকর্ডে প্রয়ােজনীয় সংশােধন এনে ব্যবস্থাটিকে স্বয়ংসম্পূর্ণ করা সহজ হবে। উদাহরণ স্বরূপ বলা যায় যদি দেখা যায় টিকাকরণ সত্ত্বেও কোনাে অঞ্চলে ‘কোভিডের প্রকোপ বাড়তে শুরু করল তাহলে বুঝতে হবে টিকার কার্যকারিতা প্রত্যাশামাফিক হয়নি। অন্যদিকে কিছু কিছু উপসর্গের অপ্রত্যাশিত বৃদ্ধি ঘটলে বুঝতে হবে সেটা টিকার পার্শ্বপ্রতিক্রিয়া। এক্ষেত্রে আর্টিফিসিয়াল ইনটেলিজেন্স-এর মাধ্যমে বিশ্লেষণ করা যেতে পারে।
প্রথম দিকে যখন বাজারে পর্যাপ্ত টিকার জোগান থাকবে না তখন এই ভাবেই প্রক্রিয়াটিকে লাগু করতে হবে। আগে বলা নির্দিষ্ট জরুরি পরিষেবার কর্মীদের ওপর এর পরবর্তী ধাপে থাকবেনতুন টিকা সম্পর্কে আতঙ্ক, এক শ্রেণীর মানুষের টিকাকরণে। অনীহা। কিন্তু আমাদের সম্পূর্ণ টিকাকরণে এগিয়ে যেতেই হবে। আর একটি উল্লেখযােগ্য দিক হলাে এই টিকাকরণ পদ্ধতির মাধ্যমে প্রধানমন্ত্রীর ন্যাশনাল ডিজিটাল হেৰ্থ মিশনের কাজকেও এক লাফে অনেক এগিয়ে নেওয়া যাবে। প্রত্যেক নাগরিক ভােটার কার্ডের মতাে একটি স্বাস্থ্য পরিচয়পত্রে তার টিকার বিবরণও থাকবে। কেন্দ্রীয় কর্মীবর্গ বিভাগ ও শিক্ষা দপ্তরের ‘দীক্ষা প্লাটফর্মের মাধ্যমে টিকা প্রদানকারীদের প্রশিক্ষিত করতে ট্রেনিং মােডিউল দেওয়া যেতে পারে। জাতীয় স্বাস্থ্য মিশন ইতিমধ্যেই যে ডিজিটাল হেথ মিশনের পরিকাঠামাে তৈরি করেছে তার মাধ্যমে কারা আয়ুষ্মন ভারত প্রকল্পের অংশীদার তা নিশ্চিত তাে হয়েই আছে। তাদের টাকা দেওয়ার প্রশ্ন নেই।
সরকারের ই-মার্কেট প্লেস (জিইএম) প্রকল্পে কোন কোন টিকা অনুমােদিত হলাে তার নাম ও দাম উল্লেখ করা থাকবে, অনুমােদিত টিকা প্রদানকারী সংস্থা সরাসরি সেখানেই বরাত দিতে পারবে। অর্থমন্ত্রকের বহু প্রকল্পে ডাইরেক্ট বেনিফিট ট্রান্সফারের (ডিডিটি) ব্যাপক অভিজ্ঞতা রয়েছে। এর সঙ্গে নতুন টিকার অর্থপ্রদানের ক্ষেত্রটি যােগ করতে কোনাে অসুবিধে নেই। বহু কৃতবিদ্য আমলা যাঁরা আধার কার্ড প্রস্তুতির সময় অসাধারণ কাজ করেছিলেন তারা আজ প্রবীণ হয়েছেন বা সদ্য অবসর নিয়েছেন। তারা ডাকলে সানন্দে তাদের অভিজ্ঞতা এই প্রকল্পেও নিয়ােজিত করতে দ্বিধা করবেন না। শুধু তাই নয়, বহু উন্নত মেধার প্রযুক্তিবিদ রয়েছেন যাঁরা নিজেদের মেধা দিতে উদগ্রীব, যেহেতু দেশ আজ একটি আপৎকালীন পরিস্থিতির মুখােমুখি। দেশকে টিকাকরণের মাধ্যমে নিরাপদ করে পূর্বাবস্থায় ফিরিয়ে আনা সময়ের দাবি। এটি কোনাে। নির্দিষ্টডিপার্টমেন্টের কাজ নয়, সমগ্র সরকারি বিভাগকে একযােগে হাত লাগিয়ে এটিকে ‘মিশন মােড-এ প্রয়ােগ করতে হবে। আমরা এ কাজে সফল হলে সারা বিশ্বের কাছে। একটি উদাহরণ সৃষ্টি হবে যে, কীভাবে মহামারীর সফল মােকাবিলা করতে হয়। এই সম্মিলিত উদ্যোগ ও সফলতা ‘আত্মনির্ভরতা’-র পথে হবে সেরা পদক্ষেপ।
নন্দন নিলেকানি
(লেখক ইনফোসিসের চেয়ারম্যান ও যুগ্ম প্রতিষ্ঠাতা এবং ইউনিক আইডেন্টিফিকেশনের অথরিটি অব ইন্ডিয়ার পূর্বতন চেয়ারম্যান)
2020-09-08