করোনা অধিকাংশ ক্ষেত্রেই প্রাণ সংশয়কারী হবে না

করোনা ভাইরাস আগেও ছিল— নানা সময়ে নানা রোগ সৃষ্টি করেছে। সময় সময় সার্স-এর মতো বিপজ্জনক রোগও সৃষ্টি করেছে। করোনা ভাইরাসের নবতম সংস্করণ (Novel Coronavirus বা CoV) দেখা দিল চীনের উহান অঞ্চলে ২০১৯-এর শেষ লগ্নে। এই ভাইরাসজনিত রোগের নাম COVID-19 (অর্থাৎ Corona virus disease-19)। COVID-19 আড়াই মাসের মধ্যে ত্রাস সৃষ্টিকরেছে সারা পৃথিবীতে। দ্রুত ছড়িয়ে পড়েছে বিশ্বব্যাপী। এই রোগের
নির্দিষ্ট কোনো ওষুধ নেই। প্রতিষেধক তৈরির সময় মেলেনি। শ্বাসনালীতে এর সংক্রমণ কাশি, জ্বর থেকে শুরু করে জীবন সংশয়কারী ফুসফুসে নিমোনিয়া সৃষ্টি করতে পারে। সংক্রমণের ভয়ে এবং সংক্রমণ রোধের ব্যবস্থাগুলির ফলশ্রুতিতে জনজীবন বিপর্যন্ত হয়ে পড়েছে।
মহামারী একটি পরিচিত শব্দ, যাকে বলে epidemic। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা COVID-19-কে ঘোষণা করেছে pandemic বলে, যার সাধারণ প্রতিশব্দ নেই।
থাকার কারণ হলো যে pandemic একটি বিরল ঘটনা। আগে ঘটেনি এমন নয়, তবে সচরাচর ঘটে না। Pandemic অর্থের তাৎপর্য হলো যে রোগ কোনো ভৌগোলিক এলাকায় সীমাবদ্ধ নেই, তা ছড়িয়ে পড়েছে বিশ্বের বিভিন্ন প্রান্তে। COVID-19 পৌঁছে গেছে এনটার্টিকা বাদে প্রতিটি মহাদেশে।
সমসাময়িক কালের জীবনযাত্রায় যাতায়াতের দ্রুততা ও সহজলভ্যতা এবং পর্যটনের ব্যাপক প্রসার এক বিশেষ পরিস্থিতি তৈরি করেছে। কোনো এলাকায়। কোনো রোগ দেখা দিলে তা অতি সহজে ও স্বল্প সময়ে অনেক দূর দেশে পৌঁছতে পারে। আগে কোনো এলাকায় মহামারী হলে তা সেই এলাকায় আবদ্ধ থাকত। মানুষের আনাগোনা নিয়ন্ত্রণ করলে রোগ ছড়াবার সম্ভাবনা কম থাকত। সময় দিলে প্রকৃতির নিয়মে, ঋতুর পরিবর্তনে এবং চিকিৎসায় মহামারী প্রশমিত হতো। এবার কিন্তু মূলত পর্যটকদের মাধ্যমে COVID-19 ছড়িয়েছে। ভারতেও ঢুকেছে ওই ভাবে।
যত ব্যাপকই হোক না কেন, একটি আশ্বাসের কথা অবশ্যই শুনিয়ে রাখা ভালো। কোনো ব্যক্তির শরীরে সংক্রমণ তখনই সম্ভব যখন তিনি এমন ব্যক্তির সংস্পর্শে এসেছেন যাঁর শরীরে ভাইরাস রয়েছে। এবং তার শরীর থেকে ভাইরাস হাঁচি, কাশির মাধ্যমে নির্গত হচ্ছে। নচেৎ সংক্রমণ হবে না।
ওই ভাইরাস বাহক ব্যক্তিটিকে চিহ্নিত করা প্রয়োজন। চিহ্নিত করার ক্ষেত্রে সমস্যা হলো যে ওই ভাইরাস-বাহক আপাতদৃষ্টিতে অসুস্থ নাও হতে পারেন। তাঁর কাশি, জ্বর, শ্বাসকষ্ট বা রোগের অন্যান্য অভিব্যক্তি দেখা দেবার আগে থেকেই তার শরীর থেকে ভাইরাস নির্গত হচ্ছে। তার অজ্ঞাতেই তিনি ভাইরাস ছড়াচ্ছেন এবং নিজের অজানতেই সুস্থ ব্যক্তি ভাইরাস দ্বারা আক্রান্ত হচ্ছে।
শরীরে ভাইরাস ইতিমধ্যেই আছে, তা রোগের লক্ষণগুলি দেখা দিয়ে থাক বা নাই দিয়ে থাক, এমন ব্যক্তিকে চিহ্নিত করা সব থেকে জরুরি। এর জন্য ল্যাবরেটরিতে পরীক্ষা প্রয়োজন। সন্দেহজনক যে কোনো ক্ষেত্রে এই পরীক্ষা করা হচ্ছে। বিদেশ থেকে ফিরছেন এমন ব্যক্তিদের বিশেষ করে পরীক্ষা করা দরকার। সময়ে পরীক্ষার মাধ্যমে ধরা না পড়লে সেই ভাইরাস বহনকারী ব্যক্তি দেশের মধ্যে সর্বসাধারণের মধ্যে ভাইরাসের সংক্রমণ ঘটাবেন। বিপত্তি নিয়ন্ত্রণের বাইরে চলে যাবে যদি দেশের অভ্যন্তরে সংক্রমিত হয়েছেন এমন ব্যক্তি থেকে স্থানীয় এলাকার আরও অনেক সুস্থ মানুষের মধ্যে সংক্রমণ ঘটতে সুরু করে।
এই পরিস্থিতির যাতে উদ্ভব না হয় তার জন্যই ভিড় ও জমায়েতের ওপর নিয়ন্ত্রণের চেষ্টা। সাক্ষাতে সংক্রমণ কমাবার জন্য ব্যক্তিগত স্তরে অবশ্য কর্তব্যগুলি স্মরণ করাবার জন্য চলেছে এত প্রচার। সেই আদেশ-উপদেশ মেনে চলা একান্ত জরুরি। রোগের সংক্রমণ রোধে সরকারি ব্যবস্থার পাশাপাশি ব্যক্তিগত দায়িত্ব পালন না করলে সংক্রমণ রোধ করা সম্ভব হবে না।
ভাইরাস ঢুকবে নাম-মুখ দিয়ে। তার লক্ষ্য শ্বাসনালী মারফত ফুসফুস। বাতাস বাহিত কণা (droplet) দিয়ে ভাইরাস ছড়ায়। সামনে কেউ নাক, মুখ না ঢেকে হাঁচলে, কাশলে কণা সহজেই অন্যের নাক, মুখ অবধি পৌঁছাতে পারে। এমনকী হাতের তালুতে বা আঙুলেও কণা হাতে চলে আসতে পারে। সেই (অপরিষ্কার) হাত নাক, মুখ, চোখে দিলে সংক্রমণ ঘটতে পারে। তাই ঠিক মতো হাত ধোয়ার বিষয়টি এতে গুরুত্বপূর্ণ। একটি আশ্বাসের কথা। আক্রান্ত ব্যক্তির অসুস্থতা অধিকাংশ ক্ষেত্রে প্রাণ সংশয়কারী হবে না। মৃত্যুর হার মোটামুটি ৩ থেকে ৫ শতাংশ। অনেক সংক্রামক ব্যাধিতে এবং ইতিহাসের বহু মহামারীতে মৃত্যুর হার এর থেকে অনেক বেশি ছিল।
জ্বর, কাশি নানা জীবাণু থেকে হয়। জ্বর, কাশি হলেই তা করোনা ভাইরাসজনিত নয়। ভীত হবার কারণ নেই। তবে ব্যক্তিগত ও সমষ্টিগতভাবে সরকারের স্বাস্থ্যবিধি ও আচরণবিধি মেনে চলতেই হবে।
ডাঃ দেবাশিস বসু (লেখক প্রখ্যাত জীবাণু সংক্রমণ বিশেষজ্ঞ)

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

This site uses Akismet to reduce spam. Learn how your comment data is processed.