ভারত -সহ সমগ্র বিশ্ব করােনা ভাইরাসের প্রকোপে উদ্ভূত পরিস্থিতির সঙ্গে লড়াই করে চলেছে। ভারতের বৈচিত্র্যপূর্ণ ও বিশাল জনসংখ্যার পরিপ্রেক্ষিতে এই যুদ্ধ বিশ্বের অন্য উন্নত ও শক্তিশালী দেশগুলির থেকে তুলনামূলকভাবে আমাদের অবস্থা অনেক সন্তোষজনক। এই প্রথম দেশবাসী লকডাউনের সম্মুখীন হয়েছে। এর সপক্ষে ও বিপরীত পরিণামের আলােচনাও সর্বত্র হয়ে চলেছে। ক্রমশ লকডাউন শিথিল করা হচ্ছে। সতর্কতার সঙ্গে আমাদের অগ্রসর হতে হবে। এই প্রকার নতুন ধরনের রােগের জন্য উদ্ভূত পরিস্থিতির মােকাবিলাও নতুন ধরনের হবে এবং এরপরে বিশ্বও আগের মতাে পরিস্থিতিতে বহাল থাকবে না। জনজীবনকে স্বাভাবিক জীবনযাত্রায় ফিরিয়ে আনা সহজ হয়ে উঠবে না। সংকল্পবদ্ধ হয়ে নতুন পথে একসঙ্গে দৃঢ়ভাবে এগিয়ে যেতে হবে।
করােনার বিরুদ্ধে লড়াইয়ে ভারত বিশ্বের অন্য দেশগুলির তুলনায় সম্পূর্ণ আলাদা এবং যথেষ্ট বিশেষতাও রাখে। বিশ্বের অধিকাংশ দেশে শাসনক্ষমতাই সর্বোপরি। সমাজের সমস্ত ব্যবস্থাপনা রাষ্ট্রের উপর ন্যস্ত। এই জন্য এদের কল্যাণকারী রাষ্ট্রে (ওয়েলফেয়ার স্টেট) আখ্যায়িত করা হয়। এই রকম বিপত্তিতে রাষ্ট্র ব্যবস্থায় প্রশাসন দ্রুততার সঙ্গে সক্রিয় হয়ে ওঠে এবং জনসাধারণও শাসনব্যবস্থার সক্রিয়তার জন্য অপেক্ষারত থাকে। কিন্তু ভারতীয় পরিস্থিতি এর থেকে আলাদা। ভারতীয় পপরম্পরায় সমাজের এক স্বতন্ত্র অস্তিত্ব রয়েছে। টানা-পােড়েন আছে, ভারতীয় সমাজের কিছু নিজস্বতাও রয়েছে। রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর তার স্বদেশী সমাজ’প্রবন্ধে স্পষ্টতই বলেছেন যে, ওয়েলফেয়ার স্টেট ভারতের পরম্পরা কখনই নয়। ভারতে পরম্পরার সঙ্গে যুক্ত কিছু গুরুত্বপূর্ণ বিষয়ই শুধু রাষ্ট্রের দায়িত্বে থাকে, অবশিষ্ট সমস্ত বিষয়গুলির ভাবনাচিন্তা রাষ্ট্রনিরপেক্ষভাবে সমাজ দায়িত্ব পালন করে চলেছে। তিনি স্পষ্টভাবে ব্যাখ্যা করেছেন, যে সমাজ নিজস্ব ব্যবস্থাপনার জন্য রাষ্ট্রের উপর ন্যূনতমভাবে নির্ভরশীল সেই সমাজকে ‘স্বদেশী’ সমাজ বলা হয়। আচার্য বিনােবাভাবেও বলেছেন যে, “যতদিন আমরা পরাধীন ছিলাম ততদিন রাষ্ট্রশক্তির গুরুত্ব ছিল, এখন আমরা স্বাধীন, সুতরাং এখন জনশক্তিকে জাগানাে বেশি গুরুত্বপূর্ণ হয়ে পড়েছে।”তিনি আরও বলেছেন, “যে সমাজ নিজ প্রয়ােজনের জন্য রাষ্ট্রের উপর বেশি করে নির্ভরশীল হয়ে থাকে সেই সমাজ অকর্মণ্য হয়ে পড়ে, শক্তিহীনও হয়ে থাকে। বেসরকারি বিষয়গুলি বেশি করে সরকারি হয়ে যেতে থাকে।”
প্রথমে আমরা ইংরেজদের গােলাম ছিলাম। ১৫ আগস্ট ১৯৪৭ সালে আমরা স্বাধীন হলাম। ২৬ জানুয়ারি ১৯৫০ সাল থেকে আমরা নিজেদের তৈরি করা সংবিধানের প্রচলন করেছি। স্বাধীন হওয়া সংবিধানে স্বাধীনতার আগে থেকে এই ‘আমরা’র নিরবচ্ছিন্নতা আমাদের প্রকৃত পরিচয়। এখানে আক্রমণ হয়েছে, রাজারা পরাজিত হয়েছেন, বিদেশি শাসন ছিল, কিন্তু এই ‘আমরা কখনও পরাজিত হয়নি।
এই ‘আমরা’ হলাে আমাদের এই সমাজ অর্থাৎ আমাদের রাষ্ট্র। এটি পাশ্চাত্যের ন্যাশনাল স্টেট’ ধারণা থেকে আলাদা, সেটা বুঝতে হবে। পূর্বতন রাষ্ট্রপতি ড. প্রণব মুখার্জি যখন সঙ্ঘের স্বয়ংসেবকদের আমন্ত্রণে নাগপুরে গিয়েছিলেন তখন তার বক্তব্যেও একই সুর শােনা গিয়েছিল। তিনি বলেছেন, পাশ্চাত্যের রাজ্যভিত্তিক রাষ্ট্রের কল্পনা এবং ভারতীয় জীবনশৈলীর দৃষ্টিভঙ্গিতে ভারতীয় রাষ্ট্রভাবনা ভিন্ন। এই জন্যই ভারতে কোনাে প্রকার মনুষ্যসৃষ্ট অথবা প্রাকৃতিক বিপত্তিতে সরকারের সঙ্গে সঙ্গে সমাজকে ত্রাণ ও পুনর্বাসনের কাজে সক্রিয় হতে দেখা যায়। | করােনা ভাইরাসের এই অভূতপূর্ব সংকটের সময় সরকারি প্রতিনিধি, সুরক্ষাকর্মী, ডাক্তার, নার্স, অন্যান্য স্বাস্থ্যকর্মী, সাফাই কর্মী সবাই প্রাণপণে নিজেদের কর্তব্য কর্ম করে যাচ্ছেন। এই কাজগুলাে করার সময় সংক্রমণশীল ব্যাধির দ্বারা আক্রান্ত হওয়ার সম্ভাবনা আছে জেনেও নিষ্ঠাসহকারে সবাই কাজ করে যাচ্ছেন। কিছুলােক সংক্রমিতও হয়েছে, কিছু জনের মৃত্যুও হয়েছে। এই জন্যই এদের ‘করােনা যােদ্ধা’নামে আখ্যায়িত করা সার্থক হয়েছে। সমাজের সমস্ত বর্গের মানুষ, বিশেষত সেনা ও পুলিশ এদের অভিনন্দন জানিয়েছেন এবং এরা তার যােগ্যও। কেউ বলতে পারেন যে এরা তাদের সরকারি কাজের দায়িত্ব পালন করছেন মাত্র, সবাই করেও থাকে। কিন্তু যে রকম মনােযােগ, নিষ্ঠা ও আত্মসমর্পণের ভাবনা নিয়ে এরা তা করছেন এবং এখনও করে চলেছেন সেটা লক্ষণীয় এবং এই জন্য সম্মানেরও অধিকারী।
এই সরকারি ও আধাসরকারি কর্মচারীদের সঙ্গে সঙ্গে সমাজের এক বড়াে অংশ নিজেদের প্রাণসংশয় করে ও দেশেজুড়ে সেই প্রথম দিন থেকে আজ পর্যন্ত নিষ্ঠাসহকারে সক্রিয় রয়েছে। এসব করতে তাদের দায়িত্বও দেওয়া হয়নি, এর বদলে এরা কিছু পাওয়ার আশাও করেন না। তবুও ‘নিজ সমাজের সংকটের সময় সাহায্য করা আমার কর্তব্য এই দায়িত্ববােধে, আত্মীয়তা বােধের ভাবনায় তাড়িত হয়ে কাজ করে যাচ্ছেন। এটিই ‘বয়ং রাষ্ট্রাঙ্গভূতা’র ভাবনা। বন্যা, ভূমিকম্পের মতাে প্রাকৃতিক বিপত্তিকালে ত্রাণকাজ, আর এই সংক্রমণশীল মহামারীর সময় নিজে সংক্রমিত হওয়ার সম্ভাবনা আছে জেনেও যুক্ত হওয়ার মধ্যে পার্থক্য অবশ্যই আছে। সমাজের এই সক্রিয় যােগদান সমস্ত দেশজুড়ে সমানভাবে রয়েছে। এটাই জাগ্রত ও সক্রিয় রাষ্ট্রশক্তির পরিচায়ক।
রাষ্ট্রীয় স্বয়ংসেবক সঙ্ঘের ৮ লক্ষ ৮০ হাজার স্বয়ংসেবক অরুণাচল প্রদেশ থেকে শুরু করে কাশ্মীর থেকে কন্যাকুমারী পর্যন্ত ৮৫৭০১টি স্থানে সেবা ভারতীর মাধ্যমে ১ কোটি ১০ লক্ষ ৫৫ হাজার পরিবারকে রেশনের কিট সরবরাহ করেছেন। ৭ কোটি ১১ লক্ষ ৪৬ হাজার খাবারের প্যাকেট অভাবী লােকেদের বিতরণ করেছেন। প্রায় ৬৩ লক্ষ মাস্ক বিতরণ করেছেন। বিভিন্ন রাজ্যে আটকে পড়া অন্য রাজ্যের ১৩ লক্ষ মানুষকে সহায়তা করেছেন। ৪০ হাজার ইউনিটস্ রক্তদান করা হয়েছে। ১৩৪১টি কেন্দ্রের মাধ্যমে ২৩ লক্ষ ৬৫ হাজার প্রবাসী শ্রমিককে খাবার এবং ১ লক্ষ শ্রমিককে ওষুধ ও অন্য চিকিৎসা সামগ্রী প্রদান করা হয়েছে। যাযাবর জনজাতি, কিন্নর, দেহ ব্যবসায় যুক্ত, তীর্থক্ষেত্রে তীর্থযাত্রীদের ওপর নির্ভরশীল পশুপক্ষী, গােরু, বাঁদর প্রভৃতি প্রাণীকে খাদ্যসামগ্রী প্রদান করা করা হয়েছে। পড়াশুনার জন্য বড়াে শহরে এসে আটকে যাওয়া ছাত্র-ছাত্রীদের সহায়তা করা হচ্ছে। বিশেষত উত্তরপূর্বাঞ্চলের ছাত্রদের জন্য বিশেষ হেল্পলাইন তৈরি করে তাদের সাহায্য করা হয়েছে এবং এদের আত্মীয়স্বজনদের সঙ্গে যােগাযােগ করিয়ে দেওয়া হয়েছে। মন্দির ইত্যাদির মতাে ধর্মীয় স্থানে ভিক্ষাবৃত্তি করে জীবনযাপন করে যারা, তাদেরও এই সাহায্য থেকে বঞ্চিত করা হয়নি। অনেক জায় গায় সংক্রামিত বস্তিতে গিয়ে স্বয়ংসেবকরা সাহায্যের হাত বাড়িয়ে দিয়েছেন। যে কোনাে দলের সরকারই হােক, সমস্ত রাজ্যেই যেখানে প্রশাসন। সাহায্য প্রার্থনা করেছে স্বয়ংসেবকরা তা পূরণ করেছেন। ভিড় সামলানাে, পরিযায়ী শ্রমিকদের নাম নথিভুক্ত করা এইসব অসংখ্য কাজ প্রশাসনের আহ্বানে বিভিন্ন স্থানে স্বয়ংসেবকরা করেছেন। পুনায় প্রশাসনের আহ্বানে স্বয়ংসেবকরা অন্য সেচ্ছাসেবী সংগঠনের সঙ্গে একসঙ্গে ঝুঁকিপূর্ণ অঞ্চলের (রেড জোন) বস্তিতে গিয়ে ১ লক্ষ লােকের স্ক্রিনিং করেছেন এবং সন্দেহভাজন ব্যক্তিদের আরও পরীক্ষা নিরীক্ষার জন্য সরকারের কাছে হস্তান্তরিত করা হয়েছে। | শুধু সঙ্ই নয়, অনেক সামাজিক, ধর্মীয় সংস্থা, মঠ, মন্দির, গুরুদ্বারা সবাই বিভিন্ন জায়গায় এই সামাজিক কাজে নিজেরা অংশগ্রহণ করেছেন। এই প্রকার সরকারি ব্যবস্থা ছাড়াও সমাজের নিজস্ব ব্যবস্থাও রয়েছে। এ সবই ‘বয়ং রাষ্ট্রাঙ্গভূতা’ভাবনার জাগরণের জন্যই সম্ভব হয়েছে। এই প্রকার জনজাগরণের জন্যই বিভিন্ন ভাষাভাষীর লােকেরা, বিভিন্ন জনজাতি নামে পরিচিত গােষ্ঠী, ভিন্ন ভিন্ন ধর্মের উপাসকরা সারা ভারতে বসবাসকারী এই সমাজ অর্থাৎ ‘আমরা এক; প্রাচীনকাল থেকেই একই আছি – এই ভাব জনজাগরণের জন্যই এটা সম্ভব হয়েছে। আমি এই বিরাট ‘আমরা’র এক অঙ্গীভূত ঘটক, এই চিন্তনই নিজেকে এই সংকটের মধ্যে ফেলেও, কোনােপ্রকার সম্মান বা প্রাপ্তির আশা ব্যতিরিকেই সমাজের জন্য সক্রিয় হতে প্রেরণা পাচ্ছে। যে কোনাে জাতি, ভারতের যে কোনাে রাজ্যে বসবাসকারী শিক্ষিত, অশিক্ষিত, ধনী, দরিদ্র, গ্রাম অথবা বনাঞ্চলে বসবাসকারী সমস্ত সমাজ আমার নিজের – এই ভাবনার জাগরণ করাই হলাে ‘রাষ্ট্র জাগরণ করা। আমি আমার জ্ঞাতিকু টুম্ব, পরিবার, প্রতিবেশী, গ্রাম, জনপদ, রাজ্য, দেশ, সমগ্র বিশ্ব এবং সম্পূর্ণ ব্রহ্মাণ্ড এই সমস্তই আমার চেতনায় ক্রমশ বিস্তার ও বিকশিত করার মাধ্যম। এর মধ্যে সংঘর্ষ নেই। এরা পরস্পরের পরিপূরক। এর মধ্যে সমন্বয় সাধনে আমার সক্রিয়তা দরকার। এটাই ভারতের সনাতন অধ্যাত্ম-নির্ভর একাত্মতা এবং সর্বাঙ্গীণভাবনা। এই বােধই ভারতকে বিশ্বে হাজার বছর ধরে বিশেষ প্রতিষ্ঠা দিয়েছে। এই জন্যই আমরা সবাই এর পৃথক পৃথক এককের সঙ্গে যুক্ত হয়ে সম্পর্কের পরিধিকে বিস্তারিত করে চলেছি। এই আপনত্ব বােধই এই প্রকার সংকটময় মুহূর্তের সময় স্বাভাবিকভাবে সক্রিয় হতে প্রেরণা দিয়েছে। এই জন্যই যে কারণে সমাজে ওঠাপড়া এসে-যায়, তাতেই সমাজ গড়া হয়ে থাকে। | এই সমাজ গড়ার কাজ তাকালিক হয় , আবার নিজে নিজেই হয় না। সচেতন। ও দীর্ঘকাল ধরে ক্রমাগত ও সহজ প্রয়াসের পরিণাম স্বরূপ এই সমাজ গড়ার কাজ সম্পন্ন হয়। প্রজন্মের পর প্রজন্ম লেগে যায় তবে তা সম্ভব হয়। রাষ্ট্রীয় স্বয়ংসেবক সঙ্ঘকেই ধরন, যার গঠন এই সম্পূর্ণ সমাজে একত্মতার ভাব সৃষ্টি করে তাকে একসূত্রে। বাঁধার কর্মসূচি গ্রহণ করেছে। আজ যে সঙ্ঘের কার্যপরিধির ব্যাপকতা, প্রভাব এবং সংগঠিত শক্তির অনুভব সকলে অনুধাবন করতে পারছে তা করে তুলতে সঙ্ঘের পাঁচ প্রজন্ম লেগে গেছে। হাজার হাজার কাজের মধ্যে একটি কাজই ‘মিশন’ হিসেবে নিয়ে লােকে সারাজীবন অতিবাহিত করেছে। অনেক যুবকের জীবন কপূর হয়ে গেছে। তবেই এই ফলাফল দেখতে পাওয়া যাচ্ছে। শুধু সদ্যই নয়, অসংখ্য সামাজিক, ধর্মীয় সংস্থা, শিক্ষক, ব্যবসায়ী অথবা বিভিন্ন ব্যবসায় যুক্ত নাগরিক, বিশেষত অসংখ্য গৃহিণীও এই ‘রাষ্ট্রজাগরণে’অনেক মৌলিক যােগদান সবসময়ই করে চলেছেন। সঙ্ঘের জন্যই এর দেশব্যাপী সংগঠিত শক্তির চিত্র দৃষ্টিগােচর হয় শুধু এইটুকুই পার্থক্য।
সম্পূর্ণ সমাজের স্বার্থে অসীম আত্মীয়তা এবং বিশেষ ব্যবস্থায় অনুশাসনের সঙ্গে কাজ করার প্রবণতা গড়ে তুলতে বহু বছরের সাধনার প্রয়ােজন হয়, তবেই তার কার্যসিদ্ধি ঘটে। এই প্রকারের এক উপলব্ধি ২০০৯ সালের ২৫ মে পশ্চিমবঙ্গের আয়লা ঝড়ের সময় হয়েছিল। দক্ষিণ ২৪ পরগনায় ব্যাপক ক্ষয়ক্ষতি হয়েছিল। আমি ৩ জুন ত্রাণকার্য। পরিদর্শনে ওখানে গিয়েছিলাম। এক ঘণ্টা জিপে যাওয়ার পর আরও চল্লিশ মিনিট নৌকা করে আমরা সেই দ্বীপে পৌঁছাই | যেখানে ত্রাণকার্য চলছিল। হাঁটুসমান কাদার মধ্যে দিয়ে সেখানে পৌঁছে কার্যকর্তাদের সঙ্গে বৈঠকে বহু অনুভূতি ও সেবা কার্যের বিষয়ে জিজ্ঞাসা করার সময় আমি জানতে চেয়েছিলাম যে আর অন্য কোন কোন সামাজিক বা ধর্মীয় সংস্থা এখানে ত্রাণকার্য করতে এসেছে? উত্তর হতাশাজনকই ছিল। তারা জানালেন যে, পাকা সড়কের আশেপাশে তাদের ত্রাণকার্য চলেছে, এখানে ভেতরে শুধু সঙ্ঘই কাজ করেছে। আমি বুঝতে পারলাম যে, স্বয়ংসেবকদের এমন পরিস্থিতির সম্মুখীন এই প্রথমবার করতে হচ্ছে। এত ভেতরে ঢুকে ত্রাণকার্য করার ব্যাপক যােজনার অভিজ্ঞতা নেই, তা সত্ত্বেও যেখানে প্রকৃতপক্ষে প্রয়ােজন সেখানে এত ভালাে কাজ অনেক অসুবিধার মধ্যেও স্বয়ংসেবকরা করছেন। এ সবই সীমাহীন আত্মীয়তাবােধ এবং সুষ্ঠ ব্যবস্থাপনায় কাজ করার অভ্যাসের ফলেই সম্ভব।
করােনা মহাসংকটকালেও এই প্রসঙ্গ এসে পড়ে। দিল্লির আনন্দবিহার স্টেশনের কাছে কোনাে অপপ্রচারের কারণবশত হাজার হাজার শ্রমিক নিজের গ্রামে ফেরার উদ্দেশ্যে হঠাৎ জমা হয়ে গেল। দিল্লির স্বয়ংসেবকরা এই খবর পাওয়ামাত্র খাবার ও পানীয় জল দেওয়ার ব্যবস্থা করেন। উত্তরপ্রদেশের স্বয়ংসেবকরা সেখানের রাজ্যপ্রশাসনের সহায়তায় শ্রমিকদের তাদের গ্রামে সুরক্ষিতভাবে পাঠানাের জন্য ৫০০০ বাসের ব্যবস্থা করেছেন। বাস্তবে এটা সরকারের দায়িত্ব ছিল, তবুও স্বয়ংসেবকরা নিজের সামর্থ্য এবং ব্যবস্থা কুশলতার পরিচয় দিয়েছেন। নিজ গ্রামমুখী হতে বাধ্য এবং আতান্তরে পড়া শ্রমিকদের গ্রামে পৌঁছে দেওয়া এক বিরাট চ্যালেঞ্জ ছিল।
সংক্রমণশীল ব্যাধি, ভিড়ের কারণে আরও বেশি সংক্রামিত হওয়ার আশঙ্কা এবং ঘরমুখী বয়স্ক, শিশু ও পরিবার-সহ বেরিয়ে পড়া শ্রমিকদের ব্যবস্থা করা সহজ ছিল না। যে ব্যবস্থা এর জন্য করা হয়েছিল তা মােটই পর্যাপ্ত ছিল না। সেজন্য সুঅভ্যাস ও ধৈর্য না থাকার জন্য বহু লােককে বেশ কষ্টের সম্মুখীন হতে হয়েছে। ওদের ছবি দেখে এবং দুঃখের কথা শুনে মন বিচলিত হয়ে ওঠে। এই নিয়ে মিডিয়াতে খুব বাদানুবাদও করা হয়েছে। সরকারপক্ষ ও বিরােধীরা পরস্পরকে অভিযােগ ও দোষারােপ করেছে, কিন্তু এই সময়ের মধ্যেই সরকারি ব্যবস্থা সামাজিক সংস্থাগুলির মাধ্যমে বিহারের ১০ লক্ষ ,উত্তরপ্রদেশের ৩০ লক্ষ , মধ্যপ্রদেশের ১০ লক্ষ এবং ঝাড়খণ্ডের ১.১৫ লক্ষ শ্রমিককে নিজ নিজ গ্রামে পৌঁছে গিয়েছে — এই সঙ্গে এটাও জানানাে আবশ্যক (২০ মে পর্যন্ত)। মধ্যপ্রদেশে উত্তরপ্রদেশ ও বিহারে যাওয়ার জন্য মহারাষ্ট্র ও গুজরাট থেকে আসা ৪ লক্ষ পায়ে হেঁটে আসা শ্রমিককে স্বয়ংসেবকরা প্রশাসনের সাহায্যে উত্তরপ্রদেশের সীমানায় গাড়িতে করে ছেড়ে দিয়ে এসেছে। সেখান থেকে উত্তরপ্রদেশ সরকার স্বয়ংসেবকদের সাহায্যে তাদের নিজের নিজের গ্রামে অথবা বিহারের সীমানায় যাওয়ার জন্য গাড়ির ব্যবস্থা। করেছে। প্রত্যেকের পরীক্ষা করা, খাবার ব্যবস্থা এবং শারীরিক দূরত্ব বজায় রাখার আগ্রহের সঙ্গে সঙ্গে ৫০ লক্ষ শ্রমিককে নিজেদের গ্রাম পর্যন্ত পৌঁছে দেওয়া হয়েছে। সেখানেও তাদের কোয়ারান্টাইন সেন্টারে রাখার ব্যবস্থা করা হয়েছে। এসবই মিডিয়ার বাদানুবাদের সময় দেখানাে অত্যাবশ্যক ছিল।
লকডাউনের কারণে অর্থনীতির অগ্রগতিও স্তব্ধ হয়ে গেছে। আচমকা হাজির হওয়া এই বিপত্তির কারণে অনেক অকল্পনীয় সমস্যা ও চ্যালেঞ্জের সম্মুখীন হতে হয়েছে। এই সমস্ত সমস্যার মােকাবিলা করার। পরিকল্পনা বা প্রয়াসের কিছু ত্রুটিও নজরে এসেছে। যার জন্য সাধারণ নিরীহ অসহায় লােকেদের কষ্ট ভােগ করতে হয়েছে সেটাই দুঃখের। এইসব ঘটনা নিয়ে সার্বজনীন জীবনে, মিডিয়ার বাকবিতণ্ডা এবং তার চর্চা হওয়া স্বাভাবিক। এটাও গণতন্ত্রেরই অংশ। তবুও কিছু লােক, নেতা, সংবাদমাধ্যম ও লেখক এইসব তর্ক বিতর্ক চলাকালীন ‘আমরাও এই সমাজের অঙ্গ’ এই উপলব্ধি থেকে বিস্মৃত হয়ে যাচ্ছে এমনটাই মনে হচ্ছে। কোনাে ঘটনাকে বাড়াবাড়ি করে দেখানাে আর সব জায়গায় এমনটাই হচ্ছে। এরকম প্রচার করাতে সমাজের আত্মবিশ্বাস, অসংখ্য কর্মচারী, আধিকারিক, সামাজিক সংগঠনের কার্যকর্তাদের নিষ্ঠা, তাদের পরিশ্রমের ওপর প্রশ্নচিহ্ন দেখা দিতে পারে । যা অনুচিত এবং একান্তভাবেই ভুল । এর জবাবদিহি করার সময় সমস্ত কিছুই ভুল করা হচ্ছে এইরকম ধারণা যাতে না হতে পারে সেদিকে খেয়াল রাখা ‘বয়ং রাষ্ট্রাঙ্গভূতা’ হওয়ার নিরিখে আমাদের সবাইকে মনে রাখতে হবে।
আমি ১৯৯২ সালে যখন আমেরিকায় গিয়েছিলাম তখনকার একটা ঘটনার কথা মনে পড়ছে। ওই সময় এক আমেরিকান বস্ত্রনির্মাণ সংস্থা আলাদা আলাদা রিভলভারের ছবি-সহ GUN লেখা টি-শার্ট তৈরি করেছিল যা সেদেশের কিশােরদের মধ্যে খুব জনপ্রিয় হয়েছিল। সেই প্রস্তুতকারক সংস্থাও প্রচুর মুনাফা করেছিল। কিন্তু পরে যখন অভিভাবকদের দৃষ্টিগােচরে এলাে এই কারণে যে অল্পবয়স্কদের মধ্যে হিংসার প্রবণতা বেড়ে উঠেছে তখন তারা প্রথমে এই টি-শার্ট বাজার থেকে তুলে নিতে আন্দোলন শুরু করেছিল এবং অবশেষে যখন ওই প্রস্তুতকারী সংস্থার সমস্ত প্রকার নির্মিত বস্তুর ওপর সকলে বয়কট করার কথা আলােচনা চলতে থাকলাে তখন সেই সংস্থা ওই টি-শার্ট বাজার থেকে তুলে নিতে বাধ্য হলাে। যখন সংবাদমাধ্যম এই নির্মাতা সংস্থার কর্ণধারকে জিজ্ঞাসা করে এই টি-শার্ট সমাজের কিশােরদের মনে বিপরীত প্রতিক্রিয়ার দেখা দিচ্ছিল, সেখানে আপনারা প্রথমেই কেন বাজার থেকে সরিয়ে নিলেন?’ তখন তাদের উত্তর ছিল Look, I am here in the business of making money and not in the business of morality.” অর্থাৎ এই সমাজ আমার নিজের অথবা এই সমাজ আমার জন্য শুধু এক সম্পদের উৎস- এই দুই দৃষ্টিভঙ্গি হতে পারে।
এই ভাবেই যদি কোথাও হিংসা, অত্যাচার, শােষণ, অন্যায়, প্রতারণার মতাে ঘটনা ঘটে তখন তার ওপর নিষেধাজ্ঞা, বিরােধিতা ও প্রতিকার হওয়া উচিত। এর তদন্ত করে দোষীকে কঠোর থেকে কঠোরতর শাস্তি প্রদান করা উচিত। কিন্তু এইরকম ঘটনাগুলির সরলীকরণ করা, বিসম। অনুপাতে তাকে বড়াে করে দেখিয়ে সম্পূর্ণ সমাজের ব্যবস্থাপনার উপর আঘাত আনা উচিত হচ্ছে কি ? কিন্তু এসবই ঘটে চলেছে, কারণ এইসব করনেওয়ালাদের মনে সেই ‘বয়ং রাষ্ট্রাঙ্গভূতা’র উপলব্ধি হয় ক্ষীণ অথবা নিঃশেষ হতে দেখা যাচ্ছে। এদের জন্য এই সমাজ, এই সমাজের এক বিশেষ অংশ, এখানের দারিদ্র্য, অশিক্ষা , অপরিচ্ছন্নতা এইরকম অ্যাজেন্ডাগুলি উপকরণের সামগ্রী রদপেই দেখতে পায়। এ হলাে আত্মীয়তাবােধের অভাবের পরিণাম।
দুর্ভাগ্য যে, আমাদের দেশে কিছু লােক সমাজ নির্মাণের এই বিষয়গুলিকে অবজ্ঞা করে শুধু একতরফা চিত্র তুলে ধরতে প্রয়াসী হতে দেখা যায়। আমাদের বৈচিত্র্যের মূলে যে ঐক্যের সুর রয়েছে, যা আমাদের অধ্যাত্ম-নির্ভর জীবনশৈলীর দৃষ্টিভঙ্গি, যার বিস্মরণ হওয়ার কারণে অথবা উপেক্ষা করার জন্য আমাদের বৈশিষ্ট্যপূর্ণ বৈচিত্র্যকে বিভেদের উপকরণ রূপে প্রস্তুত করে সমাজে নতুনভাবে বিভাজন করার ষড়যন্ত্র বহু বছর ধরে চলে আসছে। এই প্রাচীনতম সমাজে কালান্তরে কিছু ত্রুটি অবশ্যই ঘটেছে। যার জন্য অনেক সমস্যা তৈরি হচ্ছে, তার জন্য সেগুলির সংশােধন করার সযত্ন প্রয়াস আবশ্যক। কিন্তু তা করার সময় সমাজ নির্মাণ কার্যের হানি না হয় সে খেয়ালও রাখা উচিত। কিছু ঐতিহাসিক ভুল নীতির কারণে সামাজিক ও আর্থিক বৈষম্যের সৃষ্টি হয়েছে। সেগুলি দূর করে মমত্ববােধ সম্পন্ন একাত্ম সমাজ নির্মাণের জন্য সম্ভবপর সমস্ত রকমের উপায় অবলম্বন করার প্রয়াস। করা উচিত। এবং তা করতে গিয়ে ঐক্যের সূত্র যাতে শিথিল না হয়ে পড়ে, পঙ্গু না হয়ে পড়ে সেই খেয়ালও রাখা অত্যাবশ্যক। | আসমুদ্রহিমাচল বিস্তৃত এই সম্পূর্ণ সমাজ আমার সমাজ। আমাকেই একে গড়ে তুলতে হবে। ভবিষ্যতে আগত সমস্ত প্রকার সংকটের মােকাবিলা করার সামর্থ্য, একাত্মতার মধ্যে নিহিত, ‘আমারা’ ধারণার মধ্যেই রয়েছে। আমাদের সবাইকে, সবসময়, সব পরিস্থিতিতে এই ‘আমরা’ ধারণাকে বাড়াতে এবং দৃঢ় করে তােলার প্রচেষ্টা চালিয়ে যেতে হবে।
ড. মনমােহন বৈদ্য
(লেখক রাষ্ট্রীয় স্বয়ংসেবক সঙ্ঘের সহ সরকাৰ্যবাহ। ভাষান্তর: দেবযানী ঘােষ)