বাঙ্গালি হিন্দুর হোমল্যান্ডের চাবি নাগরিকত্ব সংশোধনী বিল #IndiaSupportsCAA

২০১৮ সালের ২২ সেপ্টেম্বর কোচবিহার ও আলিপুরদুয়ারে এন আর সি নিয়ে আলোচনা সভা অনুষ্ঠিত হয়। ওই বছরই বিভিন্ন সময়ে জলপাইগুড়ি, মালদা, গাজল শহরেও অনুষ্ঠিত হয় আলোচনা সভা। এই পাঁচটি সভাকে ঘিরে মানুষের আগ্রহ ও ভিড় ছিল চোখে পড়ার মতো। এই প্রতিবেদক ও রন্তিদেব সেনগুপ্ত বক্তা হিসেবে এই পাঁচটি সভাতেই উপস্থিত ছিলেন। প্রত্যেকটি আলোচনা সভার শেষে ছিল প্রশ্নোত্তর পর্ব। সেই প্রশ্নোত্তর পর্ব যেন এখনো শেষ হয়নি, প্রায় প্রতিদিনই বিভিন্ন নাগরিক কার্যক্রমে তো বটেই মোবাইল ফোনের মাধ্যমেও সিটিজেনশিপ অ্যামেন্ডমেন্ট বিল (সিএবি) এবং এন আর সি নিয়ে উদ্বিগ্ন মানুষের প্রশ্নের সম্মুখীন হতে হচ্ছে। প্রতিনিয়ত মানুষের কাছ থেকে যে সমস্ত প্রশ্ন আসছে সেগুলি থেকে বাছাই করা কিছু প্রশ্ন নিয়ে প্রশ্নোত্তরে সিএবি তুলে ধরার প্রয়াস করা হলো।
কেন্দ্রের বিজেপি নেতৃত্বাধীন সরকার কিনাগরিকত্ব সংশোধনী বিল, ২০১৬ এবং এনআরসি চালুর কথা বলে দেশ জুড়ে একটি অস্থিরতা তৈরি করল না? বিশেষ করে দেশভাগের পর ভারতে এসে বছরের পর বছর ধরে নিশ্চিন্তে বসবাসকারী হিন্দুদের নতুন করে উদ্বাস্তুর তকমা দিয়ে বিপদে ফেলে দিল না?
উত্তর : দেশভাগের পর লক্ষ লক্ষ মানুষ উদ্বাস্তু হয়ে এই দেশে এসেছে, রেশন কার্ড বানিয়েছে, ভোটাধিকার প্রয়োগ করছে, জনপ্রতিনিধি হিসেবে নির্বাচিতও হয়ে যাচ্ছে, প্রয়োজন মতো স্থাবর অস্থাবর সম্পত্তির মালিক হচ্ছে, চাকুরি, ব্যবসা বা অন্য কোনো পেশা অবলম্বন করে আর দশটা ভারতীয় নাগরিকের মতো সমস্ত নাগরিক সুযোগ সুবিধা ভোগ করছে। অপ্রিয় হলেও এটাই সত্য যে এই সমস্ত মানুষের অধিকাংশই দেশভাগের পর থেকে বছরের পর বছর ধরে ভারতে বসবাস করে সমস্ত রকম নাগরিক অধিকার ভোগ করলেও এদেশের নাগরিকত্ব আইনের কষ্টিপাথরে নিজেদের নাগরিকত্বের বৈধতা যাচাই করেনি। জমির দলিল, রেশন কার্ড, ভোটার কার্ড, আধার কার্ড, পাশপোর্ট কিংবা ড্রাইভিং লাইসেন্সের মতো নথিগুলি যে কোনো ব্যক্তির ভারতের নাগরিকত্বের গ্যারান্টি দেয় না এই বিষয়টি এখন অনেকের কাছেই স্পষ্ট। ভারতে নাগরিকত্ব আইন আছে, কিন্তু সেই আইন অনুসারে নাগরিকপঞ্জি নেই। ফলে বিভ্রান্তি চরমে। বর্তমান পরিস্থিতিতে কে এদেশের নাগরিক, আর কে নাগরিক নয় এটা নির্ণয় করা কঠিন ব্যাপার। অসমের অভিজ্ঞতা বলছে শিক্ষা, সচেতনার অভাব কিংবা প্রাকৃতিক বিপর্যয় জনিত কারণের জন্য এদেশের অনেক প্রকৃত নাগরিকের নাগরিকত্ব প্রমাণের প্রয়োজনীয় নথি নেই। ১৯৪৭-এর দেশভাগ ও ১৯৭১-এ বাংলাদেশের জন্মের সময় সুনামির ঢেউয়ের মতো আছড়ে পড়েছিল ভারতমুখী উদ্বাস্তুর স্রোত এবং প্রতিবেশী দেশগুলিতে ইসলামিক জেহাদের সৌজন্যে সেই স্রোতধারা এখনো গতিশীল। বিশাল সংখ্যক উদ্বাস্তুর বোঝা নিয়ে ভারতবর্ষ স্বাধীন হয়েছে। স্বাধীনতার সাত দশক অতিক্রান্ত হয়ে গেলেও লক্ষ লক্ষ উদ্বাস্তুর নাগরিকত্বের প্রশ্ন নিয়ে কোনো নীতি নির্ধারণ হয়নি। ফলে অসমে জাতীয় নাগরিকপঞ্জি তৈরি করতে গিয়ে লক্ষ লক্ষ উদ্বাস্তু ও প্রকৃত নাগরিকের নাম নথিভুক্ত হয়নি। সিটিজেনশিপ অ্যামেন্ডমেন্ট বিল এনে উদ্বাস্তুদের বিশেষ করে বাঙ্গালি হিন্দুদের নাগরিকত্ব প্রদানের সুনির্দিষ্ট নীতি প্রণয়ন করে বর্তমান বিজেপি নেতৃত্বাধীন কেন্দ্রীয় সরকার এই সমস্যা সমূলে উৎপাটন করতে। উদ্যোগী হয়েছে। নাগরিকত্ব নিয়ে সুনির্দিষ্ট নীতি প্রণয়ন ও জাতীয় নাগরিক পঞ্জীকরণ দুটোই কঠিন ও জটিল কাজ। এই জটিল কাজ করতে গিয়ে যে সমস্ত জটিলতা তৈরি হয়েছে তা সাময়িক।
এই বিলে মুসলমানদের নাগরিকত্ব প্রদানের উল্লেখ নেই কেন? ভারতের মতো ধর্মনিরপেক্ষ দেশে এ রকম একটি সাম্প্রদায়িক পরিকল্পনা আইনে পরিণত হয় কী করে?
উত্তর : নাগরিকত্ব সংশোধনী আইন কখনই সাম্প্রদায়িক নয়। কারণ এই সংশোধনীর ফলে কোনো একটি বিশেষ সম্প্রদায় বা ধর্মীয় গোষ্ঠী উপকৃত হচ্ছে না। বাংলাদেশ, পাকিস্তান, আফগানিস্তান থেকে উদ্বাস্তু হয়ে আসা সমস্ত ধর্মীয় সংখ্যালঘু যারা অত্যাচারিত হয়ে বা অত্যাচারের ভয়ে ভারতে চলে এসেছেন তাদের প্রত্যেকের জন্যই এই আইন প্রযোজ্য। বাংলাদেশ বা পাকিস্তানে এমন কোনো ঘটনা ঘটেনি যেখানে সেদেশের সংখ্যাগুরু মুসলমানরা অত্যাচারিত হয়ে আশ্রয় নিচ্ছেন বা আশ্রয় প্রার্থনা করছেন। তবে আশ্রয় প্রার্থনা। করলে যে সম্মানের সঙ্গে আশ্রয় দেওয়া হয় তার প্রমাণ তসলিমা নাসরিন। সেজন্য ওই দেশগুলি থেকে গোপনে সীমান্ত অতিক্রম করে ভারতে আশ্রয় নেওয়া মুসলমানদের ক্ষেত্রে নাগরিকত্বের ক্ষেত্রে কোনো রকম বিশেষ ছাড়ের যৌক্তিকতা নেই।
আপনি পশ্চিমবঙ্গকে যতই বাঙ্গালি হিন্দুদের হোমল্যান্ড বলুন না কেন ভারতীয় সংবিধানের ১৯৫৫ সালের নাগরিকত্ব আইনের সেকশান ৩(২) (খ) অনুযায়ী এরা সবাই অবৈধ অনুপ্রবেশকারী। ১৯৪৬ ফরেনার্স অ্যাক্ট এবং ১৯২০ পাসপোর্ট অ্যাক্ট অনুযায়ী এদের গ্রেপ্তার করা যায়।
উত্তর : আপনি একদম ঠিক বলেছেন। ২০১৫ সাল পর্যন্ত ওঁরা সবাই অবৈধ অনুপ্রবেশকারী বলেই গণ্য হতেন। ২০১৫ সালে এই দুটি আইনের সংশোধন করে বাংলাদেশ, পাকিস্তান ও আফগানিস্তান। থেকে আগত হিন্দু, বৌদ্ধ, খ্রিস্টান, জৈন ও পার্সিদের এই দুটি আইনের আওতা থেকে ছাড় দেওয়া হয়েছে। এখন তাঁরা অবৈধ। অনুপ্রবেশকারী নন। ওদের লং টার্ম ভিসার পদ্ধতিতে পরিবর্তন করে ভারতে চাকরি, বসবাস ও সম্পত্তি ক্রয়ের অধিকার দেওয়া হয়েছে।
মানবতার প্রশ্নই যদি আসে তাহলে ভারত মায়ানমারের রোহিঙ্গাদের আশ্রয় দিচ্ছে না কেন?
উত্তর : রোহিঙ্গা মুসলিমদের হাতে লেগে রয়েছে রোহিঙ্গা হিন্দুদের, বৌদ্ধদের গণহত্যার রক্ত। রোহিঙ্গা মুসলমানরা রোহিঙ্গা হিন্দুদের গণহত্যার জন্য দায়ী এটা অ্যামেনেস্টি ইন্টারন্যাশানালও মেনে নিয়েছে। একমাত্র অত্যাচারিতরাই শরণার্থীর সম্মান পেতে পারে, খুনি অত্যাচারীরা নয়।
নাগরিকত্ব (সংশোধনী) বিল, ২০১৬ অর্থাৎ সিটিজেনশিপ (অ্যামেন্ডমেন্ট) বিল, ২০১৬ আসলে কী?
উত্তর : নাগরিকত্ব আইন, ১৯৫৫-এর সেকশান (২) এর সাব সেকশান (১), ক্লজ (b) এর পরে এই সংশোধনী অন্তর্ভুক্ত হবে। কোনো ব্যক্তি যদি বাংলাদেশ, পাকিস্তান ও আফগানিস্তানের। সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ভুক্ত অর্থাৎ হিন্দু, শিখ, বৌদ্ধ, জৈন, পার্সি অথবা খ্রিস্টান হন যারা কেন্দ্রীয় সরকার দ্বারা বিশেষ ছাড় প্রাপ্ত, যিনি ১৯২০ সালের পাসপোর্ট (Entry into India) আইনের সেকশান (3) এর সাব-সেকশান (২) এর ক্লজ (c) অথবা বিদেশি আইন, ১৯৪৬ ধারা সমূহ কিংবা অন্য কোনো আদেশনামার আওতার অন্তর্গত হন, এই আইনানুসারে তাকে কোনো ক্ষেত্রেই অবৈধ অভিবাসী হিসেবে গণ্য করা যাবে না।
বাংলাদেশ, পাকিস্তান ও আফগানিস্তানের সংখ্যালঘু হিন্দু, শিখ, বৌদ্ধ, জৈন, পারসি অথবা খ্রিস্টান সম্প্রদায়ভুক্ত মানুষেরা এতকাল বৈধ কাগজ পত্র ছাড়া ভারতে প্রবেশ করলে অথবা বৈধ কাগজ পত্র নিয়ে প্রবেশ করার পর সেই কাগজের মেয়াদ শেষ হয়ে গেলে তারা অবৈধ অনুপ্রবেশকারী হিসেবে গণ্য হতেন এবং এদেশের। নাগরিকত্বের আবেদনের জন্য যোগ্য বলে বিবেচিত হতেন না। বর্তমান সংশোধনের মাধ্যমে উপরে উল্লেখিত তিনটি দেশের পাঁচটি সম্প্রদায়ের মানুষ যে ভাবেই প্রবেশ করুন না কেন তারা আর অবৈধ অভিবাসী হিসেবে গণ্য হবেন না এবং নাগরিকত্বের আবেদনের জন্য যোগ্য বলে বিবেচিত হবেন। অর্থাৎ তিনি একজন ভারতীয় নাগরিকের সমান মর্যাদা পাবেন।
আরও বলা হয়েছে যদি কোনো ব্যক্তি ইতিমধ্যেই অভিযুক্ত হন। বা বিচারাধীন হন তাহলে এই আইন পাশ হওয়ার পরে তার বিরুদ্ধে। সমস্ত আইনি কার্যকলাপ এই বিল পাশের সময় থেকে বন্ধ করতে হবে এবং সেই ব্যক্তি নাগরিকত্বের জন্য সেকশান (৬) এর আওতায় আবেদন করতে পারবেন। স্পষ্টতই অসমের ডিটেনশান ক্যাম্পে বাংলাদেশ, পাকিস্তান ও আফগানিস্তানের যে সমস্ত হিন্দু, শিখ, বৌদ্ধ, জৈন, পারসি অথবা খ্রিস্টান বন্দি আছেন ওরা সবাই মুক্তি পাবেন। এছাড়া অন্যদের মুক্তির জন্য আদালতের দ্বারস্থ হতে হবে।
অনেকের মতে নাগরিকত্ব (সংশোধনী) বিল, ২০১৬ বেআইনি অর্থাৎ সংবিধান সম্মত নয়। এই বক্তব্য কতটা সত্য?
উত্তর : এই ধরনের বক্তব্য ঠিক নয়। ১৯২০ সালের পাসপোর্ট আইনের সেকশান (৩) এর ভিত্তিতে ভারত সরকার ১৯৫৫-র নাগরিকত্ব আইনে সংশোধনী আনতে পারে অর্থাৎ এর দ্বারা বর্তমান। আইনের কোনো বিশেষ ধারার বশবর্তী না হয়ে কোনো ব্যক্তি বা ব্যক্তিসমূহকে শর্তাধীন বা নিঃশর্ত ছাড় দিতে পারে।
নাগরিকত্ব আইন ১৯৫৫-এর সেকশান (৬) তে কীভাবে । নাগরিকত্ব প্রদানের কথা বলা হয়েছে?
উত্তর : নাগরিকত্ব আইন ১৯৫৫-র সেকশান (৬) হলো সিটিজেনশিপ বাই ন্যাচারালাইজেশান অর্থাৎ যেখানে বিশেষ ক্ষেত্রে কেন্দ্র সরকার নাগরিকত্ব প্রদান করতে পারেন যদি তিনি অবৈধ অনুপ্রবেশকারী না হন। নাগরিকত্ব সংশোধনী বিল ২০১৬-এর চার নম্বর ধারায় বলা হচ্ছে—
In the principal Act, in the Third Schedule, in clause (d), the following provison shall be inserted, namely : “Provided that for the persons belonging to minority communities, namely, Hindus, Sikhs, Buddhists, Jains, Parsis and Christians from Afghanistan, Bangaladesh and Pakistan, the aggregate period of residence or service of a Government in India as required under this clause shall be read as ‘not less than six years’ in place of ‘not less than eleven years.”
অর্থাৎ মূল নাগরিকত্ব আইন ১৯৫৫-এর তৃতীয় পর্যায়ে, ক্লজ (D) অনুযায়ী শুধুমাত্র উপোরক্ত তিনটি দেশের পাঁচটি সম্প্রদায়ের ক্ষেত্রে নাগরিকত্বের আবেদনের জন্য উল্লিখিত সময়সীমা ১১ বছর। থেকে কমিয়ে ছয় বছর করা হয়েছে।
অনেকেই বলছেন এই বিল সংবিধানের ধারা (১৪)-কে লঙ্ঘন করছে।
উত্তর : এই বিল কোনো ভাবেই সংবিধানের ধারা (১৪)-কে লঙ্ঘন করেনি। এই ধারায় আইনের ক্ষেত্রে সকলের সমানাধিকার এবং সকলকে সমানভাবে নিরাপত্তা দেওয়ার কথা বলা হয়েছে। ১৯৪৭-এর ১৪ আগস্ট মধ্যরাত্রে সংবিধান সভার প্রথম ভাষণে ভারতের প্রথম প্রধানমন্ত্রী জওহরলাল নেহরু বলেছিলেন, “We think also of our brothers and sisters who have been cut off from us by political boundaries and who unhappily cannot share at present in the freedom that has come. They are of us and will remain of us whatever may happen, and we shall be sharers in their good and ill fortune alike.’ এই সূত্র অনুসারে বাংলাদেশ, পাকিস্তান, আফগানিস্তানে অত্যাচারিত প্রত্যেকটি সংখ্যালঘুকে নিরাপত্তা প্রদান করা ভারতের কর্তব্য। ভারতবর্ষে শরণার্থী আইন থাকলে এই শরণার্থীদের সেই আইনে সহায়তা দেওয়া যেত। কিন্তু সেরকম আইন যেহেতু নেই। সেজন্য নাগরিকত্ব আইনে সংশোধনী এনেই সেই ব্যবস্থা করতে হবে।
নাগরিকত্বের আবেদনের ক্ষেত্রে ছয় বছর বসবাসের প্রমাণ হিসেবে কী ধরনের নথি প্রয়োজন?যারা চাকরি করছেন তাদের কী হবে?
উত্তর : নাগরিকত্ব (সংশোধনী) বিল, এখনো আইনে পরিণত হয়নি। বিলটি আইনে পরিণত হলে কোন কোন নথির ভিত্তিতে নাগরিকত্বের আবেদন গ্রহণ করা হবে তা স্পষ্ট হবে। নাগরিকত্ব সংশোধনী বিল ২০১৬-এর চার নম্বর ধারায় ছয় বছর বসবাসের প্রমাণ হিসেবে কেবল মাত্র বসবাসের প্রমাণ চাওয়া হয়নি। বসবাস। বা চাকুরিক্ষেত্র কিংবা কর্মক্ষেত্রের যে কোনো একটির প্রমাণ দিলেই হবে। অর্থাৎ বর্তমানে তারা যদি চাকরিরত থাকেন তাকেও বসবাসের প্রমাণ হিসেবে মান্যতা দেওয়া হচ্ছে। সুতরাং তাদের জীবিকা হারানোর বা সম্পত্তি হারানোর কোনো ভয় থাকছে না।
প্রস্তাবিত নাগরিকত্ব সংশোধনী আইন ২০১৯ কি নতুন কোনও আইন?
উত্তর : বর্তমানে যে নাগরিকত্ব সংশোধনী আইন ২০১৯ প্রস্তাবিত হয়েছে তা প্রথম নাগরিকত্ব সংশোধনী আইন ২০১৬ নামে লোকসভায় পেশ হয়। ২০১৬ সালের ১৯ জুলাই এটি সংসদে পেশ হয়। তারপর রাজ্যসভায় বিরোধিতার জেরে ১২ আগস্ট ২০১৬ তারিখে এই বিলটি জয়েন্ট পার্লামেন্টারি কমিটির কাছে পাঠানো হয়। ৭ জানুয়ারি, ২০১৯ সংসদীয় কমিটি তাদের রিপোর্ট দেয়। জানুয়ারি ৮ তারিখে এই বিল লোকসভায় পাশ হয় কিন্তু এই বিলটি আবার রাজ্যসভায় আটকে যায়।
বর্তমান কেন্দ্রীয় সরকার উদ্বাস্তু হিন্দুদের নিঃশর্ত নাগরিকত্ব না দিয়ে, নানা শর্ত চাপাচ্ছে কেন?
উত্তর :নাগরিকত্ব হচ্ছে একটি আইন সম্মত স্বীকৃতি। যে কোনো আইনি প্রক্রিয়া সম্পন্ন করতে হলে একটি পদ্ধতির মধ্য দিয়ে যেতে হয়। বাংলাদেশ, পাকিস্তান, আফগানিস্তান থেকে হিন্দু, শিখ, বৌদ্ধ, জৈন, পারসি অথবা খ্রিস্টান সম্প্রদায়ের মানুষের ভারতে প্রবেশ করার ক্ষেত্রে কোনো রকম কাগজপত্র ছাড়াই নাগরিকত্বের আবেদনের জন্য যোগ্য বলে ঘোষণা করার বিষয়টিকে যদি নিঃশর্ত নাগরিকত্ব প্রদান বলা না হয় তবে কাকে নিঃশর্ত বলা হবে।
বাংলাদেশ, পাকিস্তান, আফগানিস্তানের সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ের মানুষ কীভাবে প্রমাণ করবে যা তারা অত্যাচারিত হয়েছে?
উত্তর : এই বিষয়টি নিয়ে আমি সুপ্রিম কোর্ট ও হাইকোর্টের একাধিক আইনজীবীর সঙ্গে কথা বলেছি। এ ব্যাপারে তাদের বক্তব্য বাংলাদেশ, পাকিস্তান, আফগানিস্তানের সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ের মানুষের অত্যাচারিত হয়ে আসার বিষয়টি একটি লিগ্যাল প্রিজামশন হিসেবে গণ্য হবে। অর্থাৎ উল্লেখিত তিনটি দেশের সংখ্যালঘুরা ভারতে আশ্রয় নিলে এটা ধরে নেওয়া হবে যে অত্যাচারিত হওয়ার জন্যই এই মানুষেরা ভিটে মাটি ছেড়ে ভারতে এসেছে। এক্ষেত্রে। কোনোরকম সাক্ষ্য প্রমাণের প্রয়োজন হবে না।
নাগরিকত্ব সংশোধনী বিল ২০১৬-তে বাংলাদেশ, পাকিস্তান, আফগানিস্তানের সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ের মানুষের নাগরিকত্বের আবেদনের ক্ষেত্রে ছয় বছর অপেক্ষা করার শর্ত রাখা হয়েছে কেন?
উত্তর : এই সময়সীমার ব্যাপারটি নতুন কোনো বিষয় নয়। নেচারালাইজেশন পদ্ধতিতে নাগরিকত্বের আবেদন করার জন্য নাগরিকত্ব আইন ১৯৫৫-তে উল্লেখতি ১১ বছরের সময়সীমা শুধুমাত্র বাংলাদেশ, পাকিস্তান, আফগানিস্তানের সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ের মানুষের জন্য কমিয়ে ছয় বছর করা হয়েছে। যারা এই সময়সীমা রাখার মধ্যে বাঙ্গালি বিদ্বেষের গন্ধ পাচ্ছেন তাদের কিন্তু বছরের পর বছর ধরে নাগরিকত্ব আইনে উল্লেখিত ১১ বছরের সময়সীমা নিয়ে কখনোই মাথা ঘামাতে দেখা যায়নি।
পশ্চিমবঙ্গ এন আর সি-র কাজ শুরু হলে তাতে নাম তুলতে গেলেও কি ১৯৭১ সালের আগের কাগজ প্রয়োজন হবে?
উত্তর : ১৯৮৫ সালে স্বাক্ষরিত অসম চুক্তিতে ১৯৭১ সাল-কে ভিত্তিবর্ষ ধরা হয়েছিল। সেই অসম চুক্তিকে ভিত্তি করেই ওই রাজ্যে এন আর সি হয়েছে। অবশিষ্ট ভারতে অসম চুক্তির মতো কোনো বাড়তি জটিলতা নেই। এই কারণের জন্য সমস্ত দেশের জন্য প্রস্তাবিত এন আর সি ভিন্ন প্রকৃতির হবে এটাই স্বাভাবিক। ভিত্তিবর্ষ যাই হোক না কেন প্রকৃত ভারতীয় এবং বাংলাদেশ, পাকিস্তান, আফগানিস্তান থেকে আগত পাঁচটি সম্প্রদায়ের মানুষের চিন্তার কোনো কারণ নেই। কারণ ২০১৫ সালে আইন পাশ করে ১৯২০ সালের পাসপোর্ট (ভারতে প্রবেশাধিকার) আইন ও ১৯৪৬ সালের ফরেনার্স অ্যাক্টে সংশোধন করে এটা নিশ্চিত করে দেওয়া হয়েছে যে ১৯১৪ সালের ৩১ ডিসেম্বরের মধ্যে উপরে উল্লেখিত সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ের যারা ভারতে প্রবেশ করবে তারা কোনো ভাবেই অবৈধ অনুপ্রবেশকারী নন। সেই সঙ্গে ১৯৫৫ সালের নাগরিকত্ব আইন সংশোধন করে তাদের নাগরিকত্ব প্রদানের ব্যবস্থাও হচ্ছে।
শোনা যাচ্ছে অসমে ১১ লক্ষেরও বেশি হিন্দুর নাম এন আর সি-র বাইরে থেকে গেল কেন? তাদের ভবিষ্যৎ কী?
উত্তর সিটিজেনশিপ অ্যামেন্ডমেন্ট বিল আইনে পরিণত হলে এই সমস্যা সম্পূর্ণ রূপে সমাধান হবে। উপযুক্ত নথি থাকা সত্ত্বেও যাদের নাম এন আর সি-তে ওঠেনি অসম সরকার তাদের সমস্ত রকম আইনি সহায়তা দিচ্ছে যাতে ফরেনার্স ট্রাইব্যুনালের মাধ্যমে এই সমস্যার সমাধান করা যায়। তাছাড়া দেশের স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী অমিত শাহ এবং অসম সরকার এই আশ্বাস দিয়েছেন একজন হিন্দুকেও যাতে ভারতের বাইরে যেতে না হয় তার জন্য সমস্ত রকম ব্যবস্থা নেওয়া হবে।
অসমের এন আর সি তৈরির প্রক্রিয়াতে কি কোনো ত্রুটি ছিল যে কোনো পক্ষই এতে খুশি হতে পারেনি?
উত্তর : ত্রুটি তো অবশ্যই ছিল। মিডিয়ায় প্রকাশিত সংবাদ বলছে। সেই সমস্ত ত্রুটি সংশোধন করে এন আর সি-র পুরো প্রক্রিয়াটি আবার পর্যালোচনার কথা নাকি ভাবা হচ্ছে। মিডিয়ায় প্রকাশিত সংবাদ বলছে পশ্চিমবঙ্গে এন আর সি-র আতঙ্কে মানুষ মারা যাচ্ছে এটা কি সত্যি?
উত্তর : এই সমস্ত সংবাদের কোনো ভিত্তি নেই। যাদের মৃত্যুর কথা বলা হচ্ছে তাদের অধিকাংশকেই রাজনৈতিক ফয়দা তোলার জন্য তৃণমূল কংগ্রেস সরকার আর্থিক সাহায্য করেছে। ফলে অভিযোগ উঠছে অন্য কারণে মৃত্যু হলেও আর্থিক সাহায্যের প্রলোভন দিয়ে এই সমস্ত পরিবারকে দিয়ে এন আর সি-র আতঙ্কে মৃত্যুর কথা বলানো হচ্ছে।
ভোটার কার্ড ভেরিফিকেশন, ডিজিটাল রেশন কার্ডের আবেদন জমা, ভোটার কার্ডের সঙ্গে আধার কার্ড সংযুক্তিকরণ ইত্যাদি কাজগুলির সঙ্গে কি এন আর সি-র কোনো সম্পর্ক আছে?
উত্তর : এই সমস্ত ব্যাপার একটি স্বাভাবিক প্রক্রিয়া। এগুলির সঙ্গে এন আর সি-র সম্পর্ক নেই।
ডি ভোটার কী? এর সঙ্গে কি এন আর সি-র কোনো সম্পর্ক আছে?
উত্তর : ১৯৯৭ সালের ১৭ জুলাই ভারতের নির্বাচন কমিশন অসম সরকারকে একটি বিজ্ঞপ্তি জারি করে নাগরিকত্বহীন ব্যক্তিদের ভোটার তালিকা থেকে বাদ দেওয়ার নির্দেশ দেয়। এই নির্দেশ পাওয়ার পর অসম সরকারের তরফ থেকে বাড়ি বাড়ি সার্ভের মাধ্যমে যাচাই করে ভোটার তালিকা নবীকরণের কাজ শুরু হয়। এই সার্ভের সময় যারা সঠিক নথিপত্র দেখাতে পারেননি অথবা যারা অনুপস্থিত ছিলেন তাদের নামের পাশে D (Doubtful) চিহ্নিত করে রাখা হয়।
ডিটেনশন ক্যাম্প কী ?অসমে এন আর সি ছুটদের ডিটেনশন ক্যাম্পে রাখার অনেক ঘটনা শোনা যাচ্ছে এই সমস্ত ঘটনা কতটা সত্য?
উত্তর : নির্বাচন কমিশন ডি-চিহ্নিত ব্যক্তিদের নিয়ে ফরেনার (ট্রাইব্যুনাল) অর্ডার ১৯৬৪ অনুসারে গঠিত ফরেনার ট্রাইব্যুনাল। ট্রায়াল চালানোর নির্দেশ দেয়। এর মধ্যে ট্রায়ালে অনুপস্থিত Dচিহ্নিত বেশ কিছু বাংলাদেশি পলাতক বলে ঘোষিত হয়। এই পরিস্থিতিতে ৪ এপ্রিল ২০০৪ গৌহাটি হাইকোর্ট ট্রায়াল শেষ না হওয়া পর্যন্ত D-ভোটারদের গোয়ালপাড়া ও কোকরাঝাড় ডিটেনশন ক্যাম্পে রাখা হয়। মিডিয়া রিপোর্ট বলছে বর্তমানে এক হাজার জনের মতে ডিটেনশন ক্যাম্পে বন্দি আছে। CAB আইনে পরিণত হলে ডিটেনশন ক্যাম্পে বন্দি উপরে উল্লেখিত তিনটি দেশ থেকে আগত পাঁচটি সম্প্রদায়ের মানুষ শুধুমুক্তি পাবেন এমন নয় ভবিষ্যতে আর কেউ বন্দি হবেন না।
অসমে এনআরসি-তে নাম না ওঠার জন্য এখনো পর্যন্ত নতুন করে একজনকেও ডিটেনশন ক্যাম্পে পাঠানো হয়নি। ভবিষ্যতে আদালতের রায়ে যারা অনুপ্রবেশকারী (বাংলাদেশ, পাকিস্তান, আফগানিস্তান থেকে আগত মুসলমান) হিসেবে চিহ্নিত হবেন তাদের ডিটেনশন ক্যাম্পে রাখা হবে এমনটাই জানা গেছে। ডিটেনশান ক্যাম্প নিয়ে কিছু মিডিয়া টিআরপি বাড়ানোর জন্য অনাবশ্যক আতঙ্ক ছড়াচ্ছে।
সাধন কুমার পাল

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

This site uses Akismet to reduce spam. Learn how your comment data is processed.