শৃঙ্খল ছাড়া যাদের হারাবার কিছু নেই, তারাই কমিউনিস্ট। কমিউনিস্ট তথা বামপন্থীদের সংজ্ঞা নির্ধারণে এটাই ছিল প্রচলিত ধারণা। খাটো পাজামা, লম্বা ঝুল সুতির পাঞ্জাবি, কাধে ঝোলা ব্যাগ, পায়ে যেমন তেমন একটা চটি। এটাই ছিল কমিউনিস্টদের সার্বজনীন পোশাক। তা সে সোভিয়েতপন্থী, রাশিয়াপন্থী কিংবা চীনপন্থী যেমনই হোক না কেন। লেনিন, স্তালিন কিংবা মাও জেদং যাঁকেই তারা অভিভাবকত্বের শিরোপা দিয়ে থাকুন না কেন সবার পিঠে ছাপ ছিল একটাই—সর্বহারা। আর সেই পরিচয়েই এদের মানুষ দেখেছে খাদ্য আন্দোলনে, বর্গা আন্দোলনে, জোতদার-জমিদার-মহাজন প্রতিরোধ আন্দোলনে। এদের মানুষ দেখেছে একই পরিচয়ে মন্ত্রীর তখতে, বিধানসভা, লোকসভার বিতর্কের মঞ্চে। ওই সর্বহারাদেরই দেখেছি নকশালবাড়িতে, ওড়িশায়, অন্ধ্রপ্রদেশে। দেখেছি অন্য রূপেমুখোশের আড়ালে জঙ্গল মহলে, সিঙ্গুরে, নন্দীগ্রামে, বাঁকুড়া, ঝাড়গ্রাম, পুরুলিয়ার জঙ্গল মহলে।
হ্যা সত্যিই ওই সর্বহারাদেরই আবার দেখেছি কর্পোরেটের বড়োকর্তা হয়ে পুঁজিপতি দখলদারদের পায়ে তেল মাখাতে। ওই সর্বহারাদেরই দেখেছি খবরের কাগজের সম্পাদক হয়ে লাল থেকে সবুজ রঙের পরিণতগিরগিটি হতে। ওই সর্বহারাদেরই দেখেছি তৃণমলি হয়ে নেত্রীর সুরে সুর মিলিয়ে ক্যা-ক্যা ছিঃছিঃ করে রাজপথে চিলচিৎকার করতে। আবার ওই সর্বহারাদেরই দেখেছি সগর্বে ঘোষণা করতে—মাননীয়ার চেয়ে বড় কমিউনিস্ট আর কে আছে?
এবার দেখলাম এক নয়া রূপধারী সর্বহারা থুড়ি কমিউনিস্টদের। গোটা পৃথিবীতেই দাস ক্যাপিটাল যখন প্রায় নিষিদ্ধ হয়ে গেছে, যখন ভারতবর্ষের কমিউনিস্টরা স্বামী বিবেকানন্দের বেদান্তমার্গকে আঁকড়ে ধরে ডুবসাঁতার না জানা শিশুর মতো খাবি খাচ্ছে—তখনই এই নব্য কমিউনিস্টদের দেখা মিলল এবারের বইমেলায়। এদের মুখে স্লোগান—আজাদি (যা এতদিন ধরে কাশ্মীরের পাকপন্থীরা বলে এসেছে)। ধুলোমাখা পা পবিত্র গীতার ওপর।শৃঙ্খল ছাড়া যাদের হারাবার কিছু নেই, তাদের এ একনবরূপ পরিগ্রহ—আধুনিক রাজনীতির অবতার স্বরূপ। না, ঘাবড়াবার কিছু নেই। ভয় পাওয়ার তো প্রশ্নই ওঠে না। কারণ কমিউনিস্টদের স্বরূপ এটাই। এরা কোনোদিনই ভারতবর্ষ তথা ভারতবাসীর মঙ্গল চায়নি। এরা কোনোদিন নিজে বাবাকে বাবা বলেনি। অন্যের বাপকে বাপ বলে পরিচয় দিয়ে এসেছে। এরা কোনদিনই চায়নি ভারতবর্ষ একটি অখণ্ড শক্তিশালী দেশ হিসেবে আত্মপ্রকাশ করুক। এদের কাছে রোলমডেল ছিল পূর্ব ইউরোপ। তাই পূর্ব জার্মানি, পোল্যান্ড, হাঙ্গেরি, রোমানিয়া, বুলগেরিয়ায় পিপড়ের মৃত্যুতেও এরা শোকমিছিল বের করে কলকাতায়, কেরালায়, দিল্লিতে। অথচ খোদ নয়াদিল্লির বুকে হাজারো নির্ভয়া ধর্ষিতা হলেও এদের বুক ফাটে না। চোখে জল আসে
। আজ দেখেছেন, ওরা দাঁড়িয়ে মহান পবিত্র গীতার ওপর পা দিয়ে দাঁড়িয়ে পড়েছে। আগামীকাল দেখবেন ওরা পা তুলেছে মহাকাব্য রামায়ণ-মহাভারতের ওপরও। কিন্তু কোরানে? নৈব নৈব চ। কারণ এখন এই মুহূর্তে যখন গোটা ভারতবর্ষে চালু হয়ে গেছে নাগরিকত্ব আইন, তখন এই কমিউনিস্টদের পরম মিত্র পাকিস্তান। কারণ পাকিস্তান গড়তে জানে না, ভাঙতে জানে। ইসলাম রক্তদান করতে শেখায় না, রক্ত ঝরাতে জানে। কমিউনিস্টরা তো এটা চায়। ভারতবর্ষকে টুকরো টুকরো করে দিক বিদেশি শক্তি। তাহলে তথাকথিত বিশ্বের টুকরো টুকরো বামপন্থী দেশগুলিকে রেড কার্পেট পেতে অভ্যর্থনা জানাতে সুবিধা হবে মহম্মদ সেলিম, সীতারাম ইয়েচুরিদের। ভুললে চলবে না, ভারতবর্ষের কমিউনিস্টরাই কিন্তু স্বাধীনতার আগে মুসলিম লিগের পাকিস্তানের দাবিকে সর্বশক্তি নিয়ে সমর্থন করেছিল। ১৯৪৬ সালের ১৬ আগস্ট কলকাতায় মনুমেন্টের নীচে মুসলিম লিগের সভায় আলো করে বিরাজ করেছিলেন সর্বহারা কমরেড জ্যোতি বসু। সেই সভা থেকেই ডাইরেক্ট অ্যাকশনের ডাক দিয়েছিলেন শয়তান সোরওয়াবর্দি সরাসরি হিন্দুদের বিরুদ্ধে এবং গোটা কলকাতা শহর ভেসে গিয়েছিল হিন্দুর রক্তে। হিন্দুর লাশের পাহাড় পাহারা দিত শুধু শকুনেরা।
ভুললে চলবে না, এই কলকাতা শহরেই জন্ম নিয়েছিল কমিউনিস্ট পার্টি অব পাকিস্তান। মদত ছিল এ রাজ্যের কমরেডদের। কিন্তু পাকিস্তানে কমিউনিস্ট পার্টি শিকড় গাড়তে পারেনি। বরং রাজনৈতিক বন্দি হিসেবে কমিউনিস্ট পার্টির কৃষক আন্দোলনের নেত্রী ইলা মিত্রের ওপর রাজশাহি ও নবাবগঞ্জের জেলে মুসলিম লিগ যে অত্যাচার করেছিল তার নজির আর দ্বিতীয়বার সৃষ্টি হয়নি ভারতবর্ষের বুকে। কিন্তু ওই যে বলে, বিশ্বের বৃহত্তম বিশ্বাসঘাতক হলেন কমিউনিস্টরা। তাইইলা মিত্রের ওপর মুসলমানদের নির্মম অত্যাচারের পরেও বামপন্থীরা চিরকাল ইসলামি মৌলবাদকেই সমর্থন জানিয়ে এসেছেন। পশ্চিমবঙ্গে ৩৪ বছরের অপশাসনে এই কমিউনিস্টরাই সবচেয়ে বেশি মুসলমান অনুপ্রবেশকারীদের ঢুকিয়েছেন ভোটব্যাঙ্ক গড়ার জন্য। এই বিদেশি অনুপ্রবেশকারীদের ভোটার কার্ড, রেশন কার্ড তুলে দিয়েছে এই কমিউনিস্টরাই। আজ যখন কেন্দ্রে বিজেপি সরকার নাগরিকত্ব আইন সংশোধন করে নাগরিকত্ব ইস্যুতে ছড়িয়ে থাকা হাজারো জটিল সমস্যার সমাধান করতে যাচ্ছে তখন এই সর্বহারার দলই কলকাতায় যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয়, প্রেসিডেন্সি কলেজের ছাত্র-ছাত্রীদের খেপিয়ে তুলে ‘আজাদি’র স্লোগান দেওয়াচ্ছেন। দিল্লির জেএনইউ-এর ছাত্র-ছাত্রীদের, জামিয়া মিলিয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র-ছাত্রীদের ভুল বুঝিয়ে হিংসাশ্রয়ী আন্দোলনে নামাচ্ছেন। কলকাতার পার্ক সার্কাস ময়দান আর দিল্লির শাহিনবাগে অশিক্ষার অন্ধকারে ডুবে থাকা গরিব মুসলমান সম্প্রদায়ের মা-বোনেদের দিনের পর দিন বিস্তীর্ণ অঞ্চল দখল করে বসে থাকতে সাহস জোগাচ্ছে। উদ্দেশ্য তো একটাই, ভারতবর্ষের জাতীয়তাবাদের শিকড়ে আঘাত হানা, যাতে দেশ টুকরো টুকরো হয়ে যায়। তাতে বামপন্থীদেরই সুবিধা। বিভিন্ন রাজ্যে এলাকা ভিত্তিক স্বায়ত্তশাসন চলবে। যেমনটি কমিউনিস্ট নেতারা ভেবেছিলেন ১৯৪৩ সালে স্তালিন কমিউনিস্ট ইন্টারন্যাশালালের অস্তিত্ব ধুরে মুছে সাফ করে ফেলার পর। ভারতবর্ষের সর্বহারার নেতৃবৃন্দ বাসবপুন্নাইয়া, রাজেশ্বর রাও, সুরাইয়া, হনুমন্ত রাও, চন্দ্রশেখর রাও-রা সেদিন যেমন ভেবেছিলেন, আজকের কমিউনিস্ট নেতারাও একইরকম ভাবছেন। রাশিয়া না আসুক চীনই দখল নিক ভারতবর্ষের—যদি তা হয় পাকিস্তানের মদতে তো হোক। কিন্তু ভারতবর্ষকে এক থাকতে দেওয়া যাবে না।
গীতার ওপর পা এরা ছাড়া কারা তুলবে? রামায়ণ-মহাভারতকে এরা ছাড়া কারা ছুঁড়ে ফেলবে? বেদ উপনিষদকে এরা ছাড়া কারা যৌন সাহিত্য হিসেবে বদনাম দেবে? এরা ছাড়া কারা কথায় কথায় কোরান হাদিশের প্রসঙ্গ তুলবে? এরা ছাড়া কারা অফিস করবে মিনি পাকিস্তান আলিমুদ্দিন স্ট্রিটে? যৌক্তিকতায় বিশ্বাসী মানুষজন একটু ভেবে দেখবেন—ভারতবর্ষ এক সনাতন ঐতিহ্যের পরম্পরাবাহী দেশ। ভারতবর্ষ সেই দেশ যেখান থেকে উদ্মত হয়েছিল সভ্যতার প্রথম বাণী অসতো মা সঙ্গময়/তমসো মা জ্যোর্তিগময়। ভারতবর্ষ সরস্বতী সভ্যতার বাহক। সিন্ধু সভ্যতার ঐতিহ্যবাহী দেশ। এদেশের মানুষ হিন্দু কোনও একক ধর্মাচরণে বিশ্বাসী নয়। সর্বধর্ম সমন্বয়ের কথাই বলা হয় হিন্দুধর্মে। সেই হিন্দুধর্মের অন্যতম প্রধান জীবনবেদ হলো গীতা। সর্বহারারা জানেন, গীতাকে ধ্বংস করতে পারলে হিন্দুত্বও বিনাশ হয়ে যাবে।
তাই কলকাতা বইমেলায় যখন খ্রিস্টানরা অবাধে বিতরণ করেন বাইবেল, যখন মুসলমানরা অবাধে বিতরণ করেন কোরান, হাদিশ, তখন হিন্দুরা হনুমান চালিশা বিতরণ করলে সবার আগে আক্রমণ করে কমিউনিস্টরা। কারণ এরা জানে, ভারতবর্ষের ৮০শতাংশ হিন্দুকে ভয় দেখানো বেশি দরকার। এরা একত্রিত থাকলে দেশও একত্রিত থাকবে। তাই ২০ কোটি মুসলমানকে সঙ্গে নিয়ে অত্যাচারের নতুন জমানা তৈরি কর। সে জমানার প্রমাণ পশ্চিমবঙ্গ-সহ গোটা ভারতবর্ষে নাগরিকত্ব সংশোধনী আইনের বিরোধিতায় মুসলমানদের ভয়াবহ হিংস্রতার প্রকাশ। সে জমানার প্রমাণ শাহিনবাগ। সে জমানার প্রমাণ জওহরলাল নেহরু বিশ্ববিদ্যালয়, জামিয়া মিলিয়া বিশ্ববিদ্যালয়, যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয়, যেখানে মুসলমান ছাত্রদের লেলিয়ে দেওয়া হয় রাজ্যপালের বিরুদ্ধেও।
কাশ্মীরের শেখ আবদুল্লা যে বিচ্ছিন্নতাবাদী নেতা ছিলেন তাতে কারও দ্বিমত থাকার কথা নয়। তারই প্রত্যক্ষ মদতে ১৯৪২ সালে শ্রীনগরে গঠিত হয় কমিউনিস্ট পার্টির কাশ্মীর শাখা। ১৯৪৬ সালের কমিউনিস্টরা সরাসরি কাশ্মীরের পাকপন্থী আন্দোলনকে সমর্থন দেয়। তখন শেখ আবদুল্লার ন্যাশনাল কনফারেন্সে ঝাঁকে ঝাঁকে সদস্যপদ নিয়েছেন কমিউনিস্টরাই। শেখ আবদুল্লার সরকারেও যোগ দিলেন একঝক কমিউনিস্ট। শেখ আবদুল্লার প্রধান উপদেষ্টা তিনিও কমিউনিস্ট বি পি এল বেদি। এদেরই মদতে ১৯৪৮ সালে কাশ্মীরের মাটিতে বিদ্রোহের আগুন জ্বলে উঠেছিল। আর কাশ্মীরের উপমুখ্যমন্ত্রী বক্সি গোলাম মহম্মদ তো প্রকাশ্যেই স্বীকার করতেন, তিনি কমিউনিস্ট। স্বাধীন কাশ্মীরের প্রধান পৃষ্ঠপোষকও তো ছিলেন তিনিই।
তাহলে কমিউনিস্টদের বরাবরই নজর এলাকাভিত্তিক স্বায়ত্তশাসনের ওপর।নকশালবাড়ি আন্দোলনও তো প্রাথমিক পর্যায়ে ছিল এলাকাভিত্তিক স্বায়ত্তশাসনের আন্দোলন- যেটিকে চীন। বলেছিল—‘ভারতের আকাশে বসন্তের বজ্রনির্ঘোষ’ বড়ো উল্লাসিত হয়েছিলেন সর্বহারা চাটুকাররা। তাই তো নিঃসঙ্কোচে কলকাতার দেওয়াল জুড়ে লেখা হয়েছিল—‘চীনের চেয়ারম্যান আমাদের চেয়ারম্যান’। আজও সেই লালসা বিদ্যমান। কারণ ভারতবর্ষকেটুকরো টুকরো করতে চাওয়া প্রায় সব শক্তিকেই মদত জুগিয়েছে সর্বহারারা চিরকাল আর স্লোগান তুলেছে—“শৃঙ্খল ছাড়া হারাবার কিছু নেই।
থাকবেটা কী? আজন্ম কমিউনিস্টরা দেশকে কী দিয়েছে? অবিশ্বাস, বঞ্চনা, হিংসা, বিশ্বাসঘাতকতা, লোভ, রিরংসা, কৃত্রিমতা আর মিথ্যাচারিতা। তার পরিণতিতে তো পাবে শৃঙ্খলই। আর কী চাও? মনে পড়ে, এই সেদিন ১৯৭১-এও তোমরা সর্বহারারাই বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধ ভেস্তে দিতে হাত মিলিয়েছিলে রাজাকারদের সঙ্গে। এই কলকাতাতেই তো জন্ম নিয়েছিল বাংলাদেশ কমিউনিস্ট পাটি (লেনিনবাদী)।
মনে রাখবেন, কাশ্মীরের পণ্ডিত পরিবারের মেয়েদের ধর্ষণ করলে কমিউনিস্টরা পথে নামে না। কিন্তু সন্ত্রাসবাদী আফজল গুরুর ফাসি হলে এরা পথে নামতে বিন্দুমাত্র সময় নেয় না। তাহলে এরা গীতার ওপর পা তুলে দাঁড়ালে আশ্চর্য হবার কিছু নেই।
স্বাধীনতার আগে থেকেই কমিউনিস্টরা এইভাবেই নােংরা রাজনীতি করে এসেছে। কিন্তু শিকড় ছড়াতে পারেনি। এবারে তারা গীতা পা দিয়ে মাড়িয়েছেন। স্বপ্ন দেখেছেন ‘ভারত তেরে টুকরে হোঙ্গে, ইনসাল্লা ইনসাল্লা। কিন্তু এবারও শিকড় ছড়ানো গেল না। তার আগেই বইমেলা শেষ হলো। শাহিনবাগও।
কমিউনিস্টদের হাতে পেনসিল ছাড়া আর কিছুই বোধহয় রইল না।
সুজিত রায়