বিগত শতাব্দীর মধ্যপাদের দুটি ঘটনা বাঙ্গালির জীবন, সংস্কৃতি ও ভূগােলকে। একেবারে বদলে দিয়েছে। ঘটনাদুটির একটি হলাে, ১৯৪৬-এর ১৬ থেকে ১৮ আগস্ট ঘটে যাওয়া কলকাতার মহাদাঙ্গা’আর অন্যটি হলাে, ‘নােয়াখালি গণহত্যা। এই ঘটনাদুটির ফলশ্রুতিতে ‘বঙ্গবিভাগ। ১৮৪৭-এর দেশভাগ এই উপমহাদেশের তথা বিশ্বইতিহাসের এক যুগনির্ণায়ক ঘটনা। কিন্তু বাঙ্গালির জীবনে তার চেয়েও সুদূরপ্রসারী ঘটনা হলাে ‘বঙ্গবিভাগ। বঙ্গবিভাগের নির্ণায়ক ঘটনাদুটির একটি অর্থাৎকলকাতার ‘মহাদাঙ্গার’ কাহিনিই আমার আজকের উদ্দিষ্ট। প্রায় চুয়াত্তর বছর আগে ঘটে যাওয়া এই ঘটনা বাঙ্গালি মানসকে আজও একইভাবে চিন্তা করতে, একই আত্মসমীক্ষা করতে তাড়িত করে।
চুয়াত্তর বছর আগে মাঝ আগস্টে টানা তিনদিন ধরে তৎকালীন বাঙ্গলার প্রধানমন্ত্রী হুসেন শাহিদ সােহরাওয়াদির আমলে তাঁরই নেতৃত্বে হিন্দুদের উপর চলে লুট, নরহত্যা, ধর্ষণ ও নির্যাতন। কেউ কেউ এই নরসংহার পর্বকে কুখ্যাত ‘দীর্ঘ ছুরিকার সপ্তাহ’ বলে অভিহিত করেছেন। কলকাতার দ্য স্টেটসম্যান পত্রিকা দাঙ্গার চারদিন পরে তাদের সম্পাদকীয় প্রবন্ধে এই মহা নরসংহারকে ‘দি গ্রেট ক্যালকাটা কি লিংস’ বলে অভিহিত করে। মুসলিম লিগের মাস্তান ও গুন্ডাদের তাণ্ডবে প্রাণ হারায় সরকারি হিসেবমতাে প্রায় পাঁচ হাজারেরও বেশি। বেসরকারি হিসেবে ৪০,০০০ থেকে ১,১০, ০০০ হিন্দু। হাজার হাজার হিন্দু নিগৃহীত হয়েছিল। আর এক লক্ষ কুড়ি হাজারের বেশি মানুষ গৃহহীন হয়েছিল। কলকাতার এই মহাদাঙ্গার কুখ্যাত নায়ক ছিলেন মুসলিম লিগের জিন্নাহর সহকর্মী তথা নেতৃত্বের প্রতিদ্বন্দ্বী হাসান শাহিদ সােহরাওয়ার্দি। কিন্তু ১৯৪৭ সালে স্বাধীনতা ও দেশভাগের পরে মার্কসবাদী, নেহরপন্থী এবং ইসলামি লেখক ও ঐতিহাসিকেরা সােহরাওয়ার্দির এই ঘৃণ্য অপরাধকে শ্বেতরঙে চুনকাম করে তাকে এক সম্মাননীয় নায়কে পরিণত করেছে। ব্রিটিশ ভারতের প্রথম নগরী কলকাতাকে সােহরাওয়ার্দি চেয়েছিল পাকিস্তানের অন্তর্ভু ক্ত করতে। যেহেতু কলকাতা ও তার পার্শ্ববর্তী জেলাগুলি হিন্দু সংখ্যাগরিষ্ঠ ছিল তাই সােহরাওয়ার্দির পরিকল্পনা ছিল কলকাতা ও সন্নিহিত জেলাগুলিকে হিন্দুদের সংখ্যালঘুতে পরিণত করা। তাঁর দৃষ্টিতে, সেটা করা সম্ভব হিন্দু হত্যা ও বড়াে আকারে দাঙ্গার মাধ্যমে হিন্দুদের ভয় দেখিয়ে। সেজন্য আগে থেকেই নানা ব্যবস্থা নিয়েছিল সােহরাওয়ার্দি। আগে কলকাতা ও বাঙ্গলার পুলিশ নিয়ােগ হতাে মূলত উত্তরপ্রদেশ ও বিহারের ভােজপুর অঞ্চলের আরা, বালিয়া, ছাপরা, দেওরিয়া প্রভৃতি জেলা থেকে। বিয়াল্লিশের আন্দোলনে মেদিনীপুরে স্বাধীনতা সংগ্রামীদের উপর চরম নির্যাতন চালানাে আইসিএস পুলিশ অফিসার নিয়াজ মহম্মদ খাঁকে সােহরাওয়ার্দিনির্দেশ দিয়ে উত্তর-পশ্চিম সীমান্ত অঞ্চলের নিষ্ঠুর ও নির্মম পঞ্জাবি মুসলমান ও পাঠানদের পুলিশে নিয়ােগের ব্যবস্থা করে। যাইহােক, ১৯৪৬-এর প্রথমদিকে ব্রিটিশ প্রধানমন্ত্রী ক্লিমেন্ট অ্যাটলি ভারতে তিন সদস্যের এক প্রতিনিধিদল যা ‘ক্যাবিনেট মিশন’ নামে পরিচিত তাদের পাঠিয়েছিলেন ভারতে ক্ষমতা হস্তান্তরের খুঁটিনাটি বিষয়গুলি স্থির করার জন্য। কিন্তু জিন্নাহর চাপে পড়ে ১৬ জুন এক বিকল্প প্রস্তাব পেশ করে অবিভক্ত ভারতকে হিন্দুপ্রধান ভারত এবং মুসলমানপ্রধান পাকিস্তানে বিভক্ত করার প্রস্তাব দেয়। কংগ্রেস সরাসরি এ প্রস্তাব বাতিল করে এবং ১০ জুলাই কংগ্রেস সভাপতি জওহরলাল নেহর মুম্বইয়ের এক প্রেস কনফারেন্সে ঘােষণা করেন যে কংগ্রেসের ‘সংবিধান সভা’তে যােগদান করতে রাজি আছে। কিন্তু তারা প্রয়ােজনবােধ করলে ‘ক্যাবিনেট মিশনের প্রস্তাবগুলি সংশােধন বা পরিবর্তন করতে পারে। এই ঘােষণা জওহরলালের পক্ষে এক বিরাট ভুল পদক্ষেপ। আগেভাগেই এই ধরনের ঘােষণা নির্বুদ্ধিতার নামান্তর। জওহরলালের এই ঘােষণায় জিন্না প্রচণ্ড ক্রুদ্ধ। হয় এবং তার ধারণা হয়, ভবিষ্যতে কংগ্রেস সংবিধান সভায় হিন্দু সংখ্যাধিক্যের জোরে ভারতবর্ষ বিভক্ত করার প্রস্তাব বাতিল করে দেবে এবং মুসলমানদের হিন্দু-আধিপত্যে থাকতে বাধ্য করবে। ক্রুদ্ধ জিন্না ২৯ জুলাই মুসলিম লিগের ওয়ার্কিং কমিটির বৈঠক ডেকে দুটি প্রস্তাব পাশ করিয়ে নেয়। প্রথমত, মুসলিম লিগ ১৬ জুনের ‘ক্যাবিনেট মিশন’ প্রস্তাব গ্রহণের স্বীকৃতি বাতিল করে এবং দ্বিতীয়ত, ‘ডাইরেক্ট অ্যাকশন ডে’র কর্মসূচি ঘােষণা করে। তারা ঘােষণা করে, তারা সরকারের সঙ্গে সমস্ত সহযােগিতা বন্ধ করে দেবে এবং সমস্ত সাংবিধানিক পন্থা বর্জন করবে। জিন্না আরও ঘােষণা করে, এরপর থেকে তারা নানা সমস্যা সৃষ্টি করবে এবং শপথ গ্রহণ করে, I will have India divided or India burned.’ এই বৈঠকেই জিন্না ১৬ আগস্টকে ‘ডাইরেক্ট অ্যাকশন ডে’ বা ‘ডে অব ডেলিভারেন্স’ বা ‘নিষ্কৃতি দিবস’হিসেবে ঘােষণা করে। ওইদিন মুসলমানদের সাধারণ হরতাল পালনের আহ্বান জানানাে হয় যাতে করে ব্রিটিশ কর্তৃপক্ষকে সমঝে দেওয়া যায় তাঁদের পাকিস্তান গঠনের ঐকান্তিকতা সম্পর্কে। কিন্তু বামপন্থী ঐতিহাসিকরা আওরংজেবের মতােই জিন্নাকেও সহনশীল ও ধর্মনিরপেক্ষ হিসেবে চিত্রিত করতে প্রয়াসী হয়েছেন। কিন্তু কলকাতার দাঙ্গা তাকে গোড়া ইসলামপন্থী হিসেবে প্রতিভাত করেছে। জিন্নাহ জেনেবুঝেই ১৬ আগস্টকে ‘ডাইরেক্ট অ্যাকশন ডে’ হিসেবে ঘােষণা করেছিল। কারণ ওইদিনের সঙ্গে ইসলামের তথাকথিত বিজয়ের সম্পর্ক ছিল। ১৯৪৬-এর ওইদিন ছিল রমজান মাসের অষ্টাদশ দিন এবং ওইদিনই হজরত মহম্মদ ‘বদরের রক্তাক্ত যুদ্ধ’ শুরু করেছিলেন অমুসলমান ‘হিদেন’দের বিরুদ্ধে। এই যুদ্ধে জয় ইসলামের ইতিহাসে এক গুরুত্বপূর্ণ বিজয় হিসেবে চিহ্নিত হয়ে থাকে। এই যুদ্ধ জয়ের ফলে মক্কা হজরত মহম্মদের অধিকারে আসে। মুসলমানদের ‘জিহাদ’বা ধর্মযুদ্ধে আহ্বান করার এটাই উপযুক্ত
দিন বলে মনে করেছিল জিন্নাহ ও তাঁর সাগরেদ হােসেন শাহিদ সােহরাওয়ার্দি।বাঙ্গলায় জিন্নার সাগরেদ সােহরাওয়ার্দি ও তার সঙ্গীরা বদরের ‘যুদ্ধজয়ের স্মৃতি স্মরণ করিয়ে উত্তেজক বক্তৃতা করতে লাগলেন কলকাতা জুড়ে। পয়গম্বরের পদাঙ্ক অনুসরণ করে ১৬ আগস্টের দিন ইসলামের জয়ের জন্য সবাইকে উত্তেজিত করলেন। মুসলিম লিগের মুখপত্র “The Star of India ’র ১৩ আগস্ট সংখ্যায় কীভাবে ‘ডাইরেক্ট অ্যাকশন ডে’ পালন করতে হবে তার বিস্তারিত নির্দেশাবলী প্রকাশিত হলাে। ওই পত্রিকায় লেখা হলাে, “Muslims must remember that it was in Ramzan that permission for jehad was granted be Allam. It was in Ramzan that the Battle of Badr, the first open conflict between Islam and heathens, was fought and won by 313 Muslims and again it was in Ramzan that 10,000 Muslims under the Holy Prophet conquered Mecca and established the kingdom of Heaven and the commonwealth of Islam in Arabia. The Muslim League is fortunate that it is starting its action on this Holy month and day.”সুতরাং এটা পরিষ্কার যে, সােহরাওয়ার্দি ও জিন্নারা ১৬ আগস্টের দিনটিকে পুরােপুরি একটা ‘জিহাদ’ বা ধর্মযুদ্ধের চেহারা দিতে সচেষ্ট ছিল শুরু থেকেই। সােহরাওয়ার্দির নেতৃত্বাধীন মুসলিম লিগ কলকাতার সমস্ত মসজিদের ইমামদের নির্দেশ দেয় ওইদিন অর্থাৎ শুক্রবার জুম্মার নমাজের শেষে তারা যেন সমস্ত মুসলমানকে পাকিস্তান সৃষ্টিতে যােগদান করতে আহ্বান জানান। মসজিদের ইমামরা এটাকে কলকাতার হিন্দুদের বিরুদ্ধে সশস্ত্র যুদ্ধ হিসেবেই গ্রহণ করেছিল এবং সেইভাবেই বিষয়টি প্রচার করেছিল। ঐতিহাসিক প্যাট্রিক ফ্রেঞ্চতাঁর পুস্তক Liberry or Death : India’s Journey of Independence & Division 2168 লিখেছেন, “Surahwardy ran the Bengal. S.H.’ League and his organisation had entrusted direct action to Calcutta’s pirs and who were told to mobilise the Muslim community at Friday, mullahs prayers.” ঐতিহাসিক যুথিকা রায়ের মতে, জিন্না কলকাতার ব্যাপারে সােহরাওয়ার্দিকে সম্পূর্ণ স্বাধীনতা দিয়েছিলেন হিন্দুদের সন্ত্রস্ত করা ও দাঙ্গা চালানাের ব্যাপারে। সমস্ত প্রাপ্ত তথ্য থেকে দেখা যায় যে, সােহরাওয়ার্দি হিংসা ও দাঙ্গায় বিশ্বাস করতেন এবং এজন্য সে এক বিশাল গুন্ডাবাহিনীর পৃষ্টপােষকতা করত। তাছাড়াও সে অতীব দুর্নীতিগ্রস্ত এবং শাসন পরিচালনায় অপদার্থ ছিল। এছাড়া তার ‘দিনলিপি’থেকে পাওয়া যায়, সে অত্যন্ত গোঁড়া ইসলামপন্থী ছিল এবং গােটা ভারতবর্ষকে দার-উল-ইসলামে পরিণত করার স্বপ্ন দেখত। আর তরবারি হাতে জিন্নার ছবিযুক্ত পােস্টার কলকাতার বিভিন্ন মহল্লায় বিলি করা হয়েছিল। তৎকালীন কলকাতার মেয়র সৈয়দ মহম্মদ উসমান একটা লিফলেট সর্বত্র ছড়িয়ে দিয়েছিল যাতে ঘােষণা করা হয়েছিল,কাফের! তােদের ধ্বংসের আর বাকি নাই, আর তােদের সার্বিক হত্যাকাণ্ড ঘটেব!” বাঙ্গলাকে কাফের মুক্ত করার আহ্বানও জানানাে হয়েছিল। তবে এটা পরিষ্কার করে দেওয়া হয়েছিল, তাদের এই ঘােষণা সরকার, পুলিশ বা ইউরােপীয়দের বিরুদ্ধে ছিল না, এটা ছিল একান্তভাবেই হিন্দুদের বিরুদ্ধে। এই দাঙ্গার প্রস্তুতিপর্বে ৫ আগস্ট ইংরেজি স্টেটম্যান পত্রিকায় সােহরাওয়ার্দি ‘শাহিদ’ ছদ্মনামে এক প্রবন্ধে লেখেন, ‘দাঙ্গা হাঙ্গামা এমনিতে খারাপ, কিন্তু তা যদি কোনাে মহান আদর্শে করা হয় তাহলে সেটা অন্যায় নয়। এই মুহূর্তে মুসলমানদের কাছে পাকিস্তান দাবি আদায় করা এক পবিত্র কর্তব্য। মুসলমানদের হাতে তরবারি আছে, তা ব্যবহার করাই মুসলমানদের কাছে পবিত্র কর্তব্য।(অনুবাদ স্বকৃত)। এদিকে জিন্নার ১৬ আগস্ট ডাইরেক্ট অ্যাকশন ডে ঘােষণার ফলে বাঙ্গলার তৎকালীন প্রধান সচিব আর এল ওয়াকারের পরামর্শে এবং সােহরাওয়ার্দির অনুরােধে বাঙ্গলার ব্রিটিশ গভর্নস্যার ফ্রেডারিক বারােজ ওই দিনটিকে ছুটির দিন ঘােষণা করে। বাঙ্গলার কংগ্রেস নেতৃত্ব এই সার্বজনীন ছুটি ঘােষণার বিরােধিতা করে। তাদের মতে, ছুটির ফলে লিগের গুন্ডারা জোরজবরদস্তি সবাইকে হরতাল পালনে বাধ্য করবে। বাঙ্গলার বিধানসভার কংগ্রেসের দলীয় নেতাকিরণশঙ্কর রায় ১৪ আগস্ট এক বার্তায় হিন্দু ব্যবসায়ী ও দোকানদারদের হরতাল পালন না করে দোকান, ব্যবসা ইত্যাদি খােলা রাখার অনুরােধ করেন। যাইহােক, লিগের পূর্বপ্রস্তুতি মতাে ১৬ আগস্ট জুম্মাবার নামাজের পরে কলকাতা, হাওড়া, হুগলি, মেটিয়াবুরুজ, ২৪ পরগণা ইত্যাদি বিভিন্ন মুসলমান অধ্যুষিত অঞ্চল থেকে। মুসলমানরা কলকাতার অক্টারলােনি মনুমেন্টের পাদদেশে সমবেত হয়। মুসলিম লিগের এই সভায় সভাপতিত্ব করে বাঙ্গলার প্রধানমন্ত্রী তথা লিগ নেতা হােসেন শাহিদ সােহরাওয়ার্দি। বক্তা ছিল সােহরাওয়ার্দি, খাজা নাজিমুদ্দিন ইত্যাদি লিগ নেতা। কমিউনিস্ট নেতা জ্যোতি বসুও প্রথম দিকে কিছুক্ষণ এই সভায় ছিলেন, পরে অবস্থা বেগতিক তেখে‘যঃ পলায়তি,স জীবতি’ নীতি অনুসরণ করে পালিয়ে যান। প্রত্যক্ষদর্শী অমিতাভ ঘােষ (আচার্য দেবপ্রসাদ ঘােষের পুত্র) লিখেছেন, The maidan meeting was attended by Jyoti Basu-the leader of the Communist Party of India which supported the creation of Pakistan. He ran away when the situation tended to go out of control.’ সভার প্রত্যেক বক্তাই উপস্থিত সশস্ত্র মুসলমান জনতাকে ক্ষেপিয়ে তােলার জন্য উত্তেজক বক্তৃতা দেয়। যদিও গণ্ডগােল শুরু হয় এই ঘটনার অনেক আগেই। প্রথম গণ্ডগােল শুরু করে হাওড়ার ঘুসুড়ি থেকে আগত একদল গুন্ডা। সকাল দশটার আগেই লালবাজারে গণ্ডগােলের খবর পৌঁছে যায়। মুসলমান গুন্ডারা বিভিন্ন অঞ্চলে জোর করে দোকান খুলতে বাধা দেয়। চারদিক থেকে ছুরি মারা, পাথর ছোঁড়া ইত্যাদি খবর এসে পৌঁছায়। এই খবরগুলি আসছিল মূলত উত্তর ও মধ্য কলকাতার বিভিন্ন অঞ্চল, যেমন রাজাবাজার, কলাবাগান, কলেজ স্ট্রিট, হ্যারিসন রােড(মহাত্মা গান্ধী রােড), কলুটোলা, বড়বাজার, ফিয়ারস লেন ইত্যাদি অঞ্চল থেকে। অক্টারলােনি মুমমেন্টের তলায় সভা শুরু হয়। ২টো নাগাদ। সভায় উপস্থিত বেশিরভাগ লােকের হাতেই ছিল লােহার রড, বাঁশের লাঠি। উপস্থিত জনতার সংখ্যা আইবি রিপাের্ট অনুয়ায়ী ত্রিশ হাজার। কলকাতা পুলিশের এক ইন্সপেক্টরের রিপাের্টের হিসেবে পাঁচ লক্ষ এবং লিগ মুখপত্র “দি স্টার অব ইন্ডিয়া’র হিসেব অনুযায়ী এক লক্ষ। সােহরাওয়ার্দির ভাষণে গণ্ডগােল চলাকালে পুলিশ ও মিলিটারি বাহিনীকে আটকে রাখার কথা বলা হয়েছিল। বাস্তবেও ঘটেছিল সেটাই। সেন্ট্রাল ইন্টেলিজেন্সের ফ্রেডারিক বারােজের কাছে। পাঠানাে এক রিপাের্টে বলা হয়েছিল, “He had been able to restrain the military and the police.” তার এই কথার বাস্তবায়ন করতেই সােহরাওয়ার্দি পরে কলকাতা পুলিশের হেড কোয়ার্টার লালবাজারে পুলিশ কমিশনারের অফিসে বসে লাগামছাড়া এই দাঙ্গার নেতৃত্ব করে। ওই সভা শেষ হবার পরেই সমস্ত উত্তর ও মধ্য কলকাতা মুসলমান সশস্ত্র গুন্ডাদের হাতে চলে যায়। ধর্মতলার মােড়ের কমলালয় স্টোর লুট করা দিয়ে শুরু হয় লুটপাট, হত্যা। দাঙ্গা ছড়িয়ে পড়ে উত্তর ও মধ্য কলকাতার বিস্তীর্ণ এলাকায়। এবং গুন্ডাদের মুখে মুখে, ‘নারায়ে তগদীর, আল্লাহ্-আকবর’, ‘কায়েদ-আজম জিন্দাবাদ’, ‘লড়কে লেঙ্গে পাকিস্তান ইত্যাদি স্লোগান। সশস্ত্র গুন্ডাভর্তি ট্রাক চলে আসে হ্যারিসন রােড ধরে। হ্যারিসন রােড ও মির্জাপুর স্ট্রিটের সংযােগস্থলে তারা হিন্দুদের দোকান ইত্যাদি আক্রমণ করতে উদ্যত হলে সেখানকার হিন্দুরা রখে দাঁড়ায়। আবার ১৭ তারিখে মেটিয়াবুরুজের লিচুবাগান বস্তিতে কেশােরাম কটন মিলের প্রায় ৩০০ ওড়িয়া হিন্দু শ্রমিককে গার্ডেনরিচ টেক্সটাইল শ্রমিক ইউনিয়নের সভাপতি সৈয়দ আবদুল্লা ফারুকি এবং এলাকার জেহাদি গুন্ডাদের নেতৃত্বে হত্যা করা হয়। পরে ওড়িয়া শ্রমিকদের হত্যার বিষয়টি তদন্ত করতে ওড়িশার মন্ত্রী বিশ্বনাথ দাশ এসেছিলেন। ১৭ তারিখ অর্থাৎ দ্বিতীয় দিনেই মুসলমান গুরা বিভিন্নস্থানে নির্মম ভাবে হত্যাকাণ্ড চালায়, তাতে অসংখ্য হিন্দু মারা যায়। এই দাঙ্গার আরেকটি উল্লেখযােগ্য দিক হলাে, এই দাঙ্গায় সম্প্রতি শ্রেষ্ঠ বাঙ্গালি হিসেবে নির্বাচিত শেখ মুজিবুর রহমানের সক্রিয় অংশগ্রহণ। মুজিবুর তখন ইসলামিয়া কলেজের (বর্তমানে মৌলানা
আজাদ কলেজ) ছাত্র এবং বেকার হস্টেলের আবাসিক সােহরাওয়ার্দির ডান হাত মুজিবুর তখন মুসলিম লিগের ছাত্র শাখার সম্পাদক ও জঙ্গিনেতা। বাম ঐতিহাসিকেরা অবশ্য মুজিবুরের রক্তাক্ত হাত ধুইয়ে দেবার চেষ্টা করেছেন। ওই দাঙ্গায় ক্ষতিগ্রস্ত হয় দক্ষিণে বউবাজার স্ট্রিট, পূর্বে আপার সার্কুলার রােড (আচার্য প্রফুল্লচন্দ্র রােড), উত্তরে বিবেকানন্দ রােড এবং পশ্চিমে স্ট্যান্ড রােডের মধ্যবর্তী অঞ্চল। লিগের ছাত্র শাখার নেতৃদ্বয় জি জি আজমিরি, শেখ মুজিবুর রহমান, শােভাবাজারের লালবাগান বস্তির ত্রাস হাবু গুন্ডা অর্থাৎ হাবিবুর রহমান, নিউ মার্কেট এলাকার কুখ্যাত মুসলমান দুষ্কৃতী বােম্বাইয়া, কর্নওয়ালিস স্ট্রিট, আমহার্স্ট স্ট্রিটের মিনা পাঞ্জাবি ও হ্যারিসন স্ট্রিট এলাকার কুখ্যাত গুন্ডা মুন্না চৌধুরীদের নেতৃত্বে হিন্দুর রক্তে কলকাতার রাস্তা লাল হয়ে যায়।মন্ত্রীদের নামে পেট্রোলের জন্য কুপন দেওয়া হয়েছিল আগেই যাতে পেট্রোলবােমা তৈরি করে রাখা যায়। অন্যান্য অঞ্চলেও বিক্ষিপ্তভাবে দাঙ্গা ছড়িয়ে পড়েছিল। দাঙ্গা দক্ষিণ কলকাতার কিছু অংশেও।
১৬ থেকে ১৮ আগস্ট এই তিনদিন ভীষণ দাঙ্গার মধ্যে থাকে কলকাতার নাগরিকেরা, ১৯ থেকে ২১ আগস্ট পর্যন্ত চলে বিক্ষিপ্তভাবে। ২১ আগস্ট ভাইসরয়ের শাসন জারি করা হয়। অবশেষে ২২ আগস্ট থেকে দাঙ্গা থামে। এই প্রবন্ধের সীমিত পরিসরে তার বিস্তারিত বিবরণ দেওয়া সম্ভব নয়। আর কয়েকটি বিশেষ দিকের প্রতি দিকপাত করেই এই প্রবন্ধের ইতি টানব।
উল্লিখিত ঘটনাগুলি থেকে একটা বিষয়। নিশ্চিতরূপেই প্রমাণিত যে, এই দাঙ্গা মুসলিম লিগ ও তার নেতা হােসেন শাহিদ সােহরাওয়ার্দির পূর্বপরিকল্পিত। দীর্ঘদিন আগে থেকেই দাঙ্গার পরিকল্পনা করা হয়েছিল। দ্বিতীয় আরও একটি বিষয় হলাে, মােহনদাস গান্ধী তিনি স্বাধীনতা আন্দোলনের প্রধান ঋত্বিকের মতাে ঘােষণা করেছিলেন যে, দেশভাগ তাঁর মৃতদেহের উপর দিয়েই একমাত্র হতে পারে, তিনি কিন্তু অভূতপূর্ব এই রক্তক্ষয়ী দাঙ্গায় নিশ্ৰুপ রইলেন। তাঁর প্রতিক্রিয়া জানিয়ে কোনাে বিবৃতি দেবার প্রয়ােজনও বােধ করলেন না। জওহরলাল নেহরু তখন ক্ষমতা পাওয়ার নেশায় মশগুল, তিনি ১৯৪৬-এর সেপ্টেম্বরে ব্যস্ত রইলেন অস্থায়ী সরকার গঠনে আর সেজন্য মুসলিম লিগের সঙ্গে দরদারিতে।
‘বাপু’গান্ধী ও জওহরলাল নেহরুর কলকাতা এসে দাঙ্গাবিধ্বস্ত নাগরিকদের দুর্দশা দেখার সময়ই হলাে না!
কলকাতার হিন্দুদের এই চরম দুর্যোগের দিনে হিন্দুদের ত্রাণকর্তারূপে আবির্ভূত হয়েছিলেন দুজন হিন্দু বউবাজারের মলঙ্গা লেনের গােপালচন্দ্র মুখােপাধ্যায় (গােপাল পাঁঠা) এবং বেলেঘাটার যুগলচন্দ্র ঘােষ। গােপাল পাঁঠার নাম কলকাতার মুসলমানদের মনে ও হৃদয়ে ত্রাস সৃষ্টিকরেছিল দাঙ্গার তৃতীয় দিন, ১৮ আগস্ট থেকে। দুর্যোগের সেইদিনে গােপলের ‘ছুরি’র ব্যবহার এক প্রাণী (ছাগল) থেকে অন্য প্রাণীতে (মুসলমান) বদলে গিয়েছিল। গােপাল ঘােষণা করেছিলেন, “প্রতিটি মৃত হিন্দুর মৃতদেহের বিনিময়ে আমি দশজন মুসলমানের মৃতদেহ চাই। ছেলেরা এগিয়ে যাও, কোনাে দয়া দেখাবেনা।” গােপাল শুধু তরবারি ও ছুরি ব্যবহারেই সন্তুষ্ট ছিল না, আমেরিকান সৈন্যদের কাছ থেকে আগ্নেয়াস্ত্রও জোগাড় করে তা ব্যবহার করেছিলেন। তিনি এইসব অস্ত্র এমন দক্ষতার সঙ্গে ব্যবহার করেছিলেন যে, দ্বিতীয় দিন সন্ধ্যে থেকে মুসলমানদের মনে কাঁপুনি ধরে যায়। এতটাই যে, মুসলিম ন্যাশনাল গার্ডের অন্যতম শীর্ষনেতা এবং কলকাতা তথা বাঙ্গলার অনেক হিন্দু গণহ্যাতর কুখ্যাত নায়ক, গােলাম রসুল গােপালের কাছে এসে কাতরকণ্ঠে বলেছিল, “বহত খুন বহ চুকা… হামারি তরফ সে ভি আউর আপকি তরফ সে ভি। আব ইস কতল-ই-আম কো রােকনা হােগা। হাম আউর খুনখারাবে কে লিয়ে তৈয়ার নহি হ্যায়। হাম সিজফায়ার কে লিয়ে তৈয়ার।” ঐতিহাসিক ভাবে, এটাই সাধারণতমুসলমানরা করে থাকে! প্রবল বাধা ও প্রবল প্রতিআক্রমণের মুখে পড়লে সবসময়ই তারা দয়া ও শান্তির কথা বলে থাকে; অন্য সময় যমের এরা জল্লাদ। তৃতীয় দিনে গােপাল মুখােপাধ্যায় এবং বেলেঘাটার যুগলচন্দ্র ঘােষের নেতৃত্বে প্রবল হিন্দু প্রতিরােধের মুখে পড়ে এবং মুসলমানদের মার খাওয়া দেখে নাটেরগুরু সােহরাওয়ার্দিও চিন্তিত হয়ে পড়ে, হিন্দুদের সঙ্গে রফার কথা তাঁর মাথায়ও আসে। সে নিজের মসনদ বাঁচাতে এবং হিংসা থামাতে দুই মাস্তান তথা মুসলিম লিগ ও মুসলিম ন্যাশনাল গার্ডের নেতা জিজি আজমেরি ও মুজিবুর রহমানকে (যে পরবর্তীকালে বাংলাদেশের সৃষ্টিকর্তা) সন্ধির জন্য গােপালচন্দ্র মুখােপাধ্যায়ের কাছে পাঠান। গােপাল মুখােপাধ্যায়ের কাছে তারা হত্যাকাণ্ড থামাতে অনুরােধ জানান। গােপাল মুখােপাধ্যায়। শর্ত দেন, প্রথমে মুসলিম লিগের ‘কিলিং স্কোয়াডকে’ নিরস্ত্র করা এবং হিন্দুদের উপর আক্রমণ থামাতে হবে। নিরুপায় সােহরাওয়ার্দি দুটিশর্তই মেনে নেয়। আসলে, ঐতিহাসিকদের মতে, গােপাল পাঁঠার নেতৃত্বে হিন্দু ও শিখদের তীব্র প্রতিরােধ মুখে সােহরাওয়ার্দি ও তাঁর সাগরেদের দেওয়ালে পিঠ ঠেকে গিয়েছিল। তাছাড়া তার মনে হয়েছিল, ব্রিটিশ ভাইসরয় অর্কিবল্ড ওয়াভেল তার সহ্যের সীমায় পৌঁছে গেছে এবং তাঁর সরকার ভেঙে দিতে পারে। বাস্তবে হয়েছিলও তাই। ২১ আগস্ট লর্ড ওয়াভেল তার সরকার বরখাস্ত করে দেয়।
কলকাতার ৪৬-এর দাঙ্গা হিন্দুদের দুটি শিক্ষা দেয়। প্রথমত, মুসলিম লিগের প্রচণ্ড হিন্দুবিরােধী নীতি ও ধ্বংসাত্মক কাজ হিন্দুদের সচেতন করে দেয় এবং দ্বিতীয়ত, হিন্দুরা সম্মিলিত প্রতিরােধ গড়ে তুলতে পারলে মুসলমানরা পিছু হটতে বাধ্য হবে। আরেকটা। বিষয়ও শিক্ষণীয়, মুসলমানরা যেমন তাদের ধর্ম রক্ষাকারীদের বীর হিসেবে গণ্য করে, শ্রদ্ধা করে, হিন্দুদেরও সেইভাবে যারা ধর্ম ও সমাজকে রক্ষা করতে এগিয়ে আসে তাদের বীর হিসেবে গণ্য করে শ্রদ্ধা করতে শিখতে হবে, গােপাল মুখােপাধ্যায়দের দিতে হবে উপযুক্ত সম্মান।
শেষে কবি রবীন্দ্রনাথের গানের কথা উচ্চারণ করে বলি, ‘যেন ভুলে না যাই, বেদনা পাই, শয়নে, স্বপনে।
বিনয়ভূষণ দাশ