করোনার কারণে রাজ্যের স্বাস্থ্য-ব্যবস্থা বিপর্যস্ত

আমাদের দেশে করোনা ভাইরাসের সংক্রমণ এই প্রথম, কিন্তু করোনা ভাইরাস আগেও খবরে উঠে এসেছিল ২০০৩ সালে ‘সার্স-করোনা ভাইরাস’ এবং ২০১২ সালে মধ্যপ্রাচ্যে‘মার্স-করোনা ভাইরাস’নাম নিয়ে। সে দুটি একটু বেশিমাত্রায় সাংঘাতিক ছিল। যে ভাইরাস রোগীকে বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই মেরে ফেলে, তা বেশিদিন বংশবৃদ্ধি করতে বা ছড়াতে পারে না। তাই ওই অসুখগুলো পৃথিবীব্যাপী ছড়ানোর আগেই স্তিমিত হয়ে গিয়েছিল। বর্তমান এই কোভিড-১৯ নতুন আর এক করোনা ভাইরাস। এর সংক্রমণ চীনা সংবাদমাধ্যম প্রকাশ করেছিল ২৯ ডিসেম্বর ২০১৯ সালে। ৩০ জানুয়ারি ২০২০-তে আমাদের দেশে এর প্রাদুর্ভাব তথা সংক্ৰমণ শুরু হয়।

ভারতের মতো বিশাল ও জনবহুল দেশে আক্রান্ত, সুস্থ হয়ে ওঠা ও মৃতের সংখ্যা কিন্তু এখন পর্যন্ত বিশেষ ভীতিপ্রদ বা হতাশাব্যঞ্জক বলা চলে না। আক্রান্ত মানুষের সংখ্যার হিসেবে ভারত বিশ্বে চতুর্থ স্থানে উঠে এসেছে বলে খুঁতখুঁজে বেড়ানো খবরের মিডিয়াগুলো হৈচৈ করলেও জনসংখ্যার নিরিখে বিচার করলে এই মুহূর্তে আক্রান্ত মানুষের সংখ্যায় ভারতের স্থান ১৩৭ নম্বরে! আর মৃত্যুর কথা ধরলে জসংখ্যার বিচারে ভারতের স্থান ১১৩ নম্বরে। প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদী একদম সঠিক সময়ে লকডাউন না ঘোষণা করলে আমাদের অবস্থান যে ঠিক উলটো হতো, এতে কোনও সন্দেহ নেই।

কিন্তু আমাদের দুর্ভাগ্য, এই রাজ্যে পদে পদে প্রধানমন্ত্রীর বিরোধিতা করা হয়। সেই বিরোধিতার ফিরিস্তি দেবার পরিসর এই প্রতিবেদনে নেই, কিন্তু স্বাস্থ্যক্ষেত্রে এই রাজ্যে যে চরম নৈরাজ্য চলছে, তার অন্যতম কারণ এই অন্তঃসারশূন্য মোদী-বিরোধিতা। স্বাস্থ্য দপ্তরের ওয়েবসাইট খুলে রাজ্যের স্বাস্থ্য-বিষয়ক তথ্যাদি ও পরিসংখ্যান খুঁজতে গেলে দেখা যাবে, সেখানে প্রাপ্তব্য সর্বশেষ পরিসংখ্যান হলো ২০১৫-১৬ সালের একটি প্রকাশনা— হেথ অন দ্য মার্চ ২০১৫-১৬, যেটিতে ব্যবহৃত পরিসংখ্যান ২০১৪-রও আগের। বর্তমানের এই গতিশীল জগতে ঠিকঠাক এবং সময়োচিত পরিসংখ্যান না পেলে কোনো কর্মকাণ্ডইচলতে পারে না, কিন্তু এই রাজ্য তো শুধুমাত্র মুখের কথার ফুলঝুরিতেই চলছে, কাজে নয়!

ঠিক এই রকমের একটা ব্যাপারই ঘটেছে করোনার ক্ষেত্রেও। মহামারী বিষয়টার গুরুত্ব অনুধাবন করে ‘এপিডেমিক ডিজিজেস অ্যাক্ট ১৮৯৭ অনুসারে দিল্লি থেকে লকডাউন ঘোষণা হলো, আর আমরা এই রাজ্যে কী দেখলাম? দেখলাম, অনুপ্রাণিত উপদেষ্টারা লকডাউনের গুরত্ব তঁাকে যেমনটি বুঝিয়েছেন, সেই মতনই আমাদের মুখ্যমন্ত্রী দলবল নিয়ে সারা কলকাতা চষে বেড়িয়ে বাজারে রাস্তায় গোল্লা আঁকছেন। মানুষ ঠিক কোথায় দাঁড়িয়ে বাজার করবেন তা বোঝাতে। আর মানুষ ভিড় করে কৌতূহলের সঙ্গে সেই সমস্ত ক্রিয়াকলাপ লক্ষ্য করছেন। লকডাউনের মতো এমন একটি জরুরি ও অবশ্যপালনীয় বিষয়কে দিনের পর দিন এই। রকম খেলো করে দেবার ফলশ্রুতি এই হয়েছে। যে, রাজ্যের মানুষলকডাউন বিষয়টা আদপেই গুরুত্বের সঙ্গে নিতে পারেননি এবং না পেরে লকডাউন কার্যত ব্যর্থ করে দিয়েছেন। ফলে যা হবার তাই হয়েছে। সংক্রমণ হু হু করে বেড়ে চলেছে, সেটা ঢাকার জন্য তার উপদেষ্টারা সঠিক পরিমাণে টেস্ট করাননি, তাঁকে খুশি করার জন্য করোনায় মৃত্যুকে অন্য রোগে মৃত্যু বলে চালিয়ে মৃত্যুর সংখ্যা কম দেখিয়েছেন। আমাদের একটিবারের জন্যও মনে হয়নি যে, একটা মহামারী পরিস্থিতিতে লকডাউনের আসল উদ্দেশ্য ঠিক কী, তাঁর। উপদেষ্টাদের কারুর সেই বোধ বা উপলব্ধি আদৌ ছিল। মহামারী সর্বদাই অতীব দ্রুতগতি সম্পন্ন একটি বিপর্যয় , যা অত্যন্ত অল্প সময়ে স্বাস্থ্য ব্যবস্থার সম্পূর্ণ ভরাডুবি করতে সক্ষম। লকাডউন তার বিরুদ্ধে লড়ার এক অতি প্রাথমিক অস্ত্র, যা সুচারুভাবে ব্যবহার করা হলে যে অতিরিক্ত সময় পাওয়া যায়, সেই সময়ের সুযোগে মহামারীর সঙ্গে যুঝবার জন্য প্রয়োজনীয় সৈন্যবল, রসদ এই সমস্তই সুসংহত ও সঠিক স্থানে উপস্থাপিত করে ফেলে প্রস্তুতিপর্ব সেরে ফেলার কথা। যাতে স্বাস্থ্য ব্যবস্থার নাগালের মধ্যেই রোগ ও রোগীর সংখ্যা রাখা যায়। সেই অবশ্য প্রয়োজনীয় কাজটাই করা হয়নি।

এই চরম অদূরদর্শিতার যা প্রত্যাশিত ফল হবার কথা, ঠিক তাই হয়েছে। আজ একটা বেডের জন্য হাসপাতালে হাসপাতালে হাহাকার। আমরা সবাই দেখেছি, অ্যাম্বুলেন্স গায়ে লেখা থাকে : ‘সংক্রামক। ব্যাধির জন্য নহে’। সংক্রামক ব্যাধির জন্য অ্যাম্বুলেন্স যদি না হয় তবে হাসপাতালগুলোই বা তা হবে কেন? আর তা যদি না হয়, তবে করোনা আক্রান্তরা যাবেন কোথায় ? এই বিষয়টা যে চিন্তাভাবনা করে গুছিয়ে পরিকল্পনা করে রাখার কথা, তা করাই হয়নি। আজ রাজ্যের বেসরকারি হাসপাতালগুলো ‘করোনা-প্যাকেজ’নাকি দশ-বারো লক্ষ টাকা বা আরও চড়া দামে বিক্রি করছে, ভেন্টিলেটর দরকার হলে দর আরও বেশি। সরকারি হাসপাতালে বেড পাওয়া যায় না, যদিও রাজ্য সরকারের তথ্য অনুসারে কোভিডের জন্য রাখা বেডের ব্যবহারের হার নাকি ২৩.৯২ শতাংশ, অর্থাৎ প্রচুর বেড খালি রয়েছে, কোনো চিন্তা নেই। ডাক্তার-সহ স্বাস্থ্যকর্মীরা সুরক্ষা-ব্যবস্থার অপ্রতুলতার কারণে দলে দলে করোনায় সংক্রমিত হয়ে কোয়ারেন্টিনে চলে যাচ্ছেন, যার ফলে হাসপাতালের দপ্তরের পর দপ্তর, ওয়ার্ডের পর ওয়ার্ড বন্ধ করে দিতে হচ্ছে। ফলে এমনিতেই যে ব্যবস্থার ভাড়ে মা ভবানী, তাতে পরিষেবা সংকোচনের ফলে পরিস্থিতি আরও ভয়াবহ আকার ধারণ করছে।

‘অসুখ হয়েছে, পর্যাপ্ত চিকিৎসা ব্যবস্থা নেই’ এই রকমের পরিস্থিতি অবশ্য রাজ্যে নিতান্তই নিত্যনৈমিত্তিক ব্যাপার। কিন্তু করোনার চিকিৎসা করতে গিয়ে অন্যান্য পরিষেবার কী হাল? এই মুহূর্তেরাজ্যে শুধুমাত্র করোনার চিকিৎসার জন্য ৬৯টি হাসপাতালকে নির্দিষ্ট করে দেওয়া হয়েছে। ওই হাসপাতালগুলো নিশ্চয়ই খালি পড়ে থাকতো না?তবে করেনার প্রাদুর্ভাবের আগে যে রোগী সেখানে ভর্তি হতেন বা চিকিৎসা পেতেন, তারা কোথায় গেলেন?নাকি সেই সমস্ত অসুখ আর হয়ই না?

আমাদের দেশে যে রোগগুলো সাধারণত হয়ে থাকে, তাদের মধ্যে প্রথম ১৫টি রোগ হলো : (১) হৃদ্‌রোগ, (২) মস্তিষ্কের স্ট্রোক, (৩) আত্মহনন, (৪) ফুসফুসের সংক্রমণ, (৫) দাস্ত, (৬) শ্বাসকষ্ট জনিত রোগ, (৭) দুর্ঘটনা, (৮) প্রসব-সংক্রান্ত অসুখ, (৯) যক্ষ্মা, (১০) রেচনতন্ত্রের অসুখ, (১১) এইডস, (১২)নবজাতকের অসুখ, (১৩) মধুমেহ (ডায়াবেটিস), (১৪) জলে ডোবা, (১৫)নবজাতকের মস্তিষ্ক-প্রদাহ।

তাহলে এই অসুখগুলো কোথায় গেল? এও কি সম্ভব যে আজ করোনা মহামারী এসেছে বলে ওই সমস্ত অসুখ বিদায় নিয়েছে? কারুরই আর হৃদরোগ হচ্ছে না? কারুর আর মস্তিষ্কের স্ট্রোক হচ্ছে না? কেউ আর শ্বাসকষ্টেভুগছেন না? কোনও শিশুর আর দাস্ত অর্থাৎ ডায়রিয়া হচ্ছে না?

এশিয়ার প্রথম ডাক্তারি শিক্ষার প্রতিষ্ঠান ১৮৩৫ সালে স্থাপিত বেঙ্গল মেডিক্যাল কলেজ, সারা ভারতের গর্ব কলকাতা মেডিক্যাল কলেজ আজ করোনা হাসপাতাল। সেখানে অন্য সমস্ত রোগের চিকিৎসা, ছাত্র-ছাত্রীদের পঠন পাঠন সমস্তই লাটে উঠেছে। কর্তাব্যক্তিদের কে বোঝাবে, শীর্ষ ডাক্তারি শিক্ষা-প্রতিষ্ঠানগুলোকে কখনও এইরকম ‘ধর তক্তা মার পেরেক ভঙ্গিতে একটিমাত্র অসুখের হাসপাতাল করে দেওয়া যায় না। বহু ক্যান্সারের রোগী সেখানে নিয়মিত চিকিৎসা পেতেন। বহু ডায়াবেটিস রোগী, বহু হৃদরোগের রোগী, অন্যান্য বিভিন্ন স্পেশ্যালিটি বা সুপার স্পেশ্যালিটি বিভাগে হাজার হাজার লোক সেখানে রোজ দেখাতে আসতেন। প্রতি বছর ওই হাসপাতালে ২৫০ জন ছাত্র-ছাত্রী এমবিবিএস পাঠক্রমে ভর্তি হয়, সেখানে বহু স্নাতকোত্তর পাঠক্রমে অনেক ছাত্র-ছাত্রী পড়াশুনো করেন। প্রতিদিন হাজার হাজার ল্যাবরেটরি টেস্ট হয়, এক্সরে বা ইসিজির মতো জরুরি পরীক্ষা নিরীক্ষা বহু গরিব রোগী বিনে পয়সায় করান। তাঁদের সবার কী হবে? আছে কি কোনও পরিকল্পনা ? যে মেডিক্যাল কলেজে দৈনিক ১২০০০ মানুষের পদার্পণ ঘটতো, সেটি আজ শ্মশানে পরিণত হয়েছে।

পূর্ব ভারতের সংক্রামক রোগের চিকিৎসার অন্যতম বৃহৎ প্রতিষ্ঠান আই-ডি হাসপাতালে দৈনিক গড়ে ৯৫টি অ্যানিম্যাল বাইট (প্রধানত কুকুরের কামড়ের রোগী) আসত। এপ্রিল মাস থেকে আসছে দৈনিক গড়ে ১১ জন। এর অর্থ কি এই যে, কুকুর আর কামড়াচ্ছে না? আর এই কথা বললেও তো চলবেনা—রাজ্যে লকডাউন এতই গুরুত্ব দিয়ে পালন করা হয়েছে যে কুকুর আর কামড়ানোর লোক পাচ্ছে না। এসব কথা বললে কুকুরগুলোও হাসবে! রাজ্যের এতই উন্নতি হয়ে গেল? তা যদি না হয় তবে এই প্রয়োজনীয় পরিষেবা যাঁদের দরকার, তারা কী অবস্থায় আছেন? এই আই-ডি হাসপাতাল রাজ্যের একমাত্র সংক্রামক রোগের চিকিৎসার শীর্ষ শিক্ষা প্রতিষ্ঠান যা সপ্তাহে সাত দিন রোজ চব্বিশ ঘণ্টাই পরিষেবা দেয়। কিন্তু এই হাসপাতালটিতে না আছে স্থায়ী বিশেষজ্ঞ বা ন্যূনতম সংখ্যক চিকিৎসক, না আছে পর্যাপ্ত নার্সিং স্টাফ। এই প্রতিবেদক ওই হাসপাতালের অধ্যক্ষ থাকাকালীন বহু চেষ্টা করেছিলেন এখানে সংক্রামক রোগের স্নাতকোত্তর পাঠক্রম চালু করার জন্য, যাতে করে রাজ্যে ডাক্তারি শিক্ষাক্ষেত্রে শিক্ষকের এবং ন্যূনতম পরিষেবার চরম অভাবের কিছুটা সুরাহা হতে পারে, কিন্তু দেখা গেছে কর্তৃপক্ষের পরিষেবা উন্নয়নের বিষয়ে বিন্দুমাত্র মাথাব্যথা নেই। আজ হঠাৎ করে একটা সংক্রামক রোগের মহামারী নয়, প্যানডেমিক অর্থাৎ বিশ্ব-মহামারী আবির্ভূত হয়ে এই কূপমণ্ডুকদের পরিকল্পনাহীনতা একেবারে চোখে আঙুল দিয়ে দেখিয়ে দিয়েছে। সংক্রামক রোগের চিকিৎসা, গবেষণা, পঠনপাঠন ইত্যাদির যে বিপুল প্রয়োজন বর্তমানে রয়েছে এবং ভবিষ্যতেও থাকবে, যার সুচারু ব্যবস্থা আমাদের দেশের অন্যান্য রাজ্যে এবং অন্যান্য উন্নত দেশগুলোতে অবশ্যই রয়েছে, সেই কথা যে কোনও দায়িত্বশীল ও বিচক্ষণ প্রশাসক বুঝবেন, কিন্তু এই রাজ্যের অভিধানে দায়িত্বশীলতা ও বিচক্ষণতা এই দুটো শব্দের কোনওটারই অস্তিত্ব নেই। মহামারী মাসে মাসে হয় না, প্যানডেমিকও ফি-বছর ঘুরে ঘুরে আসে না। কিন্তু পর্যাপ্ত পরিকাঠামো-যুক্ত সংক্রামক রোগের একটি শীর্ষ শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান যে রাজ্যে অবশ্যই থাকা উচিত, সেই বোধবুদ্ধি রাজ্যের স্বাস্থ্যকর্তাদের নেই। এখানে তোড়জোড় চলে সংক্রামক রোগের এই সুবৃহৎ হাসপাতালটিকে স্কুল অব ট্রপিক্যাল মেডিসিনের মতো ছোট্ট ও অঞ্চলভিত্তিক একটা দপ্তরের পঠনপাঠনের ছাতার তলায় নিয়ে যাবার। অতীতে আন্তর্জাতিক ভ্রমণের অসুবিধের দিনগুলোতে পৃথিবীর ট্রপিক্যাল অঞ্চলে বিশেষ কিছু আঞ্চলিক সংক্রমণজনিত অসুখের পঠনপাঠন হতো এই ট্রপিক্যাল মেডিসিন বিষয়টিতে। কিন্তু আজকের । সুপার সোনিক জেট আর হাই স্পিড ইন্টারনেটের গতিশীল যুগে সারা বিশ্বে এখন ওই সমস্তই সংক্রামক রোগের পঠনপাঠনে পড়ানো হয়, ট্রপিক্যাল মেডিসিনের মতো একটি বিলীয়মান ও ক্ষুদ্র পরিসরে নয়। কিন্তু আমাদের রাজ্যে এসব কথা শোনার ও বোঝার লোক নেই।

বিষয়টা হচ্ছে এই যে, আজ করোনা সমস্ত অসুখকে পেছনে ফেলে সামনের সারিতে এগিয়ে এলেও অন্যান্য সব অসুখই যেমন ছিল তেমনই আছে। শুধু অদূরদর্শী। পরিকল্পনাহীনতার জন্য আজ রাজ্যে চলছে সেই সমস্ত অসুখের চিকিৎসার চরম অব্যবস্থা। শুধুমাত্র করোনার চিকিৎসার জন্য যে ৬৯টি হাসপাতাল নির্দিষ্ট করা হয়েছে, তাদের মধ্যে ১৬টি সরকারি। অর্থাৎ সম্বলহীন, সঙ্গতিহীন মানুষ, যাঁদের অসুখ হলে একমাত্র গন্তব্য সরকারি হাসপাতাল, যেখানে এমনিতেই পরিষেবার বাতি টিম টিম করে জ্বলছে, সেখানে এই রকম পরিস্থিতিতে আরও ১৬টি হাসপাতাল কমে গেল। রাজ্যে করোনার জন্য নির্দিষ্ট করে দেওয়া হয়েছে ৮,৭৮৫টি বেড। এই বেডগুলো কি করোনার জন্য নতুন করে সৃষ্টি করা হয়েছে? মোটেই তা নয়। মোট হাসপাতাল-বেডের সংখ্যা থেকে হেঁটে ওই বেডগুলো করোনা রোগীদের জন্য নির্দিষ্ট করে দেওয়া হয়েছে।

আসল কথা হচ্ছে এই যে, পশ্চিমবঙ্গে রাজ্যে শুধু রাজনীতি করলেই চলে, কাজ করতে হয় না। বেশ কিছুদিন আগে এবিপি আনন্দের মতো অনুপ্রাণিত টিভি চ্যানেলের এক সাংবাদিকের প্রিয়জনকে নিয়ে বেডের খোঁজে এ-হাসপাতাল ও হাসপাতাল ঘোরার দুঃসহ অভিজ্ঞতার খবর আমরা সম্প্রচারিত হতে দেখেছি। তাতে ভাষ্যকার বলেছিলেন, পরিস্থিতি যে এতই সাঙ্ঘাতিক, নিজের রোগী। নিয়ে না ঘুরলে তা তারা জানতেই পারতেন না। সত্যি, কতটা অনুপ্রাণিত হলে পরে একজন অভিজ্ঞ সাংবাদিকের চোখ আর ক্যামেরার লেন্স কিছুতেই দেখতে পায় না দিনের পর দিন একটু চিকিৎসার জন্য হন্যে হয়ে ঘোরা সাধারণ মানুষের মর্মান্তিক হয়রানি! এই হচ্ছে এই রাজ্যের প্রকৃত চিত্র। করোনা-পূর্ব দুরবস্থার গোদের ওপর করোনার বিষ ফোড়ার ঘায়ে সাধারণ মানুষের নাভিশ্বাস উঠছে, আর তারা অসহায়ের মতো তাকিয়ে আছে ক্যালেন্ডারের পাতার দিকে— ২০২১ আর কতদূর?

অধ্যাপক উচ্ছল কুমার ভদ্র

(লেখক কলকাতা মেডিক্যাল কলেজের পূর্বর্তন অধ্যক্ষ)

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

This site uses Akismet to reduce spam. Learn how your comment data is processed.