কমিউনিস্ট চীনের স্বরূপ ধীরে ধীরে উন্মােচিত হচ্ছে


চীন গরিব দেশগুলােকে ঋণের জালে জর্জরিত করে এমনকী ঋণগ্রস্ত দেশের ভূমি পর্যন্ত নিয়ে নিচ্ছে। শ্রীলঙ্কার হাম্বানটোটা বন্দর ৯৯ বছর লিজে দখল নেওয়া তারই উদাহরণ। এভাবে আফ্রিকান দেশ জিবুতিতে গড়ে তুলেছে সামরিক ঘাঁটি। সম্প্রতি শ্রীলঙ্কার নতুন সরকারের পররাষ্ট্রমন্ত্রী প্রকাশ্যেই বলেছেন হাম্বান টোটা বন্দর চীনের কাছে ইজারা দেওয়া ছিল একটি ভুল সিদ্ধান্ত।
প্রথম পর্ব
কমিউনিস্ট চীনের স্বরুপ ধীরে ধীরে উন্মােচিত হচ্ছে। এক সময় মার্কিন সাম্রাজ্যবাদ ধ্বংস হােক’ স্লোগানটি খুব জনপ্রিয় ছিল এই উপমহাদেশে, বাংলাদেশেও। এখন সেই স্লোগান দুর্বল হয়ে পড়েছে, শােনা যায় না। তবে বিশ্বজুড়ে নতুন স্লোগান উঠে আসছে— ‘চীনা সাম্রাজ্যবাদ রুখে দাঁড়াও’
চীন যেভাবে থাবা বিস্তৃত করছে, শক্তি দিয়ে কিংবা ঋণের জালে আবদ্ধ করে একের পর এক ভূখণ্ড দখল করছে, দাবি করছে, তাতে গােটা এশিয়া তাে বটেই গােটা বিশ্বেই এক নতুন পরিস্থিতির সৃষ্টি হয়েছে। প্রশ্ন উঠছে, চীন কি বিশ্বের এক নম্বর মােড়লের ভূমিকা নিতে চায়?
বাংলাদেশের মানুষের মধ্যে যারা স্বাধীনতা চেয়েছেন, মুক্তিযুদ্ধ করে দেশ স্বাধীন করেছেন, তাঁদের কাছে চীনের এইরূপ নতুন নয়। পাকিস্তান আমলে চীন গণতন্ত্র হত্যায় পাকিস্তানি সেনানায়কদের সহায়তা করেছে, বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধে তাই স্বাভাবিকভাবেই চীন ছিল বিরুদ্ধে। অস্ত্র দিয়ে, অর্থ দিয়ে পাকিস্তানি বাহিনীকে মুক্তিসংগ্রামীদের বিরুদ্ধে লড়াইয়ে মদত দিয়েছে, ত্রিশ লক্ষ বাঙ্গালি হত্যা, চার লক্ষেরও বেশি নারী নির্যাতন ও ধর্ষণে চীন সক্রিয়ভাবে সহায়তা করেছে। এক কোটিরও বেশি শরণার্থীকে ভারতভূমিতে আশ্রয় নিতে বাধ্য করেছে পাকিস্তানি সেনারা। চীন বলছে, পাকিস্তানি সেনারা কোনাে অত্যাচার করেনি। বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধ ঠেকাতে চীন ভারত সীমান্তে সৈন্য মােতায়েন করেছিল, হুমকি দিয়েছিল ভারত আক্রমণের। কিন্তু বাংলাদেশের অভ্যুদয় ঠেকাতে পারেনি চীন। ভারতের সহযােগিতায় মুক্তিবাহিনী পাকিস্তানি হানাদার বাহিনীকে আত্মসমর্পণে বাধ্য করেছে। প্রায় ৯০ হাজার সেনা নিয়ে পাকিস্তানের পূর্বাঞ্চলীয় অধিনায়ক লে. জেনারেল নিয়াজি আত্মসমর্পণ করেন। বাংলাদেশ-ভারত যৌথ কমান্ডের অধিনায়ক লে. জেনারেল জগজিৎ সিংহ অরােরার কাছে রেসকোর্স ময়দানে, যেখানে একাত্তরের ৭ মার্চ এক জনসমুদ্রে দাঁড়িয়ে স্বাধীনতার ডাক দিয়েছিলেন বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান।।
এই পরাজয়টা শুধু পাকিস্তানের ছিল না, ছিল চীনেরও। চীন ভুলতে পারেনি এই পরাজয়ের কথা। পুরাে যুক্তিযুদ্ধের নয় মাস চীনপন্থী কমিউনিস্টরা কিংবা মাওবাদীরা বাংলাদেশে পাকিস্তানি হানাদারদের সঙ্গে কাঁধে কাঁধ মিলিয়ে মুক্তিযােদ্ধাদের হত্যা করেছে। চীনের তত্ত্ব ছিল, ভারত আওয়ামি। লিগকে নিয়ে পাকিস্তান ভাঙছে। স্বাধীন। বাংলাদেশের অভ্যুদয়ের পর পিপলস ডেইলি লিখেছিল, ‘ভারতীয় সৈন্যরা পূর্ব। পাকিস্তান দখল করেছে। সম্প্রসারণবাদী। ভারত সেখানে ঘাঁটি গেড়ে বসে থাকবে। চীনপন্থী কমিউনিস্ট পার্টি কিংবা মাওবাদী বলে কথিত উগ্রবাদীরা তাদের দলের নাম পরিবর্তন করেনি। পূর্ব-পাকিস্তানই বহাল রেখেছিল বঙ্গবন্ধু নিহত না হওয়া পর্যন্ত। কিন্তু দুর্ভাগ্য চীনের, দুর্ভাগ্য চীনপন্থী তথাকথিত বিপ্লবীদের, ভারতীয় সেনারা তিন মাসও বাংলাদেশে অবস্থান করেনি। বিশ্বে এই ধরনের কোনাে নজির নেই। চীন। রচিত ‘ভারতের পূর্ব পাকিস্তান দখল’ তত্ত্ব খারিজ হওয়া সত্ত্বেও বঙ্গবন্ধু যতদিন বেঁচে ছিলেন ততদিন চীন বাংলাদেশকে স্বীকৃতি দেয়নি। জাতিসঙ্ঘে সদস্যপদও ঠেকিয়ে রেখেছিল। চীনের স্বীকৃতি আসে বঙ্গবন্ধু সপরিবারে নিহত হওয়ার পর। অভিযােগ আছে, ইতিহাসের এই ভয়াবহতম হত্যাকাণ্ডে চীনেরও মদত ছিল। এই ধারণা জোরদার হয় এ কারণে যে, বঙ্গবন্ধু নিহত হওয়ার পর হত্যাকারীরা সরকার গঠন করার কয়েকদিনের মধ্যেই চীন স্বীকৃতি দেয় এবং হত্যাকারীদের সরকারের প্রতি সবরকম সাহায্যের হাত বাড়িয়ে দেয়। জানা যায়, চীনের ইঙ্গিতেই বঙ্গবন্ধুর খুনিদের সরকার আগস্ট হত্যাকাণ্ডের পরপরই পাকিস্তানের সঙ্গে ইসলামিক কনফেডারেশন গঠনের প্রস্তুতি নিয়েছিল। কিন্তু ভারত একথা জানতে পেরে তীব্র প্রতিক্রিয়া ব্যক্ত করে, তৎকালীন হাইকমিশনার বঙ্গভবনে গিয়ে ভারত সরকারের মনােভাব জানিয়ে দেন। ফলে মােশতাক সরকার বা পরবর্তী সময়ে জিয়াউর রহমানের সরকার আর সে পথে পা বাড়ায়নি।
বাংলাদেশে ক্ষমতাসীন একাত্তরের মুক্তিযুদ্ধ ও স্বাধীনতাবিরােধী সরকারগুলাে ভারতকে ঠেকাতে ইসলামকে হাতিয়ার করে পাকিস্তানের হাত ধরে— চীন কার্যত এটাই চেয়েছিল। বঙ্গবন্ধু হত্যাকাণ্ডের পর এসব সরকারের আমলে বাংলাদেশ চীনের চোখে ‘স্বাধীন দেশে পরিণত হয়। সমরাস্ত্র থেকে শিল্প-বাণিজ্য সব মুঠোয় পুরে নেওয়ার ‘যুদ্ধে’ নামে এবং সফল হয়। বড়াে বড়াে প্রকল্প হাতে আসে। প্রকল্প ও বিনিয়ােগের আশ্বাসের ফঁাদের এই ধারবাহিকতা থেকে বর্তমান শেখ হাসিনা সরকারও বেরিয়ে আসতে পারেনি। ফাদ বলছি এজন্যে যে, চীন সরকার তাদের প্রতিষ্ঠানগুলাের কাজ বাগানাের জন্যে রাজনৈতিক চাপের পাশাপাশি বড়াে বড়াে অঙ্কের ঘুষ প্রদান ‘জায়েজ’ করেছে। বিশ্বের সবখানে চীন এই কৌশলে কাজ করে। নির্ধারিত কাজ পাওয়ার পর সরকারের ‘বড়াে কর্তাদের সঙ্গে যােগসাজশ করে প্রকল্পের বরাদ্দ ধাপে ধাপে বাড়াতে শুরু করে, নইলে কাজের গতি থামিয়ে দেয়। এবং বাড়তি বরাদ্দ মঞ্জুর হওয়ার পর ভাগাভাগি হয়ে যায়। বিশ্বখ্যাত চীনা প্রতিষ্ঠানের ঘুষ দেওয়া ধরা পড়ে যাওয়ায় কালাে তালিকাভুক্ত হওয়ার ঘটনাও ঘটেছে। দেখা গেছে, কালাে তালিকা থেকে প্রতিষ্ঠানকে মুক্ত করার জন্য চীনের রাষ্ট্রদূত দৌড়ঝাপ পর্যন্ত করেছেন। এসব খবর সংবাদপত্রে প্রকাশিত হয়েছে। তবে স্বস্তির কথা এই যে, বাংলাদেশে অর্থনীতিবিদ ও গবেষকরা এ ব্যাপারে এখন মুখ খুলতে শুরু করেছেন। লেখালেখি শুরু হয়েছে। তারা চীনের ঋণ নেওয়ার ব্যাপারে সরকারকে সাবধান করছেন, চীনা কৌশল সম্পর্কে তথ্যগুলাে তুলে ধরেছেন। আগের তুলনায় সচেতনতা তৈরির চেষ্টা চলছে।
সুপ্রিম কোর্টের অবসরপ্রাপ্ত বিচারপতি শামসুদ্দিন চৌদুরী মানিক সম্প্রতি এক নিবন্ধে বলেছেন, “আজ চীন বিশ্বময় একটি আগ্রাসী জাতি হিসেবে পরিচিত। সমুদ্র সংক্রান্ত আন্তর্জাতিক চুক্তিসমূহ লঙ্ঘন করে সে দক্ষিণ চীন সাগর এবং সেখানকার কয়েকটি দ্বীপ দখলের চেষ্টায় লিপ্ত যার জন্য ওই অঞ্চলের ২০টি দেশের সঙ্গে তার যুদ্ধাবস্থা বিরাজ করছে এবং এসব দেশের মধ্যে রয়েছে সমাজতান্ত্রিক ভিয়েতনাম, মালেয়েশিয়া, ব্রুনাই, অস্ট্রেলিয়া প্রভৃতি (কয়েকদিন আগে ভারতও দক্ষিণ চীন সাগরে রণতরী পাঠিয়েছে)। আন্তর্জাতিক আইন অনুযায়ী সাগর ও সাগর তলের সম্পদ সব দেশের সম্পদ হওয়ায় বিশ্বের সব দেশ চীনের এই আগ্রাসী ভূমিকার বিরুদ্ধে অবস্থান নিয়েছে। চীন তাইওয়ান, কমিউনিস্ট দেশ ভিয়েতনাম ও ভুটানের অংশ বিশেষ দখলেরও পাঁয়তারা করছে বিধায় এই দেশগুলাে শঙ্কিত। অতীতে বেআইনিভাবে তিব্বত দখল করেছে। ১৯১৪ সালে সিমলা চুক্তির সৃষ্টি ম্যাকমােহন লাইন লঙ্ঘন করে সম্প্রতি কয়েকজন ভারতীয় সৈন্যকে হত্যা করেছে।
চৌধুরী আরও বলেছেন, গ্রাম্য মহাজনদের মতাে চীন গরিব দেশগুলােকে ঋণের জালে জর্জরিত করে এমনকী ঋণগ্রস্ত দেশের ভূমি পর্যন্ত নিয়ে নিচ্ছে। শ্রীলঙ্কার হাম্বান টোটা বন্দর ৯৯ বছর লিজে দখল নেওয়া তারই উদাহরণ। এভাবে আফ্রিকান দেশ জিবুতিতে গড়ে তুলেছে সামরিক ঘাঁটি। সম্প্রতি শ্রীলঙ্কার নতুন সরকারের পররাষ্ট্রমন্ত্রী প্রকাশ্যেই বলেছেন হাম্বান টোটা বন্দর চীনের কাছে ইজারা দেওয়া ছিল একটি ভুল সিদ্ধান্ত।
ঢাকা থেকে বিশেষ প্রতিনিধি

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

This site uses Akismet to reduce spam. Learn how your comment data is processed.