বর্তমানে করােনা সংক্রমণের সময়। পরীক্ষা বেশ স্পর্শকাতর বিষয়। এর মধ্যে আদালত ও রাজনীতির স্পর্শে তা আরও জটিল ও বিতর্কের হয়েছে। দু’ ধরনের পরীক্ষা-ইঞ্জিনিয়ারিং ও ডাক্তারির মতাে উচ্চ পেশার পাঠ্যক্রমে ভর্তির জন্য JEE (Joint Entrance Examination) এবং NEET (National Eligibility com Entrance Test) পরীক্ষা এবং ইউজিসি স্বীকৃত বিশ্ববিদ্যালয়ের পরীক্ষা। পরীক্ষা কেন্দ্র দীর্ঘ সময় শারীরিক উপস্থিতির প্রয়ােজনীয়তার কারণে করােনা সংক্রমণের আশঙ্কা রয়েছে। এজন্য ছাত্র-ছাত্রী, অভিভাবক ও বুদ্ধিজীবীদের একাংশ পরীক্ষা স্থগিত বা বাতিল করার পক্ষপাতী এবং সুপ্রিম কোর্টে ওই দু’ ধরনের পরীক্ষা স্থগিতের আবেদন করে সুপ্রিম কোর্টে মামলা হয়েছে। জিইই ও এনইইটি পরীক্ষা : এগুলি প্রতিযােগিতামূলক পরীক্ষা। পরীক্ষায় বসাটা ঐচ্ছিক। কিন্তু কেরিয়ার বা পেশার তাগিদ রয়েছে। জুলাই মাসে। এই পরীক্ষা হওয়ার কথা ছিল। কিন্তু করােনার কারণে তা পিছিয়ে সেপ্টেম্বরে করা হয়েছে। জেইই ১ থেকে ৬ সেপ্টেম্বর পর্যন্ত এবং এনইইটি ১৩ সেপ্টেম্বর দিন ধার্য হয়েছে। ১৭ আগস্ট মহামান্য সর্বোচ্চ আদালত জাস্টিস অরণ মিশ্রের নেতৃত্বাধীন তিন বিচারকের বেঞ্চ জেইই ও এনইইটি মামলায় রায় প্রদান করেছেন। তাতে তারা পরীক্ষা স্থগিতের কোনাে নির্দেশ দেননি। ছাত্রদের পেশা জীবন ক্ষতিগ্রস্ত হওয়া উচিত নয়। পরীক্ষা বাতিল হলে ছাত্রদের জীবনের মূল্যবান এক বছর নষ্ট হবে। তাই এনটিএ (ন্যাশনাল টেস্টিং এজেন্সি)- কে যথাসময়ে নির্ধারিত দিনগুলিতে পরীক্ষা নিয়ে নির্দেশ দেওয়া হয়েছে। তবে করােনা সংক্রান্ত সমস্ত বিধি নিষেধ মেনে এবং সতর্কতামূলক ব্যবস্থা গ্রহণ করে এই পরীক্ষা নিতে হবে।
ইতিমধ্যে ২৭ আগস্ট সােনিয়া গান্ধীর ডাকা অবিজেপি রাজ্যের মুখ্যমন্ত্রীদের আন্তর্জাল সভায় ঠিক হয় জেইই এবং এনইইটি স্থগিত করার জন্য সুপ্রিম কোর্টে রায় পর্যালােচনা করার জন্য আবেদন করা হবে। তদনুযায়ী পশ্চিমবঙ্গ-সহ ছয়টি রাজ্যের পক্ষ থেকে (অন্যগুলি হলাে
রাজস্থান, ঝাড়খণ্ড, ছত্রিশগড়, পঞ্জাব ও মহারাষ্ট্র) ২৮ আগস্ট সম্মিলিতভাবে সুপ্রিম কোর্টে আবেদন করা হয়েছে। কিন্তু তার উপর সুপ্রিম কোর্ট কোনাে শুনানি করেনি। ইতিমধ্যে ২৮ আগস্ট কংগ্রেসের ছাত্র ইউনিয়ন এনএসইউআই এবং তৃণমূল ছাত্র পরিষদ অবস্থান বিক্ষোভ করেছে। এই অবস্থার মধ্যে এনটি এ আন্তর্জালে। অ্যাডমিটকার্ড ছেড়ে দিয়েছে এবং ছাত্ররা অন্তর্জাল থেকে তা সংগ্রহ করছে। ওড়িশার মুখ্যমন্ত্রী নবীন পট্টনায়েক রাজ্যের বন্যা পরিস্থিতি এবং করােনা নিমিত্ত পরীক্ষা স্থগিত করার জন্য প্রধানমন্ত্রীকে ফোন করেন। বিজেপি সাংসদ সুব্রহ্মনিয়ম স্বামীও পরীক্ষা স্থগিতের পক্ষে ছিলেন। কিন্তু শিক্ষামন্ত্রী। জানিয়ে দিয়েছেন, পরীক্ষা নির্ধারিত সূচি অনুযায়ীই হবে। ওড়িশা সরকার ছাত্রদের জন্য ফ্রি যানবাহনের ব্যবস্থা করেছেন এবং অভিভাবকদের হােটেলের বন্দোবস্ত করেছেন। এই উদ্দেশ্যে লকডাউনও শিথিল করা হয়েছে। কিন্তু পশ্চিমবঙ্গে ৩১ আগস্ট লকডাউন হওয়ায় জেলা ছাত্রদের যাতায়াতে অসুবিধার সৃষ্টি হয়েছে। মধ্যপ্রদেশে সরকারও ফ্রি যানবাহনের। ব্যবস্থা করেছে।
এনটিএ ও করােনা মােকাবিলায় সব রকমের ব্যবস্থা করেছেন। পরীক্ষা কেন্দ্রে সংখ্যা জেইই-তে ৫৭০ থেকে বাড়িয়ে ৬৬০ এবং এনইইটি-এ কেন্দ্র সংখ্যা ২৫৪৬ থেকে বাড়িয়ে ৩৮৪৩ করা হয়েছে। উল্লেখ্য ৯৯ শতাংশ ছাত্রই তাদের প্রথম পছন্দের কেন্দ্র পেয়েছেন। জেইই-তে কম্পিউটার মাধ্যমে পরীক্ষা দিতে হবে। জেইই-তে ৮ ক্ষেপের পরিবর্তে ১২ ক্ষেপ করা হয়েছে এবং প্রতি ক্ষেপে পরীক্ষার্থী সংখ্যা ১.৩২ লক্ষ থেকে কমিয়ে ৮৫০০০ করা হয়েছে। দুই পরীক্ষার্থীর মধ্যে একটি আসন ছাড়া থাকবে। এনইইটি-এ কাগজে কলমে লিখিত পরীক্ষা দিতে হবে। সেক্ষেত্রে কক্ষ প্রতি পরীক্ষার্থী সংখ্যা ২৪ থেকে কমিয়ে ১২ করা হয়েছে। উল্লেখ্য জেইই-তে ৮.৫৮লক্ষ এবং এনইইটি-এ ১৫.৯৭ লক্ষ পরীক্ষার্থী রয়েছে। ইউজিসি পরীক্ষা :
করােনা সময়ে বিশ্ববিদ্যালয়ের বিভিন্ন পরীক্ষা সম্পাদন ও শিক্ষাসূচি গঠন। ব্যাপারে প্রফেসর আর সি খুলাড, প্রাক্তন ইউজিসি সদস্য ও হরিয়ানা কেন্দ্রীয় বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্যের নেতৃত্বে একটি কমিটি গঠন করা হয়। তার সুপারিশ অনুসারে ২৯ এপ্রিল ইউজিসি এক নির্দেশনা জারি করে। তাতে বলা হয়, মধ্যবর্তী বর্ষ বা সেমিস্টারের ছাত্রদের জন্য পরীক্ষা দরকার নেই। অভ্যন্তরীণ মূল্যায়ন এবং পূর্ব বর্ষ বা সেমিস্টারে প্রাপ্ত নম্বরের ভিত্তিতে একজন ছাত্রের ফল নির্ধারিত হবে। প্রথমবর্ষ বা সেমিস্টারের ক্ষেত্রে শুধু অভ্যন্তরীণ মূল্যায়নের উপর ভিত্তি করে ফল নির্ধারিত হবে। কিন্তু অন্তিম বর্ষ বা সেমিস্টারের ছাত্রদের ক্ষেত্রে অবশ্যই পরীক্ষা দিতে হবে। পরীক্ষাই একজন ছাত্রের যােগ্যতার মাপকাঠি। তাছাড়া এই পরীক্ষা ফলের উপর ভিত্তি করে অনেকেই বিদেশে পড়তে যাবে। সেক্ষেত্রে পরীক্ষা
নেওয়া জররি। এই পরীক্ষা অনলাইন-অফলাইন বা উভয়ের সমন্বয়ে হতে পারে। বিশ্ববিদ্যালয় সুবিধানুসারে এই পদ্ধতিকে সরল করে নেবে। এই পরীক্ষা জুলাইয়ের মধ্যে সম্পূর্ণ করার প্রস্তাব দেওয়া হয়।
করােনা এবং লকডাউন জনিত কারণে বিশেষজ্ঞ কমিটির সুপারিশে সেই সময় আরও পিছিয়ে সেপ্টেম্বরের মধ্যে সম্পন্ন করতে বলা হয়। কিন্তু এর বিরুদ্ধে কিছু ছাত্র, অভিভাবক এবং বুদ্ধিজীবী সুপ্রিম কোর্টে মামলা করে। মহারাষ্ট্রের শিবসেনার যুব শাখা খুব সেনাও এই মামলায় শামিল হয়। ইতিপূর্বে দিল্লি ও মহারাষ্ট্র সরকার Disaster Management Act অনুসারে পরীক্ষা বাতিল ঘােষণা করেছিল। ইউজিসি তাদের সিদ্ধান্তকে প্রতিবাদ করে। এই রাজ্যগুলিও মামলায় পক্ষ হয়। অনেকগুলি শুনানির পর ২৮ আগস্ট সর্বশেষ সুপ্রিম কোর্টের সামগ্রিক রায় প্রকাশিত হয়। জাস্টিস অশােক ভূষণের নেতৃত্বে তিন বিচারকের বেঞ্চ এই রায় দেন।
তাতে সুপ্রিম কোর্ট ইউজিসি-কে পরীক্ষা ব্যাপারে সিদ্ধান্ত নেওয়ার একমাত্র অধিকারী হিসেবে স্বীকৃতি দেয় এবং অন্তিম বর্ষ বা সেমিস্টারের ছাত্রদের জন্য পরীক্ষা আবশ্যিক ঘােষণ করে। Disaster Management Act অনুসারে কোনাে রাজ্য পরীক্ষা বাতিল ঘােষণা করতে পারে
। তারা চাইলে ওই আইনে ইউজিসি-র অনুমােদনক্রমে পরীক্ষার দিন পেছতে পারে। কিছু ছাত্র অভিযােগ করে অন্তিম বর্ষের ছাত্রদের প্রতি ইউজিসি বৈষম্য করছে। কারণ মধ্যবর্তী ছাত্ররা পরীক্ষা না দিয়েই পরবর্তী বর্ষ বা সেমিস্টারে উত্তীর্ণ হচ্ছে। কোর্ট তা খারিজ করে দিয়েছে। সলিসিটর জেনারেল তুষার মেহেতা কোর্টকে জানান ৮১৮টি বিশ্ববিদ্যালয়ের রিপাের্ট তারা পেয়েছেন। এর মধ্যে ১২১টি Deemed, ২৯১টি নিজ এবং ৫১টি কেন্দ্রীয় বিশ্ববিদ্যালয় রয়েছে।)
উল্লেখ্য, ভারতে মােট বিশ্ববিদ্যালয়ের সংখ্যা ৯৫০টি। ৮১৮টির মধ্যে ৬০৩টি বিশ্ববিদ্যালয় পরীক্ষা নিতে সিদ্ধান্ত নিয়েছে, তার মধ্যে ২০৯টি বিশ্ববিদ্যালয় পরীক্ষা সম্পূর্ণ করেছে এবং বাকি ৩৯৪টি বিশ্ববিদ্যালয় সেপ্টেম্বরের মধ্যে পরীক্ষা সম্পূর্ণ করবে। সব রাজ্য ও বিশ্ববিদ্যালয় গুলি এই রায় অনুসারে পরীক্ষা নেওয়ার তােড়জোড় শুরু করেছে। পশ্চিমবঙ্গে আসন্ন দুগাপুজোর আগে অক্টোবরে পরীক্ষা সম্পূর্ণ করার কথা ভাবা হচ্ছে।
বেশিরভাগ ছাত্র সবসময়ই পরীক্ষাকে ভয় পায়। এটি একটি মনস্তাত্ত্বিক বিষয়। টিভি ও মিডিয়া এরকম ছাত্রদের সাক্ষাৎকার ও বিবৃতি দিয়ে বাজার গরম করছে। অপদিকে ঐকান্তিক ছাত্ররা কিন্তু এই পরীক্ষার জন্য অপেক্ষা করছে। অন্তিম বর্ষের ছাত্ররাও পরীক্ষা ছাড়া উত্তীর্ণ হলে ভবিষ্যতে এটি একটি খারাপ নজির হয়ে যেত এবং পরীক্ষা সম্পর্কে ছাত্রদের লঘু মানসিকতা তৈরি হতাে। এগুলির ফল। মােটেই শুভ নয়।।
করােনা সারা বিশ্বের মাথা ব্যথার কারণ হয়েছে। তার জন্য তাে জীবন পুরাে স্তব্ধ হয়ে যেতে পারে না। করােনা কবে শেষ হবে, তার কোনাে নিশ্চয়তা নেই। এই অবস্থায় পরিস্থিতির সঙ্গে সামঞ্জস্য রেখে সরল পদ্ধতিতে পরীক্ষা গ্রহণের রায় খুবই বাস্তবােচিত। মাথার যন্ত্রণাহলে মাথা কেটে দেওয়াটা সমাধান হতে পারে না। করােনার ক্ষেত্রে ভয় মারাত্মক ক্ষতিকর। করােনাতে এমনিতে কম, বিশেষ করে তরুণদেরকে সেভাবে করােনা কাবু করতে পারেনি। পরীক্ষা এড়িয়ে গিয়ে এই ভয়কে জয় করা যাবে না, করােনাকে চ্যালেঞ্জ করেই তরুণরা আত্মবিশ্বাসী হবে। তবে একটি প্রশ্ন ওঠে গেছে, বিরােধীরা কেন এত দেরি করে জেইই-এনইইটি স্থগিত করার আবেদন করল ? শুধুই কি রাজনৈতিক উদ্দেশ্য চরিতার্থ করার জন্য ?
নির্মল মাইতি
2020-09-08