বিশ্ব জুড়ে করোনা ভাইরাস একটি আতঙ্ক ও ত্রাসের নাম। গত বছর ২০১৯-এর শেষ দিকে মধ্য চীনের উহান শহর থেকে বিশ্ব মহামারী সৃষ্টিকারী এই মারণ ভাইরাস সারা বিশ্বে ছড়িয়ে পড়ে এবং আগুনের চেয়েও অনেক দ্রুতগতিতে সমগ্র বিশ্বকে গ্রাস করে নেয়। মধ্য চীনের উহান। শহরের অবৈধ বন্যপ্রাণীর বাজার থেকে এই মারণ ভাইরাসের আবির্ভাব বলে মনে করা হচ্ছে, যদিও এ ব্যাপারে চীন সরকারের এবং তৎসহ বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার সত্য নিরূপণের ভূমিকা সম্পর্কে সারা বিশ্ব সন্দিহান। এ বিষয়ে বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থায় ভারতবর্ষের উত্থাপিত চীনের ভূমিকার ব্যাপক তদন্ত প্রস্তাব বিশ্ব বিপুল ভাবে সমর্থন করেছে। এ বিষয়ে নিঃসংশয়ে বলা যায়। সরকারি ভাবে চীন ও বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার ভূমিকা যে খুব সদর্থক ছিল একথা বলা যায় না। যে সময়ে এ লেখা হচ্ছে সেই সময়কালে বিশ্বে প্রায় ১১ কোটি ৫৭ লক্ষ মানুষ এই মারণ মহামারীতে আক্রান্ত। বিশ্বে এই ভাইরাসে আক্রান্ত মৃতের সংখ্যা প্রায় ৫ লক্ষ। ৩৭ হাজার। ভারতবর্ষে আক্রান্তের সংখ্যা ৬ লক্ষ ৯৮ হাজার এবং মৃতের সংখ্যা ১৯ হাজার ৭০৩। পশ্চিমবঙ্গে আক্রান্তের সর্বশেষ সংখ্যা ২২ হাজার ১২৬ ও মৃতের সংখ্যা ৭৫৭।
সমগ্র ভারতবর্ষের সঙ্গে সঙ্গে পশ্চিমবঙ্গে মার্চ ২০২০ থেকে এই রোগের প্রাদুর্ভাব মারণ আকার নেয় এবং উচ্চ মাধ্যমিক ও একাদশ শ্রেণীর পরীক্ষা মাঝপথে স্থগিত করে রাজ্য সরকার ও কেন্দ্রীয় সরকার সরকারি ভাবে ঘরবন্দি (লকডাউন) ঘোষণা করতে বাধ্য হয়। স্থগিত হয়ে যায় সমস্ত ধরনের শৈক্ষিক, ব্যবসায়িক , অর্থনৈতিক কাজকর্ম এবং মানুষের স্বাভাবিক জীবনযাপন। ভারতবর্ষ তথা সমগ্র পৃথিবীর সাম্প্রতিক ইতিহাসের ক্ষেত্রে এই অবস্থা এককথায় অভূতপূর্ব। সামাজিক সংক্রমণ রোধ করতে এবং ব্যাপক জীবনহানি রোধ করতে এই পদক্ষেপ গ্রহণ করা ছাড়া সরকারের আর অন্য কোনো বিকল্প ছিল না।
করোনা ভাইরাস বিশ্বের শিক্ষা ব্যবস্থাকে এক চূড়ান্ত প্রতিস্পর্ধার সম্মুখে দাঁড় করিয়ে দিয়েছে। শিক্ষা ব্যবস্থার যে পরিচিত কাঠামো ছিল এই বিশেষ উদ্ভূত পরিস্থিতিতে তাকে সচল রাখা আর মারণ ফাঁদের মধ্যে পরবর্তী প্রজন্মকে যেতে বাধ্য করা একই ব্যাপার। সুতরাং খুব স্বাভাবিক ভাবেই সেই আপাত ব্যবস্থিত শিক্ষা পরিকাঠামোকে আপকালীন ভাবে পরিহার করতে হয়েছে। তা আমেরিকা যুক্তরাষ্ট্রের হার্ভার্ড বিশ্ববিদ্যালয়ই হোক বা ভারতীয় প্রাদ্যোগিকি সংস্থানই হোক। বিশ্ব জুড়ে স্কুল বন্ধ, শিক্ষার্থীরা গৃহবন্দি, শারীরিক কাজকর্ম বা খেলাধুলার কোনো অবকাশ নেই, এমনকী বন্ধুদের সঙ্গে যোগাযোগের সমস্ত সুযোগও অত্যন্ত সীমিত এবং বিশ্ববিদ্যালয় থেকে প্রাথমিক স্তর পর্যন্ত সমস্ত পরীক্ষা স্থগিত। ভারতবর্ষে আই আই টি, আই আই এম-এর মতো সংস্থা এবং বিশ্ববিদ্যালয়গুলিও তাদের ক্যাম্পাস বন্ধ করে দিতে বাধ্য হয়েছে। এমনকী জি ম্যাট, জি আর ই, এস এ টি ও অনির্দিষ্ট কালের জন্য স্থগিত অসংখ্য বিদ্যার্থীর ভবিষ্যৎ এক কোটি। সবচেয়ে বেশি যুবপ্রজন্মের দেশ হিসেবে ভারতবর্ষে ছাত্র-ছাত্রীদের সংখ্যা এতটাই বেশি যে শিক্ষাক্ষেত্রে করোনা ভাইরাস জনিত এই ক্ষতিকর প্রভাব ভারতবর্ষের ক্ষেত্রেই সবচেয়ে প্রবল।
সমস্যা-২. পরিকাঠামোগত সমস্যা : পাঠদান ও মূল্যায়নের পরিকাঠামো শিক্ষা প্রতিষ্ঠানগুলি বন্ধ থাকার কারণে পুরোপুরি ভাবে ব্যাহত। হাতে-গোনা কিছু বেসরকারি শিক্ষা প্রতিষ্ঠান অনলাইন পাঠাদান চালু করতে পেরেছে। কিন্তু স্বল্প পরিষেবার বেসরকারি ও সরকারি শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের ক্ষেত্রে অনলাইন পাঠদান চালু করতে পারা এক অবাস্তব পরিকল্পনা। কারণ স্বল্প আয়ের অভিভাবকদের অনলাইন পাঠদান গ্রহণ করাবার মতো উপকরণের ব্যবস্থা করা মোটেই সহজ ব্যাপার নয়। এই ধরনের স্কুলগুলির শিক্ষার্থীরা স্কুলের মিড ডে মিলের স্বাস্থ্যকর খাবার থেকেও বঞ্চিত হচ্ছে। এও এক ধরনের অর্থনৈতিক ও সামাজিক সুযোগের অপ্রাপ্তি।
সমস্যা-৩. উচ্চ, কারিগরি ও প্রযুক্তিগত এবং পেশাগত শিক্ষাক্ষেত্রে সমস্যা : উচ্চ শিক্ষাক্ষেত্র, কারিগরি ও প্রযুক্তিগত এবং পেশাগত
শিক্ষাক্ষেত্রে করোনা ভাইরাস জনিত এই প্রায় ৫ মাস পিছিয়ে যাওয়া ভারতবর্ষকে অর্থনৈতিক ভাবে প্রভাবিত করবে। ছাত্র-ছাত্রীদের বিদেশে পড়তে যাওয়ার হিসেবে ভারতবর্ষ দ্বিতীয় স্থানে রয়েছে, চীনের পরেই। পরিস্থিতির ব্যাপক পরিবর্তন না হলে দীর্ঘকালীন প্রভাব হিসেবে আন্তর্জাতিক উচ্চশিক্ষার ক্ষেত্রে ছাত্র-ছাত্রীদের আগ্রহ কমাটাই স্বাভাবিক।
সমস্যা-৪. পদ্ধতিগত সমস্যা : দীর্ঘকাল ধরে চলে আসা পাঠদানের পদ্ধতি অর্থাৎ বক্তৃতা পদ্ধতি ও ব্ল্যাকবোর্ড ব্যবহার করোনা ভাইরাসের মারক সংক্রমণ বাতিল করে দিয়েছে। সেটা স্বল্পকালীন না দীর্ঘকালীন তা সময় বলবে। তবে শিক্ষাক্ষেত্রে পাঠদানের মাধ্যম হিসেবে প্রযুক্তির নতুন নতুন উদ্ভাবন ও তার ব্যবহার ও প্রয়োগের সুযোগ এই সময় করে দিয়েছে। কীভাবে সমস্যাগত ভাবে এর বিচার বিশ্লেষণ করে শিক্ষার্থীদের সবাইকে স্বল্প খরচেই লার্নিং পদ্ধতির অন্তর্ভুক্ত করে বা অন্য কোনো রকম সুবিধেজনক ভাবে এই সমস্যার সঠিক সমাধান করা যায় তার দায়ভার শুধুমাত্র সরকারি নীতি নির্ধারকদের নয়, বরং শিক্ষার সঙ্গে সংশ্লিষ্ট বৃহত্তর সমাজের।
এ বিষয়ে বিশদে চিন্তন করতে গিয়ে বার বার একটা কথা মনে হয়েছে যে, মেকলে প্রবর্তিত প্রায় দুশো বছরের পুরনো এই প্রতিষ্ঠান নির্ভর শিক্ষাদানের পদ্ধতির পরিবর্তে ভারতবর্ষের প্রাচীনকাল থেকে চলে আসা সনাতন গুরুকুল পদ্ধতি যদি বর্তমানেও প্রবর্তিত থাকত তবে হয়তো সবচেয়ে বেশি শিক্ষার্থীর দেশ হিসেবে ভারতবর্ষের এতখানি ক্ষতিসাধন হতো না। উচ্চশিক্ষা বা কারিগরি ও প্রযুক্তিগত এবং পেশাগত শিক্ষার ক্ষেত্রে হয়তো বা সামান্য কিছু ক্ষতি হতো কিন্তু শুধুমাত্র সামাজিক সংক্রমণ রোধে এত বড়ো আকারে প্রতিষ্ঠান বন্ধের কোনো প্রয়োজন হতো না। সনাতন গুরুকুল পদ্ধতির ভিত এতটাই শক্তিশালী ছিল যে বৈদেশিক শত্রুর আক্রমণে বা অন্যান্য সংক্রমণজনিত মহামারী রোধে এই ধরনের কোনো ব্যবস্থা প্রাচীনকালে বা মধ্যযুগীয় আধুনিককালের থেকে পশ্চাদপদ সময়েও গ্রহণ করতে হয়নি। ভারতবর্ষের সনাতন নিরবচ্ছিন্ন শিক্ষার ধারা স্বতঃ প্রবাহিত থেকেছে। কোনো কোনো ক্ষেত্রে খুব আঞ্চলিক কোনো স্থান ব্যতিরেকে কোনো কারণেই খুব সাময়িক ভাবে হলেও কখনোই তার গতিরুদ্ধ হয়নি।
শুভেন্দু কুমার বক্সী
(লেখক দক্ষিণ দিনাজপুর জেলার ঠ্যাঙ্গাপাড়া উচ্চ বিদ্যালয়ের শিক্ষক)