চীনাপণ্য বয়কট, রবীন্দ্রনাথ ও কিছু প্রাসঙ্গিক প্রশ্ন

সম্প্রতি লাদাখ সীমান্তে চীনা সেনাদের বর্বরোচিত আক্রমণে ২০ ভারতীয় জওয়ানের মৃত্যু এবং ভারতের প্রত্যাঘাতে অন্তত ৪৫ চীনা সেনার মৃত্যুর প্রেক্ষিতে দেশজুড়ে চীনাপণ্য বয়কটের দাবি উঠেছে। আর সেই প্রেক্ষাপটেই মূলত বামপন্থীরা অর্থাৎ কমিউনিস্টরা, চীন যাদের ধাত্রীভূমি, তাদের তরফ থেকে কিছু তির্যক প্রশ্ন উঠে এসেছে। যাঁরা কমিউনিস্ট পাঠশালায়। পড়েননি, তাঁরা এই প্রচারে রীতিমতো বিভ্রান্তবোধ করছেন। এমনকী যাঁদের দেশের প্রতি ভালোবাসার কমতি নেই তাঁরাও এই প্রচারের ফলে সন্দিহান হয়ে পড়েছেন, আদৌ চীনাপণ্য বয়কট করা সম্ভব হবে তো কিংবা বয়কট করলেও তার পরিণাম ভেবে তারা আশঙ্কিত। আশঙ্কার বাস্তবিক কারণ রয়েছে। কারণ চীনাপণ্য ভারতের বাজার ছেয়ে ফেলেছে। পেটিএমের মতো আর্থিক অ্যাপেও তাদের বিপুল লগ্নি রয়েছে। এই অবস্থায় তাদের বয়কটের সিদ্ধান্ত কি আদৌ ফলপ্রসূ হবে? উত্তর খোঁজা যাক।।

অনেকে এই চীনাপণ্য বয়কটের পরিপ্রেক্ষিতে রবীন্দ্রনাথের দোহাই দিচ্ছেন। বঙ্গভঙ্গ-বিরোধী আন্দোলনের পরিপ্রেক্ষিতে রবীন্দ্রনাথ স্বদেশি পণ্য ব্যবহার ও বিদেশি পণ্য বয়কটের পক্ষপাতী ছিলেন। তারপর এই আন্দোলন চলাকালীনই তার অবস্থানের বদল ঘটে। বলাই বাহুল্য, এই ধরনের প্রচার আসলে অর্ধসত্য, ভাবের ঘরে চুরি। রবীন্দ্রনাথ তাঁর মতাদর্শ বদল করেননি। স্বদেশি পণ্যের ওপরই তার আস্থা ছিল। তিনি দেখেছিলেন স্বদেশি উন্মত্ততায় বিদেশি দ্রব্য পোড়াতে গিয়ে লোকসান হচ্ছে এদেশীয় ব্যবসায়ীদেরও। এতে রবীন্দ্রনাথ মনে আঘাত পান। তার যুক্তি ছিল, আমাদের লড়াই বিদেশিদের তৈরি বিদেশি পণ্যের বিরুদ্ধে। এদেশের মানুষকে ভাতে মারলে আমাদের কোনো উদ্দেশ্য সাধিত হবে না।

এই দৃষ্টিকোণ থেকেই তিনি স্বদেশি আন্দোলন থেকে তথাকথিতভাবে সরে আসেন। সমসাময়িক বিভিন্ন উপন্যাসে বিশেষ করে ঘরে-বাইরে-তে তার এই মনোভাবই ব্যক্ত হয়েছে। | রবীন্দ্রনাথ কতটা দূরদৃষ্টিসম্পন্ন ছিলেন, এই ঘটনা তার প্রমাণ। মনে রাখতে হবে, রবীন্দ্রনাথ যখন তাঁর এই মনোভাবের পরিচয় দিচ্ছেন, তখন দেশটা পরাধীন। দু’ দুটো বিশ্বযুদ্ধের একটিও তখনও পর্যন্ত সংঘটিত হয়নি। ঔপনিবেশিকতাবাদ তখন। পুরোপুরি কায়েম। প্রথম বিশ্বযুদ্ধের পরে লিগ অব নেশনস গঠিত হয়। আজ যেমন রাষ্ট্রসঙ্ঘ (ইউনাইটেড নেশনস) রয়েছে, তেমনি সুবিচারের আশায় প্রথম বিশ্বযুদ্ধোত্তর পরিস্থিতিতে লিগ অব নেশনস কাজ করেছিল, যদিও এর উদ্দেশ্য সার্বিকভাবে ব্যর্থ হয়েছিল, তারই ফলশ্রুতিতে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ। যাইহোক, ঔপনিবেশিকতার অত্যাচার বিশ্বের দরবারে জানাবার করবার কোনো মাধ্যম তখনও পর্যন্ত ছিল না, অন্তত স্বদেশি আন্দোলনের ঊষাপর্বে। দূরদৃষ্টিসম্পন্ন রবীন্দ্রনাথ কোনো সাময়িক উত্তেজনার বশে দেশীয় ব্যবসায়ীর ক্ষতিসাধন চাননি। ভাবলে অবাক লাগে, সেই সময় মুক্তবাণিজ্য, বিশ্ব অর্থনীতি এই ধারণাগুলোর সঙ্গে আমরা পরিচিত ছিলাম না। কিন্তু একশো বছর পর বিশ্ব অর্থনীতির গতি-প্রকৃতি কোন দিকে যাবে সেই মুহূর্তে বোঝা সম্ভব না হলেও রবীন্দ্রনাথের পদক্ষেপ আজ শতবর্ষ পরেও কতটা প্রাসঙ্গিক তা বেশ বোঝা যাচ্ছে। | একশো বছর পরে অর্থনীতির চালচিত্রটা আমূল পাল্টে গেছে। একদিকে মুক্ত অর্থনীতি, অন্যদিকে আর্থিক সংস্থাগুলির

ওপর সরকারি নিয়ন্ত্রণ; স্বাধীন ভারতের অর্থনৈতিক ভিত্তি এখন অনেক মজবুত। বিরোধীরা যাই বলুক, মোদী সরকারের আর্থিক সংস্কারে গত ছয় বছরে বিশ্বের বৃহৎ অর্থনীতির দেশগুলি যখন মন্দার বাজারে পুঁকছে, তখন ভারতীয় অর্থনীতি সংগ্রাম করে হলেও যথেষ্ট সুদৃঢ়। এমনকী করোনাকালেও মোদী সরকারের আর্থিক প্যাকেজে ভর করে অর্থনীতির ধস অন্তত আটকানো গেছে। সর্বোপরি ভারতীয় অর্থনীতি ঘুরে দাঁড়াবার স্বপ্ন দেখছে।ইকনমিক জায়ান্টরাও কিছু এই সময় এই কাজটা করতে পারেনি।

স্বভাবতই, ভারতের বিশাল একটা বাজার রয়েছে। যে বাজারের নাগাল পাওয়ার জন্য যে কোনো বাণিজ্যিক প্রতিষ্ঠান হাঁ-করে বসে থাকে। এটা ঠিক, যে কোনো কারণেই হোক সস্তার চীনা ইলেকট্রনিক্স পণ্য এইমুহূর্তে ভারতীয় বাজার ছেয়ে ফেলেছে। বিভিন্ন বড়ো শিপিং কোম্পানিগুলোতে চীনের প্রভূত বিনিয়োগ রয়েছে। আর্থিক লেন-দেনের অ্যাপে তাদের বিনিয়োগ রয়েছে। এককথায় চীনের অর্থনীতির ভিত্তিটাই ভারতের ওপর নির্ভরশীল। শুধু চীনাপণ্য বয়কটের ডাক দিতেই সে দেশের। অর্থনীতি তথা বাণিজ্য থরহরি, কম্পমান। একটা কথা বুঝতে হবে, এখন যুদ্ধটা শুধু সমরাঙ্গনে হয় না। সেই সঙ্গে কূটনীতি, অর্থনীতি, রাজনীতি প্রতিটি ক্ষেত্রে লড়াই। চলে। তারাই যুদ্ধে জয়ী হয়, যারা সামগ্রিকভাবে এই সবকটি ক্ষেত্রে জয়লাভ করবে। চীন ভারতের অর্থনীতির ওপর নির্ভরশীল, এটা আমাদের কূটনৈতিক যুদ্ধেও কয়েক কদম এগিয়ে রেখেছে। হাতেনাতে তার প্রমাণ দেখুন, রাষ্ট্রসঙ্ঘের নিরাপত্তা পরিষদের অস্থায়ী কাউন্সিলে সদস্য পদের নির্বাচনে চীন এমনকী তাদের দোসর পাকিস্তানেরও ভারতকে সমর্থন। সামরিক শক্তিতে ভারত চীনের সঙ্গে টক্কর দিতে পারে, তার প্রমাণ আমরা অকুস্থল গালওয়ানেই পেয়েছি। ১৯৬২ সালে আমরা সামরিক শক্তিতে যত না হেরেছিলাম, রাজনৈতিক নেতৃত্বের সংকট আমাদের অবস্থা আরও কাহিল করেছিল। | কেউ কেউ এমন তির্যক এমন মন্তব্যও করছেন যে, চীনাপণ্য তো চীন থেকে হেঁটে এসে আমাদের কাছে পৌঁছচ্ছেনা, আমরাও কেউ চীনে যাচ্ছি না। অর্থাৎ বয়কটের রাজনৈতিক স্লোগান না তুলে চীনা পণ্য ভারতীয় বাজারে না ঢুকতে দিলেই তো পারে ভারত সরকার, তাহলে আর বয়কটের হাঙ্গামায় যেতে হয় না। বলে রাখা ভালো, অতি সম্প্রতি চীনা দ্রব্যের ওপর ভারত সরকার শুল্ক বাড়িয়েছে। এতে যেমন সরকারের আয়ও হবে, তেমনি বয়কটেরও খানিক প্রয়োজন মেটাবে। চীনাপণ্যের ওপর নির্ভরতা কমাতে কুটির শিল্পে উৎসাহ প্রদান, আর্থিক সাহায্যের প্যাকেজ সরকারের ঘোষিত নীতি। আর্থিক লেনদেন, শিপিং কোম্পানিগুলিতে চীনা বিনিয়োগ কমিয়ে ভারতীয় বিনিয়োগ বাড়াতে দ্বিতীয় মোদী সরকারের একগুচ্ছ পরিকল্পনাও নেওয়া হয়েছে। সব মিলিয়ে ভারতীয় অর্থনীতিতে চীনকে ক্রমাগত ব্রাত্য করতে মোদী সরকার বদ্ধপরিকর। কিন্তু সেটা একদিনে করতে গেলে হিতে বিপরীত হবে। আমাদের দেশের অনেক মানুষের কর্মসংস্থান হয় চীনের বিনিয়োগের সৌজন্যে। হঠাৎ করে চীনা দ্রব্য বয়কট করে দিলে এই মানুষগুলো আতান্তরে পড়বেন।

ঠিক এখানেই শতবর্ষেরও আগে রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের পদক্ষেপের প্রাসঙ্গিকতা। তিনি বিদেশি পণ্যের বয়কট চেয়েছিলেন, কিন্তু দেশের মানুষের ক্ষতি চাননি। আজ দেশপ্রেমের প্রয়োজনে চীনা দ্রব্যের বয়কট একান্ত অপরিহার্য, কিন্তু দেশের মানুষের আর্থিক ক্ষতি করে নয়। দেশের মানুষের এই উপলব্ধির সময় এসেছে, দেশানুগত্যের পরিচয় দিতে চীনাপণ্য বয়কটের। তবে আবেগের বশে নয়, ধীরে ধীরে সার্বিক পরিস্থিতি সুযুক্তিপূর্ণ বিবেচনার পর। এখানে সরকারের ভূমিকা গৌণ। একবিংশ শতাব্দীতে অর্থনীতির ধারণা পালটাচ্ছে। সরকারের অর্থনীতিকে নিয়ন্ত্রণ করার অর্থ এই নয় যে সরকার জোর করে কিছু চাপিয়ে দেবে।

রবীন্দ্রনাথ জানতেন না, শতবর্ষ পরে অর্থনীতির এই পরিস্থিতি দাঁড়াবে। শুধু তিনি কেন, সেই সময় তাবড় অর্থনীতিবিদদের পক্ষেও টাইম মেশিনে চড়ে একশো বছর পরের এই অর্থনৈতিক চালচিত্রটা অনুমান। করা সম্ভব ছিল না। কিন্তু দূরদৃষ্টি দিয়ে তিনি বুঝেছিলেন, একদিন পৃথিবীর অর্থনীতির চালিকাশক্তি হবে মানুষ, কোনো সরকার নয়। আজ চীনের হয়ে যারা এত সওয়াল করেন, তাদের জানা উচিত কমিউনিস্ট শাসকের ধর্ম মেনে, চীনে শ্রমিক, কৃষক, যারা অর্থনীতির চালিকাশক্তি তাদের কী হাল। সামাজিক ন্যায়বিচারের ন্যূনতম দাবিটুকুরও অধিকার থেকেও বঞ্চিত তারা। আগ্নেয়গিরির ওপর দাঁড়িয়ে আছে সে দেশের অর্থনীতি, যে কোনোদিন অগ্ন্যুৎপাত হবে।

সূত্রের খবর, ভারতের হাত তাদের মাথা থেকে উঠে গেলে চীনে লক্ষ লক্ষ মানুষ কাজ হারাবে। এখন তবু কমিউনিস্ট শাসকের অত্যাচার সয়েও মানুষ কোনোরকমে খেতে পরতে পারছে। সেটুকুও না জুটলে, দেওয়ালে পিঠ ঠেকে গেলে অত্যাচারী কমিউনিস্ট শাসকের মৌরুসিপাট্টার অবসান হতে বেশি দেরি হবে না। সে কারণেই সম্ভবত লাদাখ সীমান্তে আগ্রাসন নীতি। যদিও ভারতের প্রত্যাঘাতে চীনের এখন গর্ত খোঁজার পালা। স্রেফ আর্থিক বয়কটের ডাক শুনেই গেল গেল রব, করলে না জানি কী হবে। ভারতের কূটনৈতিক সাফল্যে বিশ্বের দরবারেও চীন একঘরে। তাদের শাসকরাও দেওয়াল লিখন পড়তে পারছেন; পারছেন। না শুধু এদেশের হরেক কিসিমের নানা দলে মিশে থাকা জাতে কমিউনিস্টরা আর তাদের নয়া দোসর সোনিয়া মাইনো ও রাহুলের দল।

অভিমুন্য গুহ

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

This site uses Akismet to reduce spam. Learn how your comment data is processed.