সমসাময়িক বিশ্ব পরিস্থিতি অতি দ্রুত পালটে ‘new normal’-এর সঙ্গে খাপ খাইয়ে দেশব্যাপী নতুন সমীকরণ তৈরি করছে। এই অবস্থার পরিবর্তন কয়েক মাস আগেও হয়তো অচিন্তনীয় ছিল। তবে এই পট পরিবর্তনে গণতান্ত্রিক মূল্যবোধ’-এর ওপর আস্থা একটা বড়ো ভূমিকা নিচ্ছে। এ মাসের শুরুতেই বিশ্বের ৮টি গণতান্ত্রিক দেশের মধ্যে আমেরিকা, ব্রিটেন, জাপান, অস্ট্রেলিয়া, কানাডা, জার্মানি, সুইডেন ও নরওয়ের প্রবীণ সংসদীয় আইন প্রণেতারা মিলে একটি যৌথ সংসদীয় ফোরামে তৈরি করে উদ্ভূত পরিস্থিতিতে উপযুক্ত পন্থা ও নীতি নির্ধারণ করে কীভাবে একযোগে কৌশলগতভাবে চীন সংক্রান্ত বিষয়গুলির যথাযথ ও সময়োপযোগী মোকাবিলা করা যায় সে বিষয়ে জোট তৈরি করেছেন। তারা জানিয়েছেন, বিশ্বে প্রচলিত পারস্পরিক বোঝাপড়ার বাতাবরণ বজায় রাখার ক্ষেত্রে চীনের। অর্থনৈতিক উত্থান প্রবল চাপ তৈরি করছে। এই পরিস্থিতির একক দেশ হিসেবে মোকাবিলা করা অত্যন্ত কঠিন। এ কারণেই গণতান্ত্রিক মূল্যবোধে বিশ্বাসী দেশগুলিকে একত্রিত করে তারা পরিস্থিতির মুখোমুখি হতে চান। মার্কিন রিপাবলিকান ও ডেমোক্রাট সেনেটর উভয়ে, জাপানের প্রতিরক্ষামন্ত্রী, ইউরোপীয় দেশগুলির সংসদ ও বিদেশ সংক্রান্ত প্রতিনিধি ও বৃহত্তম ব্রিটিশ Tory দলের নেতা এই মিলিত জোটের উল্লেখযোগ্য সদস্য।
অর্থনীতির প্রাচুর্যের দম্ভে চলতি ‘করোনা মহামারীর ক্ষেত্রে চীনের উদ্দেশ্যপ্রণোদিত দায়িত্বজ্ঞানহীন আচরণে বিশ্বের দেশগুলি এমন আশঙ্কা করছে যে, ভবিষ্যতে টাকা ছড়িয়েই চীন বিশ্বাসের পরিকল্পনা নিতে পারে। এই পরিস্থিতিতে গণতন্ত্রকে মূল বাঁধন গ্রন্থি করে দেশগুলির ভবিষ্যৎ পৃথিবীতে পারস্পরিক অবস্থানের নব নির্মাণই এই জোটের মূল লক্ষ্য। এই সূত্রে ব্রিটেন অত্যন্ত তাৎপর্যপূর্ণভাবে এই নবগঠিত জোটে ভারত ও দক্ষিণ কোরিয়াকে অন্তর্ভুক্ত করতে উদগ্রীব । যাতে ৫-জি পরিষেবা নিয়ে চীনের সমগ্র বিশ্বের ওপর একাধিপত্য খর্ব করে বিকল্প সরবরাহকারীর ব্যবস্থা করা যায়। অন্যান্য উন্নত প্রযুক্তির ক্ষেত্রেও চীনের যাঁতাকল থেকে বেরোতে দেশগুলি বদ্ধপরিকর।
মাত্র কয়েক মাস আগেই চীনের টেলিকম ক্ষেত্রে দৈত্যসম বিশাল সংস্থা ‘হুহাই’কে ব্রিটেনে ৫-জি নেটওয়ার্ক বিস্তার করার বরাত দেওয়ার পরই বরিস জনসন সরকার পরে পড়েছে। এই বরাত নাকচ করতে প্রবল চাপ আসছে। ইতিমধ্যেই ব্রিটেন চুক্তি পুনর্বিবেচনা করা শুরু করার সঙ্গে সঙ্গেই বিশ্বের সমমনোভাবাপন্ন গণতান্ত্রিক দেশগুলিকে একত্রিত করতে এ বিষয়ে আলোচনা শুরু করে দিয়েছে। বিগত কয়েক মাস ধরে চীনের আচরণ ব্রিটেনকে এমন খোলাখুলিভাবে অন্য দেশগুলিকে নিয়ে চীনের বিরুদ্ধাচরণের পথে ঠেলে দিয়েছে।
অন্যদিকে আমেরিকা দীর্ঘদিন ধরেই চীন বিরোধিতার নীতি নিয়েছে। অতি সম্প্রতি মার্কিন রাষ্ট্রপতি জি-৭ দেশগুলির আহূত সম্মেলন বাতিল করেছেন। আগামী মাসে এই সম্মেলন নির্ধারিত থাকলেও সেপ্টেম্বর অবধি বিলম্বিত করে তিনি অস্ট্রেলিয়া, রাশিয়া, ভারত ও দক্ষিণ কোরিয়াকে এই সম্মেলনে অতিথি করতে চান। তার এই নতুন পরিকল্পনার মূলে। দীর্ঘদিন ধরে চলে আসা বর্তমান জি-৭ দেশগুলির সীমাবদ্ধতা রয়েছে এবং এই সংস্থা বহুকাল আগে তৈরি তাই বদল আনা যেতেই পারে এমন একটি মত কার্যকরী ভূমিকা নিয়েছে।
এরই পরিপূরক ধাপ হিসেবে রাষ্ট্রপতি ট্রাম্প ভারতের প্রধানমন্ত্রী মোদীকে ফোন করে জি-৭ এর পরবর্তী বৈঠকে আসার আমন্ত্রণ জানান। প্রত্যুত্তরে আমন্ত্রণ গ্রহণ করে মোদী ট্রাম্পকে ধন্যবাদ দিয়ে করোনা পরবর্তী পরিস্থিতিতে তার এই দূরদর্শিতার প্রশংসা করে এই পদক্ষেপের প্রয়োজনীয়তার কথা ব্যাখ্যা করেন। এই পরিকল্পনায় গণতন্ত্রের প্রক্রিয়া বলবৎ থাকার যে আবশ্যিক শর্ত সত্ত্বেও রাশিয়ার অন্তর্ভুক্তি চীনকে বেশ হতবাক করেছে। ট্রাম্পের পরিকল্পনা নিয়ে চীনের সংবাদমাধ্যম তোলপাড় হচ্ছে। তারা ট্রাম্পের ফাঁদে পা দেওয়া নিয়ে ভারতের ওপরও বিষোদ্গার করছে। অবশ্য তারা তো সকলেই সরকারি মিডিয়া। চীন কিন্তু এই জোটবদ্ধতার অন্তর্নিহিত বার্তাটি পেয়ে গেছে। এই সূত্রে বিশ্বে বহুদেশীয় ভূমিকার গুরুত্ব ও অংশগ্রহণ নিয়ে ভারত দীর্ঘ ২ দশক ধরেই আওয়াজ তুলে আসছে। কেউ তাতে কর্ণপাত করেনি। কেবল ২০০৭-০৮-এর ব্যাপক অর্থনৈতিক সংকটের সময় বেশি সংখ্যক দেশের অংশগ্রহণ নিয়ে জি-২০ গঠন করা হয়েছিল। কিন্তু ভবিষ্যতে দেখা যায় এটি একটি সাময়িক বিচ্যুতি মাত্র। জি-২০ সক্রিয় ভূমিকা কখনই নিতে পারেনি।
বিশ্বব্যাপী বহুদেশীয় ফ্রন্ট তৈরির ব্যবস্থাকে বিভিন্ন দিক থেকে আক্রমণ করা হয়। নিজস্ব আধিপত্য ধরে রাখতে মার্কিন রাষ্ট্রপতি ট্রাম্প কখনই এতে উৎসাহী ছিলেন না। তাঁর ‘আমেরিকা ফার্স্ট’নীতির সূত্রে বহুদেশীয় যোগসূত্রের। কোনো স্থান তার ভাবনায় আসতেই পারেনি। এরই পরিণতিতে তিনি বিশ্বের নানান বহুজাতিক ফোরাম ও সংস্থা থেকে আমেরিকাকে বিচ্ছিন্ন করতেই বেশি উৎসাহী ছিলেন। এরই ফলশ্রুতিতে সুযোগসন্ধানী চীন নিজেকে বিশ্বত্রাতা হিসেবে নিজেকে তুলে ধরার একটা সুযোগ পেয়ে যায়। বিশ্বের ক্ষমতা বিন্যাসকে ধরে রাখতে তারাই প্রভু হয়ে ওঠার চেষ্টা করে। ভবিষ্যতে বিশ্বের বহুদেশীয় ক্ষমতা বিন্যাসের প্রসঙ্গ নিয়ে বিতর্ক অনেকদিন ধরেই শুরু হয়।
আগে বলা পৃথিবীর অন্য কিছু দেশকে নিয়ে বহুদেশীয় শক্তি জোট তৈরি করার যে প্রসঙ্গ ভারত দু দশক ধরে জোর দিয়ে আসছে তাতে তাল না মিলিয়ে বহু দেশ এটা ভাবছিল যে, চীন একটি দায়িত্বশীল দেশ হিসেবে নিজেকে মেলে ধরবে। এই করোনা মহামারী সেই সমস্ত দেশকে সেই ভ্রান্ত নিদ্রা থেকে টেনে তুলেছে। সকলেরইনজরে পড়েছে করোনার প্রসঙ্গে চীনের দাপটে জি-২০, রাষ্ট্রসঙ্ঘের নিরাপত্তা পরিষদ বা শক্তিধর হু (বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা) কেউই আন্তর্জাতিক স্তরে চীনের বিরুদ্ধে টু শব্দটি করতে পারেনি।
এরই অন্তিম পরিণতিতে আমরা এমন বিতর্কের পরিস্থিতি কাটিয়ে উঠে মিলিতভাবে প্রতিরোধের একটা পথ সন্ধান করতে সফল হচ্ছি। গুরুত্বপূর্ণ শক্তিধর দেশগুলি নতুন ফোরাম ও সংস্থা তৈরি করে চীনা চ্যালেঞ্জের পাল্লা নেওয়ার প্রস্তুতি নিচ্ছে। এই ক্ষেত্রে গণতান্ত্রিক শাসন ব্যবস্থা জারি থাকার বিষয়টি কেন্দ্রবিন্দু বলে বিবেচিত হচ্ছে। অতীতে চীনের সঙ্গে ভারতের মূলগত পার্থক্য বোঝাতে ভারত বার বার তার গণতান্ত্রিক সংস্কৃতির কথা ব্যক্ত করেছে, আজ যা একত্রিত হওয়ার ক্ষেত্রে একটি অন্যতম আবশ্যিক শর্ত হিসেবে পরিগণিত হচ্ছে। বহু দেশ এই বিন্দুটির ওপর প্রাপ্য গুরুত্ব আরোপ করেছে।
উপসংহারে বলা যায়, বিশ্বে দ্রুত পরিবর্তনশীল ক্ষমতাবলয় তৈরি হওয়ার ক্ষেত্রে গণতান্ত্রিক দেশগুলির সঙ্গে চীনের মুখোমুখি অবস্থানের ইঙ্গিত পাওয়া যাচ্ছে। ভারতের বিদেশনীতি নির্মাণের ক্ষেত্রে এই গণতান্ত্রিক ভাবনাটিকেই। কেন্দ্রবিন্দুতে স্থাপন করতে হবে। বাস্তবে সরাসরি পক্ষ অবলম্বনের ঝুঁকি থাকলেও কৌশল ও পারদর্শিতায় তার মোকাবিলা ছাড়া অন্য পথ নেই।
হর্ষ পন্থ
(লেখক নয়া দিল্লির স্টাডিস অ্যাট অবজারভার রিসার্চ ফাউন্ডেশনের ডিরেক্টর এবং লন্ডনের কিংস কলেজের আন্তর্জতিক সম্পর্ক বিষয়ক অধাপক)